গণমানুষের চিন্তা-চেতনা ও জীবনের সার্বিক মঙ্গল কামনাই মুনীর সিরাজের লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রবলভাবে বাঙালির স্বা্ধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অর্জনে বিশ্বাসী তিনি। আসাম্প্রদায়িক ও জীবনবোধের বাস্তবতার নিরিখে শিল্প ও সাহিত্যের সৃষ্টি এবং জীবনের প্রয়োজনেই শিল্প, এই নান্দনিক চেতনাবোধই তার লেখালেখির প্রতিপাদ্য বিষয়। মানুষের জীবনের প্রতিদিনকার ঘাত-প্রতিঘাত, অপরাধ ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের যে সংস্কৃতি, সেই সৃষ্টির প্রতিই মুনীর সিরাজ বিশেষভাবে মনোযোগী। নন্দনতত্ত্বের ভাববাদী ও বস্তুবাদী বিতর্কের ঊর্ধ্বে তিনি বিশ্বাস করেন—শিল্প মানুষের জন্য। নান্দনিক চর্চার মাধ্যমে মানুষের মনন সৃষ্টিতেই শিল্পের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশিত হয়। সেই পথেই জীবনের বিকাশ, এমনি ধ্যান-ধারণায় মুনীর নিরলস কলম সংগ্রামী।
তো এ রকম যার সাহিত্যদর্শন, তিনি কোন কোন মাধ্যমে পরিচালিত করলেন, তার সাহিত্য জীবন? সেদিকে তাকালে দেখা যাবে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতেই তিনি বিচরণ করেছেন আজীবন। কবিতা ও প্রবন্ধে, কিংবা সম্পাদনায় কিংবা ভ্রমণসাহিত্যে কিংবা শিশুসাহিত্যে তার অগাধ ও সৃষ্টিশীল বিচরণ। তার কাব্যগ্রন্থগুলো বিরুদ্ধ স্রোতে যাত্রা (১৯৭৬), তিমিরে তরবারি (১৯৯৪), তিনটি শিশুর আত্মা (১৯৯৫), এখনো আদিম রাত (১৯৯৬), ঢাক গুড় গুড় (১৯৯৭), আঁধারে কণক প্রভা (১৯৯৯), অনত প্রদীপ শিখা (২০০৫), ফোর্ট ওয়ার্থের ডায়েরি ( ২০০৯)। অনুবাদ কবিতার মধ্যে রয়েছে কারাগারের কাব্য (হো চি মিন-এর প্রিজন ডায়েরি) (২০০৮, ২০১৭), অ্যাডগার অ্যালেন পো’র কবিতা (২০০৯), আফ্রিকান আমেরিকান লোককাব্য। অনুবাদ গল্প ফোর স্টোরিজ, মহসিন শস্ত্রপাণি (২০১৭)। উপন্যাস অনুবাদ করেছেন নেপালের লেখক মণি দিক্ষিতের সাংগ্রিলা উপাখ্যান। প্রবন্ধ গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, কবিতা এবং সমাজ চেতনা (২০০৩), কবিতার শক্তি ও অন্যান্য রচনা (২০১৪), সমুদ্র গুপ্ত’র কবিতা: তুলনামূলক বিচার (২০১৪), আহমদ রফকি:জীবন বাস্তবতার নান্দনকি কবি (২০১৫)। সম্পাদনা করেছেন জহুরুল ইসলামের কবিতা (২০০৮), সমুদ্রবচন (২০১৩)। ভ্রমণসাহিত্য ইয়েতির দেশ নেপাল (১৯৯০)। শিশু সাহিত্য: শূন্য (২০১৪)।
মুনীর সিরাজের রচনা-বৈচিত্র্যের দিকে তাকালেই তার সৃজন-প্রতিভা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। পেশাগত জীবনে অধ্যাপক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম নামে পরিচিত। তিনি বিশেষজ্ঞ শিশুরোগ চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদ। ঢাকা শিশু হাসপাতালে অবস্থিত, বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, অ্যাকাডেমিক পরিচালক ও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন। তিনি ‘ঢাকা শিশু হাসপাতাল জার্নাল’ -এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
মুনীর সিরাজ ১৯৭২ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস, ১৯৮২ সালে কলেজ আব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস থেকে এফসিপিএস (শিশু) এবং ১৯৯৩ সালে শিশু পুষ্টি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কমনওয়লেথ ফাউন্ডেশনের ফেলো (১৯৯১), এবং জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে WHO-এর ফেলো (১৯৯৮)।
শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য নেপাল শিশু চিকিৎসক সমিতি তাকে ‘আম্বিকা মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৮)’, নেপাল নবজাত শিশু সমিতি ‘পেসন মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড (২০০০)’, প্রদান করে। ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াটিক্স কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে তিনি কলকাতায় অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ‘এসপি ঘোষাল স্মারক বক্তৃতা (২০০৮, ২০০৯)’ প্রদান করেন।
কবি-প্রাবন্ধিক মুনির সিরাজের দুটি গ্রন্থ নিয়ে সামান্য কথা বলতে চাই। তাতে তার সৃজন প্রতিভার একটু স্পর্শ পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করি। তিনি কবি, লেখক, রবীন্দ্র-নজরুল গবেষক ও ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের কাব্য-প্রবণতা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন যা পূর্বেই বিধৃত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের প্রয়াস খুব বিরল। একজন কবির সমগ্র কবিতা নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনার উদাহরণ খুব বেশি নেই। মুনীর সিরাজ সে-কাজটি করেছেন। এবং গ্রন্থটিতে তিনি শিল্পকলার বিভিন্ন আঙ্গিক ও তত্ত্বের আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন আহমদ রফিকের কবিতা।
গ্রন্থটিতে রয়েছে চৌদ্দটি প্রবন্ধ। লেখক মুনীর সিরাজ কবি আহমদ রফিকের বারোটি কাব্যগ্রন্থের স্বতন্ত্র-ব্যবচ্ছেদ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে। পাশাপাশি তার কাব্য চেতনার এক বা একাধিক রূপ যখন ভিন্ন কাব্যগ্রন্থেও সঞ্চার হয়েছে, তিনি তাও বিশ্লেষণ করেছেন ওই স্বতন্ত্র কাব্যগন্থের আলোচনা ভেতরে। কিন্তু মুনীর সিরাজের বিশ্লেষণের অনন্যতা কোথায়? তা বুঝতে হলে গ্রন্থটির প্রথম প্রবন্ধে প্রবেশ করতে হবে। এই প্রবন্ধের শিরোনাম, ‘জীবনবাস্তবতার ভাষ্যকার: আহমদ রফিক’।
কবিতার সংজ্ঞা হয় না, ঠিক আছে, কিন্তু কবিতার তো একজন কবি থাকে। কবিকেই যদি তার কবিতার প্রকৃত সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে কবিতার অন্দরে প্রবেশ করার জন্য কবির মানস সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হয়। কবির মানস সম্পর্কে জানতে হলে তার কাব্য-চেতনা, জীবন-ভাবনা, ও শিল্প সম্পর্কিত ধারণাও জানতে হয়। মুনীর সিরাজ এমন কুশলী বিশ্লেষক যে, তিনি কাব্য-মূল্যায়নে এই ধারণাটি ব্যবহার করেছেন। তা করতে গিয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন আহমদ রফিকেরই আরেক প্রবন্ধ ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’। যা থেকে কবি আহমদ রফিকের কবি-মানস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মুনীর সিরাজ এই উপাদানটি ব্যবহার করতে গিয়ে এটারও ব্যবচ্ছেদ করেছেন। ‘জীবনবাস্তবতার ভাষ্যকার: আহমদ রফিক’ শিরোনামীয় প্রবন্ধটি এটার ব্যবচ্ছেদ-রূপ। এই ব্যবচ্ছেদ ও বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মুনীর সিরাজ যেমন আহমদ রফিকের মানসের ওপর আলো ফেলেছেন, তেমনি প্রতিবিম্বিত করেছেন নিজস্ব শিল্প-ধারণা এবং সামগ্রিক শিল্প-ধারণার রূপ। ফলে প্রথম প্রবন্ধটিই হয়ে উঠেছে যেন আহমদ রফিকের সামগ্রিক কাব্যমূল্যায়নের মুখবন্ধ। কিন্তু এখানে অনন্যরূপে কয়েকটি বিষয় প্রযুক্ত হয়েছে। সেগুলো হলো—কাব্য মূল্যায়নে কবির মানস-রূপের উপস্থাপন, লেখকের নিজস্ব শিল্প-ধারণা, এবং সামগ্রিক শিল্প-ধারণার প্রয়োগ। এগুলোর যুগপৎ সম্মিলনে যে ধারণার জন্ম হয়েছে, তার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে কবি আহমদ রফিককে। কাব্য মূল্যায়নে নিঃসন্দেহে এই সব উপাদানের ব্যবহার লেখক মুনীর সিরাজের স্বাতন্ত্র্য দাবি করে। পাশাপাশি কবি আহমদ রফিকের কাব্য-ব্যবচ্ছেদও সঙ্গতভাবে হয়।
মুনীর সিরাজ জানাচ্ছেন, ‘ভাববাদী চেতনার বিপরীতে জীবনবাদী চেতনার সাহিত্য যে উৎকর্ষতার দিক থেকে এক ধাপ এগিযে তারই প্রামাণ্যগ্রন্থ ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন।’ বোঝা যাচ্ছে—কবি আহমদ রফিকের কবি-মানসরূপের প্রাথমিক ধারণাটি কেমন। বোঝা যাচ্ছে জীবনবাদী চেতনাকেই মুনীর সিরাজও শিল্পের দায় হিসেবে গণ্য করতে চান। শিল্পের জন্য শিল্প সেখানে গৌণ।
মুনীর সিরাজ জানাচ্ছেন, ‘এর যথার্থ মূল্যায়ন না হলে তাঁর কবিতার চেতনাগত ভিত্তি এবং নান্দনিক উৎকর্ষতা আমাদের কাছে অস্পষ্ট থেকে যাবে’। মুনীর সিরাজ সে দায় নিজে নিয়েছেন। নিবিষ্ট মনে অবগাহন করেছেন আহমদ রফিকের কাব্য-সরোবরে। বের করে এনেছেন তার কবিতার নান্দনিক উৎকর্ষতা। স্পষ্ট করেছেন তার কাব্য চেতনার গোপন সৌন্দর্য এবং পুরো কাব্যযাত্রাকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখিয়েছেন তিনি আসলে জীবনবান্তবতার নান্দনিক কবি। যাকে যথার্থ না বললে সত্যের অপলাপ হয়ে যাবে।
মুনীর সিরাজের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কর্ম হো চি মিনের কবিতার অনুবাদ। ‘কবিতা আবৃত্তির অভ্যাস নেই আমার/ কিন্তু এ বন্দিশালায় কি আছে অন্য কাজ?/ কয়েদি এ দিনগুলো কাটাব কবিতা লিখে/আর তা গাইতে গাইতেই নিকটে আনব/ স্বাধীনতার দিন।’ (ডায়েরির প্রথম পাতা)। কবিতার অমোঘ শক্তির প্রতি আস্থা রেখে যিনি এ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন তিনি বিপ্লবী নেতা হো চি মিন। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দু’তিনজন বিপ্লবীকে পাওয়া যায়, যারা বিপ্লবের একটা অস্ত্র হিসেবে কবিতাকে মান্য করতেন, চর্চাও করতেন। চিনের যেমন মাও সে তুং, চিলির পাবলো নেরুদা ও ভিয়েতনামের হো চি মিন। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন নেতাকে পাওয়া যায়, যারা তাঁদের লক্ষ্যে স্থির থেকে কার্য সম্পাদন করে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা, আমেরিকায় মার্টিন লুথার কিং, বাংলায় যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিপ্লব ও ভিয়েতনামের ইতিহাসে তেমনি একটি নাম হো চি মিন। চিনের কোয়াংসি প্রদেশে তেরোটি জেলার তেইশটি কারাগারে বা কারাগার সদৃশ স্থানে চৌদ্দ মাস বন্দি করে রাখা হয়েছিল হো চি মিনকে। সে-সময় তিনি লিখে ফেলেন ‘প্রিজন ডায়েরি’; যা চীনা ধ্রুপদী ভাষায় রচিত কবিতার প্রতিচিত্র সংবলিত। ১৯৬৭ সালে আইলিন পামার গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। কবি ও প্রাবন্ধিক মুনীর সিরাজ অনুবাদের মাধ্যমে বাংলার পাঠকদের সামনে নিয়ে এলেন হো চি মিনের কারাগারের কাব্য।
সন্ধ্যার পর অন্ধকারে বসে হো চি মিন দৃকপাত করতেন সকল সমস্ত ঘুমন্ত এবং জাগ্রত বন্দিদের প্রতি। নিষ্পাপ মুখের মানুষগুলি মাটিতে শুয়ে। দেয়ালে ছারপোকার হামাগুড়ি, আকাশে বিমানের ঝাঁকের মতো মশকের ঝাঁক। বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে স্বদেশ এবং কমরেডদের থেকে অনেক দূরে, জেলের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে তিনি মর্ম যাতনায় কাতর। এমন অসম্ভব সময়েই একটি ছোট পুরাতন নোট বইয়ে তিনি বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো রূপান্তর করেন কবিতায়। উল্লেখ্য কারারক্ষীদের ভাষাতেই তিনি তা রচনা করেছিলেন, কারণ ভিয়েতনামি ভাষায় কবিতাগুলো লিখলে তিনি সন্দেহের চোখে পড়তে পারতেন।
মূলত, ভিয়েতনামের সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই হো চি মিনের কবিতার মূল সুর। এতে তিনি যে স্বর ব্যবহার করেছেন, তাও সাধারণ। সাধারণে প্রবেশ্য। বিপ্লব এমন এক জিনিস, যেখানে সাধারণ্যের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হো চি মিন সেটা ভালোভাবেই বুঝতেন। কবিতায় তিনি রাজনীতি সচেতন এবং স্বদেশের মুক্তির জন্য প্রচণ্ডভাবে বিপ্লবে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাসে তিনি ছিলেন আপসহীন। এই আপসহীন বিশ্বাসটিকেই তিনি কবিতার মাধ্যমে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন—‘প্রতি সকালেই দেয়ালের ওপর ওঠে সূর্য/ প্রবেশ দরোজায় ঠিকরে দেয় আলো/ অথচ দরোজা তালাবন্ধ।/ জেলের ভেতর ঘরময় অন্ধকার/ তবু আমরা জানি, বাইরে জেগেছে উজ্জ্বল অরুণ। (সকাল)
তার কবিতায় অনুধাবনীয় বিষয়, যা অনায়াসেই ধরা যায়, তা হলো নিপীড়িত মানুষের জীবনের শিল্পীত রূপ। তিনি নিজেই নিপীড়িত ছিলেন বিধায় তার এই বোধ অধিকতর বাস্তবসম্মত—‘ক্ষুধায় হা মুখ তার/ পিশাচ দানব যেন লোহার পদবেড়ি/ প্রতি রাতে কামড়ে ধরে মানুষের পা।/ শক্ত চোয়ালে চেপে থাকে/ ডান পা সকল বন্দির, শুধু/ বাঁকানো নড়ানো যায় মুক্ত বাম পা। (লোহার পদবেড়ি)।
তার বিপ্লবী চেতনা ছিল সত্যনিষ্ঠ। এই সত্যনিষ্ঠতা তিনি কবিতায় সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। তাতে তার কবিতায় সৃষ্টি করেছে বিশ্বাস্য দৃঢ়তা। বিষয়টি কবিতায় যেমন নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে তেমনি বিপ্লবে কিংবা বিপ্লবে কবিতার সংশ্লিষ্টতায় যোগ করেছে বিশ্বাস। এই ধারাটি বিশ্ব কবিতার ইতিাসে নতুন। সম্ভবত সে-জন্যই ভিয়েতনামী সমালোচেকরা তাঁর কবিতাকে উল্লেখ করেছেন স্টিলি স্ট্রাকচার হিসেবে। শব্দগুচ্ছটি বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ইস্পাত অবয়ব।’
শুধু তাই নয়। কারগারকে তিনি নিছক কারাগারই মনে করেন না—‘সন্ধ্যার আহার শেষে সূর্য ঢেলে পড়ে/ লোকগীতি আর বাজনার ধ্বনি বেজে ওঠে/ সহসা চারদিকে,/ বিষণ্ন সিংসি জেল/ নবরূপে মূর্ত যেন ললিতকলাবিদ্যানিকেতন।’ (সন্ধ্যা)।
রূপান্তরক মুনীর সিরাজ রূপান্তরে তার কাব্য-চেতনা যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন। ফলে অনুবাদটি হয়ে উঠেছে ঝরঝরে, প্রাঞ্জল। অনুবাদে যেমন তিনি মূলানূগ, কাব্য চেতনা প্রয়োগেও তিনি কৌশলী। তাতে অনুবাদের কঠিন গন্ধ যেমন বিরক্ত করে না তেমনি হয়ে ওঠে না তার নিছক নিজের কবিতা। এসবের সমন্বয়ে অনুবাদকর্মটি হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য।
লেখক শিবির প্রদত্ত ‘হুমায়ূন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৭৬), ‘আলাউদ্দিন আহমেদ সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা’ (১৯৯৮), ‘কবি সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার’ (২০০১), ‘খুলনা রাইটার্স ক্লাব পদক (২০০২), ‘স্বপ্নকুঁড়ি সম্মাননা’ (২০১২), ‘নবগঙ্গা সাহিত্য পরিষদ মোগুরা) সম্মাননা’ (২০১২), অনুবাদ সাহিত্যের জন্য ‘নাট্যসভার’ আজীবন সম্মাননা (২০১৪), সহ অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ভ্রমণ করেছেন দেশে ও বিদেশের বহু জনপদে।
কবি-প্রাবন্ধিক মুনীর সিরাজের জন্ম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬, মাতুলালয় বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার খৈয়াগাঁও গ্রামে। পৈতৃক বাড়ি বিক্রমপুরের সিরাজদিখান থানার বাহেরঘাটা গ্রামে। প্রথম প্রকাশিত কবিতা, ‘পুতুল চিকিৎসক’—ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল সাহিত্য পত্রিকা, ১৯৬১। নিয়মিত শিশু সাহিত্য পত্রিকা ‘রঙধনু’তে প্রকাশিত প্রথম কবিতা—‘শূন্য’ ১৯৬২ সালে। ‘উন্মেষ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ’ -এর একজন সদস্য। জাতীয় কবিতা পরিষদ-এর নির্বহী সদস্য। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য।
আজ এই লেখকের জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে প্রণতি জানাই।