মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ একজন স্বকালবিদ্ধ, সন্ন্যাসনিষ্ট যূথচ্ছিন্ন কবি। নিঃসঙ্গতার অন্ধকারেই প্রলম্বিত তাঁর কবিতার মায়াপথ। তাঁর কবিতা জীবনানন্দ দাশের আদলে বলা যাবে না, অথচ কাব্যচেতনায় কখনো কখনো মিলে যায়; তবে কাব্যশৈলীতে তিনি বিশেষভাবে স্বতন্ত্র। কবি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণের সোচ্চার প্রতিনিধি। হাহাকারের কুয়াশাময় বেষ্টনীর মাঝে মর্মরে-মর্মরে আত্মবেদনে অপরূপ চিত্রকল্পে, কবিতার নির্মাণ শৈলীতে ভিন্ন ভিন্ন ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় পাঠককে, না ঘোর এসে যায় অলৌকিকভাবে। মোহাবিষ্ট করে আত্মার নড়ন-চড়ন করেন একেকটি শব্দে। নির্দ্বিধায় বলা যায়—তিনি প্রকৃতির প্রেমিক, প্রণয়ের সাধক এক শুদ্ধতম কবি—সুন্দর ও শব্দের শিল্পী।
০২.
কবি সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল চরিত্র এ জগতে। আত্মার আকুতি-মিনতি ব্যতিরেকে সবকিছুই আনুষ্ঠানিকতা, কবি মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ বলেন—‘কাসিদা প্রত্যহ শোনে আত্মার সেতার-মেঘের বিলাপ;/ কবি, পৃথিবীর সমানপ্রবীণ-কখনো তো কবরের পরোয়া করে না।’(কবর ও কাসিদা/ পোড়ামাটির সানাই)। দেহের কোনো অমরতা নেই, আছে শুধু আত্মার আবেদনে-সৃষ্টিশীলে। মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ আত্মবৎ হয়ে কখনো শীতের রাতে বেজে ওঠা রুপোলি নূপুর পায়ে,কখনো গুলতির চোটে পাখ ঝাপটানো ধূসরশালিক, ধূসরশালিক রাহেলাবুবু আবার কখনো ঈশ্বরের ভুল বিন্যাসের অজুহাত দিয়ে বিচ্ছেদে-দাম্পত্য দ্বৈরথে কামে কাতরায়ে প্রিয়াকে ‘মৌমিতা’ নাম ধরে ডাকে ‘ডুগডুগি ‘কবিতায়।
অবশেষে, বিজ্ঞান চেতনায় মঙ্গল যাত্রা,অদৃশ্য উদ্যানের দিকে অতৃপ্ত হৃদয়ে আহ্বান—‘অতৃপ্ত আদমের মতো মাটির গন্ধম খেয়ে মঙ্গলের দিকে যাবো/— আরেক পৃথিবী দেখো।…তুমি অনঙ্গ প্রেমের কথা বলে অদৃশ্য উদ্যানের দিকে হাঁটো/ একটু দাঁড়াও সোনা, তুমিও অমরতা পাবে পুরাণে-প্রণয়ে কথা আর কবিতায়।’ (তুমিও অমরতা পাবে/মায়াবী রোদের ডানা)। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশেষ করে কক্সবাজার, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী অঞ্চলের সমুদ্রের গর্জন, যেখানে ঘূর্ণিঝড় বাসিন্দাদের মূল প্রতিপক্ষ। ওই জনপদের মানুষের হাসি-কান্না,জীবনযাপনের নানান অনুষঙ্গ তাঁর কবিতায় মিশে শক্তিশালী রূপলাভ করেছে। কাব্যভাষা, কাব্যভঙ্গি ও বিষয়বস্তু আশ-পাশে ছড়ানো-ছিটানো হলেও মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ’র কবিতায় এসব উদ্ভট না, তদোপুরি শিল্পহারাও না। বরঞ্চ ধ্বনিগত রূপ-মাধুর্যে আধুনিকতম ও নিজস্বতায় কবিতার নয়া অলংকার। মিথ ও পুরাণের বিষয়ে সুফিজমের ব্যাখ্যায় অভিনবত্ব, যুক্তি-খণ্ডন মেনে নিতে কারও কষ্ট হয় না, বোধোদয় হবে নয়া আদলের নয়া কিছুর উদ্বোধন—‘রাত জেগে তোমার কুশল লিখে রাখে সে-মুমিনের কাঁধে জাগা ফেরেশতাদের/ মতো। (নীল মমি/ মায়াবী রোদের ডানা)।
০৩.
আধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য মৃত্যুচেতনাকে কবি মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ আধ্যাত্মিক ভাবধারায় মিলিয়ে নিয়েছেন সুখপাখি হিসেবে—‘তুমি কি জান না হায়—মগ্ন নীরবতা নয়, শ্মশান মাতম নয়, মৃত্যু এক অচেনা/ অধীর সুখপাখি;…শর্ত নয়,স্বার্থ নয়, নয় কোন সোনার মোহর/ জীবন ভোরের নদী, দেউলিয়া চাঁদ-লালনীল উজালা হাপর-এক আগুনের ঘর।’ (উজালা হাপর/ মায়াবী রোদের ডানা)। কবির চোখে জীবন যেন অভিনয় করে কাটিয়ে দেওয়া কিছু সময়ের সমষ্টি, মায়ার আঁঠায় লেগে দিন-রাত্রি পার করা। ‘সংসার সঙসার-তবুও কিষাণ বধূ শুঁকে যায় মেঘের সুঘ্রাণ; সোনার নোলক/ হাসে নাকের উঠোনে,/ নীল জলে নীল মেঘে যমুনা তেরসা বহে-কায়া আর মায়া জুড়ে নিপাট সন্ন্যাস।’ (সন্ন্যাস/ মায়াবী রোদের ডানা)। প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জন্মস্থান ও মায়ের প্রতি সমানে ভালোবাসার বিশুদ্ধ উচ্চারণ ‘মা’ কবিতাটি। সামাজিকতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চরম হতাশায় কবি লিখেছেন—‘এইভাবে সমুদ্র আকাশ গেলো,অরণ্য সবুজ গেলো-চেতনার রং ক্রমে পুড়ে/ পুড়ে ছাই/ কিভাবে এখন ভালো থাকা যায় বলো?’ (তোমার প্রস্থানের পর/ মায়াবী রোদের ডানা।
অনির্ণেয় কষ্টার্জিত স্বাধীন মাতৃভূমে রাজাকারদের বুক ফুলিয়ে বসবাস কবি মানতে নারাজে মেজাজ না হারিয়ে নরম ভাষায় গরম কথা—‘আমার সামনে তবু তুমি আজ দাঁড়িয়ে স্বপন কাড়ো-/ রাজাকার তুই গোখরো হায়েনা এখুনি বাংলা ছাড়ো।’ (বাংলা ছাড়ো/ মায়াবী রোদের ডানা) রাজনৈতিক দুষ্টচক্রে দলিত নাগরিক জীবন, দলবাজি-দখলবাজিতে মিথ্যের আশ্বাসের রাষ্ট্রীয় কলে তৈরী মুখোশপরা মানুষ—‘সড়কশালিক গোঙায় শীতার্ত দেহে-কাক ও শকুন ছোড়ে তাজা ককটেল;/ দীর্ঘশ্বাস বাড়ে-মধ্যাহ্নেই রাত। অচিন আজাব—পোড়ারুটিগুলো দগদগে মুখ,/ বিদঘুটে ক্ষত পোড়া বুক হাত কালশিটে পিঠে তুমি শুয়ে আছো;’ (বার্ন ইউনিট/ পোড়ামাটির সানাই)। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বারবার বহিরাগতদের নাক গলানো, মিনমিনে শয়তানদের গোপন ধারালো নখের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে যাচ্ছে মাতৃভূমি, কেড়ে নিচ্ছে ভাতের গ্রাস। এক্ষেত্রে নিজেদের দোষ স্বীকার করতে হয়। পলাশীতে মীরজাফর, একাত্তরে রাজাকার আর এখন কালো নেকাবে উগ্রবাদী জানোয়ার—‘দুপুরের রোদ কাঁপে কাকের ডানায় আনবিক আঁধারের ভুল সহোদর,/সারাটি জনম ভর আগুনবারুদ গোলা; প্রতিটি জরায়ু ভ্রুণে মিসাইলবোমা/- যুদ্ধের উত্তরাধিকার।’ (শকুন : পোড়ামাটির সানাই)।
০৪.
২০১৪ সালে প্রথম কবিতার বই ‘মায়াবী রোদের ডানা’ নিয়ে হাজির হন মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ। এ প্রসঙ্গে বইটির ফ্লাপে কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী লিখছেন, ‘‘মায়াবী রোদের ডানা’ মেলে কাব্যভুবনে উপস্থিত হলেন মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ। দেখা যায় কবিতাগুলোর রচনাকাল দুই পর্বে বিভক্ত-(১৯৯২-৯৪) ও (২০১২-১৩)। তাঁকে নবীন মনে হলেও এই দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব তাঁর আবেগকে করেছে সংহত, বোধকে দিয়েছে গভীরতা।” এরপর এই বছর একুশের বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ’র দ্বিতীয় কবিতার বই ‘পোড়ামাটির সানাই’। নিচে কিছু কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়া হল—
ক. আপনারা কেউ কবিতাকে দেখেছেন?/ নীল শাড়ি, খোলাচুল,লাল টিপ,সমস্ত শরীরে তার কাঠগোলাপের ঘ্রাণ-সাত/ সাগরের নুন চোখেমুখে মেখে আজ সে ফেরারি। (ফেরারি/ পোড়ামাটির সানাই) ।
খ. পৃথিবী মঙ্গলে নয়, তোমাতে/ আস্তানা যাচে-অমরতা মাগে। (কলবের চোখগুলো মায়াপারে হাঁটে/ পোড়ামাটির সানাই)।
গ.শৃঙ্গারে সঙ্গমে শূন্যতায় সংসারে কোথায় লুকাবে বলো-হৃদয়ে রেখেছি পুঁতে /ঈশ্বরের চোখ। (ঈশ্বরের চোখ/ মায়াবী রোদের ডানা)।
ঘ. আমাকে বেঁধেছো তুমি/ পরম আদরে রাঙা দুটো পায়ে-এই বেশ আছি,/ দরজাটা বাঁধো সোনা,/ জোছনাজোয়ান রাত- রুমালে বেঁধেছি চোখ/ খেলি কানামাছি। (নূপুর / পোড়ামাটির সানাই)।
বিষধর সাপ আজদাহা, কুফুরি কালাম, তসবিহ বিষধর সাপ, তাহলিল, মথুরা, হাঁসুলি, তোয়াফ, মুজিজা, কিসতি, ইথারে, মুরুলি, হাঁপর, হালহকিকত, বানরুটি, যোনিফুল, কাসিদা, মেঘফুল, সাকিন, কাঁকুই, মেটেমালসার ফুল, সোয়ারি, জোছনাগজল, তাহকিক শব্দগুলো মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ’র কবিতায় উৎকর্ষ সাধনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর কবিতা পাঠে দেখা যায় তিনি সমিল ও অমিল মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে হয়তো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কবি মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ ১৯৬৭ সালের ১ আগস্ট মহেশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বয়সের লুকোচুরিতে কবি এবার পঞ্চাশে পা দিলেন। আমরা বাংলা ভাষাভাষী সব পাঠকের পক্ষ থেকে কবিতার উর্বরতা বাড়াতে কবির সক্রিয় শতায়ু কামনা করছি।