জিন্দাবাহার। পুরান ঢাকার একটি এলাকা। এখানকার থার্ড লেনের সাত নম্বর বাড়ি। নিম্নবিত্তের বহু মানুষের বাস এই বাড়িতে। মিলু নামের সাত বছর বয়সী এক শিশু তার শিশু-চোখ দিয়ে দেখছে বাড়ির বিচিত্র মানুষগুলোকে। তাদের পেশা, প্রতিদিনকার জীবন, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার প্রতিচ্ছবি দেখছে তার সরল চোখে। কখনো আনন্দ এসে ভাসিয়ে নিচ্ছে তাকে, কখনো বেদনার ভার নত করছে। কখনো কৌতূহলে দিকশূন্য হয়ে যাচ্ছে সে। কখনো সে আকাঙ্ক্ষায় হয়ে যাচ্ছে কাঙাল। ষাটের দশকের শুরুর দিকের পটভূমি। মাধ্যম সাত বছর বয়সী শিশুর সরল কৌতূহলী চোখ। কিন্তু উঠে আসছে ওই সময়ের পূর্ণ ছবি। পুরান ঢাকার চালচিত্র। মানুষের বিকাশ ও বিকার। জয় ও পরাজয়। ক্ষয় ও অবক্ষয়।
জিন্দাবাহার। দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনের বৃহদায়তনিক গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।
বিক্রমপুর এলাকা থেকে এসে পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার লেনের ভাড়া বাড়িতে উঠে একটি পরিবার। এই পরিবারেরই এক সন্তান মিলু। সে শিশু চোখ দিয়ে দেখছে সবকিছু। সদরঘাট লঞ্চ থেকে নামার সময় থেকেই তার শুরু। তারপর রাতের ঢাকা। তারপর একে একে এ-গলি সে-গলি, তস্যগলি, নবাব বাড়ি, নবাব বাড়ির লোকজন, আহসান মঞ্জিল, বিহারি বাড়ি, লায়ন হলো, হনুমান পাতাল বিজয় সিনেমা হয়ে তার বাবার জৌলুসপূর্ণ জীবন ধীরে ধীরে সাধারণ হতে হতে নিম্ন পর্যায়ে চলে যাওয়া। বাবার চাকরি না থাকায় একসময় না-খেয়ে থাকার যন্ত্রণা, তখনকার মনস্তত্ব, একটু খাবারের জন্য বড়লোকের বাড়িতে যাওয়া, একটু পয়সার জন্য প্রেসের সিসার টুকরো সংগ্রহ, চরম অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বাবার ভেঙে পড়া জীবন, মায়ের পরাজিত মুখ। একসময় হেরে গিয়ে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য আবার তাদের গ্রাম-দেশে চলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে যায় এই করুণ আখ্যান। মাঝখানে সময়ের ব্যাপ্তি মাত্র এক-দেড় বছর।
এসময়ের মধ্যেই যা বলবার তা বলে দেন জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন। বলেন সাত বছরের শিশুর চোখ দিয়ে। তার সরল রৈখিক বিবরণের মধ্য দিয়ে। বলেন তার শাদা চোখে যা দেখা যায় তাই-ই। স্রেফ ভাবনালিপি। বলেন পরম নির্মোহে। বলেন নির্মেদ ভাষায়। বলেন অলঙ্কারহীন। তাতেই কী শোভা! কেন এত শোভা? কারণ যে-দৃশ্যলিপি দেখা যায় উপন্যাসে তা নিছক শিশুর দেখা। একবারেই ভণিতাহীন। যা অকৃত্রিম। এই সহজ-রৈখিক ধারা পুরো উপন্যাসকে দিয়েছে অপার মহিমা অকৃত্রিমতাকে ধারণ করে হয়ে উঠেছে শিল্প-শোভিত।
ইতিহাস তো অনেক সময়ই সন-তারিখ আর ঘটনার সমারোহ। ইতিহাসের চোখ এগুলোকেই মোটা দাগে দেখে। লেখক ইমদাদুল হক মিলন ঐতিহাসিকের চোখ দিয়ে ওই সময়ের পুরান ঢাকাকে দেখেননি। দেখেছেন শিশুর চোখ দিয়ে। আর শিশুর চোখ এমনই যে এই এলাকার সকল মানুষের খুঁটিনাটিও তার চোখে ধরা পড়ছে। বিচিত্র পেশার মানুষের হাসি কান্না অভিব্যক্তি চালচলন অভ্যাস—সবকিছু তার চোখে ধরা পড়ছে। যেন গোপন স্ক্যানার। যা দিয়ে সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ চলছে ওই সময়কার।
কিছু কিছু কাঠামো আছে, কিছু কিছু উপস্থাপন আছে যা লেখকের উদ্দেশ্যপূরণের সঙ্গে মাত্রাসিদ্ধভাবে সম্পর্কিত। যে কাঠামোর কোনো বিকল্প হয় না। যে কাঠামোর কোনো প্রতিস্থাপকও হয় না। ইমদাদুল হক মিলন জিন্দাবাহার উপন্যাসে সাত বছরের একটি ছেলের জবানিতে-কথনে যা তুলে এনেছেন তা ওই উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে একান্তভাবে মিলে যায়। ফলে ভাবনার কেন্দ্রীয় বাসনার সঙ্গে উপস্থাপনার যোগসূত্র সংশ্লেষিত হয়ে যথার্থভাবে। যা যথার্থ ভাবনায়। যা যথার্থ উপস্থাপনায়।
একটু পরপর ক্যাপস্টেন সিগারেট খাওয়া বাবা যখন সিজার সিগারেট ধরেন তখন থেকে বোঝা যায়, এই পরিবারের বিপর্যয়ের পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। মিলুর চোখ তা এড়ায় না। মিলু দেখে বাবার পকেটে সিজার সিগারেটের কয়েকটা মাত্র শলাকা। একদিন মিলু দেখে তার বাবার পকেটে অর্ধেক খাওয়া সিজার সিগারেট। এলাকার মিন্তি (কুলি)রা এভাবে সিগারেট খায়। মিলুর বুকটা কষ্টে ফেটে যায়। একদিন বাবা হুকা কিনে আনেন। এক বেলা খাবার জোটে। দুই বেলা উপোস। এভাবে এক পর্যায়ে রাতে মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া। দেয়ালে বাবার পিঠ ঠেকে গেছে। মা তার মায়ের কাছে চিঠি লেখে। আর অপেক্ষা করে। একদিন দেখে বড় ভাই এসেছে নানির বাড়ি থেকে। মা বাবা সবার চোখ আনন্দে নেচে ওঠে। আদর করে তাদের বড় ছেলেকে। খোঁজ নেয় টাকা দিয়েছে কি-না। মিলুর বড় ভাই সেলাই করা পকেট দেখায়। সেই পকেট খুলে দেখা যায় আড়াইশ টাকা। একশত টাকা বাবা বাড়িওয়ালাকে দিয়ে আসেন পাঁচ মাসের ভাড়া বাবদ। আর অনুরোধ করেন দুইমাস পর ভাড়া দেওয়ার কথা। বহুদিন পর মিলুদের বাড়িতে মিন্তি দিয়ে বাজার করানো হয়। ধার দেনা শোধ করা হয়। কিন্তু এ জৌলুস থাকে মাত্র পনেরদিন। তারপর যেই কি সেই। আইসক্রিমওয়ালা, সনপাপড়িওয়ালা আসে। ককটিওয়ালা আসে। মিলু সে-দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। মিন্তি লোকটা আগের মতোই বিড়ি টানে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুকরি নিয়ে চলে যায় নয়াবাজারের দিকে। মিন্তি খরচ বাঁচানোর জন্য ছোট্ট হাত দিয়ে লাকড়ি বয়ে নিয়ে আসে ছ্ট্টো মিলু। চাল, বাজার এবং লাকড়ি—এতগুলো জিনিস একসঙ্গে আনতে কষ্ট হবে বলে ছোট্ট মিলু তিনবার বাজারে যায়, আসে। কষ্টে চোখ ফেটে পানি পড়তে চায়। সমবয়সী প্রতিবেশী বিরিং মিলুকে টিটকিরি দেয়, ‘মিলুমিন্তি’। একদিন বাবা প্রস্তাব দেন মাকে, চলো গ্রাম-দেশে ফিরে যাই। সেখানে অন্তত খাবার কষ্ট নেই। মা-ও রাজি হয়ে যান।
ভোর হওয়ার অনেক আগে আবার বোচকা বাচকি নিয়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে একজন বাবা ঘর থেকে উঠোনে নামেন। মিলু নামের ছেলেটি চিপাগলি থেকে মুখ ঘুরিয়ে বাড়িটার দিকে তাকায়। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। এ জগতে তার আর কখনো ফেরা হবে না।
সময়টাই যেন ঘোরের। জিন্দাবাহার এলাকাটাই যেন ঘোরের। এই ঘোরের মধ্যে সত্যিকার ঘোর নিয়ে আসে মিলু নামের শিশুটি। যে আচ্ছন্ন করে রাখে জিন্দাবাহার উপন্যাসের প্রতিটি শব্দের সঙ্গে। পাঠকও লেপ্টে থাকে। এই ঘোর একসময় তাকে বেদনার দিকে নিয়ে যায়। বেদনা নিয়ে যায় হাহাকারের দিকে। জিন্দাবাহার উপন্যাসখানি শেষ হয়ে যায়। এই হাহাকার আর শেষ হয় না। মলাট বন্ধ হযে যায়। চোখ যে একটু ঝাপসা ঝাপসা! সেখানে আঙুল দিলে তার মাথা ভিজে যায়। অনুভব করা যায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু!
জিন্দাবহার উপন্যাসখানি শেষ পর্যন্ত অশ্রু ঝরায়।
ইমদাদুল হক মিলন এভাবেই পাঠকের অনুভূতিতে স্পর্শ করেন। স্পর্শ করে করে তিনি হয়ে উঠেছেন দুই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের অন্যতম। লিখেছেন নুরজাহান উপন্যাস, যা বাংলাভাষার বৃহত্তম উপন্যাস। একইসঙ্গে কালজয়ী। এবং সমান জনপ্রিয়। তাঁর সর্বসাম্প্রতিক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস সাড়ে তিন হাত ভূমি।
একই সঙ্গে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক হওয়ার বিরল কৃতিত্ব খুব কম সংখ্যক লেখকেরই হয়ে থাকে। ইমদাদুল হক মিলন সেই কম সংখ্যক লেখকদের একজন। আজ তাঁর জন্মদিন। তাঁর জন্য অফুরন্ত শুভ কামনা।
মন্তব্য