তার নাম মারিয়ানা আলসোফোরাডো (Mariana Alcoforrado)। পেশায় পর্তুগিজ নান। আজ থেকে সাড়ে তিনশত বছর আগে তিনি প্রেমে পড়েছিলেন এক ফরাসি সৈনিকের। একজন নানের পক্ষে ধর্মের কড়া বিধিনিষেধ উপক্ষো করে সেই রক্ষণশীল সমাজে এক ভিনদেশির প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! মারিয়ানা শুধু প্রেমেই পড়েননি, ফরাসি প্রেমিক (Chamilly)-কে মোট পাঁচটি প্রেমপত্রও লিখেছিলেন। সেই প্রেমপত্রগুলো পাঠ করলে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে প্রেমে উতলা হয়ে ওঠা এক নারীর মুখচ্ছবি!
মারিয়ানার চোখের জলে লেখা সেই প্রেমপত্রগুলোর প্রতিটা শব্দে ফুটে উঠেছে তার প্রেমিককে কাছে ফিরে পাওয়ার আকুল আর্তি। ২০০৬ সালে প্রকাশিত মাইরিয়াম সায়ারের বিখ্যাত গ্রন্থ Letters of a Portuguese Nun: Uncovering the Mystery Behind a 17th Century Forbidden Love এর পাতায় পাতায় রয়েছে সেই অসাধারণ গল্প।
আজ থেকে সাড়ে তিনশত বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় মারিয়ানা শুধু তার ঐতিহাসিক প্রেমের জন্যেই ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, তা কিন্তু নয়! বরং তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তার লেখা দুর্দান্ত কিছু প্রেমপত্রের জন্যে। মারিয়ানার প্রেমিক চামেলিকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠিগুলো পড়লে সত্যি অবাক হতে হয়! কী অপরূপ দক্ষ কায়দায় ভাষার গাঁথুনি আর শব্দের শৈলী মিশিয়ে তিনি তার হৃদয়ের কথাগুলো অকপটে বলে গেছেন! সেই চিঠি পড়লে মনেও হয় না চিঠিগুলো আজ থেকে সাড়ে তিনশত বছর আগে লেখা হয়েছিল! বরং চিঠিগুলোর ভাষা বর্তমান আধুনিক যুগে লেখা কোন প্রেমপত্রকেও হাড় মানাবে। সেই চিঠিগুলোর প্রতিটা শব্দ যেন প্রেমিক হৃদয়ের করুণ আর্তনাদ হয়ে আমাদের কানে ধরা দেয়!
সতের শতকে পর্তুগিজরা যখন জলদস্যু হিসেবে গোটা পৃথিবীতে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল ঠিক সেই সময় সেখানে মিশনারির কাজে ব্যস্ত একজন নানের গোপন জীবনের অভিসার এবং তার প্রেমে পড়া গল্প গোটা ইউরোপে চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল! সতের দশকের গোটা ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে ইউরোপের বিভিন্নদেশ থেকে পর্তুগালে সৈনিক, নাবিক, গায়ক, লেখক, নান, পাদ্রি ও ব্যাবসায়ীদের আগমন ঘটেছিল। পর্তুগাল ও স্পেনের দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধও তখন অন্যতম একটি কারণ ছিল। এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ফরাসিদের সেনাছাউনি ছিল। সেসব সেনা ছাউনির একটির দায়িত্বে ছিলেন চামেলি নামের এক ফরাসি সেনা কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে সেই সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পতুর্গালের মিশানারির নান, যারা নামই ছিল মারিয়ানা।
মারিয়ানা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন ফরাসি প্রেমিক আর কোনোভাবেই তার কাছে ফিরে আসবে না। সন্দেহ নেই চিঠিপত্রগুলো যে-কোনো মানবিক মানুষের আত্মাকে বিদ্ধ করতে বাধ্য।
খ্রিষ্টান ধর্মমতে জাগতিক চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে ঈশ্বর বন্দনায় একজন নান তার জীবন উৎসর্গ করবে বলে বলা হয়েছে। কোনো পার্থিব ভোগ বিলাস, প্রেম ভালোবাসা, মন দেওয়া-নেওয়া একজন নানের জন্যে নিষিদ্ধ কড়া। পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে ইউরোপের ধর্মীয় গোড়ামিকেও আমাদের আমলে আনতে হবে। পতুর্গালের এক নান তার ফরাসি প্রেমিককে লেখা প্রেমপত্রগুলো সংকলতি গ্রন্থ ‘পর্তুগিজ লেটার’ স্বাভাবিকভাকেই ফ্রান্স ও পর্তুগাল উভয় সরকারকেই বেকায়দায় ফেলেছিল। নানা কারণে মারিয়ানা আলকোফোরাডো বিতর্কিত হয়ে উঠতে থাকেন। অনেকের দৃষ্টিতে পর্তুগালের মতো একটি রক্ষণশীল সমাজে একজন খ্রিষ্টান নানের এমন বিগলিত ভাষায় প্রেমপত্র লেখা রীতিমত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই দুই দেশের কিছু কিছু ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক পন্ডিত এই প্রেমের আখ্যানকে ধামাচাপা দিতে নানা রকম ফন্দিফিকিরের আশ্রয় নেয়। তাদের দাবি, ‘বইটিতে মনগড়া কেচ্ছা কাহিনি দিয়ে কেউ মনের সুখে লিখে ভরে রেখেছে।’ ফরাসি দুই পণ্ডিত এবং ইতিহাস গবেষক জেক রাওজত এবং ফেডরিক দেলোফরি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, ‘পতুর্গীজ লেটার’ গ্রন্থটিতে নানদের সঙ্গে ফরাসি সেনাদের যে রোমান্টিক সম্পর্কের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের চুলচেরা বিচারের সামনে তাদের সেসব যুক্তি টিকতে পারেনি।
মারিয়ানা আলসোফোরাডো জন্মগ্রহণ করেন পর্তুগালের বাজা শহরে ১৬৪০ সালের এপ্রিলের ২২ তারিখ। তার ব্যাপটিজম হয় সান্তা মারিয়া নামের সাদা রঙের একটি ছোট গির্জায়। গির্জাটি মারিয়ানার বাড়ি থেকে হাঁটার দূরুত্বে অবস্থিত। শহর হিসেবে বাজা ছোট একটি শহর। সেখানে সবাই সবাইকে চেনে। তাদের একমাত্র কাজ কৃষি থেকে আয়। ভুট্টা, জলপাই তেল শহরটির মূল আয়ের উৎস। সেই সময় শহরটির লোক সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার আর গির্জার সংখ্যা ছাব্বিশ। মারিয়ানা রক্ষণশীল ঘরেই বেড়ে উঠতে থাকেন। ১৬৫৬ আলকোফোরাডে নটরডেম ডে লা চার্চে তিনি নান হিসেবে শিক্ষানবিশ হয়ে প্রবেশ করেন এবং ১৭০৯ সালে মিশনারির উচ্চতর পদে তিনি উন্নিত হন। মারিয়ানা ছিলেন পাঁচ বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। তার ছিল তিন ভাই। বড় বোন আনা ছিলেন বিবাহিতা। মারিয়ানা এবং তার অন্য বোনরা তখন খৃস্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করছেন। পরবর্তী সময়ে দেখা যায় আনার বিয়ের সংসার খুব একটা সুখের ছিল না। তাকে নানা সময়ে দাসী হিসেবে ব্যাবহার করা হতো।
জানা যায় মারিয়ানা সচ্ছল একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার বাবা তাকে চার্চে পড়াশোনা করার জন্যে পাঠান। মনে রাখতে হবে তখন পর্তুগালে চলছে গৃহযুদ্ধ। ইউরোপের নানা রকম রাজনৈতিক সংকটে দেশটি তখন ছিল আচ্ছন্ন। স্পেনের সঙ্গে যখন তখন যুদ্ধে পর্তুগাল লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। ঠিক কঠিন এই সময়ে মারিয়ানাকে কোন আভিযাত চার্চে নান হিসেবে শিক্ষানবিশ হয়ে ভর্তি হওয়া অযৌক্তিক কিছু নয়। মরিয়ানা যখন চার্চের নামকরা নান তখন ফরাসি সেনা কর্মকর্তা মারকুইস ডে চামিলি পুর্তগালে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। ধারণা করা হয় মারিয়ানা প্রথম তার প্রেমিককে দেখতে পেয়েছিলেন চার্চের জানালা দিয়ে। মারিয়ানার কোন এক দুসম্পর্কের ভাই যিনি নিজেও পর্তুগিজ সেনাবাহিনীতে ছিলেন সম্ভবত তার মাধ্যমেই মারিয়ানার সঙ্গে চামেলির পরিচয় হয়ে থাকবে।
আবার মারিয়ানার দ্বিতীয় চিঠিতে আরেকজন নানের ক্ষীণ সম্পৃক্ততার আভাস পাওয়া যায়। দেখা যায় মারিয়ানাকে তিনি বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ভালোবাসার পথটি যেন সহজ হয়, তা নিয়ে তিনি উৎকণ্ঠায় থাকতেন। আর মারিয়ানাকে ধৈর্য ধরতে বলতেন। মারিয়ানার তার চিঠিতে লিখছেন, ‘তার উৎসাহেই আমি বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং তাকে আবিষ্কার করেছিলাম।’
মারিয়ানার বয়স তখন ২৫ আর মারকুইজের বয়স ২৯। দুজন দুজনের গভীর প্রেমে পড়লেন। তবে মারিয়ানার পক্ষে প্রেমে পড়া এত সহজ ছিল না। বিশেষ করে একজন নান প্রেমে পড়ছেন একজন ফরাসির যুবকের প্রতি! মারিয়ানার খুব সখ ছিল ঘর বাঁধার এবং প্রেমিককে বিয়ে করে সাগর পাড়ি দেওয়ার। কিন্তু তা আর হলো না। প্রতারক প্রেমিক মারিয়ানার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন না। কিন্তু মারিায়ানার লেখা চিঠিগুলো মারিয়ানাকে অমর করে দিলো। ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যে মারিয়ানার প্রেমকাহিনি আরও দশজনকে প্রবলভাবে উদ্বদ্ধ করলো। প্রেমের দায়ভার নিজ কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছেন মারিয়ানা। ধারণা করি, তৎকালীন সরকার এবং আমজনতাও মারিয়ানাকে কোনো অংশেই ছাড় দেয়নি।
মারিয়ানার পেমপত্র
দেখা যাক কী আছে মারিয়ানার প্রেমপত্রগুলোতে? আগেই উল্লেখ করেছি মারিয়ানার চিঠিগুলোর ভাষা ছিল সংযত এবং রোমান্টিক। চিঠির প্রতিটা শব্দে ছিল বিরহের করুণ আর্তনাদ। পাশাপাশি তার চিঠিতে রয়েছে অভিযোগ এবং অপমানের জ্বালাও। চিঠির শব্দে মাঝে মাঝে ফুটে উঠেছে প্রেমিক চামেলিকে ভালোলাগার আর ভালোবাসাময় অন্তরঙ্গের মুহূর্তগুলো। চিঠি পড়লে বোঝা যায়, তার ফরাসি প্রেমিক গোপনে মারিয়ানার সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করতে আসতো। তারা সেখানে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতো। তার চিঠিগুলো পড়লে মারিয়ানার তীব্র ক্ষোভ দেখতে পাই। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, মারিয়ানা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন ফরাসি প্রেমিক আর কোনোভাবেই তার কাছে ফিরে আসবে না। সন্দেহ নেই চিঠিপত্রগুলো যে-কোনো মানবিক মানুষের আত্মাকে বিদ্ধ করতে বাধ্য।
আদিও, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো! তোমাকে আমি আর কখনো ভালোবাসতে বলবো না। ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায় সেটির অপেক্ষায় আমি এখন দিন গুনবো।
সেই সতের শতকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা চিঠিপত্রগুলো শুধুই কি নিছক প্রেমপত্র! বরং সেই চিঠির ভাঁজে ভাঁজে খুঁজে পাই সেই শতকে মানুষের অন্তরাত্মায় রোপণ করা ভাবনা, সমাজের নানা রকম দিক, রাষ্ট্রের অবস্থানও। তখন মারিয়ানার প্রেমপত্রগুলো শুধু প্রেমিকার সংলাপ বলে ব্রেকেটবন্দি করা যায় না। পতুর্গিজদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, পৃথিবীর বড় বড় জলদস্যুতায় তাদের যেমন সম্পৃক্ততা আছে, তেমনি মারিয়ানার মতো একজন গোঁড়া খ্রিষ্টান নানের প্রেমপত্র দিয়ে সাজানো গল্পগাথাও আছে। তখন একটি সমাজের নানা রকম বিচিত্রতা আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়।
প্রথম প্রেমপত্র: ডিসেম্বর, ১৬৬৭
প্রথম প্রেমপত্রটি লেখেন ১৬৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। চামিলি তখন বাজা শহরে অবস্থান করলেও এই চিঠিটি তার হাতে পৌঁছে ছিল অনেক পরে। মারিয়ানা লিখেছেন, ‘হায় দুর্ভাগ্যময় এই ভালোবাসা! তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা করলে আর বিশ্বাসঘাতকা করলে আমার মিথ্যে কল্পনার বোনা আশ্বাসের সঙ্গেও। প্রেমের জন্যে যে ধৈর্যটি আমি ধারণ করেছিলাম, তা এখন ভয়াবহ কঠিন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এখন এই না পাওয়ার বেদনা আমাকে প্রতিনিয়ত আহত করছে।
তিনি লিখছেন, ‘তোমার সঙ্গে যেদিন আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেদিন থেকেই আমি তোমার হয়েছিলাম প্রিয়। প্রতিদিন হাজার বার আমি তোমাকে খুঁজতে নানা রকম চেষ্টা চালিয়েছি। আমার হৃদয় তোমাকে না দেখে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে গেছে। তোমাকে না দেখলে আমি কি অসুস্থ হয়ে না হয়ে পারি? খুব গোপনে আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। অথচ তুমি আমার সঙ্গে এ কী আচরণ করলে? এই কি আমার পুরস্কার? তোমাকে নিখাদ ভালোবাসাই কি আমার অপরাধ? তুমি তো জানো, তোমাকে ছাড়া আমি আর কারও দিকে তাকাবো না। এই ছিল আমার পণ। কিন্তু তাতে কি লাভ হলো বলো? তুমি কি আমার জায়গায় হলে এই কাজটি করতে পারতে?’
মারিয়ানা আরও লিখছেন, ‘আমি তোমাকে ভুলতে পারছি না। আমি ভুলতে পারছি না। তুমি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলে এই বলে যে, তুমি আমার কাছে আসবে। কিছু সময় দেবে। হায়! কেন এসব তোমার বেলায় ঘটেনি! এসব কিছুর জন্যে আমি শুধু আমার ভাগ্যকেই দায়ী করি। ভালোবাসা এমন এক শক্তি, যা গোটা জীবনে একত্রে বেঁধে রাখতে পারে।’
দ্বিতীয় প্রেমপত্র: জানুয়ারী, ১৬৬৮ সাল
মারিয়ানা তার দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছিলেন ১৬৬৮ সালের জানুয়ারী মাসে। তিনি লিখেছেন, ‘আদিও (মারিয়ানা তার প্রেমিককে আদর করে আদিও বলে সম্বোধন করেছেন), আমাকে ছেড়ে তুমি চলে গেলে তা তোমার জন্যে হয়তো সহজ হয়েছে। কিন্তু দেখো তোমাকে লেখা এই পত্রটি শেষ করতেও আমার জন্যে কত কঠিন হয়ে যাচ্ছে! আমি তোমাকে আমার জীবনের চেয়েও হাজারগুণ ভালোবাসি আদিও। তুমি কিভাবে আমার সঙ্গে এত রূঢ় হতে পারলে! তুমি আমাকে চিঠি লিখছ না। এই কথাগুলো তোমাকে না লিখে আমি থাকতে পারলাম না। আমি তোমাকে চিঠি লিখি আমার কথা বলার জন্যে নয়। বরং তোমাকে স্মরণ করেই আমার এই চিঠি লেখা। আমি আমাকে চিঠি লিখে সান্ত্বনা দিতে চাই। জানি, আমার দীর্ঘ চিঠি দেখে তুমি হয়তো বিরক্ত হবে। হয়তো তোমার পড়ার সময়ও হবে না। কিন্তুই তুমিই বলো, আমার এই চিঠি লেখা কি খুব অন্যায়? খুবই বিরক্তিকর? কেন তুমি আমার জীবনটাকে এমন বিষময় করে দিলে? কারণ কি এই যে, আমি তোমার কাছে শুধুই একজন ভিনদেশি মানুষ! অন্য একটা দেশে আমার জন্ম হয়েছিল এই আমার অপরাধ? আদিও, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো! তোমাকে আমি আর কখনো ভালোবাসতে বলবো না। ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায় সেটির অপেক্ষায় আমি এখন দিন গুনবো।’
তৃতীয় প্রেমপত্র: ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৮
‘আমি এখন কী করবো? আমার সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে? আমি যা কল্পনা করেছিলাম, সেই জায়গা থেকে ভাবলে এখন সব আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়! আমার খুব আশা ছিল, তুমি আমাকে লিখবে। তুমি যেখানেই চলে যাও না কেন, আমাকে লিখবে। তোমার সেই চিঠিটি হবে দীর্ঘ, সেখানে লেখা থাকবে তোমার আমার ভালোবাসার গল্প, সেখানে লেখা থাকবে আশার কথা। আবার আমাদের দেখা হবে, কথা হবে। তোমার ওপর সেই বিশ্বাস আমার ছিল। এই বিশ্বাস থেকে আমি ভাবতে শুরু করবো যে, আমি একান্ত তোমারই।’
তোমার মারিয়ানা তোমার আর কতকাল অপেক্ষা করবে? সে এখন আর ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারে না। বারে বারেই সে মূর্ছা যায়। আদিয়ো, আদিয়ো, আমাকে তুমি দয়া করো।
তিনি লিখছেন, ‘আমি এখন নিজের ওপরই খুবই বিরক্ত হয়ে আছি। যখন আমি ভাবি তোমার জন্যে এই যে আমার এত ত্যাগ এসবই বৃথা। তোমার জন্যে আমি আজ সমাজে নষ্টা মেয়ে। আমার সব রকম সামাজিক ভাবমূর্তি আমি হারিয়েছি। পরিবার আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, দেশের আইন আমার বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে তারপরও আমি ভেবেছি শত বাধার পরেও আমি তো তোমাকে পেয়েছিলাম! কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি যে, আমি যা ভেবেছি, তা সত্য নয়! তোমাকে আমি ভালোবেসেছি ঠিকই, কিন্তু সেই ভালোবাসা এখন আমার জীবনে বিপদ ডেকে এনে দিয়েছে।
আহ! আমি লজ্জায় মরে যেতে চাই। হাজার বার উচ্চারিত আমার প্রেমের আর্তিটি এখন কি তোমার কাছে মৃত নয়? আমি কি তাহলে তোমার সঙ্গে প্রেমের প্রতারণা করেছি? তুমি আমাকে সেই দোষেই অভিযুক্ত করছ? তুমি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলে। তোমাকে আর আমি কখনোই দেখবো না। তুমি ঠিকই বলেছ। আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।
চতুর্থ প্রেমপত্র: জুন ৩, ১৬৬৮ সাল
‘মাঝে মাঝে আমি ভাবি। সবই কি তাহলে মিথ্যা? আমার ভাবনা কি মিথ্যা? আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞেস করি। আমি কত যে খুশি হতাম যদি তুমি আমার মনের এই আর্তিটাকে বুঝতে পারতে! তখন তুমি তোমার নিজের মতো করে জানার চেষ্টা করতে।
আমি কি মনে করতে পারি তুমি তোমার গোটা জীবনটাই এই পতুর্গালে কাটিয়ে দেবে? তাহলে হয়তো তুমি তোমার দেশকে ভুলে গিয়ে শুধু আমার কথাই ভাবতে পারতে? আমার দুঃখ আমাকে কোনো কিছু থেকেই মুক্ত করছে না। তোমাকে আমি যত বেশি স্মরণ করি, ততই যেন আমি দুখের সাগরে ডুবে মরছি।
তোমাকে আমার মনের এই নিগুঢ় কথাগুলো কখনোই বলিনি। না, এসব কথা শুনে কখনো আফসোস করো না। আমি তোমার কাছে তাই চাই যা তোমার হৃদয় থেকে আসে। অন্য সব আমার কাছে মিথ্যা”
তোমার জন্যে আমি পাগল হয়ে গেছি। তোমার মারিয়ানা তোমার আর কতকাল অপেক্ষা করবে? সে এখন আর ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারে না। বারে বারেই সে মূর্ছা যায়। আদিয়ো, আদিয়ো, আমাকে তুমি দয়া করো।’
পঞ্চম এবং শেষ প্রেমপত্র: জুন, ১৬৬৮
‘এই চিঠিটিই তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি। আমি আশা করবো তুমি ইতোমধ্যেই আমার চিঠির ভাষা এবং মেজাজ পড়ে বুঝতে পেরেছ যে, আমি তোমাকে যেমন ভালোবাসি, তুমি আমাকে ঠিক সেভাবে ভালোবাসো না। তাই, আমিও তোমার মতো নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছি। তোমাকে ভালো না বাসাই হবে সব দিক থেকে মঙ্গল। তুমি আমাকে যেসব উপহার দিয়েছিলে, সেসব তোমাকে আমি পাঠিয়ে দেব। না আমি পার্সেলের খামের ওপর তোমার নামটিও লিখবো না। আমি এই বিষয়ে ডোনা ব্রিতেসকে খুলে বলেছি। ডোনা এই গোপন পার্সেলটি তোমার জন্যে নিয়ে যাবে এবং তোমার হাতেই পৌঁছে দেবে। সে আমাকে নিশ্চিত করবে যে, তুমি আমাকে উপহার হিসেবে যে ব্রেসলেট আর প্রতিকৃতিটি দিয়েছিলে, সেটি ফেরত পেয়েছ।
আজ থেকে সাড়ে তিনশত বছর আগে মারিয়ানা তার প্রেমিক চামেলিকে যে প্রেমপত্র লিখেছিলেন, সেই প্রেমপত্রগুলো এখনো এই পত্রহীন ডিজিটাল যুগেও সমানভাবেই গুরুত্ব বহন করে।
আমি এই চিঠিটির কোনো কার্যকারিতা নিয়েও ভাবছি না। আমি খুব ভালো করেই জানি যে, তুমি এই চিঠি পড়ে আমার প্রতি তুমি যে অন্যায় আচরণ করেছ, সে জন্যে তোমার কোনো অনুতাপ আসবে না। আমার জীবনের অনিশ্চিত অন্ধকার থেকে আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাইছি না। আমি আশা করি, এই জীবনে এসব কিছু ধারণ করেই সামনে পথ চলবো। আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আমি তোমাকে ঘৃণা করছি না। কারণ ঘৃণা দিয়ে ভালোবাসা জয় করা যায় না।’
তারপর অনেক বছর কেটে গেলো!
তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেলো! মারিয়ানার সঙ্গে কি শেষ পর্যন্ত তার প্রেমিক চ্যামেলির দেখা হয়েছিল? অথবা চামেলিকি আবার মারিয়ানার কাছে ফিরে এসেছিলেন? স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রশ্ন আমাদের সবার মনেই উঠবে। জানা যায় চামেলিকে লেখা মারিয়ানার দ্বিতীয় চিঠি পর্যন্ত তিনি পর্তুগালেই ছিলেন। পর্তুগাল থেকে তার ফ্রান্সে যেতে সময় লেগেছিল ৭ মাস। তিনি যখন ফ্রান্সে পৌঁছান তখন ফ্রান্সের রাজা লুইস (চৌদ্দ) তাকে স্বাগত জানান। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার দপ্তরে চামেলিকে নিয়োগ দেন। তবে চামেলির জীবন যে সুখের ছিল, তাও নয়। তার জীবিতাবস্থাতেই তাকে লেখা মারিয়ানার চিঠিপত্রগুলো ফ্রান্সে প্রকাশিত হতে থাকে। চামেলি এই বিষয়ে অবগত ছিলেন। মারিয়ানার সব চিঠি তিনি পড়েছেন এবং তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কটিকেও তিনি অস্বীকার করেননি। ফরাসি সরকার বিভিন্ন সময়ে চামেলিকে জাহাজে করে নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পাঠিয়েছে। বীরের মতো তিনি ফ্রান্সের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে যুদ্ধেই তার সময় পার হয়ে যায়। মাঝখানে ইসাবেলে দে বাউচেট (Isabelle Du Bouchet) নামের এক নারিকে তিনি বিয়ে করেন। ইসাবেলে জানতেন তার স্বামী চামেলির সঙ্গে মারিয়ানা নামের এক পর্তুগিজ নারীর প্রণয়ের কথা। তাছাড়া এই প্রেমপত্র নিয়ে ততদিনে ফ্রান্স ও পতুর্গালে হৈচৈ পড়ে গেছে। অর্থাৎ বিষয়টি কারও কাছেই তখন গোপন ছিল না। তিনি স্বীকার করতেন যে, মারিয়ানাকে তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু তারচেয়েও বেশি গুরুত্বর্পূ ছিল তার নিজ দেশের সেনাবাহিনী এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধায় নত থাকা। কিন্তু মারিয়ানার মতো এক সহজ সরল অবুঝ প্রেমিকার মন সে কথা বুঝবে কিভাবে?
১৭১৫ সালের জানুয়ারির ৮ তারিখ ৭৯ বছর বয়সে চামেলির (Chamilly) মৃত্যু হয়। সমাপ্ত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের এক প্রেম কাহিনির। অন্যদিকে মারিয়ানা (Mariana Alcaforado) মৃত্যু হয় ১৭২৩ সালের ২৮ জুলাই। তিনি কখনো বিয়ে করেননি। তিনি তার বাকি জীবন চার্চের সেবা করেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। চার্চের কাজ কর্মে তিনি ছিলেন খুবই দায়িত্বশীল। কাজে কখনো তার অবহেলার কথা জানা যায়নি। সবার সঙ্গে খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিল তার।
আপনি যদি এখনো পর্তৃগালের বাজা শহরে যান, সেখানে মারিয়ানা যে জানালা দিয়ে তার প্রেমিককে দেখতেন, আলাপ করতেন এবং চিঠি বিনিময় করতেন, সেই জানালিটি এখনো সংরক্ষিত আছে। এখনো সেখানে পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকযুগল ভ্রমণ করতে আসে। সবাই তখন মারিয়ানাকে স্মরণ করে সেই জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। এরপর মারিয়ানার চোখ দিয়ে জানালার ভেতর দিয়ে তার প্রেমিককে দেখার চেষ্টা করে। মারিয়ানার সেই বারান্দাটি এখনো খুব আদর যত্নে সংরক্ষণ করা আছে। মারিয়ানা যে বাড়িটায় মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন, সেই বাড়িটি এখন সরকার জাদুঘরে রূপান্তর করেছে।
মারিয়ানার মৃত্যু হয়েছে বটে কিন্তু তার প্রেমের মৃত্যু কখনোই ঘটেনি। তার চিঠিগুলো আমাদের স্মরণ করে দেয় ভালোবাসার মৃত্যু নেই। আজ থেকে সাড়ে তিনশত বছর আগে মারিয়ানা তার প্রেমিক চামেলিকে যে প্রেমপত্র লিখেছিলেন, সেই প্রেমপত্রগুলো এখনো এই পত্রহীন ডিজিটাল যুগেও সমানভাবেই গুরুত্ব বহন করে।
তারপরও একটি কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে। মারিয়ানা কি শেষ পর্যন্ত তার প্রেমিক চামেলিকে ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন?