যখন পঞ্চম শ্রেণীতে, তখন হাই স্কুলের এক বড় ভাই এসে বললেন, একটা কবিতা লিখে দাও। বললাম, আমি তো কবিতা লিখতে জানি না। তিনি একটা ম্যাগাজিন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটাতে কিছু কবিতা আছে, পড়ে দেখো। কয়েকটা পড়ে দেখলাম। কেমন জানি লাগলো। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কবিতা নিয়েই ভাবতে থাকলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরোটা পথজুড়ে আমি একটা ঘোরের মধ্যেই পড়ে রইলাম। মনে মনে কী জানি বিড়বিড় করলাম।
স্কুল থেকে দলবেঁধে বাড়ি ফিরতাম। অন্যরা হৈ হুল্লোড় করছে, কিন্তু আমি তখন আরেক জগতে। মনে হচ্ছিল এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠেছে আমার আর বন্ধুদের মাঝখানে। অবশ্য এরকম দেয়াল আমি এরও আগে টের পেয়েছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে খেলছি, হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়তাম। এক ভাবা-না-ভাবার আলো আধারিতে পড়ে রইতো মন। মনে হতো, ওরা একরকম, আর আমি কেমন জানি অন্যরকম। কিন্তু সেই অন্যরকমটা যে কী, তা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারতাম না। বস্তুত, সারাটা শৈশব-কৈশোরজুড়েই নিজের ভেতরে একটা বিপন্নতা নিয়ে বড় হয়েছি। কাউকেই বলতে পারিনি সে-কথা।
সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতেই ৮-১০টা লাইন লিখে ফেললাম মনে মনে। নাম দিলাম ‘অপূর্ব সৃষ্টি’। এটাই আমার জীবনের প্রথম কবিতা। কবিতাটার একটা আবছা স্মৃতি খালি মনে আছে—অপূর্ব সৃষ্টি কথাটাও কোনো একটা লাইনে ছিল, আর পথের দুপাশের ঝিরিঝিরি, ছায়া-ছায়া বাঁশপাতাদের সঙ্গে শব্দগুলোর একধরনের মাখামাখি হচ্ছিল তখন। বাড়িতে গিয়ে কাগজে লিখে রেখেছিলাম এটি। পরেরদিন সেই বড় ভাইয়ের হাতে কাগজখানি তুলে দিয়েছিলাম, তিনি মুচকি হেসেছিলেন, কবিতাটি একটা ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছিল। এখনো আফসোস করি সেটি যদি সংগ্রহ করে রাখতাম! মাঝে মাঝে ভাবি, আমার সেই কবিতাখানি এখন কোথায়! এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো আকারে বা প্রকারে সে অস্তিত্বশীল আছে।
এরপর নবম শ্রেণীর আগে আর লিখেছি বলে মনে পড়ে না। এসএসসির আগে-পরে কবিতার মতো কিছু জিনিস লিখেছি। তবে কলেজে উঠে ডায়েরি ভরে লিখেছি। তখন সিলেটের একটা দৈনিকে আমার দুই-একটা কবিতা ছাপাও হয়েছিল।
লেখালেখি আমার ওপর জেঁকে বসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৯৬ সালের দিকে আমি যখন অনার্স ১ম বর্ষে, তখন দৈনিক বাংলাবাজারের সাহিত্য পাতার দায়িত্বে ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। ছাপা হবে কি না, এই আশঙ্কা নিয়েও একটি কবিতা ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলাম। সাপ্তা দুয়েক পরে একদিন দেখি বাংলাবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় ছোট্ট বক্সে লেখা—আগামীকাল প্রকাশিত হবে কয়েকজন টগবগে তরুণের কবিতা (যদ্দুর স্মরণে আসে, এরকম কিছু লেখা ছিল)। মনে হলো, আমার কবিতা হয়তো তাতে থাকতে পারে। সেদিন শুক্রবার ছিল। ক্যাম্পাস থেকে ছুটে গেলাম হাটহাজারীতে, পত্রিকা সংগ্রহের জন্য। পত্রিকা খুলেই যখন সাহিত্য পাতায় আমার কবিতা দেখতে পেলাম, সে কী উত্তেজনা! সেই উত্তেজনা আমাকে আরেকটু গতিময় করে তোলে। আস্তে আস্তে পাগলামি পেয়ে বসে।
সিলেটের বইপত্রে (বইয়ের দোকান) সান্ধ্য আড্ডা, তার বাসায় রাতের পর রাত কবিতা নিয়ে আলাপচারিতা, আমার বাড়ির ছাদে আর সুরমা নদীর তীরে বসে শীত ও কুয়াশায় ভিজে ভিজে জ্যোৎস্না দেখা, আমি কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি!
আমি আর সোহেল বায়েজীদ (বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ) চার পৃষ্ঠার একটা কবিতার কাগজ বের করি, যার নাম ছিল ডুবোচর। ডুবোচরে শুধু আমার আর ওর কবিতা ছিল। সাদা কাগজে প্রিন্ট করে, সেটি আবার ফটো কপি করে ৪০/৫০ জনের কাছে বিলি করেছিলাম আমরা। সেই সময়টায় কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয় যারা লেখালেখির চেষ্টা করতো। মাঝে মধ্যে আমরা বুদ্ধিজীবী চত্বরে বসতাম, আড্ডা দিতাম, সেখানে গান কবিতা হতো। ওই আড্ডা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের সবার লেখা দিয়ে একটা ম্যাগাজিন করবো। বৈঠা নামে ছোট্ট একটা কাগজ বের করলাম। যার সম্পাদনায় আমি নিজেই ছিলাম। ছাপার অক্ষরে নিজের কবিতা দেখে সবার চোখে-মুখে কী যে মাদকতা, সেটা এখনো মনে আছে।
পরবর্তী সময়ে আরও একটা পত্রিকা করেছিলাম—নাম ছিল জলকাচ। নামটা চন্দন চৌধুরীর দেওয়া। তখন লেখাজোখায় একটা পরিণত-ভাব আসতে শুরু করেছে। কবিতার কিছু কিছু পঙ্ক্তি তখন মহাকাশের দিকে উঁকি দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কবিতা লেখা সম্ভব। জলকাচে আমার একটা কবিতা ছিল—‘নির্জনা এবং খণ্ডদহনের কাল’। এই কবিতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তখনকার স্মৃতিগুলো এখনো মনের পুকুরে ঘাই তোলে। এখনো জানি না, তখনো জানতাম না, আসলেই কবি হতে চাই কি না। কিন্তু এক নিরন্তর বেদনা প্রবাহ, শব্দ-কথা-চিত্রের সঙ্গে এক অন্তহীন নৈঃশব্দ্য-মুখরিত ওঠা-বসা আমাকে এই পথে নামিয়েছে।
দুই জন কবির সঙ্গে পরিচয় আমার লেখালেখিতে বেশ ভূমিকা রাখে। কবি জফির সেতু আর মোস্তাক আহমাদ দীন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই ১৯৯৫ সালের দিকে পরিচয় হয় জফির সেতুর সঙ্গে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স করছিলেন। মূলত তার মাধ্যমেই লিটল ম্যাগের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। কবিতা নিয়ে অনেক আড্ডাও হয় তার সঙ্গে। তার কবিতার প্রতিও বেশ মুগ্ধতা তৈরি হয় ওই সময়টায়। মূলত সমকালীন কবিদের মধ্যে আমার প্রথম প্রেম ছিলেন জফির সেতু। তার কবিতা পাওয়া যেতো লিটলম্যাগে। তাই ঝুঁকে পড়ি লিটলম্যাগের প্রতি। সেখানে আবিষ্কার করি মোস্তাক আহমাদ দীনকে। দীনের অন্যরকম বাক্-বিভূতি আমাকে খুব টানতে থাকে। আমি অপার হয়ে তার কবিতা পড়তাম।
একে একে সাক্ষাৎ পূর্ববর্তী অনেক কবির কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। আমার জন্য এটা ভালোই ছিল যে, আমি কবিতায় প্রবেশ করেই সমকালীন কবিদের আগে পাঠ করে নিয়েছিলাম। তাই আমার সময়ের কবিতার ভাষাটা ধরতে তেমন কষ্ট করতে হয়নি। একদিন সিলেটে দেখা হয়ে যায় দীনের সঙ্গে। সেই থেকে পরিচয়, বন্ধুত্ব। তার হাত ধরেই বিভিন্ন লিটলম্যাগে আমার কবিতা ছাপা হতে থাকে। মোস্তাক আহমাদ দীনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, ওঠা-বসা, তার সঙ্গযাপন—এ-সব আমার জীবনের একটা বড় অধ্যায় হিসেবেই আছে। সিলেটের বইপত্রে (বইয়ের দোকান) সান্ধ্য আড্ডা, তার বাসায় রাতের পর রাত কবিতা নিয়ে আলাপচারিতা, আমার বাড়ির ছাদে আর সুরমা নদীর তীরে বসে শীত ও কুয়াশায় ভিজে ভিজে জ্যোৎস্না দেখা, আমি কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি!
মনে হয় যেন বর্তমান লেখাটা লেখার জন্যই আপনি ২ বছর আগে সেই পঙ্ক্তিগুলো লিখেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে, এমনতর রহস্য আর আবহমান দুঃখের সারাৎসার যেন এই লেখক জীবন।
ওই সময় কয়েকটা লিটলম্যাগকে কেন্দ্র করে সিলেটে দারুণ এক আড্ডার সার্কেল গড়ে ওঠে আমাদের মধ্যে। তার মধ্যে শুভেন্দু ইমামের ‘পাঠকৃতি’, আহমেদ সায়েমের ‘সূনৃত’, সৈয়দ আফসারের ‘অর্কিড’, আহমেদুর রশীদ টুটুলের ‘শুদ্ধস্বর’ অন্যতম। এসব আড্ডায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আরও থাকতেন আহমদ মিনহাজ, মোস্তাক আহমাদ দীন, শুভেন্দু ইমাম, জাহেদ আহমদ, সৈয়দ আফসার, আহমেদ সায়েম, চ্যাবন দাশ, শেখ লুতফরসহ অনেকেই। বিশেষ করে ‘অর্কিড’ ও ‘সূনৃত’ প্রেসে যাওয়ার আগে আগে আমাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করতো। বিশেষ করে ‘অর্কিড’ সম্পাদক সৈয়দ আফসারের শাড়ির দোকান হয়ে ওঠে আমাদের, মানে আমি, জাহেদ, সায়েম আর আফসারের মিনি আড্ডাস্থল। এসব আড্ডা, সঙ্গ ও সংঘ আমার কবি হয়ে ওঠার পেছনে কোনো না কোনোভাবে কাজ করেছে। এদের সবার প্রতিই আমার সৃষ্টিশীলতার ঋণ থেকে যাচ্ছে।
কবিই হতে চেয়েছিলাম আমি? এর সরল কোনো উত্তর আছে কি না, জানি না। কিংবা এটা হয়তো হতে চাওয়ার বিষয়ই না, হয়ে ওঠার বিষয়। কিংবা হয়তো তাও না। আমি তখন নবম শ্রেণীতে। স্কুলে কোনো একটা প্রতিযোগিতায় জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ বইটি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম। কখনো নেড়েচেড়ে দেখিনি। কয়েকমাস পরে হঠাৎ একদিন বিকেলে কী মনে করে বইটি হাতে নিলাম। প্রথম কবিতাটা পড়েই চমকে উঠলাম। এক বলতে-না-পারা অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। আমি পড়তেই থাকলাম, পড়তেই থাকলাম। কখন যে চোখ ভিজে এলো বুঝতে পারিনি। আমার কান্না পাচ্ছিল কেন, কেনই বা বেদনা জাগছিল খুব, সেটা বোঝার মতো বয়স আমার ছিল না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম একটা দৈব কিছু আমাকে অধিকার করে নিচ্ছে, এমন এক অনুভূতি যার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই। সেই থেকে মূলত শুরু। কবিই হতে চেয়েছিলাম কি না জানি না, কিন্তু সেই যে নাম-না-জানা ক্ষরণ শুরু হয়েছিল হৃদয়ে, আর তা থামেনি।
কেন লিখি? লিখতে পারি বলেই লিখি। না লিখে আর কোনো উপায় তাহকে না তাই লিখি। একবার ২/৩ বছর লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল কবিতা ত্যাগ করা। কিন্তু পারিনি। আবার সে জেঁকে বসেছিল আমার ওপর। বেদনা ঘোচাতে লিখি। আবার বেদনা জাগাতেও লিখি। কখনো আমি ড্রাইভিং সিটে থাকি, কখনো কবিতাই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে লিখিয়ে নেয়, কখনো বা নিজেকে দাবার ঘুঁটি মনে হয়, মনে হয় কেউ যেন আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে এমন কিছু, যা না লিখলে এই মুহূর্তে কোনো বিপর্যয় ঘটে যাবে। কিন্তু কখনো কখনো লেখার পেছনে বড় পরিকল্পনাও থাকে। সেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা ও নির্মাণ হাত ধরাধরি করে চলে। আসলে কবিতা বা সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়টি এমন রহস্যময় যে, এখানে কবি হয়ে ওঠা বা কবিতা হয়ে ওঠা, কেন লিখি বা লেখক হয়ে ওঠার গল্পটা আসলে কী—এসব বিষয় চূড়ান্তভাবেই অমীমাংসিত থেকে যায়।
যেমন ধরুন, আপনি হয়ত কবিতা লিখতে বসেছিলেন। ৫/৬ লাইন লেখার পর আর এগোয়নি। আপনিও আর চেষ্টা করেননি। কিন্তু আজ যখন আপনি নতুন একটা কবিতা লিখতে বসেছেন, ১০/১২ লাইন লিখেও ফেলেছেন, তখন আপনি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন যে, ২ বছর আগের সেই ১০/১২ লাইনের মধ্য থেকে ২/৩ টি লাইন এই কবিতায় এসে আশ্চর্যজনকভাবে উঁকি দিচ্ছে। মনে হয় যেন বর্তমান লেখাটা লেখার জন্যই আপনি ২ বছর আগে সেই পঙ্ক্তিগুলো লিখেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে, এমনতর রহস্য আর আবহমান দুঃখের সারাৎসার যেন এই লেখক জীবন।
আরও পড়ুন:
লেখক হওয়ার গল্প