দক্ষিণ সাগর থেকে সার বেঁধে মেঘেরা এসে জমে আমার বউবাজারের ফ্ল্যাটের আকাশে। মেঘের ছাদের নিচে দু’হাতের ডানা মেলে উড়ি। কিশোরবেলা কী প্রগাঢ় অলিঙ্গন করে। মনে মনে বলি—’মিতু দাতু শামীম বেবী আয় আবারও সবাই মিলে/ পাখি পাখি পাখি খেলি’। কত রঙের মেঘ! কালো, সাদা, ধূসর, নীল! মেঘেরা আচানক আমাকে ছেড়ে আরও এগোয়—থরে থরে জমে ওঠে বাটালি হিলের চূড়ায়। কালো ছায়ার নিচে সবুজ পাহাড় মুখ ব্যাদান করে থাকে, আমার মন বেদনাবিলাসী হয়ে ওঠে। ব্যস্তবেদন শহরে—জীবিকা জটিল জঙ্গমে নিজেরই কানে—চুপি চুপি নিজকেই বলি—’আয় মেয়ে দাঁড়া তুই তোরই পাশে/ নিজেকে কিশোরী করে শার্ট খুলে উড়াবি আকাশে।’
আহা আমার কিশোরী বেলা। এত অসহ্য সুন্দর কেন ছিল? কেন আজও আমি কিশোরী বেলায়! লেবুমামা—আমার আর বড় হয়ে ওঠা হলো না। গল্প কবিতা আর গদ্যজুড়ে কেবলই এক কিশোরীর স্মৃতিবেলা উঁকি দেয়। জাহাজের ভেঁপু বাজে, ক্রেনগুলো উর্ধমুখী পণ্যের চাতক। কর্ণফুলী পাড়ের জলবাতিগুলো সীমায়িত করে রাখে চোখের দিগন্ত। নোনা হাওয়া পিছু টানে। আমিতো সমুদ্রকন্যা। কতটা জীবন রেখে এসেছি ওই জলবন্দরে। কত কথা, বেদনা, স্বপ্ন জমা রেখেছি ওই পাড়ায়—সে শুধু আমিই জানি, আর কেউ নয়। ওখানেই লেখা হয়েছে—
কিশোরী সময় যায়
সখাহীন একা
বাড়ন্ত রোদ্দুরে পোড়ে
হৃদয় মৃত্তিকা।তুমিতো দেখেছো তাকে
বহু বহুবার
দেখোনি হৃদয় নীল
নীল পদ্ম গোঁজা।সুবর্ণ তারার রাতে
সেই কালো কিশোরীর
বুনো চুল
শ্যাম দূর্বা চোখ
যদি রাখে সে তোমাকে
তুমুল অস্থিরঘুমহীন-আশরীর
দৃষ্টির মুদ্রায় রেখে
রূপচাঁদা ঢেউ
তবে ডেকো তাকে।
জেনো কিশোরীর বুকে
অপেক্ষারা হিমায়িত থাকে।
আজ প্রায় আঠারো উনিশ বছর পর সিন্দুকের হারানো চাবি খুঁজে পাওয়ার মতো করে ফিরে এসেছি চট্টগ্রাম বন্দরে। এখন তবে আমার বয়স কত?
১৯৭৫ সাল, ১৫ আগস্ট। সকাল দশটা কী এগারোটা। আমার শিশুচোখ বিস্ময়ে থমকে গেল প্রথমবারের মতো! আমাদের পাশের বাসার বন্ধ ড্রয়িংরুমের ভেতর নিজের মুখ চেপে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন বাবাসহ বন্দরের ৭/৮ জন কর্মকর্তা। আমরা ক’জন দরোজার ফাঁকে অস্থির হয়ে উঠি। আমার সেই ঝলমলে শৈশবে—সেইক্ষণে ছোট আপা আমার মুখ চেপে ধরে কানে কানে বলল—’একদম চুপ, পাকিস্তানিরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে।’ এই কথার কোনো তাৎপর্যই তখন ছিল না আমার কাছে। কেবল দীর্ঘ-দীর্ঘ দিন, এমনকি আজও—বাবার সেই ক্রন্দন আমাকে তাড়া করে ফিরছে।
আজও মনের ভেতর মেঘের পলেস্তরা খসে পড়ে চকচকে বৃষ্টির জলে—একটি কিশোরী ডানা মেলে। সোনালি সেই কৈশোরে যে মোটা পানির পাইপটা আমাদের মাঠ ছুঁয়ে, বিল ছুঁয়ে বন্দর হাসপাতালে ঢুকেছিল—তার ওপর বসে নিটোল জলে সাদা মেঘের উড়ে যাওয়া, অথবা জলের ভেতরের সিকির মতো রূপালি মাছ, কিংবাবা কালো মেয়ের আলোয় ধোয়া মুখ দেখে—নার্সিসাস, কথা বলেছি নিজের সঙ্গে নিজেই। সেই বিল আজ আর নেই। এখন সেখানে সারি সারি সাজানো বিল্ডিং। অথচ ওখানটায় বল খেলতাম আমরা। কখনো কখনো বলটা টুক্ করে লুকিয়ে যেত ঘাসের আড়ালে। কেউ জানতো না, আমি চুপি চুপি হারানো বলের পক্ষ নিয়ে বলতাম—লুকিয়ে থাক—কেউ যেন খুঁজে না পায় তোকে। আজ বহুবছর পরে খুঁজে পেতে চাই সেই হারানো বলটিকে। ফিরে পেতে চাই সেই দিনগুলো—যেখানে ছিল না এমন সীমায়িত জীবন। খুব সহজেই ঘোড়ার পিঠে পাখির পাখা বসিয়ে দিয়ে বানানো যেত পঙ্খিরাজ ঘোড়া। সেই সুন্দর কৈশোরে—কোনো টেলিভিশন ছিল না বাড়িতে। রেডিওতে গান শুনতাম—আর বাড়ির বিশাল লাইব্রেরির গাদা-গাদা বই পড়তাম। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ঠাকুরমার ঝুলি, রামায়ন আর মহাভারত এখনো আমার বুকের ভেতর ওম ছড়ায়। মনে পড়ে—টাট্টা নগরের স্বপ্নে বিভোর ভোম্বল সর্দার, মিসিসিপির অববাহিকায় বেড়ে ওঠা দুঃখ মলিন, দু’চোখে পিঁচুটি ভরা দরিদ্র, হ্কফিন কিম্বা আস্ত্রাখানের পেশকভ—যাকে এতটা নির্যাতন করা হতো প্রতিদিন! ওহ্! আমার বুক ভেঙে কান্না পেত, কী ভীষণ রাগ হতো। তারপর যখন সে বলত—দেখিস, একদিন পালিয়ে যাব’, তখন ভাবতাম—কবে পালাবে, কবে? কত দুপুর, নির্ঘুম রাত—তার হাত ধরে আমিও পালাতে চেয়েছি—দূরে, দূরে কোথাও, আজও চাই পালিয়ে যেতে, তোমার কাছ থেকে, তোমাদের কাছ থেকে, নিজের কাছ থেকে। বিভূতিভূষণের দূর্গার মৃত্যু—কী গভীর বেদনায় নাড়িয়ে দিয়েছিল—আমার প্রান্ত কৈশোর। বাংলাদেশ সোভিয়েট মৈত্রী সমিতির মাধ্যমে রাশান সাহিত্যের ভরপুর ছিল আমার কৈশোর। বাবার বুকনি খেয়ে কতবার যে আমি ইভান হতে চেয়েছি—’শিব্কা বুর্কা জাদুকা লারকা/ চেক্নাই ঘোড়া সামনে এসে দাঁড়া’—সেই ঘোড়া আজও আসেনি। আজও কাজলরেখা হয়ে সময় গুনি। আমার অন্ধ চক্ষু বন্ধ চক্ষুকে খুলে দেবে তবে? আহা কৈশোর—এত নাজুক, এত নরম, উষ্ণ, এমন অসহ্য কাছের ও দূরের কেন হয়? সেই কৈশোর আমাকে ছড়া-কবিতা লিখতে শিখিয়েছে। অনুভূতির ছা-পোনা ধীরে ধীরে গল্প বলেছে। রূপালি স্নানে যখন বউবাজার ভিজে যায়, বেড়াল নিভৃত পায়ে বৃষ্টির ধারা বাতাসের দোলায় চেপে আসে—আজও মন পেতে রাখি এক কালো কিশোরীর ছায়ায়, আর সিঁড়িঘরটি আজও কি ওম নিয়ে তেমনিই অপেক্ষায় আছে?