মেলা—শব্দটা শুনলেই আজকাল নিজেকে কেমন যেন মাতাল-মাতাল লাগে। মেলার যে বহুমাত্রিকতা, মেলায় যত মসলা, যত মানব-মানবী—তাদের টক-ঝাল গন্ধের গর্জন; সত্যিই মাতাল না হয়ে পারা যায় না। অদ্ভুত আজিব এক শব্দ। মেলা কথা, মেলা লোক, মেলা দেশ, এই যে অনেকের ঐকতান লুকিয়ে আছে এর অভ্যন্তরে। সে তো নতুন কিছু নয়। বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি-কৃষ্টি-কালচারে এ শব্দের প্রবেশ, তাকে মেনে নিয়ে মান্য করা কে না করছে বলুন!
‘মেলা’ এখন হাজার পদের, লাখ গোছের। ছোটকালে—আইমিন বছর বিশ-তিরিশেক আগেও মেলার একটা মহিমা ছিল। জড়িয়ে থাকত মায়া-মমতা। আজ এই যুগের দাবানলে পুড়তে পুড়তে শরীর তার ছাইয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে কেবলই আঙরা। করপোরেটের কড়া জাল বিস্তার করেছে এর ওপরে। আধিপত্যের আদর বুলিয়ে দিচ্ছে তারা বিবিধ মেলার মনে, মননশীলতায়।
এ সব কথা বলছি আমি কোন রাগ, মান-অভিমান থেকে নয়। যুগের হাওয়া বলে কথা। সময় চলছে তার সুযোগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সেখানে আমির আহ্বানে থাকতেই হয়। কাজেই অ্যাজ-এ মানুষ হিসাবে আমাকেও এর ভালো-মন্দ দেখতে হয়, শুনতে হয়। কখনো বা শোনাতেও হয়।
যাই হোক, মনের কথা মানুষ জানুক এই মর্মে জানাই কিছু ঢালি কিছু কারণসুধা। অনেক মেলার এক মেলা এই ‘বইমেলা’। দেশের কাঁচা-পাকা, আধা-সেমি সব শিক্ষিতই জানেন এর মর্মকথা। বোঝেন এর উদ্দেশ্য-বিধেয়। তবু এ নিয়ে তর্ক রটে। টালবাহানার রক্ত ছোটে। সামান্য, পাতার মতো পাতলা আর মলিন এই দেশ আমাদের। অনেক রক্তে, বহুত প্রাণে—তবেই কি না বাংলাদেশ। সব দেশেতেই ফেব্রুয়ারি। বাট, আমার দেশে অন্য বেশ। অন্য অর্থ। হাজার বাঁকের অনির্দেশ।
যান্ত্রিক এই যুগে মানুষ যেখানে হন্যে হয়ে ছুটছে সবকিছুকেই হরণ করতে, সেখানে সারামাসজুড়ে এ-মেলার আয়োজন কিছুটা বিস্ময়েরই বটে! অবাক তথা হতবাক হওয়ার মতোই ঘটনা। আয়োজক বাংলা একাডেমিকে ধন্যবাদ। অপবাদও যে দেওয়ার নেই এমনটা নয়।
বই আসলে কী করে? দিলের মধ্যে দোস্তের আসন গেড়ে বসে। পাঠান্তে সে ভাবায়। সে সৎ ও শুদ্ধ সামিয়ানার নিচে, শীতল ছায়ায় আমাদের শুয়ে-শুয়ে ভবিষ্যতের, আগামী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। প্রকৃত মানুষ করে তোলে। শান্ত-সভ্য-সভ্যতার ফরমান জারি করে। করে, এমন হাজারো বিশেষণে ভরা বইয়ের ইতিহাস।
এসব লাজুক, চম্পা-চামেলিমার্কা কথা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কথায় আছে—বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। কাজেই বই কেন, বই পড়ো। মানুষ গড়ো, মানুষ হও। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তব বড় কঠিন। একটা সময় ছিল বটে, মানুষ বই পড়ত। সে বিনোদনই হোক বা জ্ঞানার্জনের স্বার্থেই হোক, পড়ত। প্রথার মতো বংশপরম্পরায়। আজ ২০১৬-এর নিরেট বাস্তব ঠিক তার উল্টো। সে যুগ কবে শ্মশানে পরিণত হইছে। সে সময়ের ওপর কত-কত শ্যাওলার সর পড়ে গেছে। স্মৃতির শিরোমনি এখন সেসব।
মিডিয়ার বেহুদা মাতলামিতে, শাসনে, শোষণে কবে বই বাক্সবন্দি হইছে; আমাদের নিজেরই অজান্তে। সময় আসলেই সাহসী এক শয়তান। প্রকৃত অর্থেই একটি বই কেনে, তারে তরিয়ে তরিয়ে পাঠ, পাঠানুভূতি, তার প্রতিটি বাক্যের থেকে নিঙড়ে নিয়ে রসে রসাচ্ছিদ হওয়ার যে কৌশল—তার জন্য চাই সত্যিকারের শরৎ কিংবা শীতের মতো শান্ত কিছু সময়। যা সত্যিকার অর্থেই নেই আমাদের। না শিশু, যুবক, বুড়ো—নাথিং। সবাই ব্যস্ত। সকাল থেকে সাঁঝরাত্রি। দুপুর থেকে দ্বিগুণ-রাত্রি। দম ফেলার সময় নেই।
এই যদি হয় চিত্রালি। বলি, বইটা পড়বে কখন সে। কাজেই বৃহৎ একটা শ্রেণি আজ একেবারেই বলা যেতে পারে বই বিমুখ। ভিন্নার্থে, দেশের বিশাল এক ইয়াংচ্যাপ— যারা টোটালি নেট-নির্ভর। নেটের অদ্ভুত এক মায়াজালে আটকে আছে তারা—দিন হতে দিনান্তে। যার কিছু অংশ কদাচ পড়ার আগ্রহী হলেও প্রশ্ন করে দেখেছি—‘ও ওই বই! ও পড়ে নেব নেটে।’ তাহলে কেসটা দাঁড়াচ্ছে কী? যিনি লেখক, তিনিই পাঠক। হতে পারে খুবজোর তার সামান্য অনুসারীরা। হাতেগোনা কিছু ভক্তকুল। আর কিছু খেপাটে বিচ্চু বাউল।
বেশ ক’বছর পর চলতি এ মেলায় পর পর দুদিন গিয়েছি আমি। কবিতার সামান্য কারিগর হিসাবে সবটা না হলেও মোটামুটি একটা ঢুঁ-মারা হয়েছে বলা চলে। স্পেসের কারণে মেলা আজ দুভাগে বিভক্ত। তাতে সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। সেটুকু মানতে হবে বৈকি। অসংখ্য না বলে আমি অজস্রই বলব, তবু বই বেরুচ্ছে। ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিচিত্রসব অসাধু লুটেরা প্রকাশনী। অনেকেই ছবি হতে কবিতে রূপান্তরিত করছেন। কড়া সুদে। রমরমা ব্যবসা বটে এক। তাদের দানবীয় দাপটে সত্যিকারের লেখক-কবি আজ কোণঠাসা। কলঙ্কের এ এক করুণ চিত্র। সমগ্র মেলা-প্রাঙ্গণজুড়ে। মিডিয়াও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে রূপ আর রসের ওপরে। বলি তাদেরও দোষ কী! চাকরিটা তো বাঁচাতে হবে। এই হলো রাজধানী। অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
তবে ভুলে গেলে চলবে না, এরও কিন্তু পর আছে। এই ফেব্রুয়ারিতেই ভাষার এই মাসকে ঘিরে দেশের বিবিধ জেলায়, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও আয়োজন চলছে বইমেলার। সেখানে হয়তো রাজধানির মতো অতটা চটকদারি নেই। নেই নোংরামো। নেই জি-হুজুরের দল। নেই বিভেদ। দল আর উপদলের ধুন্দুমার রাজনীতি। সত্যিকারের পাঠক, বইপ্রেমী এখানেই খুঁজে পাই আমি।
তারপরও বছর চলে যাবে। আসবে নতুন ফেব্রুয়ারি। ঘুমন্ত কবি জেগে উঠবে ফের। নতুন বইয়ের বিবিধ গন্ধে ভরে উঠবে মেলার মাঠ। জন্ম নেবে হাজারো বই। অধিকাংশই তার গার্বেজে চলে যাবে। মগজের মধ্যে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়াবে যে টেক্সট। তার যেন মরণ নেই কোনো। আজ না হোক ইতিহাসের কোনো এক জলসায় সে গেয়ে উঠবে আপন অছিলায়। তারে মান্য করতে, তার পায়ে লুটিয়ে পড়তে সমগ্র দালাল-দুষমন খুব সাবধান। এখনই তৈরি থেকো। কোন তীরে যে বিষমাখা রয়, খবর তাহার কে জানে!