মনি হায়দার একজন মেধাবী ও কুশলী গল্পকার। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে একজন শক্তিমান গল্পকার হিসেবে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছেন অনেক আগেই। তার প্রাণ খোলা অট্টহাসি আকৃষ্ট করেনি, এমন পাথর হৃদয়ের মানুষ পাওয়া কঠিন।
মনি হায়দার আসলেই একজন মায়াবি কথাকার। হয়তো বা মায়ার আবরণেই তিনি পাঠককে বেঁধে রাখার কৌশল আবিষ্কার করেন। যেখানে যুক্ত হয়ে যায় এক অপরূপ গদ্যভাষা। আবার প্রয়োজনে জাদুবাস্তবতারও আশ্রয় নেন। তাই ‘ইলিশে মাংস’, ‘জিহ্বার মিছিল’-এর মএতা গল্পগ্রন্থগুলো অন্য মাত্রা পায় পাঠকের কাছে।
তার গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পের মায়ার অন্তরালে অন্তঃশীলা থাকে চাপা এক নিষ্ঠুরতা। যেমন ‘আহীর আলমের বাম পা’ সিরিজ গল্পগুলো কিভাবে যেন আমাদের চিন্তার উৎসমুখ খুলে দেয় চুপিসারে, বুঝতেও পারি না। কেন আহীর আলমেরা হাতে তুলে নেয় হন্তারক ছুরি, তা আমাদের অজ্ঞাতই থেকে যায়। মানববৃত্তির জলছবি আঁকতে আঁকতে মনি হায়দার আসলে মানবিকতার পলেস্তারা খসিয়ে দেন এক লহমায়, মানবমনের গূঢ়তলচারী বিকারকে তার লিখনবিশ্ব করে তোলেন। মানুষ ও সমাজের সেই আশ্চর্য যৌক্তিক বিপর্যয় তার সমস্ত ট্র্যাজেডি নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়।
আমাদের সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে বিশেষত গল্পসাহিত্যে কথাকার মনি হায়দারের আর্বিভাব তাই বেশ ঘটনাবহুল। অবশ্য সেই স্বকীয়তার পরিমাণ কতটুকু বা আমার মন্তব্যের স্বচ্ছতা কিংবা গভীরতা কতখানি, তা বোঝার জন্য সূত্রাকারে কয়েকটি মন্তব্য করতে চাই। তবে সেই মন্তব্য করবো তার ‘ইলিশের মাংস’ গল্পগ্রন্থ এবং ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ উপন্যাসকে ঘিরে। মনি হায়দারের ষাটের অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে ‘ইলিশের মাংস’ গল্পগ্রন্থে তাকে আবিষ্কার করি একদম ভিন্নভাবে। এই গ্রন্থের প্রায় প্রত্যেকটি গল্পই বুদ্ধির প্রখরতায় আমাদের শেষাবধি মুগ্ধ করে ছাড়ে।
‘ইলিশের মাংস’ অথবা ‘আসমানী মেওয়া’ গল্পে নরম তুলোর মতো উড়ে যায় তার যে শব্দরা, তারাই আবার ‘মুজিবনগরে, আমবাগানে’ গল্পে তেজি অশ্বের মতো মাটিতে সজোরে পা ঠোকে। হ্রেষাধ্বনিতে ভেসে যায় চরাচর। ‘রাত যখন খান খান হয়ে যায়’, অথবা ‘স্পর্শ’ নামক গল্পে মনি হায়দার ছোট ছোট চিত্রকল্প, ঘটনা এবং সংলাপের মধ্যে বিশাল পটভূমি ঢুকিয়ে দিয়েও আমাদের হতবাক করে দেয় সমানভাবে।
১৯৬৮ সালে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের এই দিনে বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুরে জন্ম নেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই অফুরান শুভেচ্ছ।
ব্যক্তিজীবনে গল্পপ্রবণ মনি হায়দার বাল্যকালে প্রমত্ত কচানদীর পারে বসে সমাজজীবনের যে ভাঙাগড়া দেখছিলেন, সে সমাজকে অস্বীকার না করে বরং সেই সমাজের গুরুত্ব মেনে নিয়েছেন পুরো লেখক জীবনে। হয়তো এ কারণেই সমাজ ভাঙার আহ্বান মনি হায়দারের কণ্ঠে মুখরিত হয়ে ওঠেনি কখনো বরং সমাজের ভেতরে থেকে তার দোষক্রটিগুলো সংশোধনের চেষ্টা করে গেছেন সব সময়। ফলে মনি হায়দার আমাদের কাছে অত্যন্ত হৃদয়বান এবং যথার্থ মানবদরদি কথাশিল্পী হয়ে উঠেছেন।

অগ্রজ এই কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে আমার রয়েছে নানা রকমের স্মৃতি। তার সঙ্গে না মিশলে বোঝার উপায় নেই, তিনি কতটা আন্তরিক আর মানবিক মানুষ। আমি দেখেছি যেকোনো মানুষের কষ্টে তিনি দ্রুত সঞ্চারিত হতে পারেন। কারও জন্য কোনো উপকার করতে পারলে তিনি যে অকৃত্রিম আনন্দ পান, সেটারও অনেক নিদর্শন পেয়েছি আমি। মিথ্যে অহং যাদের ঘিরে রাখে, আমি তাদের সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি। বিপরীতে সারল্যেভরা যেকোনো মানুষের প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা আর ভালো লাগা অনেক পুরনো। ঠিক সেই জায়গাতে থেকে মূল্যায়ন করলে মনি ভাই একজন সত্যিকারের অগ্রজ। মানুষের প্রতি মনি হায়দারের যে অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ আমি দেখি তা আমাকে আপ্লুত করে সব সময়।
মনি হায়দার গল্প উপন্যাসে একদিকে যেমন জলমাটির গন্ধসহ মানুষকে তুলে আনেন তেমনি তার কথাসাহিত্যের একটি প্রধান মৌল প্রবণতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। তার অসংখ্য গল্পে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ছাপ দেখতে পারি। অন্যদিকে মনি হায়দারের উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে অতি সাম্প্রতিক সময়ে তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটিই উপন্যাস ‘কিংবদন্তির ভাগীরথী’ প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশের পরেই উপন্যাসটি পাঠকের মন নাড়িয়ে দিয়েছে, পাঠান্তে পাঠক হয়েছে বাষ্পরুদ্ধ ও বেদনাসিক্ত। পিরোজপুর শহরের এক মুচির স্ত্রী ভাগীরথীর মর্মস্পর্শী জীবনাগাথা এই উপন্যাসে বিস্তৃত হয়েছে। আমি পেশাগত দায়িত্ব পালনে গত চার বছর পিরোজপুরে যাতায়াত করার সময় এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে এই কিংবদন্তি ভাগীরথীর যে গল্প শুনে আসছি তারই যেন চিত্রনাট্য রচনা করলেন কথাকার মনি হায়দার। এই উপন্যাস কোনো কল্পকাহিনি নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনার ওপর নির্মিত একটি শক্তিশালী ডকুমেন্টারি উপন্যাস।
আমরা এমন এক সময়ে দিনযাপন করছি যে সময়টা অস্থির, আতঙ্ক এবং অনিশ্চিতের। এমন অনিশ্চিয়তার মধ্যেই যখন একজন কথাসাহিত্যিক তার ৫৩ বছরের এক বর্ণিল জীবনকে নিশ্চত করে তখন আমি অকৃত্রিম এক আনন্দ অনুভুব করি। ১৯৬৮ সালে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের এই দিনে বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুরে জন্ম নেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই অফুরান শুভেচ্ছ।