যাদের কবিতায় সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পাশাপাশি দেশপ্রেম, দ্রোহ একইসঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে, তাদের একজন কবি মিনার মনসুর। প্রেম-দেশপ্রেম ও দ্রোহের মিশেলে মিনার মনসুর যত কবিতা লিখেছেন, সেগুলোর অন্যতম, ‘কুশল সংবাদ’। এই কবিতায় তিনি বলেন, ‘তুমি নেই তবু কী চমৎকার আছি দেখে যাও;—/ এখনো স্মৃতির মতো তরতাজা ভোর এসে নিত্য/কড়া নাড়ে আমার দুয়ারে।…/ জমে থাকা জিজ্ঞাসার মতো জমকালো রাত্রির রাধারা এসে/ভালোবেসে জড়ায় আমাকে’। ঠিক একইভাবে ‘প্রিয় ইথাকা আমার’ কবিতাটিও উল্লেখযোগ্য। এখানে কবি প্রিয় ইথাকা বলতে বাংলাদেশকে বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশকে বসিয়েছেন প্রেমিকার স্থানে। তাই তিনি যখন একই কবিতায় বাংলদেশকে প্রেমিকারূপে কল্পনা করে লেখেন, ‘আমাদের উষ্ণ আলিঙ্গনগুলি/ নতুন পলির মতো সুফলা করেছে বন্ধ্যা মাটির শরীর’, তখন আমরা বুঝতে পারি—দেশপ্রেম যদি বাংলাদেশ নামের রূপসীর সঙ্গে মিশে যায়, তবে অনুন্নত বাংলাদেশ স্বনির্ভর হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি, মিথ, ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে তাঁর কবিতার পরতে-পরতে। তিনি গ্লোবাল ভিলেজ ধারণায় বিশ্বাসী। তবে ‘গ্লোবালাইজেশন অব পয়েট্রি’র বদলে রচনা করেছেন বাংলাদেশের কবিতা। তাই কবিতায় দুশ্চিন্তা, ভয়, দুঃস্বপ্নের পরিমণ্ডলকে প্রাধান্য দিয়ে চারপাশের মানুষের করুণ অবস্থা তুলে ধরেন তিনি। তুলে ধরেন রাষ্ট্রের যুক্তিহীন আচরণ আর অমানবিকতার স্থির প্রতিচিত্রও। তাই ‘চলে যাবো’ কবিতায় বলেন, ‘নারী কুকুর, হোটেল মালিক, নষ্টগলির ভণ্ডকবি/ সব শালাদের কসম খেয়ে বলতে পারি/ …কুত্তামরা, মানুষমরা, সদরঘাটের নারীমরা/ এমনি কত হাজার মরার গন্ধ মেখে/ এবার আমি চলেই যাব/..নারী তুমি রাগ করো না হয়তো ক’দিন কষ্ট পাবে/ টাকা দিয়ে রূপ কিনবার মানুষ কি আর অভাব হবে/… ভণ্ড কবি তুই শালা আর যাবি কোথায়?/ জীবনটা তো পরের ঘাড়ে কর্মবিখ কাটিয়ে দিলি।’ তিনি ‘রূপ কিনবার মানুষ’, ‘কুত্তামরা গন্ধ’, নষ্ট গলির ভণ্ড কবি’ ও ‘সব শালাদের কসম খেয়েও’ শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। তুলে ধরেছেন সমাজবাস্তবতার করুণ অবস্থা।
কবি রাজনীতিকে কখনো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবতে পারেন না। সময়ের হিংস্রতা দেখে তিনি অবাক হন। সময় যেন তাঁর প্রতিযোগী হয়ে প্রেম করতে চায় প্রেমিকার সঙ্গে। ছিনিয়ে নিতে চায় তার স্বপ্ন। তাই মর্মাহত কবি তাকে তুলনা করেন এভাবে, ‘এ বড় কঠিন যাত্রা একাকী আমার।/ সামরিক গোয়েন্দার মতো চতুষ্পার্শ্বে/ ওঁত পেতে আছে এক ভয়ানক প্রতারক কাল।… যাওয়াটাই একমাত্র অনিবার্য নিয়তি আমার।/ তবু তুমি কেন জেনেশুনে এ পথেই বাড়ালে পা!’
পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের আধার নারী। তাই তার হাতে হৃদয় বন্ধক রেখেই কবিতা লেখা কবির স্বভাব। এ ক্ষেত্রে মিনার মনসুরের কবিতায় কখনো-কখনো নারীকে দেখি সুবিধাবাদী পিংকি রূপে। যাকে কবি চিত্রায়িত করেন এভাবে, ‘পিংকিরা চলিয়া যায় বারংবার কবিকে মথিত করে।’ আবার কখনো সেই নারীর রূপেই কবি মুগ্ধ হন। মৃত্যুর চেয়ে নারীর সৌন্দর্যের দাপটে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘মৃত্যুর দাপট কে বলে অধিক নারীর বক্ষের চেয়ে?’। এই যে নতুন যুক্তি দাঁড় করিয়ে পাঠককে ভাবিয়ে তোলা, এই যে সাধারণ বাস্তবতাকে অসাধারণ উপস্থাপনায় দর্শন করে তোলা, তা কেবল কবির পক্ষেই সম্ভব। তাই তিনি কখনো প্রেমিকাকে না পাওয়ার বেদনায় কাতর। আবার কখনো প্রেমিকার রূপকীর্তন করে বেদনাহত।
কবিও প্রেমে অটুট থেকে প্রেমিকার বিরোধিতা করা থেকে মনকে বারণ করছেন। মনকে প্রেমিকার অনুগত থাকতে বলছেন এভাবে, ‘মন তুমি সেরে ওঠো; সাইবেরিয়ার তীব্র তুষার ঝড়ের মতো/তোমাকে যে হিমায়িত করে গেলো তাকে ভুলে যাও/…সদ্য যুবতীর মতো বিপুল বর্ণাঢ্য সাজে বসন্ত নাড়ছে কড়া—নির্বাসিত দুয়ারে তোমার।/… এই তোমাকে ফেরাবে বলে/কিশোরী রোদেরা এসে ব্যাকুল বুলায়/হাত তোমার কপালে।…/ নিঃসঙ্গ গোলাপটিও স্বেচ্ছায় মেতেছে মৌনব্রতে;-/সেও শুধু তোমারই আশু রোগমুক্তি কামনায়—/ প্রিয় মন তুমি সেরে ওঠো।’
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘পা পা করে তোমার দিকেই যাচ্ছি’ বইটির কিছু কবিতা নির্বাচিত কবিতা বইটিতে স্থান পেয়েছে। তিনি তুলে ধরেন রাষ্ট্র যন্ত্রটি কিভাবে নাসিরনগরে, কাশ্মীরে, আরকানে, আফগানিস্তানে ও মধ্যপ্রাচ্যে মানবতাকে পিষ্ঠ করে চলে। তাই তিনি বলেন, ‘দজলা-ফোরাত থেকে গঙ্গা ও নাফ। কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু রক্তস্রোতে শ্যাওলার মতো ভেসে যাচ্ছে মানবতার বিবস্ত্র দেহ।’ এই যে রূপকে রূপকে বাস্তবতা তুলে ধরাই একজন কবির প্রকৃত কাজ। কবি এসব নদীর অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘তবু ও গঙ্গা ও নাফ—তুমি বইছো কেন?’ এই মানবতার প্রতিধ্বনি কিভাবে পৌঁছে দিতে হয় মন থেকে মনে—কবি তা ভালোভাবেই জানেন। আর জানেন বলেই তিনি ‘পঙ্গু পরিত্রাণ’ কবিতা লেখেন। তিনি সভ্যতাকে পরিহাস করে বলেন—‘কাঁটাতারে ঝুলন্ত যে ঝলমলে কিশোরীকে দেখছো, সে আমি।’ যেখানে চেঙ্গিস খাঁরা কবির কাছে বাংলাদেশের সব শোষণকারীদের প্রতীক। আর এই শোষকশ্রেণীকে তিন আঙুল তুলে লেখেন, ‘চেঙ্গিস খাঁদের অজেয় অশ্বের পদাঘাতে উড়ে যায় যত উলুখাগড়ার প্রাণ/ আমি সেই শবাধার; অদূরে নিভৃতে খুব পাথরে মস্তক ঠোকে পঙ্গু পরিত্রাণ।’
কবি বলতে চাইছেন, আমি সেই সমঝোতাকারী রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধি যে ছাড় দিতে দিতে জীবনকে তুচ্ছ বানিয়ে প্রাণের বদলে শোষক শ্রেণী ও ভূ-রাজনৈতিক পরাশক্তিদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলে। এতকিছুর পরও তিনি প্রেমিক। পুরোই একজন প্রেমিক পুরুষ বলা যায়। কারণ তিনি কবিতায় মার্চের মতো চিৎকার করে জানাতে পারেন, তিনি প্রেমিকাকেই চান। আর বলতে পারেন, ‘আমি মুখ খোলার আগেই আমার সকল রক্তকণা সাতই মার্চের জনসমুদ্রের মতো সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে: তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই।’ কবিতাপ্রেমী এ বাংলার আবহাওয়া তাকে নিঃসন্দেহে স্বাগতম জানাবে।