বগুড়া মানেই মহাস্থান গড় কিংবা বেহুলার বাসর। এগুলো বাদেও যে আরও অনেক কিছু আছে—সেদিকে কারও যেন খেয়ালই নেই। বগুড়ার আছে হাজার বছরের ইতিহাস। এখানে আছে পাল রাজাদের বসতবাটির ধ্বংসাবশেষ,, চাঁদ সওদাগরের বাড়ি, হাজার বছরেরও বেশি পুরনো বৌদ্ধবিহার। যে বৌদ্ধবিহারের কথা উল্লেখ আছে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ কাহিনিতে। যে বৌদ্ধ বিহারের কথা উল্লেখ আছে শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে, সেলিনা হোসেনের ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে কিংবা জাকির তালুকদারের ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসেও। কেউই যেতে চায় না। কারণ অনেকে জানেই না।
আমি রীতিমতো জেদ ধরলাম আমিন ভাইকে (কবি সরকার আমিন) এবার বৌদ্ধ বিহারে নিয়ে যাব। বগুড়ার সরকারি মোস্তাফাবিয়া মাদ্রাসার মাঠে দাঁড়িয়ে ‘ঝগড়ার কাছাকাছি’ পৌঁছে যাচ্ছি কবিবন্ধু অনন্ত সুজনের সঙ্গে। সুজনের ইচ্ছা আমিন ভাইকে নিয়ে যাবে যমুনা নদীতে। আমিও নাছোড়বান্দা। অদূরে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের ‘প্রায় ঝগড়া’ দেখছে তরুণ কবি দেব জ্যাতি ভক্ত। বন্ধু রাহাত মোটরবাইকে বসে মজা দেখছে। আমিন ভাই একইসঙ্গে ছেলে পক্ষ এবং মেয়ে পক্ষের অভিভাবকের মতো কোনা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না।
বিকেল বেলার ছায়ার দৈর্ঘ্য আর বাড়াতে দিলেন না আমিন ভাই। তিনি এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘যেহেতু দু’জনেই সমানে সমান, সেহেতু আমি একটা প্রস্তাব করতে পারি?’
আমরা দু’জনেই মেনে নিলাম। আমিন ভাই যা বলবে তাতেই রাজি। সুজন বলল, ‘আমিন ভাই আপনি যা বলবেন তাতেই আমি রাজি। যদি বলেন গু খাও। গু খাব। এমরানকে যদি বলেন ড্রেনের পানি খাও। ও তাই খাবে। কিরে খাবি না?’
আমি বললাম, ‘তুই যদি এক চামচ খাস আমি দুই চামচ খাব।’
আমিন ভাই হেসে দিলেন। বললেন, ‘তাহলে টস করা হোক। বৌদ্ধবিহার উইন করলে বৌদ্ধ বিহারে সমভিব্যবহার হবে, নতুবা যমুনায় যৌবন বিলি।’
আমরা রাজি হয়ে গেলাম। টস হলো। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি জিতে গেলাম। সুজন একটা কপট রাগ দেখিয়ে মোটর বাইক স্টার্ট দিলো।
আমরা বৌদ্ধবিহারে যাচ্ছি। মনে মনে জয়ের আনন্দের রেশ। দশ পনেরো মিনিটই হয়নি। হঠাৎ আমাদের মোটরবাইক দু’টি পথ পরিবর্তন করে ফেলল একইসঙ্গে। মোটরবাইক দু’টি সে-পথ দিয়ে যাত্রা শুরু করল যে-পথ বৌদ্ধ বিহারের পথ নয়। যে-পথ যমুনা নদীর পথ। হায় রে! লটারিতে জিতেও আমাদের শপথ গেল কোথায়!
আমিন ভাই একটা হাসি দিলেন শুধু। বুঝলাম আমিন ভাইয়েরও সায় আছে এতে।
ঝগড়ায় বেশ সময় নষ্ট করে ফেলেছি আমরা। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। দিনের নদী কি তাহলে দেখা হবে না! আমিন ভাইয়ের এত ইচ্ছা! বেশ গতিতে ছুটে চলছে আমাদের মোটরবাইক দু’টি।
কিন্তু না নদীর কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে আমরা সন্ধ্যা লাগিয়ে ফেললাম। সন্ধ্যার নদী। ক্রমশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হতে থাকা নদী। আমরা বসে পড়লাম নদীর পাড়ে। আবছা ঢেউ ক্রমশ আবছা হতে থাকল। একসময় শুধুই ঢেউয়ের শব্দ। দূরে আলোর দুলুনি। খানিক বাদেই হালকা চাঁদের কুয়াশামগ্ন আলো! সেই আলোতে কাউকেই মনে হয় না সরকার আমিন। কাউকেই মনে হয় না অনন্ত সুজন। কাউকেই মনে হয় না এমরান কবির। কাউকেই মনে হয় না দেব জ্যোতি ভক্ত। মনে হয় মহাসুদূর থেকে ভেসে আসা অলৌকিক বন্ধনের কতিপয় পঙ্ক্তি। যার শেষে মহাশূন্যের মতো হাহাকার।
মেঘ এসে ছেয়ে ফেলল কুয়াশামগ্ন আলো। বৃষ্টি হতে পারে। ততক্ষণে আমাদের ভেতরে সংক্রামকের মতো ছড়িয়ে পড়েছে অলৌকিক বেদনাবোধ। অজ্ঞাত হাহাকার। অসমাপ্ত পিপাসা। আমাদের যে উঠতে হবে! আমাদের যে উঠতে হয়!
আমিন ভাই বললেন, ‘হুমায়ুন আজাদের কবিতা তোমাদের কেমন লাগে?’ সঙ্গে সঙ্গে এক বাউর বাতাস ধুলি সমেত আমাদের নাড়িয়ে দেয়। আমি এবং আমিন ভাই এক সঙ্গে বলে উঠি, ‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো। ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।’ বাতাস থেমে যায়। অবাকই লাগে একইসঙ্গে দু’জন ভিন্ন বয়সী মানুষ একই কবির একই কবিতার একই লাইনগুলো আওড়াচ্ছি কিভাবে! আমরা তো কেউ কাউকে বলে দেইনি!
ততক্ষণে তীব্র অন্ধকার। ঝড়ো হাওয়া। ছুটে চলেছে আমাদের দুটি মোটরবাইক। যেন হাছনের নাও। মেঘ ভেঙে ভেঙে ছুটে চলছে অনন্ত গন্তব্যে।
আমরা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সামনে সামনে চলা রাহাতের মোটরবাইককে। সুজনের বাইকে গিয়ারে সমস্যা হচ্ছে। স্পিড নেওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎই মোটরবাইকটি একটি তিন মাথার মোড়ে এসে থেমে গেল। ভয়ঙ্কর রকম কুটকুটে অন্ধকার। ঝড়ো হাওয়া। হালকা বৃষ্টি। ঝোপঝাড়। তিন রাস্তা। এখন কোনদিকে যাওয়া হবে?
সুজনের জানাশোনা ভালো। আমি সুজনের উদ্দেশে বলি, ‘এখন কোন দিকে যাব আমরা?’
সুজন দ্বিধাগ্রস্ত। বুঝতে পারছে না আমাদের রাস্তা কোনটা।
আমিন ভাই বললেন, ‘আমরা সব রাস্তায় যাব। কবিরা সব রাস্তায় যায়। কবিরাই সব রাস্তায় যেতে পারে।’
আমি বললাম, ‘একসঙ্গে যাব? না কি আলাদা আলাদা?’
আমিন ভাই বললেন, ‘প্রথমে একসঙ্গে, তারপর আরও একাধিক রাস্তা বের হবে, তখন পথও হয়ে যাবে আলাদা।’
সেই একই পথে কিংবা আলাদা রাস্তায় একা একা কিংবা একসঙ্গে যেতে যেতে বিচ্ছিন্ন হতে হতে একত্র হতে হতে আমরা পৌঁছে যাই আরেক কুয়াশামগ্ন প্রান্তরে। সেখানে আমি এমরান কবির একজন সরকার আমিনকে চিনি। সেখানে আমি এমরান কবির একজন সরকার আমিনকে চিনি না। সেখানে একজন সরকার আমিন এমরান কবিরকে চেনেন। সেখানে একজন সরকার আমিন একজন এমরান কবিরকে চেনেন না। আমরা আমাদের দেখছি কিংবা দেখছি না। আমাদের সামনে সৌম্যকান্তি এক বৃদ্ধ তাঁর হীরকদ্যুতিময় চোখ তুলে তাকাচ্ছেন। তাঁর আঙুল দুটি একটি সেতারার তারে টুংটাং আওয়াজ তুলছে। হঠাৎ থেমে যায় সেই আওয়াজ। আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই, বৃদ্ধ বলছেন, ‘আমি হলাম আমার বাবা মার প্রেমের ফসল। বিয়ের নয়।’
তারপর আমরা কিভাবে কিভাবে যেন একত্র হই। তুমুল বৃষ্টি আমাদের একাকার করে দেয়। আমিন ভাইয়ের কালো ফ্রেমের চশমার কাঁচ বেয়ে বেয়ে গলে পড়ে বৃষ্টি। আশ্চর্য তাতে কাঁচ একটুও ঝাপসা হয়ে যায় না। হঠাৎ আমিন ভাই বলে ওঠেন, ‘বলো তো বৃষ্টি কী?’
আমরা কোনো কথা খুঁজে পাই না। আসলেই তো বৃষ্টি কী? কোনোদিন তো এভাবে ভাবিনি! শেষে আমিন ভাইয়ের কথা-ই ধার করে বলি, ‘বৃষ্টি হলো পবিত্র মদ।’
দুই.
চমকপ্রদ নামকরণ, অভিনব উপমার ব্যবহার, আকর্ষণীয় ভঙ্গিমার জন্য সরকার আমিনের কবিতা স্বতন্ত্র। শুধু তাই নয় তার কবিতা এক অনন্ত পাঠ পিপাসার সুগভীর সমুদ্র যা কেবলই সম্প্রাসারণোন্মুখ। পাঠকের সঙ্গে সহজে সংযোগী হওয়ার বিরল ক্ষমতা নিয়ে তার প্রত্যেকটি কবিতা সংশ্লেষিত। ফলে তার কবিতা বিপুল পাঠকের কাছে সমাদৃত। ‘আত্মহত্যার পরিবর্তে এক কাপ চা খাও, ব্লেড দিয়ে কেটেছিলে জল, চার পাঁচ হাজার পিপড়ের দুঃখ, যাকে খুন করার কথা তাকে দেখে হেসে ফেলি—এরকম অদ্ভুত নামকরণের ফলে পাঠক খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠে। এই কৌতূহলের জন্য পাঠক তাঁর কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষণ তাদের কাছে চমক হয়ে আসে। (কবিতায় চমক থাকা না-থাকা নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’ধরনের বক্তব্যই পাওয়া যায়। চমক যদি চমকেই শেষ হয়ে যায় কিংবা চমক সর্বস্বতাই যার একমাত্র বৈশিষ্ট্য কিংবা চমক দিয়েই নিঃশেস হয়ে যাওয়া যার একমাত্র বৈশিষ্ট্য তার শিল্পমূল্য নিয়ে বিশাল প্রশ্ন ওঠে।) সরকার আমিনের কবিতা চমক দিয়ে শুরু হয় কিন্তু চমকসর্বস্বতা দিয়েই শেষ হয় না। কিংবা সাদামাটা ভাবে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যায় চমকের রাজ্যে। তাতে প্রথম প্রবেশেই পাঠক অনুভব করতে থাকে এক অদ্ভুত পিপাসা। এই পিপাসা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এভাবে এই পাঠ-পিপাসা তাকে নিয়ে যাবে কবিতার শেষতম শব্দে। তারপর ভাবাবে। তারপর আবার কবিতাটি পড়াবে। তারপর আবার ভাবাবে। এই ভাবনা তাকে নিয়ে যাবে পরবর্তী কোনো কবিতার অন্দরে।
এভাবে পাঠককে পিপাসার্ত করে তোলা এবং পিপাসা ধরে রাখার এক বিরল গুণ রয়েছে কবি সরকার আমিনের।
আরো আছে অভিনব উপমা ব্যবহারের আশ্চর্য ক্ষমতা। যেমন:
দাড়ি কাটার মতো মানুষকে মেরে ফেলা ভালো নয়
দুঃখগুলো ভিজে কাথার মতো শুকাতে দাও রোদে
আকাশও কর্ণফুলী কাগজের মতো হয়ে গেছে রক্তশূন্য
কাগজের ঠোঙার মতো পড়ে থাক পথে
মেছতার দাগের মতো মিলিয়ে যায় অভিমান
সূক্ষ্ণ অনুভূতি প্রকাশের এক মনোযোগী কবি সরকার আমিন। ব্যবহার করেন সহজ স্বর। যেন নিতান্তই আটপৌরে। নিতান্তই ব্যবহারিক। নিতান্তই সাদামাটা। কিন্তু কেন যে এত সংবেদী হয়ে ওঠে সেগুলো! এত স্বতঃস্ফূর্ত! তবু কেন যে অন্যরকম! যেন হাস্যোচ্ছলে বলে ফেলা কথা। কিন্তু কেন যে এত হৃদয়বেদী!
তাঁর কবিতার অনেক পঙ্ক্তির রয়েছে প্রবাদ-মূল্য। যেমন:
বিমান বালাদের চাকরি আছে স্মৃতি নেই
পাথর ও পাথরের মাঝে দূরত্ব থাকাটাই ভালো
পিপড়ে চড়ে বসতে পারি হাতির কাঁধে , হাতি তা পারে না
ওভার ব্রিজ কাঁদে না ভেঙে পড়ে
অনেক কিছু আছে, ঘটে, পেছনে পড়ে থাকে না কোনো যুতসই হেতু
তিন.
তুমি এখনই যেয়ো নাকো
বসে থাকো চোখের ভেতরে
তুমি পথে নামলে সমবেত সভ্যগণ অসভ্য হয়ে যাবে
প্রিজাইডিং বুথে জ্বলে দেবে স্ব স্ব কামনার আগুন
তুমি এখনই যেয়ো নাকো
বসে থাকো চোখের ভেতরে!
দুই দশক হতে চলল, তবুও কেন যে এই চরণগুলোর আসক্তি থেকে মুক্ত হতে পারলাম না! কত কিছুই তো চেঞ্জ হলো। এক সময়ের কত প্রিয় কিছু এখন হয়ে গেছে অর্থহীন। কিন্তু এই চরণগুলো এখনও একই রকম উজ্জ্বল।
আমিন ভাইয়ের কবিতা এরকমই।
চার.
সেদিন যমুনা পর্ব শেষ করে বাসায় ফেরার পরে মনে পড়ল, আমার অনেক জ্বর ছিল। কিন্তু কোনো টেরই পাইনি। আমিন ভাইয়ের সঙ্গ এরকমই। কারণ এই মানুষটি হৃদয় দিয়ে হাসতে জানেন। আমরা যা কেউই পারি না। পারি না বলেই তিনি সঙ্গে থাকলে জ্বরও লাগে মিষ্টি।