বাংলা তো নিজেদের ভাষা, জন্মগতভাবেই সবাই জানে। তাহলে আবার কী দরকার, এই ভাষা বিষয় হিসেবে পড়ার? ভুল বানান-উচ্চারণে আমার স্বাধীন সোনার বাংলা সুস্থ বা যেমন অবস্থায়ই হোক, চলছে তো। বড়জোর কিছু মানুষ, যারা ভুল দেখছেন ও বুঝতে পারছেন, তারা মনে মনে কর্তৃপক্ষের জ্ঞান নিয়ে একটু প্রশ্ন তুলছেন, এই যা! কোনো কিছু তো বন্ধ হচ্ছে না তাতে। তবে আর এত ভাবনা কিসের!
ইংরেজি? এটা শুধু ভাষা নাকি? এটা তো অন্য কিছু (?) সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ওটা তো নিজের না, নিজের দেশের নিজের ভাষা শুদ্ধভাবে না বললে কিচ্ছু হয় না, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলতে না পারলে কি চাকরি হয়? যদিও অন্য দেশের শিশুরাও ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, যেমন আমাদের দেশের শিশুরা বাংলায়।
ইংরেজি বিষয় তো কথা বলা শেখায়, আর কী চাই? ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ, জাপানিজ বা আরবি তো কোর্স করলে চলে। তাই সবাই তা-ই করে। কিন্তু ইংরেজি তো কোর্স করলেই কথা বলা যায় না (?) চীন দেশের মতো কি বোকা সবাই? অন্যের বশ্যতা স্বীকার না করে নিজের ভাষাকে মর্যাদা দিয়ে ওরা কত পিছিয়ে আছে অর্থনৈতিক দিক থেকে! আমরা কি আর সেই বোকামি করতে পারি? এতটা নির্বোধ হলে কি চলে? আমরা বুদ্ধিমান বড়!
অবশ্যই আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে একজন শিক্ষিত মানুষের ইংরেজি জানা প্রয়োজন, কিন্তু আমরা কি সত্যিকার অর্থে এর প্রয়োজনের সঠিক জায়গা বা মাপকাঠিটা জানি? আমরা জেনে ও বুঝে কি বলি যে, বাংলায় পড়ছ কেন, ইংরেজিতে সুযোগ হয়নি? এই প্রশ্নগুলো আমাদের জ্ঞানের কোন স্বরূপটিকে উন্মোচন করে?
ইংরেজি নিয়ে ছয় বছর পড়লে কথা বলা শেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তবে স্পোকেন কোর্সটা কী? আর অনার্স-মাস্টার্সে ইংরেজি বিষয়ে কি কথা বলার ওপর বা লেখার ওপর কোনো কোর্স আছে? থাকলেও কয়টা? এসব কথা প্রাসঙ্গিক, কারণ আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ এটাই জানে বা মনে করে, ইংরেজিতে পড়লে কথা বলা শেখা যায়। আর যদি কেউ বিষয়টার পুরো নামের দিকে তাকান, তবে তা হবে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। কিন্তু আমরা কি জানি, ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স করলে সাহিত্য পড়তে হয়, তাও আবার ইংরেজি সাহিত্য! এখন যখন বাংলা সাহিত্য পড়ার সঙ্গে চাকরির কোনো সম্পর্ক নেই, সেহেতু ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সঙ্গে চাকরির সম্পর্কটা ঠিক কী রকম?
সাহিত্য মানে আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেকের ধারণা গল্পের বই, যেটা শীতের ছুটিতে পড়া যায়। কবিতা বড়জোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই একটা পোস্টের জন্য কাজে আসে। তাহলে সাহিত্য তারা কেন পড়বেন বা পড়াবেন?
নাকি যারা নিজের ছেলে বা মেয়েকে ইংরেজিতে পড়িয়ে গর্ববোধ করেন বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকেন এবং আশে পাশে কেউ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন জানলে তার বোকামির কোনো অর্থ খুঁজে পান না; তারা জানেনই না যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্সে একই জিনিস পড়ানো হয়। আর সেটা হলো বিশ থেকে তিরিশ ভাগ ভাষা আর সত্তর ভাগ সাহিত্য। এই দুই বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো বাংলা বিভাগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয় আর ইংরেজি বিভাগে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়ানো হয়। আর যদি সবাই জেনেও থাকেন, তবে বোধ করি তারা নিজেদের সাহিত্যের চেয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর ভরসা ও বিশ্বাস বেশি করেন।
ইংরেজিতে চার লাইন কেউ কথা বললে আমরা কেমন তার পদতলে নিজেকে লুটিয়ে দেই, মনে করি তার চেয়ে বিদ্বান বুঝি আর কেউ নেই! কিন্তু কেন? যিনি আরবি, ফার্সি আর স্প্যানিশ বলতে পারেন, তাকে কি এতটা কুর্নিশ করি? করি না। কারণ ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। আন্তর্জাতিক ভাষা জানলে বৈশ্বিক যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। আচ্ছা যোগাযোগ স্থাপন করলেই কি ভালো চাকরি আর প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়? যায় না। কারণ সুন্দর করে কথা বলতে পারা তো একটা মিষ্টিগুণ, থাকলে ভালো, না থাকলে কোনো ক্ষতি নেই। তাহলে আমাদের সব চাওয়া ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আমরা কি সেটা প্রকৃত অর্থে জানি?
এ সব কথাকে অনেকেই বলবেন, ‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা’, কিন্তু নেচে কী হয়? আর এগুলো তো প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন, যার সঙ্গে ইংরেজির প্রতি প্রীতি না অপ্রীতির কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্যই আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে একজন শিক্ষিত মানুষের ইংরেজি জানা প্রয়োজন, কিন্তু আমরা কি সত্যিকার অর্থে এর প্রয়োজনের সঠিক জায়গা বা মাপকাঠিটা জানি? আমরা জেনে ও বুঝে কি বলি যে, বাংলায় পড়ছ কেন, ইংরেজিতে সুযোগ হয়নি? এই প্রশ্নগুলো আমাদের জ্ঞানের কোন স্বরূপটিকে উন্মোচন করে?
কালের স্রোতে গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গেলে শেষে কূল থাকে না শুধু ডিগ্রিধারীর। জানা প্রয়োজন অনেক কিছু, যেন খড়কুটো পাওয়া যায় আঁকড়ে ধরার জন্য। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা যথাযথ পরিচর্যায় বিকশিত হোক আমাদের প্রজ্ঞায়, যত্নে ও ভালোবাসায়।
প্রয়োজন ও সম্ভাবনা প্রতিটি ভাষা ও সাহিত্যেরই রয়েছে। অবশ্যই ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়াটা চমৎকার ব্যাপার কিন্তু তা যদি হয় জেনে বুঝে তবেই তা সৌন্দর্য ছড়ায় এবং অন্য ভাষা ও সাহিত্যকে জেনে বুঝে সন্মান করতে শেখায়। বাস্তবে যখন চিত্রটা ভিন্ন, তখন মুক্তচিন্তাশক্তি প্রশ্ন বাড়ায়। নয়তো ইংরেজির মতো একটি শ্রুতিমধুর ভাষা অল্প সংখ্যক লোকের কাছে হলেও ভয় ও বিতৃষ্ণার বিষয় হতো না। আমরা নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় নিজের ভাষাকে যথাযথ সন্মান না করে অন্যের ভাষাকেও অসম্মানিত করছি কোনো না কোনোভাবে।
একটা দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা, যে দেশটার গণমাধ্যম, অর্থনেতিক- সামাজিক- রাজনৈতিক প্রচার মাধ্যম বাংলা, যে দেশটার স্বাধীকার আন্দোলনের মূল ভিত্তিটা বাংলা সে দেশে আমরা অধিকাংশ মানুষই ভাষাকে পরিচর্যা করার, জানার, জেনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। যেখানে ভুল বানানে দেশের অধিকাংশ জায়গায় প্রচার প্রচারণা চলে, ভুল উচ্চারণ অধিকাংশ কার্যক্রম চলে; যেখানে আমরা বাংলা ভাষা চর্চার পরে কর্মক্ষেত্র কোথায় তা খুঁজে পাই না। কী আশ্চর্য!
ভাবের সাগরে ভেসে নিজেরে না চিনে, না বুঝেই পার করে দেই সময়ের নদী। তারপর ভাবি আমরা কতটা সফল আর কতটাই বা বিফল! তারচেয়ে যদি যেকোনো ভাষাকে জেনে-বুঝে গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন ভাবা যায়, তবে আর কিছু না হলেও সাহিত্যবোধ জাগে। প্রজ্ঞাবানও হওয়া যায়। কারণ চাকরির জন্য তেমন কিছু না, বিজ্ঞতাই প্রয়োজন, যা বিভিন্ন প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে কর্মোদ্ধার করা শেখায়। বিপদগামী হয়েও অর্থ আনা যায়। কিন্তু সঠিক পথে প্রতিষ্ঠা পেতে জ্ঞান প্রয়োজন। কালের স্রোতে গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গেলে শেষে কূল থাকে না শুধু ডিগ্রিধারীর। জানা প্রয়োজন অনেক কিছু, যেন খড়কুটো পাওয়া যায় আঁকড়ে ধরার জন্য। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা যথাযথ পরিচর্যায় বিকশিত হোক আমাদের প্রজ্ঞায়, যত্নে ও ভালোবাসায়।
জীবনানন্দের কবিতায় বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণ ॥ অনীক মাহমুদ