গত শতকের নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে আমরা কতিপয় তরুণ যখন তারুণ্য আর কবিতার ঘোরে বগুড়া শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, তখনই পরিচয় হয় কবি মামুন রশীদের সঙ্গে। বোধ হয় সেটা বগুড়া লেখক চক্রের পাক্ষিক সাহিত্য আসর হয়ে থাকবে। নিয়মানুযায়ী তিনিও কবিতা পড়লেন। সঞ্চালক পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিনি বগুড়া আযিযুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র। দেখলাম এক লাজুক ছেলে, কিছুটা নার্ভাস হয়ে কবিতা পাঠ করল। মুখে তার সরল অভিব্যক্তি। শিশুসুলভ। কবিতা নিয়ে আলোচনার সময় খুব আগ্রহ নিয়ে তার কবিতার আলোচনা শুনলো। আসরের ভেতরেই কবিবন্ধু অনন্ত সুজন ফিসফিস করে আমাকে বলল আমাদের নতুন এক সঙ্গী জুটল। দেখিস ওর কবিতা অনেক ভালো হবে। আসর শেষে তাঁর সঙ্গে আমাদের বিশেষভাবে কথা হলো। আমরা মানে আমি, অনন্ত সুজন এবং শামীম শামস (তখন এস, আই, শামীম নামে লিখত)। জানলাম তিনি আমাদের আগে থেকেই চেনেন। আজ পরিচয় হলো। আরও জানলাম তিনি আমাদের একটু সিনিয়র। সুজনদের ব্যাচের। তিনি হয়ে গেলেন আমার মামুন ভাই।
এর কয়েকদিন পর আযিযুল হক কলেজের ক্যাম্পাসে আমি আর কবিবন্ধু মাহমুদ শাওন আড্ডা দিচ্ছিলাম। দেখলাম মামুন ভাইকে। মাহমুদ শাওনের সঙ্গে পরিচয় হলো মামুন ভাইয়ের। আমাদেও সঙ্গে যেদিন পরিচয় হয়েছিল মামুন ভাইয়ের সে-দিনই পরিচয় হতে পারত শাওনের সঙ্গে। হয়নি, কারণ শাওন ছিল না। শাওন বগুড়া লেখক চক্রের আসরে যেতে পছন্দ করত না।
বগুড়া শহরে তখন তরুণ লেখকদের লেখার প্রতিযোগিতা হতো রীতিমতো। কেউ নতুন কিছু লিখলেই সেটা পাঠ হতো। তারপর চুলচেরা বিশ্লেষণ। আড্ডার নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছিল। আড্ডাকেন্দ্রের চরিত্র অনুযায়ী আপনা আপনি সেগুলো যেমন গড়ে উঠত আপনা আপনি ভেঙেও যেত। যা হোক, এই শহরে কেউ ঢুকলে ওইসব আড্ডার কেন্দ্রে একবার হলেও ঢুঁ মারত। তাতে কারো না কারো সঙ্গে দেখা হয়েই যেত। এবং কবিতার ঘোরে এমন মত্ত থাকতাম যে, সেখান থেকে কারো নিস্তার থাকত না। আসলে কেউ নিস্তার পেতে চাইতো না। কারণ ওইসব আড্ডা ছিল শুধুই সাহিত্য নিয়ে। কবি-সম্পাদক আনওয়ার আহমদ বলতেন, তোমাদের আড্ডার কথাগুলো রেকর্ড করলেই তো দারুণ গদ্য হয়ে যায়। তো যা বললে তা একটু লিখে দাও না। কিন্তু আড্ডার কতাগুলো কী আর লেখা যায়!
কিছুদিনের মধ্যেই আমরা লক্ষ করলাম এই শহরে মামুন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা হয় না। যেমন আমরা (আমরা মানে কবিবন্ধু অনন্ত সুজন ও মাহমুদ শাওন) সারাক্ষণ এক সঙ্গে থাকি কিন্তু মামুন ভাইকে সেভাবে পাই না। দেখা হলে কিছুক্ষণ থেকেই তিনি উঠে পড়েন, বলেন- আমার একটু তাড়া আছে উঠতে হবে। আমরা আরো আবিষ্কার করলাম প্রতিবারই একই ঘটনা ঘটছে মামুন ভাইয়ের সঙ্গে। আজ দুই দশক হতে চলল আমাদের সম্পর্কের ওই ঘটনা এখনও ঘটছে। যেমন গত ইদুল ফিতরে মামুন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো বগুড়ায়। পটাপট কয়েকটা ছবি তোলার পরই মামুন ভাই বললেন, একটু পরই আমার গাড়ি। আমাকে উঠতে হচ্ছে। এমরান, শাহবাগের কনকর্ডে দেখা হবে। ফোন দিও।
বিষয়টা নিয়ে অনেকবার ভেবেছি। মামুন ভাইয়ের সঙ্গে কেন এমন হয়। কনকর্ডের বেহুলাবাংলার অফিসে দেখা হলেও একই অবস্থা। তাকে জোর করে রাখতে হয়। বিষয়টির একটা ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করেছি। সেটা হলো মামুন ভাইয়ের সঙ্গে সময়-সম্পর্কিত একটা রহস্যঘণ কাকতাল। তার সঙ্গে দেখা হবার আগে তার কোনো না কোনো জরুরি কাজ পড়ে যাবে। অথবা তার জরুরি কাজ পড়ার পরই আমার সঙ্গে দেখা হবে। গত বিশ বছর ধরে এটাই হয়ে আসছে। আমি ধরেই নিয়েছি মামুন ভাইয়ের সঙ্গে বাঁকি জীবন এভাবেই কাটবে।
তখন বগুড়া লেখক চক্রের সাহিত্যপত্র ঈক্ষণের সম্পাদনার ভার পড়ত চক্রাকারে। কখনো আমি কখনো অনন্ত সুজন কখনো শামস শামীম কখনো রেজাউল করিম কখনো মামুন রশীদ- এভাবে। তো যেবার প্রথম দায়িত্ব পেলেন মামুন ভাই খুব অতীষ্ঠ হয়ে গেলেন লেখক কবির ব্যবহারে। লেখা সংগ্রহ করা যে কী জটিল কাজ তিনি প্রথম টের পেলেন। একদিকে সময়মতো বের করতে হবে ঈক্ষণ, অন্যদিকে তালিকাভুক্ত অপরিহার্য কিছু লেখক তখনো লেখা দিচ্ছেন না। তিনি রাগে দুঃখে একটা কবিতাই লিখে ফেললেন, ‘চাইলেই কবি হয়ে যায় তারা…।’
কবিতার ভেতরে স্নিগ্ধ স্বর যারা সন্ধান করেন, কবি মামুন রশীদের কবিতা তাদের মুগ্ধ করবে। কবিতার স্বর ও সুর থেকে স্লোগান ও হে জাতীয় কথাবার্তা উঠে গেছে ঠিকই কিন্তু ভেতরে স্নিগ্ধতার খুবই অভাব। কবি মামুন রশীদের কবিতা ব্যক্তি মামুন রশীদের মতোই স্নিগ্ধ, সাবলীল কিন্তু গভীরতা সঞ্চারী। ওই গভীরতা ক্রমশ তৈরি করে এক রহস্যঘণ ইন্দ্রজাল। কবিতায় আমরা যে ঘোর ও আচ্ছন্নতার সন্ধান করি মামুন রশীদের কবিতায় তা পাওয়া যায় জোরালোভাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দার্শনিক উপলব্ধি:
সময় বলে কিছু নেই। বন্ধ খামের ভেতরে বয়ে বেড়ানো শূন্যতা শুধু।
এ এক শরীরী ভ্রমণ। দেহ থেকে দেহান্তরে চক্রাকারে।
শূন্যতায় কোলাহল—বোবা অনুভূত-দিনমান অস্থরিতা
শূন্যতায় ফসিফসি—কলকল ছলছল—স্বপ্নময় র্স্পশ।
একাগ্রতায়, আনমনে শুধু ঘুরিয়ে দেখানো নয় নিজেকে।
প্রতবিম্বি অশরীরীর মতো চলমান।
অভমিান—অনুরাগ—ভালোবাসায় দীর্ঘ দিবস।
এ শুধু ভ্রমণ নয়। এক শরীরী যাপন।
(সময়: কালো পাতা ওড়ো সাদা ছাই)
প্রথম কাব্য কালো পাতা ওড়ো সাদা ছাই (২০০৫)-এর প্রথম কবিতা এটি। সময় নিয়ে কবি মামুন রশিদের এই যে দার্শনিক উপলব্ধি তা যেন কবিতা, শিল্প, বাস্তবতা এবং অভিজ্ঞতার মিথষ্ক্রিয়ার এক অনন্য রূপ। এরকম কবিতা তার প্রজন্মে খুব বেশি লেখা হয়নি।
চার বছর বিরতির পর বের হয় তার দ্বিতীয় কাব্য কুশল তোমার বাঞ্ছা করি (২০০৯)। এর পর বের হয় আরো তিনটি কাব্য তোমার পরে মেঘ জমলে (২০১৩), এই বইটির কোনো নাম দিব না (২০১৪) এবং সকল ভ্রমণ শেষে (২০১৬)। কাব্য প্রকাশের এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে কবিতার প্রতি তার সচল টান এবং নিমগ্নতাকে।
কবিতা চর্চার সমান্তরালে নিরলসভাবে তিনি চর্চা করে গেছেন গদ্যেরও। কি প্রবন্ধ কি শিশুসাহিত্য কি উপন্যাস কি জীবনীগ্রন্থ। বাংলাদেশের কবিতা সৃজনে অর্জনে (২০১১), ষাটের কবি স্বাতন্ত্র ও বৈভবে (২০১৫) তাঁর কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের বই। বাংলাদেমের কবিতা সৃজনে অর্জেনে গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন আমাদের জাতীয় জীবনের অর্জনে কবিতার কীরূপ ভূমিকা। ষাটের কবি স্বাতন্ত্র ও বৈভবে গ্রন্থে তিনি ষাট দশকের কবি ও কাব্য প্রবণতার উপর বিষদ আলোচনা করেছেন। দশক ভিত্তিক প্রবন্ধের এমন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ সচরাচর চোখে পড়ে না।
মামুন রশীদ শিশু সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন। শিশুদের জন্য লেখা গল্পের সংকলন সবুজ বাড়ির ভুত (২০১০) এবং ভূতের সঙ্গে একদিন (২০১৬) । এছাড়াও রয়েছে জীবনীগ্রন্থ এবং ইতিহাস গ্রন্থ। ডিরোজিও (২০১২), নেলসন ম্যান্ডেলা (২০১৫) ও মাদার তেরেসা (২০১৫)। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস: বগুড়া। বগুড়ায় ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখেছেন উপন্যাস টিটু মিলনায়তন (২০১৬)। সম্পাদনা করেছেন আমার রাজনৈতিক জীবনের ৫৫ বছর: মোতাহার হোসেন তালুকদার (২০১৬)। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ দ্বিবাচ্য। শিশু কিশোরদের জন্য কাগজ ভুতটুশ (যৌথভাবে) পেয়েছেন পাঠকপণ্য পাঠশালা সম্মাননা (২০১২) এবং ভারত থেকে বনানী পুরস্কার (২০১৬)। মামুন রশীদ এক স্নিগ্ধ অবয়বের নাম। কবিতায়, গদ্যে, ব্যক্তিত্বে। আজ তার জন্মদিন। শিল্পের কণ্টক পথকে তিনি ফুলেল করে তুলবেন যেমন জোনাকি পোকা ফুলেল করে তোলে রাতের সমস্ত আঁধার। তার জন্য শুভ কামনা।