অধিকাংশ কবিতারই রচনার আড়ালে থাকে কোনো না কোনো ঘটনা বা গল্প, যা কবিকে কবিতাটি রচনার প্রণোদনা দেয়! তবে তা প্রায় সবসময়েই থাকে অদৃশ্য। কিন্তু এই গল্পগুলোই কবিতার উৎসমূল বা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। খুব কম সময়ই এর সংকেত পাঠক টের পান। কবিতাটি পড়ে বোঝারও উপায় থাকে না—এমন উৎস থেকে এটি রচিত হয়েছে।এই রচনায় থাকলো, কিছু কবিতার তৈরি হওয়ার আড়াল-গল্প। কবিতাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘শহর যৌবন ও রাত্রি’ (২০০৪) শীর্ষক প্রথম কাব্যগ্রন্থে।
অ্যান্টেনা: একটা সময় ছিল যখন শহরে-বন্দরে প্রায় সব বাড়িরই ছাদে বা চালে টিভি অ্যান্টেনার দেখা পাওয়া যেতো। দিন নেই, রাত নেই, গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা নেই সে দাঁড়িয়ে থাকে একা। তার চারপাশে ঘিরে থাকে কেবলই শূন্যতা। তবে শূন্যতার মধ্যেই তার অস্তিত্ব নিহিত এবং তার কাজও শূন্যতার সঙ্গেই। শূন্যে শূন্যে যে কথা শব্দ দৃশ্য স্বর সুর ভেসে আসে, একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্য থেকে তাকে ধরে এনে সে ঘরের মধ্যে পাঠায়। কিন্তু ধাতব এই বস্তুটি কি কেবলই নিষ্প্রাণ বা তার কি কোনো সক্রিয় সত্তা নেই? এসব ভাবনা থেকেই জন্ম এই এক লাইনের কবিতাটি।
মা, আমার: ‘আমার মা আমার আশ্রয়’ লিখেছিলাম আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে। কিন্তু আমার মা আসলে আমার চোখে কেমন? মাকে আমি দেখি আমার ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড হিসেবে। এ দেখা নয় শুধু, তিনি আমার গর্ভধারিণী, স্নেহময়ী জননী বলে। বরং আমার মা তার জীবনদর্শন ও জীবনসংগ্রাম, তার ব্যক্তিত্ব, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, তার সুফিবাদী চৈতন্য ও জগৎ-জীবন-সময় পাঠের মধ্য দিয়ে আমার ভেতরে এমন একটি জায়গা তৈরি করেছেন, সে কেবল তারই জায়গা। তাই মাকে দেখার বোধটিও আমার আলাদা। কারণ জীবনের জঙ্গমতা, সময়ের প্রবাহকে মেনে নিয়েও তিনি যেন অনেকটা পৃথক। অথচ তাকে প্রাচীনপন্থী বলা যাবে না কিছুতেই, আবার নবীনের অনুসারীও নন। তিনি পার্থিব হয়েও অপার্থিব, জাগতিক হয়েও পরাজাগতিক। এসবেরই এক প্রস্থ ধরা আছে এই ‘মা আমার’ কবিতাটিতে।
শীত, আমাদের শহরে: কখনো কখনো এত আকস্মিকভাবে একটি কবিতা তৈরি হয়ে ওঠে, অথচ মনে হয় এর পেছনে অনেক দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল। হয়তো অবচেতনে সেটি জট পাকিয়ে ছিল নানা উপাদান বা অনুষঙ্গে। বেরিয়ে পড়েছে খানিকটা নাড়া খেয়েই।
আমাদের ঢাকা শহরটি শীত এলেই ধূলিস্বর্গ হয়ে ওঠে। তখন জীবনকে কেবলই ধূলি-ধূলিময় মনে হয়। ব্যাপারটা ভাবনার মধ্যে হয়তো কোনোভাবে লুকিয়ে ছিল। অন্যদিকে ধূলিমগ্ন জীবনে শীত নিয়ে শহুরে মধ্যবিত্তের আদিখ্যেতার বিষয়টিও হয়তো গোপনে কাজ করেছে। কিন্তু কবিতাটি হয়তো কখনোই রচিত হতো না, যদি তৎকালীন প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক ব্রাত্য রাইসু তার সাময়িকীর শীতের কবিতা সংখ্যার জন্য লেখা না চাইতেন। অবাক হয়ে ভাবি, কিভাবে এক বৈঠকেই কবিতাটি দুটি খণ্ডে কাগজে নেমে গেল। কেবল তাই নয়, যদিও তাৎক্ষণিক, তবু একে যথেষ্ট কবিতা বলেই আমার মনে হয়। কারণ নিজের কবিতাগুলোর মধ্যে ‘শীত, আমাদের শহরে’ও আমার একটি প্রিয় কবিতা।
শীত ও বসন্ত : কখনো কখনো খুব খামখেয়ালি নিয়েই হয়তো দু-চার লাইন বেরিয়ে আসে, কিন্তু তার পেছনে থাকে অবচেতনের অনেক প্রস্তুতি। হয়তো সে দৃশ্যগুলো, ভাবনাগুলো বহুদিন ধরেই কাজ করে চলেছে, বেরিয়ে পড়েছে হঠাৎ করেই।
শীতের সঙ্গে বসন্তের বৈপরীত্য, ঋতুর সৌন্দর্যের বাইরেও, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে খুবই সংশ্লিষ্ট। শীতের দৃশ্যটি কল্পনা করুন, নগরের অভিজাত আর দরিদ্রদের মধ্যে, উত্তরের কনকনে হাওয়ায় বিপণ্ন দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবনের সঙ্গে আর দেশের অন্য এলাকার মধ্যে। শ্রেণী অবস্থানটি এ সময় বড় পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন শহরের বস্তির কিংবা গ্রামের দরিদ্র একটি শিশুর শীত নামক দৈত্যর সঙ্গে প্রায় শূন্য ও নির্বস্ত্রভাবে লড়াইয়ে নামতে হয়।
আবার দেখুন ফাল্গুনের প্রথম দিনটিই। বসন্ত যেমন নতুন জীবন আনে, নাগরিক জীবনও তাকে বরণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এখানেও সেই শ্রেণীর ব্যাপার। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্তও নিজের সামর্থ্য অনুসারে নিজের রঙে রাঙাতে চেষ্টা করে বসন্তকে। এই দৃশ্যগুলোকে আমি দেখাতে চেয়েছি কিংবা আমার চোখে পড়েছে ‘শীত ও বসন্ত’ কবিতায়।
১৯৯৭: একটি বছর। মাত্রই তো কটি সংখ্যা। অথচ কী আশ্চর্যভাবে এই সংখ্যাগুলো লেপ্টে থাকে সময়ের সঙ্গে, আমাদের জীবনের সঙ্গে। আমাদের আয়ুর বয়স, জীবনের হিসাব-নিকাশ, আমাদের অর্জন-ব্যর্থতা-আকাঙ্ক্ষাগুলো এই সংখ্যাগুলোর সঙ্গে কী বিস্ময়করভাবে জড়িয়ে থাকে! কিন্তু এসবও একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে, যখন আমরা হয়ে পড়ব দূর অতীত, যেমন আমাদেরও বহু বহকাল আগে অতীত হয়ে গেছে অনেক অনেক বর্তমান এবং তার মানুষ ও তাদের অর্জনগুলো। বিশেষ করে কেন যে শুধু ১৯৯৭ সালটাই কবিতায় ধরা পড়লো জানি না, তবে সময়ের স্মারক হিসেবে আজ যখন আবার একে দেখি, কত স্মৃতিই তো ভেসে আসে। ওই সালটার মধ্য দিয়ে নিজেকে আর নিজের অতীতকেই যেন পুনর্বার পাঠ করি।
অ্যান্টেনা
নিঃসঙ্গ অ্যান্টেনা কথা বলে আকাশের সাথে
মা, আমার
পৃথিবীর রৌদ্রজলহাওয়ার উজ্জ্বলতায়
দেখে নিতে নিতে
কখনো কখনো দেখি আঁধারলীন
. আমার মাকে
যেন মৌলানা রুমীর সূর্যপিপাসু হৃদয়
ক্রমশ আঁধার-হ্রদে ডুবে যায়
সৌরছাওয়া পৃথিবীর বন্দনায়
. যদিও আপ্রাণ তিনি
তবু সৌররৌদ্রহীন অন্য এক
. রৌদ্রের দিকে
ক্রমাগত
. হেঁটে
. যেতে দেখি
. আমার মাকে
পৃথিবীরই সূর্যরঙের রৌদ্রের আড়ালে
শীত, আমাদের শহরে
শীত এলো আমাদের শহরে, ধূলিসুন্দরে
আমরা তো সুন্দরপিয়াসী আর ধূলি
. আমাদের আদিজননী—
তাবৎ ধূলিকণা থেকে জন্ম এই ব্রহ্মাণ্ডের
আর, ব্রহ্মাণ্ড কীভাবে রচিত হয়
দেখা যাবে এই শীতে, আমাদের নগরে
২.
আসুন শীত-উৎসব করি—ভাই ও বোনসকল,
পিঠে ও পুলি, গোধূলি, গাঁওগেরামের ওম
. সকলি শহুরে বুলি
আসলে জীবন কেবলই ধূলিকণা, ধূলি, ধূলি…
শীত ও বসন্ত
শীত বস্তি ও গ্রামশিশুর করুণ চোখ
. ভীত কাতরানি
বসন্ত শহরকুমারীর উদ্দাম ও বুনো
. হলুদ হাওয়া
১৯৯৭
সাতানব্বই আহা সাতানব্বই
এইভাবে হাজার সাতানব্বই
. এসে চলে গেছে
কালভ্রূণের অনন্ত গহ্বর থেকে
. দিনগুলি রাতের আড়ালে
. রাতগুলি দিনের আড়ালে
. স্নাত হতে হতে
অদৃশ্য আঁধারকণা হয়ে গেছে
সন্ধ্যাবাতির মতো নিভে গেছে
. সান্ধ্যভাষা
আর সাতানব্বইগুলি কেবলই
. সাতানব্বই…