সাহিত্যের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পেছনে ফিরে তাকিয়ে একটা প্রশ্ন নিজেই করেছি। ফেলে আসা স্মৃতি জড়ানো আর শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা লেখালেখির সূচনার শৈশব-কৈশোর ঝাপসা হয়ে আসে। মনে হয় ‘অতীত এক ভিন্ন দেশ’। যে দেশে একদিন আমি অভিবাসীর মতো বসবাস করতাম। এক অদ্ভূত ঘোরলাগা বিষয় কাজ করে!
ক’দিন আগে চিন্তাসূত্রের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, ‘আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামের সঙ্গে আমার নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলো অস্থির ছিলাম। কৈশোরের সেই সময়টা খুব টালমাটাল ছিল। আমাদের বাড়ি ছিল ব্রহ্মপুত্রের ওপারে চরাঞ্চলে। একাত্তর সালে আমাদের এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অভয়ারণ্য। বয়সের কারণে যুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসা যোদ্ধাদের সাহায্য করেছি, তাদের কাছে থেকে দেখেছি। তাদের অস্ত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে যুদ্ধ অনুভব করেছি। ক্লাশ ছিল না। পাড়াশোনা ছিল না। তখন মাথায় নানান বিষয়, নানান ভাবনা, নানান চিন্তা কাজ করতো। তা রোল করা খাতায় লিখতাম। কী লিখতাম, আজ আর মনে নেই। তবে সেখান থেকেই হয়তো লেখালেখির বীজ বপন শুরু।’(প্রতি মুহূর্তে দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে: চিন্তাসূত্র)।
আমার মনে হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমার লেখক হয়ে ওঠা হতো না। হয়তো সাধারণ একটি জীবনে যাপন করতাম। মুক্তিযুদ্ধ শুধু ঐতিহাসিকভাবেই নয়; আমার জীবনেও টার্নিং পয়েন্ট। ফলে বিজয়ের পতাকা আমার সাহিত্য জীবনেও আরেক পতাকা উড়েছে। সেজন্য গর্ববোধ করি।
সৈয়দ আলী আহসানের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিমালা, ‘আমার পূর্ব-বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ/ অন্ধকারের তমাল অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়/ একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ নিকুঞ্জের তমাল’ আজও গেঁথে আছে মর্মমূলে!
যাই হোক। গাছ গাছালি, প্রকৃতির প্রতি আমার প্রেমটা ছোট বেলা থেকেই। অজপাড়া-গাঁয়ে এক নান্দনিক বাগান করেছিলাম। সেই বাগান-বাড়ি দেখার জন্য দূর দূরান্ত থেকে দর্শক আসতো, হিন্দু সম্প্রদায় পুজোর জন্য ফুল নিয়ে আসতো।
তাছাড়া গ্রামের নদী-নালা-খাল-বিল-মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গল এসবের তো তুলনা নেই। আমি কৈশোরে প্রকৃতির সন্তান হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। আর ছয় ঋতুতে ছয় ধরণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতাম। এই মুগ্ধতা এখনো আছে। এখনো আমি প্রকৃতির প্রেম থেকে মুক্তি পায়নি। যা আমার কবিতায় ঘুরে ফিরে নানা ভাবে আসে। এবং গাছ-পাখি-প্রকৃতি-পরিবেশ বিয়ে আমার তিনটি কাব্যগ্রন্থ (একি কাণ্ড পাতা নেই, পাখিদের গ্রামে আজ একটি গাছে সাথে সাক্ষাৎ করার কথা, ফেরোমনের গন্ধে নেশাগ্রস্ত প্রজাপতি) এবং একটি কিশোর উপন্যাস (গাছখুন) রয়েছে।
স্বাধীনতার পর নান্দিনা মহারাণী হেমন্ত কুমারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে অটোপ্রমোশন পেয়ে ক্লাস নাইনে উঠলাম এবং ১৯৭১ সালে প্রথম স্বাধীনতা দিবসে একটা ছোট্ট সংকলন সম্পাদনা করলাম। সেখানে নিজের ও সহপাঠীদের লেখা ছিল।
সেই সূত্র ধরে নান্দিনার গণ্ডি ছাড়িয়ে জামালপুরের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। আমার লেখালেখি জীবনের প্রথম বন্ধু রাজু অর্থাৎ সদ্য প্রয়াত আহমদ আজিজ।
আরও পড়ুন: বিশ্বাস থেকে এক পাও নড়ি না ॥ তিথি আফরোজ
আমি আর রাজু স্বাধীনতার পরপর যৌথভাবে ‘শব্দ নৈঃশব্দ’ বের করতাম। সেই সময় আমরা বিভিন্ন জেলার তরুণ লেখক বন্ধুদের সঙ্গে লিটল ম্যাগের নেটওয়ার্ক তৈরি করি। তাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে দেশের সেরা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যেমন আসাদ মান্নান, মিনার মনসুর, তসলিমা নাসরিন, হালিম আজাদ, নাজমা হক শান্তা (অভিনেত্রী শান্তা ইসলাম), রোকেয়া খাতুন রুবি, নাসিমা সুলতানা, মুস্তাক দাউদীসহ অনেকেই।
ইন্টারমিডিয়েটে ওঠার পর পাঠ্যগ্রন্থ বাংলা বই হাতে পেয়েই সিলেবাসের বাইরের লেখাগুলো পড়ে ফেলি। এতদিন রবীন্দ্র-নজরুল-জসীম উদ্দীন-বন্দের আলী মিয়া-সুফিয়া কামালদের কবিতা পড়েছি। তা থেকে ভিন্ন স্বাদের কবিতা পড়ে চমকে উঠি! তার মধ্যে সৈয়দ আলী আহসানের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিমালা, ‘আমার পূর্ব-বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ/ অন্ধকারের তমাল অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়/ একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ নিকুঞ্জের তমাল’ আজও গেঁথে আছে মর্মমূলে!
আরে, এ তো আমার মনের কথা, আমার চারপাশের কবিতা। আমার দেখা দৃশ্য, আমার একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতা! পড়তে পড়তে অভিভূত এবং শিহরিত হয়ে উঠি।
সেখানে অত্যন্ত যত্ন করে ‘তৃষ্ণার্ত জলপরী’ নিয়ে চুলচেরা আলোচনা করেছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক কবি আবুহেনা মোস্তফা কামাল। আমার কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ।
সত্যি বলতে গেলে, আমি প্রথম আধুনিকতার কবিতার চেতনা পাই, সৈয়দ আলী আহসানের এই কবিতার স্পর্শে। অনেকটা পরশ পাথরের ছোঁয়ার মতো আমাকে ভেতরে কাজ করে। আমি পাল্টে যাই! স্কুল থেকে কলেজে ওঠার মতো কবিতার ক্ষেত্রেও যেন উত্তরণ ঘটে।
পরে ঘটনা চক্রে সেই মফঃস্বল শহর ছেড়ে ঢাকায় আসি, ১৯৭৭ সালে। যুদ্ধোত্তর রাজধানী ঢাকা যেন সাহিত্যের উত্তাল সমুদ্র। হাবুডুবু খাই, ভেসে উঠি, ডুবে যাই। সাঁতারিয়ে কূল-কিনারা পাই না। তবু হাল ছাড়িনি এবং আজো হাল ধরে আছি। এখন হয়তো পাল তুলেছি। মাঝখানে উজান-ভাটির গল্প, গুণটানা, দাঁড় বাওয়া, লগি মারা, বৈঠার ঘটনাগুলো বাদই দিচ্ছি।
এভাবেই তখন ৪/৫টি দৈনিক এবং ৩/৪টি সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা লেখা শুরু করি। পতিকাগুলো ছিল আহসান হাবীব সম্পাদিত দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতা, মাহমুদ আল জামান (আবুল হাসনাত) সম্পাদিত দৈনিক সংবাদের সাহিত্যপাতা, আল মুজাহিদী সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্যপাতা এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী, চিত্রালী, পূর্বাণীতে কবিতা লেখার পাশাপাশি ‘বেকার জীবনে খ্যাপ মারি’; মানে আজেবাজে গদ্য লিখি।
সেই আজেবাজে গদ্য লেখা থেকেই গবেষণার নেশা ধরে এবং মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে কাজ করি, করছি। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার্ত জলপরী’ ১৯৮২ সালে বের করে রুনা প্রকাশনী। বই বের হওয়ার আনন্দের পাশাপাশি বেদনাও ছিল। বইটি কভার ছাপা হয়েছিল তিন-তিন বার। আগে বইয়ের ভেতরটা ছাপা হয়েছিল সাধারণ বইয়ের সাইজে। কিন্তু সৈয়দ লুৎফুল হকের আঁকা দু’ রঙের কভার ছাপা হলো ক্রাউন সাইজে। সঙ্গত কারণে প্রচ্ছদ বাতিল। দ্বিতীয় বার দাড়িওয়ালা এক ছবি দিয়ে কালো রঙের কভার ছাপা হলো। বেলাল চৌধুরী, আরেফিন বাদল এঁরা তা মোটেও পছন্দ করলেন না। বেচারা প্রকাশক রুহুল আমিন বাবুল তৃতীয় বার কভার ছেপে বই বাজারে আনেন। তাই তখন টেনশন ছিল, মনে হয় বইটা আর বের হবে না। অবশেষে বইমেলাতেই বের হয়।
আরও পড়ুন: আমিই আমার কারিগর ॥ রফিকুজ্জামান রণি
আমাদের চার কবির মাসুজ্জামান, হাসান হাফিজ, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল (এবং আরেক জনের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) প্রথম বই নিয়ে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে আলী ইমাম একটি চমৎকার অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে অত্যন্ত যত্ন করে ‘তৃষ্ণার্ত জলপরী’ নিয়ে চুলচেরা আলোচনা করেছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক কবি আবুহেনা মোস্তফা কামাল। আমার কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ।