সৃষ্টিশীল-মননশীল মানুষকে তার সৃষ্টি দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। সৃষ্টিগুলোই থেকে যায় সময়ের পাটাতনে। মানুষ তো হারিয়ে যায় প্রকৃতির নিয়মে। কে কিভাবে হারিয়ে গেলো বা চলে গেলো না-ফেরার দেশে, তা জানা কি খুব মুখ্য হয়ে যায় মানুষটির সব সৃষ্টির কাছে? বরং সৃষ্টিই তো তাকে বাঁচিয়ে রাখে! মৃত্যুতে নাহয় সীমারেখা টেনে দেয়! মৃত্যু অবধারিত। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’—এই চিরন্তন সত্যকে আমরা অনেক সময় মেনে নিতে চাই না। বিশেষ করে কেউ যদি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু তো মৃত্যুই, স্বেচ্ছায় কী আর অনিচ্ছায় কী! যা হওয়ার তা তো হবেই। সবই প্রকৃতির খেলা। কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ যদি স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন, সেটা তার ইচ্ছা। কবি, লেখকদের অনুভবের অনুভূতি মূল্যায়ন বা তাকে হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করার ক্ষমতা যদি কোনো লেখক, কবির না থাকে তাহলে তাকে সৃষ্টিশীল কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অবশ্যই, হৃদয়ের অনুভূতিকে সম্মান জানাতে না পারলে, সেই কবিগণের কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়াও বাঞ্ছনীয় ।
কবি মুনিরা চৌধুরীকে নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে আমাকে শুরুতে এভাবে কিছু কথা লিখতে হলো। কারণ, তার অকস্মাৎ মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জাল বেঁধেছে। এই মৃত্যু রহস্য নিয়ে যে যেভাবে পারে কথা বলুক, তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। কারণ, কবির কোনো মৃত্যু নেই। সেই মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন! হৃদয়ের আলোড়ন কেউ সহ্য করতে পারে, কেউ পারেনা।একধরনের অতৃপ্তিই মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়।এমন দৃষ্টিতে দেখতে গেলে কবি মুনিরা চৌধুরী সেই অর্থে ব্যতিক্রম কিছু নন। কবির মনস্কামনা যদি এমন হয়, তাহলে আমাদের কী করার আছে? যেখানে তার কবিতা জ্বলজ্যান্ত সাক্ষী হয়ে কথা বলে! কবির কবিতাই যে কবিকে বাঁচিয়ে রাখবে। সেই সুবাদে থেকে যাবেন কালের সোপানে। যদিও বিলেতবাসী কবি মুনিরা চৌধুরীর অকাল প্রয়াণে বিশ্বব্যাপী বাংলা সাহিত্য অনুরাগীদের মনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আমরা সেই শোক কাটিয়ে উঠতে চাই তার কবিতার মধ্য দিয়ে। সেইসঙ্গে বাঁচিয়ে রাখতে চাই কবিকেও।
অনেকে বলেন যে, যিনি জগতের একখানি যথাযথ স্বাভাবিক চিত্রপট এঁকে দিতে পারেন, তিনিই যথার্থ কবি । একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করে ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতার সহযোগে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় সাধারণত বহুবিধ অর্থ বা ভাবপ্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধারায় বিভাজন ঘটানো হয়। এই অর্থে, যিনি কবিতা লেখেন, তিনিই কবি। ঠিক এইভাবে যদি কবি মুনিরা চৌধুরীকে দেখি তবে তার কবিত্ব শক্তির বিভিন্ন দিক খুঁজে পাবো; খুঁজে পাবো কবিতায় তার নিজস্ব সত্তাকেও। তাছাড়া কবি মুনিরা চৌধুরীর যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে, করে দুর্বল; সে বিষয়টি হলো তার দৃঢ় মনোবল ও আত্মবিশ্বাস। এই দৃঢ় মনোবলই একজন কবিকে কবি সত্তার পূর্ণতা দেয়। কবি মুনিরা চৌধুরীর ব্যক্তিত্বে এমন দৃঢ় চিত্তের ছায়াপাত ছিল। যা তার কবিতায়ও ফুটে উঠেছে। সংবেদনশীল মনের অধিকারী এই কবি জীবন, জগৎ, প্রকৃতিকে দেখেছেন নিজ অনুরণনে, দেখেছেন নিজ সত্তায়। প্রকাশও করেছেন নিজস্ব ধারায়।
মার্কিন কবি আর্চিবল্ড ম্যাকলিশের কথায়, A poem should not mean/but be, অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে কোনো কবিতাকে বাস্তব অর্থে মূল্যায়ন করি না বটে, তবে তার অন্যপৃষ্ঠেই কবিতার সত্যতা রয়ে যায়। আমরা বেশিরভাগ সময় কবিতার রূপক ভাবটা অনুধাবন করি, অনুধাবন করি না কবিতায় কবি হৃদয়ের অন্তর্নিহিত ভাবটা। কবিতা পড়ে হৃদয়ের ভাবাবেগে ডুবে যাই, আন্দোলিত হই আবেগঘন মুহূর্তে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, কবির হৃদয়ই কবিতার জন্ম-ভূমি। সময়-বিশেষে কোনো একটি বিশেষ সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা কবিতার রূপ ধরে প্রকাশের পথ পায়। কবি বেদনাকে রস-মূর্তি দান করেন। ব্যক্তিগত বেদনার রসমূল থেকে কবি যখন কল্পনার সাহায্যে আনন্দমধু আস্বাদন করতে পারেন, তখন বেদনা পর্যন্ত সুন্দর হয়ে ওঠে। বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা কল্পনাকে যে-লেখক অনুভূতির স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ তনুশ্রী দান করতে পারেন, তাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি। কবি মুনিরা চৌধুরীর কবিতা পড়তে পড়তে আমার মধ্যে এমন ভাবের অবতারণা হয়:
কে যেন রাস্তার পাশে মলিন চাঁদটাকে রেখে গেছে
চাঁদের গায়ে হোঁচট খেলাম শুধু পা নয়,
সমস্ত ‘আমি’ ভেঙে গেলে চাঁদের শরীর থেকে চাঁদনী ও আগুন বের হয়…
জন্ম হয় দাউ দাউ চিতার…
মহানন্দে পুড়তে থাকি পৃথিবীর প্রথম মানুষ
ওহে শ্রীমতি, ঠাকুর মা আমার
আমিও চিতা জ্বালানোর কৌশল শিখে গেছি!
নিজের মধ্যে নিজেকে ভাঙাচোরার এক নির্মম অভিলাষ। সত্য যখন ধরা দেয় না বাস্তবে তখন বোধ হয় এভাবেই নিজের মধ্যে ভাঙতে হয়। এমন সব কবিতার শব্দ বাক্যে কবির মননের সম্মোহন শক্তির ছোঁয়া পাই। একইসঙ্গে ফুটে উঠেছে বাস্তবচিন্তার বিমূর্ত রূপ।
সমাজ, সংসারের কাছে মানুষের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে, থাকে কিছু প্রতিশ্রুতি। যার সবকিছুই চলে এক নিয়মের ঘূর্ণিতে। এমন নিয়মের বেড়াজালে কবি হৃদয় তড়পাতে থাকে। আমি কবিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, জানি না। তবে তার কবিতা এবং লেখনী শক্তির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম৷ কবিতার মধ্যে কবিকে খুঁজতে গিয়ে দেখছি তার জীবনের টানাপড়েন, পাচ্ছি তার মনোরাজ্যের বিচিত্র সব অনুভূতি।
কবি মানেই দুঃখ-কষ্টের আকর আর যন্ত্রণার নিস্তব্ধ এক পাহাড়। প্রকাশ নেই কিন্তু ভাষা আছে, আছে শব্দ; এসবই কবির সম্বল। তাই নির্ভীক কবি বলেন,
রৌদ্রোজ্জ্বল এই দিনে
আপন ছায়া কেটে দিচ্ছি
প্রতি অঙ্গে মেখে নিচ্ছি ছায়ার রক্ত।
তীব্র বিষাদের অকপট প্রকাশ। কবির স্পর্শকাতর অনুভূতি মনোজগৎকে অসহায় করে তোলে। যা সাধারণের দৃষ্টিতে অগোচরে থেকে যায়, থেকে যায় কবিতার আড়ালেও। এখানেই মনে হয়, মৃত্যুতেই যেন কবির স্বীকৃতি কিংবা কবিতার স্বীকৃতি। যদিও কবির কোনো প্রস্থান নেই। শুধু অনন্তকালের দিকে কবিতার সিম্ফনি বেজে যায়। সেই সিম্ফনি সংকেত পাঠায় কবিকুলে। তাই বলতে পারি, কবি মুনিরা চৌধুরী আছেন কবিতার ধ্রুপদীতে, আছেন কবিতার সংহতিতে।
কবিহৃদয় এক অস্থির হৃদয়। হেথা নয় অন্যকোথাও, অন্য কোনোখানে ছুটে বেড়ানোটাই কবি হৃদয়ের সহজাত প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির তাড়না থেকেই কবিতার সৃষ্টি। জীবন তৃষ্ণার অনন্ত জ্বালা নিয়ে কবি মুনিরা চৌধুরীর অতৃপ্ত হৃদয় মনে হয় কবিতাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই কবি বলেন,
মজবুত চাকার রথ সমুদ্রের ওপর চলছেই চলছে আর
উদভ্রান্ত ডানায় ভাসতে ভাসতে জল ও যন্ত্র উভয়ই পুড়ে গেছে
হায় শ্যাম
তুমি কি এই ভাঙা যন্ত্রের সওয়ারী হবে!
আমি যে আত্মার নয়নই হারিয়ে ফেলেছি।
আবার অন্যভাবে কবির প্রকাশ দেখি…
দু’চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল পৃথিবীর প্রাচীন কবরে হায়!
এ-আনন্দধারায় আমিও জেনে যাই- বর্ষা এসেছে
জন্মসূত্রে ব্রিটিশ বাঙালি কবি মুনিরা চৌধুরীর কবিতায় বাংলার সমুদয় লক্ষণ পরিস্ফুট। বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে তার নাড়ির যোগ ছিল দৃঢ়ভাবে। আরও পরিসর নিয়ে বলা যায়, একইসঙ্গে মানুষ, বাঙালি, ব্রিটিশ, প্রগতিশীল মুসলিম ইত্যাকার পরিচয়ে তার যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচরণ ছিল, তা প্রতিফলিত হয় তার সমস্ত লেখায় ও কর্মকাণ্ডে।
কবি মুনিরা চৌধুরীর কবিতায় কবিকে খোঁজার প্রয়াস চালিয়েছি মাত্র। এভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে খুঁজতে গেলে অনেক ভাবের অনুপ্রাস চলে আসে। তবে, তার কবিতাগুলো সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি তার বইগুলোও সংগ্রহ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তার এ পর্যন্ত তিনটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো, ‘নয় দরজার বাতাস’, ‘মৃতের মাতৃমঙ্গল’ ও ‘মেহেকানন্দা কাব্য’। এছাড়া আরও কিছু সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন তিনি। অনলাইন ঘেঁটে যা পেয়েছি তাই পড়ে কবি মুনিরাকে বুঝতে চেষ্টা বা কবিতার আলোকে কবি মুনিরাকে খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। কারণ, কবির অনলাইনে পোস্ট করা অনেক লেখা মুছে ফেলা হয়েছে। এমনকি তার সামাজিক মাধ্যমটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি কেন করেছে, আমরা জানি না। তবে এই অমানবিক এবং ঘৃণ্য মানসিকতার তীব্র নিন্দা জানাই। কবিতা সৃষ্টিকারী কবি গণমানুষের হয়ে যান, হয়ে যান পৃথিবী ও প্রকৃতির কবি; তখন সে আর ঘরের কেউ থাকেন না। এই বাস্তবতা বুঝতে হয়তো অনেকেরই সময় লাগবে। তবে সত্য একদিন উদ্ভাসিত হবে ললাট লিখনের মতো। কবি মুনিরা চৌধুরীও থেকে যাবেন কবিতার আকাশে এক নক্ষত্র হয়ে।