প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পরাস্ত সহিস’ বেরিয়েছিল ১৯৮২ সালে। তারও এক দশক আগে থেকে লেখালেখি শুরু। শুরুর পর প্রায় অর্ধশত বছর হতে চলল। নিরন্তর বহমান তাঁর কলমের ঝর্ণাধারা। এরই মধ্যে বের হয়ে গেল শতাধিক গ্রন্থ। একদা চকরিজীবী ছিলেন। এখন বেকার। বর্তমান বেকার এই মানুষটি মঈনুল আহসান সাবের। বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন মাত্রা সংযোজনকারী এই মহান লেখকের আজ জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে প্রণতি জানাই।
আপাত গম্ভীর ও রাশভারী স্বভাবের মঈনুল আহসান সাবেরের কথাসাহিত্য ঠিক তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। খুব গুরুগম্ভীর বিষয়ই তাঁর কথাসাহিত্যের উপজীব্য। কিন্তু উপস্থাপন এত আটপৌরে যেন বহুদিনের এক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে বসেছেন। সেই বন্ধু গল্প বলছেন অন্য বন্ধু সেই গল্পের ভেতরে ঢুকে নিজেও অংশগ্রহণ করছেন। অভিমত দিচ্ছেন। এই যোগযোগী ক্ষমতা বোধ করি মঈনুল আহসান সাবেরের কথাসাহিত্যের অন্যতম একটি গুণ।
এই গুণ থাকাতে পাঠক সহজেই ওই গল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। কিন্তু এই যোগাযোগী ক্ষমতা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, যে চরিত্রের কথা বলা হচ্ছে তিনি আমাদেরই সমাজের মানুষ, আমাদেই চেনা আত্মীয়, আমাদেরই দেখা বন্ধু। সেই মানুষের, সেই আত্মীয়য়ের সেই বন্ধুর বিপন্ন হওয়ার গল্প যখন বলা হয়, এবং এমন জীবন্ত এবং চাক্ষুষরূপে হাজির করা হয় তখন তো পাঠক একাত্ম না হয়ে পারে না।
এভাবেই তিনি অর্ধশত বছর ধরে নির্মাণ করে যাচ্ছেন আমাদের সমাজের বিশেষ বিশেষ আক্ষেপ। যে আক্ষেপ প্রায়শই আমাদের নিয়ে যায় সেই ব্যথার দিকে, যে ব্যথা প্রায়ই হিসাব করে কী হলো এবং কী হতে পারতোরর বিয়োগফল।
প্রথম গ্রন্থ বের হওয়ার পরের বছরই বের হলো ‘অরক্ষিত জনপদ’ (১৯৮৩), ‘তারপর স্বপ্নযাত্রা’ (১৯৮৪), ‘আগমন সংবাদ’ (১৯৮৪), ‘একবার ফেরাও’ (১৯৮৫), ‘আগামী দিনের গল্প’ (১৯৮৭), ‘পাথর সময়’ (১৯৮৯), ‘কেউ জানে না’ (১৯৯০), ‘মানুষ যেখানে যায় না’ (১৯৯০), ‘কয়েকজন অপরাধী’ (১৯৯০), ‘এ এক জীবন’ (১৯৯১), ‘অগ্নিগিরি’ (১৯৯১), ‘অপেক্ষা’ (১৯৯২), ‘কবেজ লেঠেল’ (১৯৯২), ‘লজ্জা’ (১৯৯২), ‘এক ঝলক আলো’ (১৯৯৪), ‘মৌমাছি ও কাঠুরিয়া’ (১৯৯৬), ‘তিন সাংবাদিক ভূত’ (১৯৯৭), ‘অবসাদ ও আড়মোড়ার গল্প’ (১৯৯৯), ‘বৃষ্টি দিন’ (২০০০), ‘খুনের আগে ও পরে’ (২০০০), ‘এক একত্রে অপেক্ষা করছে’ (২০০১), ‘শরীরের গল্প’ (২০০৪), ‘সুকুমারের লজ্জা’ (২০০৫), ‘দুরের ওই পাহাড় চূড়ায়’ (২০০৬), ‘আখলাকের ফিরে আসা’ (২০১৪), ‘আবদুল জলিল যে কারণে মারা গেল’ (২০১৫), ‘এভাবেও লেখা হতে পারে আরেকটি গল্প’ (২০১৬) ইত্যাদি।
আয়তনের দিক বিবেচনা করলে মঈনুল আহসান সাবেরকে হয়তোবা বহুপ্রজ বলা যেতে পারে। কিন্তু বহুপ্রজ হওয়ার যে প্রবল ঝুঁকি থাকে তার ভেতর তাঁকে কখনো পড়তে দেখা যায় না। বহুপ্রজ হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো লেখার মান ঝুলে যাওয়া। মনোনিবেশের ঘাটতিজনিত কারণে লেখার গাঁথুনি শিথিল হয়ে যাওয়া। তবে, আশার কথা এই যে, এইসব দুর্বলতা মঈনুল আহসান সাবেরের কোনো রচনাকে স্পর্শ করে না।
গত বছর বইমেলায় প্রকাশিত ‘আবদুল জলিল যে কারণে মারা গেল’ উপন্যাসে দেখা যায় এ সময়েরই একটি প্রতিচ্ছবি।
মৃত্যুর মতো অনীবার্য নিয়তিকেও মানুষ মেনে নেয়। ধরে নেয় এ এক স্বাভাবিক প্রপঞ্চ। কিন্তু তা যদি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে? তাহলে তা মানতে চায় না যেকোনো স্বাভাবিক মানুষ। একজন মানুষ এ জীবনের কত কিছু করার চেষ্টা করে। সে যা কিছুই করতে চাক না কেন এর পেছনে যেমন অনেক কারণ থাকে তেমনি থাকে কত আয়োজন! এই আয়োজন যদি এক নিমিষেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তখন?
কোনো মানবশিশু পৃথিবীতে আসার জন্য মায়ের পেটে যখন প্রথমে ভ্রূণ হিসেবে আত্মপ্রকাশিত হয়, তখন এবং তার আগে-পরে এই মানুষের, এই মানুষের দ্বারা গঠিত সমাজের, সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতির কতনা আয়োজন কতনা চেষ্টা-প্রচেষ্টা থাকে! তার বিকাশেরও একটা পর্যায় থাকে। দুই মাসে হাড়ের বিকাশ, তিন মাসে চামড়া, পাঁচ মাসে ফুসফুস। তারপর একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে তার আনন্দময় আগমন।
এতসব প্রস্তুতি, বিকাশ আর আয়োজনের পর ধীরে ধীরে সে বড় হতে থাকে তার আপন সত্তা নিয়ে। সরকার-যন্ত্রের এক নির্দেশে একটা গুলি খরচের মাধ্যমে যদি মিটে যায় সে-জীবনের লেনদেন, তাহলে?
‘আবদুল জলিল যে কারণে মারা গেল’ উপন্যাসে অনুপুঙ্খভাবে এসেছে সরকার-যন্ত্রের কৌশলে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হওয়া আবদুল জলিলের কাহিনি। এই আবদুল জলিল শুধু একটি নাম নয়। এদেশের অসংখ্য আবদুল জলিলের প্রতিনিধি। পাশাপাশি অন্যসব অধরা আবদুল জলিলদের অপকর্মের বলি।
অফিসে কাজ করে খাওয়া অতি-সাধারণ এক মানুষ আবদুল জলিল। অফিস শেষে ঝালমুড়ি খচ্ছিল। কিন্তু সে-খাওয়া শেষ হলো না। বাড়িও ফেরা হলো না। একটা মাইক্রোবাস ঝড়ের গতিতে এসে থামল। নামল তিনজন। চোয়ালে ঘুষি মেরে তাকে তুলে নিয়ে গেল।
তারপর প্রশ্ন আর প্রশ্ন। এতসব প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই। তবে তার কিছু বলার ছিল। কিন্তু প্রশ্নকর্তাদের তা শোনার আগ্রহ নেই। আবদুল জলিল নিজের পরিচয় দেয়। তাতেও তাদের আগ্রহ নেই। আবদুল জলিলের পরিচয় একেকদিন একেকরূপে প্রকাশ পায়। কখনো সে জাল টাকার কারবারি, কখনো ডাকাত দলের সর্দার, কখনো ভাড়াটে খুনি। কখনো ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়া কেউ, কখনো সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ী, কখনো স্যাবোটাজে জড়িয়ে পড়া কেউকেটা। এরকম আরও কিছু।
চাপিয়ে দেওয়া এসব পরিচয়ের ভারে হারিয়ে যায় আবদুল জলিলের আসল পরিচয়। কিন্তু এতসব পরিচয় উদঘাটনের মতো বিশাল কর্ম সম্পাদনের পর সরকারি বাহিনীরও যেন কিছু করার নেই আবদুল জলিলকে মৃত্যু উপহার দেওয়া ছাড়া।
এভাবেই আবদুল জলিলরা মারা যায় আঙুল ও ট্রিগারের একটি চাপে। আসল আবদুল জলিলরা পায় পৃষ্টপোষকতা। এভাবেই একটি রাষ্ট্রের শক্তি-ভিত্তিগুলো নষ্ট করে দেওয়া হয়। কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের ‘আবদুল জলিল যে কারণে মারা গেল’ উপন্যাসে কোনো কারণের ব্যাখ্যা দেননি সরাসরি। কিন্তু কারণগুলো সবারই জানা হয়ে যায়। এক শৈল্পিক হেঁয়ালির ছোঁয়া পুরো উপন্যাসে। এক প্রচ্ছন্ন স্যাটায়ার সরকার-যন্ত্রের ওপর যা বর্তমান ও নিকট অতীতের বাংলাদেশকেই উপস্থাপিত করে।
এ বছর বই মেলায় প্রকাশিত তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘এভাবে লেখা হতে পারে আরেকটি গল্প’ যা কল্প-বাস্তবতার এক চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।
একজন লেখকের মনস্তত্ত্বে যেমন বাস্তব চরিত্র থাকে, তেমনি থাকে তাঁর রচিত কাল্পনিক চরিত্রগুলোও। রচিত চরিত্রগুলো কখনো বাস্তব থেকে উঠে আসে কখনো আসে লেখকের কল্পনার জগত থেকে। কিন্তু উভয় চরিত্রের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে লেখক যা বলতে চান তার বাস্তবায়ন। এভাবে চরিত্ররা লেখকের বিবেচনার পাত্র হয়ে তার রচনায় বিরাজ করেন।
মাঝে মাঝে লেখকের মনস্তত্বে এমনভাবে কল্পনার চরিত্রগুলো ঢুকে যায় যে লেখক এই দুই জগতের মধ্যকার বিভেদাত্মক সুতোটিকে ধরতে পারেন না। তখন কল্পনা ও বাস্তবের চরিত্ররা চলে এসে তার মনোজগতে বিবিধ ক্রিয়া করতে থাকেন। তাঁর চিন্তার জগৎ ও বিবেচনাবোধকে প্রভাবিত করতে থাকেন।
‘এভাবে লেখা হতে পারে আরেকটি গল্প’-এ এরকম একটি বিষয়ের অবতারণা হতে দেখি। যেখানে লেখক নিজে তো আছেনই। আরও আছেন তাঁর বাস্তব জগতের বাসিন্দা—স্ত্রী। আছেন বহু বছর আগে লেখা একটি উপন্যাসের চরিত্র ফারহানা। তার প্রেমিক লোটন। আছেন ফারহানার স্বামী পারভেজ।
উপন্যাসে দেখা যায় লেখক ঈদসংখ্যার জন্য লেখালেখিতে ব্যস্ত। হাতে সময় নেই। কিন্তু কী এক অবসাদ কাজ করছে। অবসাদ কাটানোর জন্য তিনি যেতে চান বন্ধু এহসানের কাছে, সিলেটে। চা বাগানে।
এর মধ্যে এক সকালে এক তরুণী এসে হাজির। তরুণী লেখকের কাছে এসে জানতে চায়, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? লেখক তাকে চেনেন না। তরুণী পরিচয় দেয়, প্রায় দু’যুগ আগে লেখা একটি উপন্যাসের নায়িকা সে। তার নাম ফারহানা। উপন্যাসে কাহিনীর শেষে লেখক তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে তার বিয়ে হয়েছে পারভেজ নামক এক পুরুষের সঙ্গে। সেখানে সে সংসারব্রত পালন করছে। কিন্তু লোটন নামের একটি ছেলের প্রতি রয়ে গেছে তার অগাধ টান। যাকে লেখক উপন্যাসের শেষাংসে পাঠিয়েছিলেন এক চা বাগানের ম্যানেজার করে।
ফারহানা এখন এই কাহিনির শেষাংশের পরিবর্তন চায়। চায় লেখক নতুন করে লিখুক শেষ অংশ। যেন সে ও লোটন, তার পছন্দের মানুষটি, তাদের দিনগুলো এখানেই পার করতে পারে।
লেখক খুব বিস্ময়ের ভেতরে পড়ে যান। তিনি ঘোরের ভেতরে হাবুডুবু খেতে থাকেন। বাস্তব এবং বহু বছর আগে লেখা উপন্যাসের চরিত্রটির মধ্যে পড়ে তাঁর খেই হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়ে যায় যেন। ধীরে ধীরে বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে থাকেন। বলেন, তা কি হয়! যে লেখা হয়ে গেছে তা কি আর বদলানো যায়? যায় না। কারণ যা লেখা হয় তা সবদিক বিবেচনা করেই লেখা হয়।
ফারহানা নাছোড়। সে বলে, আপনাদের সঙ্গে আমিও যাচ্ছি। লোটনকে তো আপনি চা বাগানের ম্যানেজার করে পাঠিয়েছেন। ওখানে তার সঙ্গে তো দেখা হবেই। তখন আমরা ওখানেই ঠিক করব কী হবে এই কাহিনির সমাপ্তিতে।
দেখা যাচ্ছে লেখকের হাতে গড়া চরিত্রটি উল্টো লেখককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এমনকি কাহিনির চালিকাশক্তিও সে হয়ে উঠছে যেন। লেখকের বিনির্মাণ যেন লেখককে দিয়ে বদলিয়ে নিচ্ছে কাহিনির পরিসমাপ্তি।
সিলেটে গিয়ে যথারীতি দেখা হয়ে যায় লোটনের সঙ্গে। লোটন ধীর স্থির। ফারহানার জন্য তার ভালোবাসাও প্রবল। কিন্তু কোনো কিছুতে সে উতলা নয়। যতটা উতলা ফারহানা। ফারহানা বলে, লোটনের হাত ধরে বনের ভেতরে হাঁটতে তার অসামান্য লাগছিল। এই মিলনই মৌলিক। তাহলে বিরহের কষ্ট নিয়ে সে কেন পড়ে থাকবে আমেরিকায়। সুতরাং সিদ্ধান্ত হয়, লেখক উপন্যাসে রাখবেন লোটনের সঙ্গে ফারহানার দাম্পত্য যাপন। দেখানো হবে পারভেজের সঙ্গে ফারহানার বিয়ের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে এমন কিছু বলা হয়নি। লেখক লিখবেন এ উপন্যাসের আরও একাধিক পর্ব। দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে দেখানো হবে বিয়েটা আসলে হয়নি। কেন হয়নি সে-বিষয়ে যৌক্তিক কারণও দেখানো হবে।
ফারহানা অস্থির হয়ে ওঠে। সে জানতে চায় লোটনের সঙ্গে তার মিলন হবে তো! লেখক বলেন, হবে। তবে কিভাবে হবে, সেটা জানতে চেও না, আমি নিজেও জানি না। ফারহানা বলে, জানতে চাইব না কিভাবে মিলন হবে। শুধু চাইব আমাদের মিলন যেন হয়ই।
এ রকম কাহিনির একটি বিস্ময়কর উপন্যাস ‘এভাবে লেখা হতে পারে আরেকটি গল্প’। যেখানে লেখক, তার বাস্তব জগতের স্ত্রী, উপন্যাসের চরিত্র ফারজানা, তার প্রেমিক লোটন—সবার মনস্তত্বের এক অপূর্ব রসায়ন পুঞ্জিভূত হয়েছে। যা যার যার অবস্থান থেকে বিশ্লেষিত হয়েছে। বিশ্লেষিত হয়েছে যার যার অবস্থানগত যুক্তির আলোকে। বিশ্লেষিত হয়েছে সক্ষমতা-অক্ষমতার নিরিখে। বিশ্লেষিত হয়েছে সকল সম্ভাবনার সম্ভাব্য পরিণতির বিচারে। আর যা কিছু অসম্ভব তা বিশ্লেষিত হয়েছে বিপুল আক্ষেপে, হাহাকারে।
বোধ করি উপন্যাসটি সমকালের বিবেচনায় অদ্ভুত, অন্যরকম এবং বিস্ময়কর হিসেবে উল্লেখিত এবং আলোচিত হবে।
পেয়েছেন বাপ্পি শাহরিয়ার শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), হুমায়ূন কাদিও সাহিত্য পুরুস্কার, ফিলিপস পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৬), ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার।
জন্মদিনে তাঁকে অশেষ শুভেচ্ছা জানাই।