ব্যস্ততার ক্ষণিক অবসরে, ক্লান্তি তাড়িয়ে, বিনোদিত হওয়ার লোভে, টুপ করে ঢুকে পড়ি শূন্য পরিসরে। কখনো মনের টানে, কখনো বা তথ্য শিকারে, আবার কখনো কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে—শুধু অস্থির হয়ে যেতে অথবা ধীরতায় জমতে, আমরা ইদানীং প্রায়সই চলে যাই চেনা-অচেনা, আধাচেনা, ছায়ামানুষে ভরা এক ছায়াপৃথিবীতে। বাস্তব পৃথিবীতে আলো-আঁধারে শুয়ে-বসে ক্রমেই ডুবে যাই অন্য এক বিকল্পবাস্তবে। আমাদের বাস্তবতাগুলো এখন তুমুল গতিশীল এক বাস্তবিক ধরনের মনোবাস্তবতায় গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। কোন বর্তমানে বাস করি আমরা, বাস্তব নাকি মনোবাস্তব? নাকি সবকিছুই রূপান্তরিত, আমরা উপলক্ষ মাত্র, করুণার পাত্র!
আকাশজালে মানুষ ভাসে
নাগরিক জীবনের ছোট্ট ঘরে বসেও প্রাণনাশী বিদ্যুতের প্রেমময় উপযোগে ডুবে ব্যাপক পরিসরে নতুন নতুন অভিতর্ক সৃষ্টি করা যায়। আকাশজালের খোলা বাতায়নে বসে সবকিছুকে সম্ভব করা যায়। বিশ্বগ্রামের ব্যস্ত জীবনে দমকা দমকা ক্ষণিক সময়গুলোতে একাকিত্বের নিরিবিলিজুড়ে কত-শত দম দেওয়া মানুষ যে আকাশজালে ছায়ামানব রূপে হাফ ছাড়ার চেষ্টা করে! ইদানীং জেগে ওঠা সামাজিক বাতায়নের কমনীয় ত্বকের স্পর্শে মানুষ নতুন করে নিজের লুকায়িত ব্যক্তিত্বের সন্ধান খুঁজে পাচ্ছে। লেখাপড়া করতে, বিনোদন খুঁজতে, পত্রিকা ঘাঁটতে অথবা না বলা কথাগুলো বলে দিয়ে দম ফেলে বাঁচতে—আমাদের সাইবার স্পেস ভারী হতে থাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নিঃশ্বাসে।
প্রতিটি নিঃশ্বাসকে মাধ্যম ধরলেও অম্লযানে-উদযানে, ফুসফুসে-হৃদপিণ্ড, মানুষে-বৃক্ষে এক অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটে। স্বল্প পরিসরে হিসাব করলেও, আমরা কিন্তু বেঁচেই থাকি এইসব চিরন্তন জৈবিক যোগাযোগ স্রোতে। কারণে বা অকারণে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, নিত্য এই যোগাযোগের মধ্যেই বেড়ে ওঠে আমাদের অসভ্য-সভ্যতা ও বেয়াড়া সময়। বাড়ন্তকাল কখন যে যৌবন ছুঁয়েছে, অবাধ্যতার ডানা মেলে উড়াল দিয়েছে, তা বুঝতে বুঝতেই আমাদের অনেক সময় লেগে যায়; কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে চরম বিপর্যয়।
যতখানি সম্মুখযাত্রা ঠিক ততখানি পশ্চাতে
মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে এই শূন্য মাধ্যমে ঈশ্বরের আগমন ঘটতেও বেশি সময় লাগে না। স্রষ্টা-সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অথচ আদিসংঘাতময় সম্পর্কটা কী অত সহজে মিইয়ে যাওয়া চলে! ক্রাক ক্রাক ডানা ঝাপটে অশরীরী ঈশ্বর ভেসে ওঠে আকাশজালে। মিথ ফিরে আসে নতুন ডেমন রূপে। ছায়ায় ছায়ায় যুদ্ধ শুরু হয়, সাইবার পরিসরে। কিংবদন্তির যুদ্ধে ছায়া থেকে কায়া বেরিয়ে পড়ে। গলগল করে রক্ত ঝরে শাহবাগে, আজিজ সুপার মার্কেটে, সিলেটে, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বাস্তব অঙ্গনে। ছায়া মানবেরা কায়ার জগতে এসে কেউ খুন হয়, কেউ খুন করে, কেউ চায় তা সামলাতে। কেউ আবার দেশ ছেড়ে পালাতে পরামর্শ করে। কেউ বাধ্য হয় চলে যেতে, হৃদয়ভাঙা কষ্ট চেপে দেশ ছাড়ে। কেউ সংশয় চেপে অবশেষে থাকে। আর কেউ কেউ ঝোঁক বুঝে কোপ মারে, নিজের ব্যক্তিগত ঘর থেকে বেরিয়ে সরাসরি উড়াল দেয় প্রবাসে! বেদনা, ঝুঁকি আর লোভ একই পথে ছড়িয়ে থাকে।
প্রচারণা, পাল্টা-প্রচারণা চলে শাহবাগে প্রজন্মের জাগরণ নিয়ে; প্রায় পাঁচ দশক সময় ধরে শাসন দণ্ড ধরে থাকা সরকারগুলোর সচেতনতা, দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে- হেফাজতের হুমকিময় পুনরুত্থানে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও জাতীয় নীতিমালা প্রসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ব্যর্থতাই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। এসবের মধ্য দিয়েই প্রজন্মের তুমুল আবির্ভাব ফেসবুকে-ব্লগে। এ যেনো এক নতুন পৃথিবী!
ছায়া পৃথিবীর অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস-অবিশ্বাসগুলো জমাট বাঁধে কায়াদের চারপাশে।
আইনের ব্যাখা চলে, পাল্টা-ব্যাখ্যাও চলে। সংবিধান সক্রিয় হয়, আইনজীবীরা মাথা কুটে মরে। সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে আইসিটিনীতির আলোকে অপরাধ ধরতে হয়, কী দুর্বল চিত্ত রে! সিনেমা হল থেকে ফিরে এসে টেলিভিশনে দেখলে একই জিনিস ছাড়া-ছাড়া লাগে।
আমাদের যোগাযোগ নীতিমালাগুলোর মধ্যকার বিস্তর ফারাক খালি চোখে ধরা পড়ে।
সরকার বাহাদুর একবার বধূদের দাসী থেকে মানুষের কাতারে টেনে এনে নারীনীতি করে, আবার খানিকটা সময় গড়ানোর পর ‘যতখানি এগুনোর কথা, ঠিক ততখানি পিছিয়ে’! ঘরে আর বাইরে দণ্ডই অবশেষে বড় হয়ে ওঠে। এটা কেনো ঘটে জানেন, যখন আমাদের নারীরা শুধু পশ্চিমাদের পরিত্যক্ত এজেন্ডার প্রাচ্যবণিক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে শুরু করে, অর্ধশিক্ষা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। দালাল বুদ্ধিজীবী-অধ্যাপক-সম্পাদক আর এনজিওবাজরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে অস্থির করে তোলে! আমাদের নারীবাদ বিকৃত আর ধর্মের শিক্ষা অসম্পূর্ণ। আমাদের নেতারা লম্পদ আর জনগণ মূর্খ।
আমাদের শিক্ষানীতি বারবার সংশোধন হয় এবং ফাইলের মধ্যে শুয়ে শুয়ে ঘুমায়, কোটারিতে বন্দি আর রাজনৈতিক পক্ষপাতদোষে দুষ্ট আমলারা শুধু আয়েসী-বিলাসী জীবন চায়, রাজনীতিকরা একেকজন মদনপুরের জমিদারী চালায়, জনস্বার্থের ফাইলগুলো রোগশয্যায় ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় মরেই যায়।
রাষ্ট্রীয় নীতিমালার প্রচার প্রসার তো দূরের কথা, শিক্ষা নীতি বা নারী নীতিসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতিমালার উদ্দেশ্য, এসব নীতির সঙ্গে সার্বিক জাতীয় উন্নয়নের সম্পর্ক… এসব কয়জন মানুষই বা জানে! রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেও কী এসব ভুলে থাকে! তাহলে ঐ নীতিমালা দিয়ে লাভ কী! বাস্তবায়ন করার কথা মনে হয় নীতি প্রণেতারা কখনও ভাবেন নি! ন্যূনতম কিছু ভাবলেও কওমি মাদ্রাসার প্রাঙ্গণে পতপত করে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলতো সফেদ পাঞ্জাবীর মায়াবী কিশোরেরা। কিন্তু তা তো হলো না! দেশ স্বাধীনের প্রায় পাঁচ দশক পড়ে এসেও এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, হচ্ছে তো! এতো বছর দেশ চালানোর নামে তাহলে কে-কী চালালো? আমাদের স্মার্টনেস অচল ইংরেজিতে ভরা আর কিছু বিকৃত বাংলা! আর আমাদের চেতনা ভোটের রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ! টাউটের সংস্কৃতি চক্রবৃদ্ধিহারে ছড়াচ্ছে, মাদকের চেয়েও এটি ভয়াবহ।
তাই বলছি কী, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বাস্তবায়নের পথে না হেঁটে, শুধু কাগজে কলমে লিখে ফাইলে চেপে সিল মেরে দেওয়া হোক, ‘নাগরিক অধিকার সীমিত!’
বলাকাজুড়ে উড়ন্ত পায়রা নাকি মরীচিকার মরুভূমি
বিস্তর ফারাক ঈশ্বর আর সামন্তে, কর্ম আর আইনে, নীতিতে আর সংবিধানে। অনেকখানি ছেদ পরে যায় তাই প্রকাশে ও আর গ্রহণে। তাই তো ছায়াবাজির জীবনেও কেউ কেউ চোরামিতে ডুবে থাকে, চুরি করে কেউ কেউ বাতাসে ভেসে থাকা গোপনীয়তাকে। কাগজের পাতা থেকে আঁধার ছড়িয়ে পড়ে কায়াদের কারো কারো চেতনাতে, কক্ষচ্যুত বর্ণমালারা আগুন জ্বালায় কখনো কখনো ইতিহাসে-ঐতিহ্যে। তখন ল্যাংড়া পায়ের আলতো চাপে জীর্ণ রাষ্ট্রের জবান পর্যন্ত ধপাং ধপাং বন্ধ হতে থাকে।
উত্তরাধুনিকতার অর্থ খুঁজতে এখন আর লাইব্রেরি পর্যন্ত হেঁটে না গেলেও চলে। বাস্তব দুনিয়ায় অনেক অসম্ভবই অনায়াসে হয়ে যাচ্ছে অপরবাস্তব জীবনে। আকাশজালে জড়িয়ে জড়িয়ে, নিজেকে জড়াতে জড়াতে, নিজেদের অস্তিত্ব এখন দিন থেকে দিনে আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে ওয়াইফাই আর ফাইবার অপটিকে। বিকল্পবাস্তব কখনো কখনো বাস্তবতাকেও গিলে ফেলে। একটা মাত্র আকার নিয়ে আমরা এখন জড়িয়ে থাকি হাজার হাজার অস্তিত্বে। আমাদের প্রতিটি লাইনে লাইনে ছন্দ থাকে, তবে রূপে-রসে মেলে না কখনো। তাইতো অদ্ভুত দূরত্ব থেকে যায় গণ্ডাখানেক চেষ্টার মধ্যে। আমাদের লাইনগুলো কবিতা হতে পারে না বিক্ষিপ্ততার দোষে।
বিশৃঙ্খলতায় বাহাস দিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বয়স বেড়েছে, বাহন বদলেছে, ঘুরে গেছে সেই চাকাটি যাকে সবাই সভ্যতা বলে। টমটম থেকে বোরাক, বোরাক থেকে রকেট হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাস্তাগুলো একটুও বদলায়নি। সেই বর্ষার ভেঙে যাওয়া রাস্তায় শরতের বিকেলে থেমে থেমে শুধু গুটিকয় রিকশা চলে, আমাদের রাস্তাগুলো বিপদবহ। আমাদের কাগজগুলো বড় পুরাতন, জিরজিরে হয়ে গেছে; নতুন কলমে লেখা যায় না ওতে। বইগুলো যেন কোথাও কোথাও এলোমেলো, বাংলা কবিতার সাথে ফরাসি পদ্য, দর্শনের ভাবালুতার মাঝে ব্যাঙ্গের জীবনচক্র, সিলেবাস রীতিমতো জঘন্য। আমাদের পথগুলো এলোমেলো ছড়ানো-ছিটানো, গন্তব্যগুলো তাই একেবারে ছিন্নভিন্ন।
নিহত রাতের আঁধারেই মুক্তি!
প্রকাশ্য লিস্ট ধরে ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় এখন এই দেশে; গারদে ঢুকানো হয় যখন-তখন যাকে-তাকে, যে কোনো অজুহাতে। দিনদুপুরে প্রকাশ্যে আগুনে পুঁড়িয়ে মারা হয় মানুষকে। পেট্রোলবোমার ক্ষত বহন করে পথচারীদের অনেকে। নৃশংসতা দেখতে দেখতে আমাদের অনুভূতি মরে গেছে। উদ্ভট উটের পিঠে এই দেশ চলছে; এক অন্ধ গাধার পিঠে আঁড়মোড়া বেঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে আমজনতাকে, সেই অন্ধ গাধা হাড্ডিসার নিতম্বটা দোলাতে দোলাতে পেছনের দিকে হাঁটছে আর কম্বলচোরদের তুমুল হর্ষধ্বনি চলছে।