শাড়ি! আহা শাড়ি! বাঙালি নারীর শাড়ির প্রতি থাকে আজন্ম নাড়ির টান।
পৃথিবীর আর সব সৌভাগ্যবতী মেয়েদের মতো আমার মায়ের সঙ্গে আমার তো কখনো গলায় গলায় ভাব ছিল না। আম্মাকে কখনো প্রিয় বন্ধুর মতো জীবনে চলার পথে আমার পাশে পাইনি। বরং আম্মার সঙ্গে আমার সম্পর্কে ছিল যোজন যোজন দূরত্ব। আর ছিল আতঙ্ক, ভয় মিশ্রিত এক অস্বাভাবিক সম্পর্ক। ফলে খুব আনন্দের কোনো স্মৃতি যে আছে, তাও নয়। কিন্তু মায়ের শাড়ি নিয়ে স্মৃতিকথা লেখার মতো অবশ্য কিছু অনুপম স্মৃতি আমারও আছে। তার প্রধান কারণ হচ্ছে আমার শৈশব-কৈশোরে আমি যখন সারা পৃথিবীর প্রতি অজস্র কৌতূহল নিয়ে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছি, তখন কিন্তু আম্মা সবসময় শাড়িই পরতেন। আর সেইসব নরম কোমল রেশমের মতো সুতির শাড়িগুলো গোসল করে আম্মা মেলে দিতেন আমার বাসার পেছনের উঠোনে।
বাসার পেছনের এই উঠোনে ছিল বেশ কয়েক প্রকারের গাছ। উঠোনের এক কোণায় ছিল একটি পেয়ারা গাছ আর আরেক কোণায় ছিল একটি বিশাল বরই গাছ। গাছ দুটির ডালের সঙ্গে দড়ি বেঁধে সেখানে ভেজা কাপড় মেলে দেওয়া হতো। ওখানেই আম্মা গোসলের পর শাড়ি মেলে দিতেন। আমি স্কুল থেকে এসে সোজা চলে যেতাম পেছনের উঠোনে। যেখানে আমার প্রিয় পেয়ারা গাছটি ছিল। আর আমি দিনের বেশিরভাগ সময় ওই গাছটিতে উঠে বসে থাকতাম।
পেয়ারা গাছের কাছে যেতে হলে আমাকে আম্মার শাড়ি হাত দিয়ে সরিয়ে তারপর যেতে হতো। আর সেই শাড়ি পার হয়ে গাছের কাছে যেতে যেতে আম্মার শাড়ি থেকে আসা এক অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ আমার নাকেমুখে এসে আছড়ে পড়তো। সেই আবেশ মাখানো গন্ধ যেন এখনো আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে ভেসে বেড়ায়। আর আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার সেই দুর্দান্ত শৈশবে।
এত গেলো আম্মার শাড়ি নিয়ে আমার ছোটবেলার কিছু মধুর স্মৃতির কথা। ওই সময় ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্সে পড়ি। তখন পর্যন্ত আসলে শাড়ির প্রতি বিশেষ কোনো টান বা মমতা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ক্লাস নাইন-টেনে ওঠার পর থেকেই শাড়ির প্রতি এক ধরনের তীব্র আকর্ষণ জেগে উঠলো। ও ওই সময় খুব মনোযোগ দিয়ে আম্মার শাড়িগুলো খেয়াল করতাম। দেখতাম আম্মার বেশিরভাগ শাড়ি জর্জেটের। আম্মা ঘরে সুতির শাড়ি পরেন কিন্তু বাইরে বের হওয়ার সময় জর্জেটের শাড়ি পরেন। আর আম্মার প্রায় সব জর্জেটের শাড়িগুলোই দেশের বাইরে থেকে আনা শাড়ি। কারণ আব্বা অনেক বছর দেশের বাইরে ছিলেন। আসার সময় অনেক শাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া, আমার মেজ চাচা তখন ইংল্যান্ডে ছিলেন। পরে অবশ্য সিঙ্গাপুরে গিয়ে বাইশ থেকে আবারও পরে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলেন। তো যাইহোক মেজ চাচা-চাচি দেশে আসলেই আম্মার জন্য জর্জেটের শাড়ি নিয়ে আসতেন। আবার সেজচাচাও দেশের বাইরে নানা ট্রেনিংয়ে যেতেন। সেখান থেকেও আম্মার জন্য আর সেজ চাচির জন্য চাচা জর্জেটের শাড়ি নিয়ে আসতেন। এভাবেই আম্মার বেশ কিছু একেবারে অন্যরকম জর্জেটের শাড়ি জমে গেলো। শাড়িগুলো এত সুন্দর আর আনকমন ছিল যে আমার কয়েকটা শাড়ির দিকে ভীষণ লোভ ছিল। ততদিনে আমিও কলেজে উঠে গেছি। লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছি।
সেসব ড্রেসগুলো আমি এখন আর পরি না। কিন্তু আম্মার শাড়ি দিয়ে তৈরি সেই জামাগুলো এখনো আমার কাছেই আছে। আর যতদিন বেঁচে আছি নিশ্চয়ই ওগুলো সাথেই থাকবে।
এদিকে বাসা তো পল্লবীতে। সেসময় লালমাটিয়া কলেজের ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য দুইটি কোস্টার ছিল। আমি সেই কোস্টারেই যাতায়াত করতাম। এদিকে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বা কোনো বান্ধবীর জন্মদিনে অথবা কারও বিয়েতে (কলেজে থাকতেই কয়েকজন বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল) সবাই শাড়ি পরতো। কিন্তু আম্মার কাছ থেকে শাড়ি নিয়ে পরার সাহস আমার সবসময় হতো না। আসলে আম্মার কাছে ঘেঁষারই সাহস তো ছিল না। শাড়ি চাইবো কী করে? কিন্তু পরে বুঝেছিলাম যে আম্মা জানতো আমার কোন কোন শাড়ি খুব প্রিয়। একটা শাড়ি ছিল খুব মিষ্টি কমলা রঙের ওপর মেরুন আর খয়েরি ছোট ছোট বল। এত সুন্দর ছিল শাড়িটি যে আমি মাঝেমাঝে আম্মার আলমারি খুলে লুকিয়ে লুকিয়ে শাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আম্মা বাসা থেকে খুব কম বের হতেন। যখন বের হতেন জর্জেটের শাড়িই পড়তেন। কারণ জর্জেটের শাড়ির পরার অনেক সুবিধা। এটিকে প্রথমত আয়রন (স্ত্রি) করতে হয় না।
এছাড়া জর্জেটের শাড়িতে খুব সুন্দর করে কুঁচি দেওয়া যায়। আর সহজেই ধুয়ে ফেলা যায় আর খুব তাড়াতাড়ি শুঁকিয়েও যায়। ওই সময়টিতে জর্জেটের শাড়ির প্রতি যে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করতাম সেটা আর পরবর্তী সময়ে আমার ছিল না। এখন তো আমার নানা ধরনের সুতি, জামদানি, মসলিন এসবই আমার প্রিয় হয়ে উঠেছে।
যাইহোক, এইচএসসি’র রেজাল্টের পরপরই আমার বিয়ে হয়ে গেলো। আমার হাসবেন্ড তখন নতুন ক্যাপ্টেন সাহেব। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং। থাকেন আর্মির মেস বি’তে। আমিও কয়েকদিন খুলনায় শ্বশুরবাড়িতে থেকে মেসে চলে আসলাম থাকার জন্য (তখনো বাসা পাওয়ার জন্য যোগ্য ছিলাম না আমরা)। মেসে আসার কয়েকদিন পরেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ক্ল্যাসিক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করলাম। মেসে মাত্র একটা রুম। জায়গা কম তাই জামাকাপড়ের সুটকেসগুলো তখনো খোলা হয়নি। দুই-তিনটা ঢাউস সাইজের সুটকেস ভর্তি অনেক জামাকাপড় আর শাড়ি-ব্লাউজ। এতদিন সবকিছু খুলে গোছানোর সময়ও পাইনি। আর মেসের ভেতর এত কাপড়চোপর কোথায় রাখবো, চিন্তা করেও ওগুলোতে হাত দেওয়া হয়নি। এরইমধ্যে আমার গাদা গাদা সব কাপড় রাখার জন্য একটি ওয়ারড্রবও কেনা হয়েছে। ফলে কোচিং ক্লাস করতে যাওয়ার জন্য সমস্ত জামাকাপড় বের করে গোছাতে শুরু করলাম।
যে সুটকেসে শাড়ি-ব্লাউজ ছিল ওটা গোছানোর জন্য সব কাপড় বিছানায় ঢালতেই দেখলাম একটা পোটলায় কী যেন সব আছে। পোটলাটা খুললাম। দেখলাম আম্মার যেই শাড়িগুলো আমার খুব প্রিয় ছিল সেরকম পাঁচটা শাড়ি ওর মধ্যে রয়েছে। তার একটি হচ্ছে সেই হালকা মিষ্টি রঙের কমলা বলপ্রিন্টের শাড়িটা। আমি তো হতভম্ব হয়ে পোটলাটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকলাম। জীবনে এত খুশি আর কখনো হয়েছি কি না, মনে নেই। সম্বিৎ ফিরে শাড়িগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ যে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম—বলতে পারবো না।
বহুবছর ধরে সেই শাড়িগুলো আমি যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম। জর্জেটের শাড়ি পরা হয় না বলে শুধু একটা শাড়ি স্মৃতি হিসেবে রেখে অন্যগুলো দিয়ে পরে গাউন, কামিজ আর ফতুয়া বানিয়ে পরতাম। সেসব ড্রেসগুলো আমি এখন আর পরি না। কিন্তু আম্মার শাড়ি দিয়ে তৈরি সেই জামাগুলো এখনো আমার কাছেই আছে। আর যতদিন বেঁচে আছি নিশ্চয়ই ওগুলো সাথেই থাকবে।