আমেরিকার বিখ্যাত কবি ড. মায়া অ্যাঞ্জেল্যু ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল মিসোরি রাজ্যের সেন্ট লুইস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে, গায়িকা, অভিনেত্রী, নাট্যকার, শিক্ষক ও একজন জীবনীকার। তার পুরো নাম মার্গারেট অ্যানি জনসন। পৃথিবীর প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও নাগরিক অধিকাররক্ষাকর্মীদের মধ্যে একজন হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। দারিদ্র্য, হিংস্রতা, বর্ণবৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে সমাজের নানা অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে প্রতীবাদ করে একটি পুরোজীবন অতিবাহিত করা যায়, তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখা হয় তাকে। চিরকাল ধর্ষণ, বর্ণবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সাহসী কণ্ঠস্বর হিসেবে সংগ্রাম করে গেছেন মায়া।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি তার নিজের লেখা কবিতা ‘পালস অব মর্নিং’ আবৃত্তি করেন। এজন্য পরে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পান। ইতোপূর্বে ১৯৬১ সালে একমাত্র কবি রবার্ট ফ্রস্টই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দ্য গিফট আউটরাইট’ কবিতাটি আবৃত্তি করার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে মায়া এঞ্জেলোর কবিতা পাঠ করে তাকে সম্মান দেখান। কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সমগ্র পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সম্মাননা পান। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট বা ডক্টর উপাধি পান। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল মেডেল অব আর্টস ও প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডমের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ও। তার কর্মজীবনের প্রায় তিন দশক ধরে তিনি শিক্ষকতা করেছেন ওয়েক ফরেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি নিজেকে সবসময় এমনই একজন সাধারণ মানুষ মনে করতেন, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ভালো-মন্দের সব বৈশিষ্ট্যই।
দুই.
১৯৩১ সালে যখন মায়ার বয়স মাত্র তিন বছর, তিনি তার চার বছরবয়সী বড় ভাই বেইলি জনসনের সঙ্গে আরকানসরের ছোট্ট শহর স্ট্যাম্পে দাদি অ্যানি হেল্ডারসনের বাড়ি চলে যান। সেখানেই মায়ার শৈশব কেটেছে। তাই তার কল্পনার জগৎও প্রসারিত হয়েছিল এই শহরেরই আলোছায়ায়। চার বছর পর হঠাৎই একদিন বাবা বেইলি জনসন এসে তাদের দাদির বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে মা ভিভিয়ান জনসনের তত্ত্বাবধানে দিয়ে আসেন। সেখানে আট বছর বয়সী শিশু অ্যাঞ্জেল্যু তার মায়ের প্রেমিক, ফ্রিম্যান নামক এক বিকৃত মস্তিষ্কের প্রৌঢ়ের হাতে ধর্ষণের শিকার হন। মাত্র একদিনের জন্য জেলহাজত হওয়ার পর ফ্রিম্যান কারাগার থেকে বেরিয়ে এলে মায়ার মামারা তাকে হত্যা করেন। পুরো ঘটনাটি শিশু মায়ার মনে এক ভয়াবহ বিষণ্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। তিনি মনে করেন, তার এই স্বীকারোক্তি অর্থাৎ তার কণ্ঠস্বর ফ্রিম্যানকে মেরে ফেলেছে। ফলে পরবর্তী পাঁচ বছর অ্যাঞ্জেল্যু কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। এই ঘটনার পর তাকে আবারও দাদির কাছে আরাকানসরে পাঠানো হয়। এই সময়টিতেই সাহিত্যের প্রতি অ্যাঞ্জেল্যুর গভীর আগ্রহ জন্মে।
এরপর সিঙ্গেল মাদার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য তাকে নানা ধরনের কাজ করতে হয়েছিল। তারমধ্যে হোটেলের ওয়েট্রেস ও বাবুর্চির কাজও রয়েছে
এদিকে, শিক্ষিকা ও বন্ধু বার্থা ফ্লাওয়ারের অক্লান্ত পরিশ্রমে একসময় মায়া তার মুখের ভাষা ফিরে পান। বার্থাই প্রথম তাকে চালস ডিকেন্স, উইলিয়াম সেক্সপিয়ার, এডগার এলান পো, ডগলাস জনসন, জেমস ওয়েল্ডন জন্সনের মতো বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মায়া ও তার বড় ভাই সানফ্রানসিসকোতে ফিরে যান। এরপর তিনি স্কলারশিপ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার লেবার স্কুলে ডান্স ও ড্রামায় ভর্তি হন। তবে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পড়ালেখা বন্ধ করে প্রথম আফ্রো-আমেরিক্যান মহিলা ক্যাবল-কার কন্ডাকটর হয়ে যান। এই চাকরিটি পাওয়ার জন্য তিনি এতই ব্যাকুল হয়ে ছিলেন যে, তার মা চাকরিটিকে তার মেয়ের জীবনের স্বপ্নের চাকরি বলতেন। কিছুদিন চাকরি করার পর তিনি আবারও উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য স্কুলে ফিরে আসলেন। তবে, এরইমাঝে অল্প কিছুদিনের জন্য তিনি একটি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার ফলে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এরপর সিঙ্গেল মাদার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য তাকে নানা ধরনের কাজ করতে হয়েছিল। তারমধ্যে হোটেলের ওয়েট্রেস ও বাবুর্চির কাজও রয়েছে।
তিন.
১৯৫১ সালে মায়া তার মায়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এনাস্টাসিওস টস অ্যাঞ্জেল্যু নামে একজন গ্রিক নাবিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান ও উঠতি মিউজিসিয়ানকে বিয়ে করেন। এদিকে বিয়ের পর মায়া নাচ শিখবেন বলে মনোস্থির করে নাচ শেখার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যান। এসময় তিনি স্যানফ্রান্সিসকোর একটি একাডেমিতে আধুনিক নাচের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। এবং নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার এলভিন অ্যালে ও রুথ ব্যাকফর্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। নাচ শিখতে শিখতেই একপর্যায়ে তিনি ও অ্যালে মিলে গঠন করলেন ‘অ্যাল অ্যান্ড রিটা’ নামের একটি নাচের দল। এরপর তিনি আফ্রিকান নৃত্য নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। যোগাযোগ করেন ত্রিনিদাদিয়ান নৃত্যশিল্পী পার্ল প্রিমুসের সঙ্গে। ১৯৫৪ সালে প্রথম স্বামী এনাস্টাসিওস টস অ্যাঞ্জেল্যুর সঙ্গে ডিভোর্সের পর তিনি পেশা হিসেবে নাইটক্লাবের ড্যান্সকে বেছে নিয়েছিলেন। এসময় তিনি স্যানফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত নাইটক্লাব বিট-ইরা, পার্পল অনিয়নসহ বিভিন্ন ক্লাবে পেশাদার নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেন।
ক্রমশ উঠতি কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের মধ্যে আলোচিত ও অন্যতম হয়ে ওঠেন মায়া
সিদ্ধান্ত নেন ভবিষ্যতে এই পেশাটিকেই তিনি পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করবেন। একইসঙ্গে তিনি তার মার্গারেট অ্যানি জনসন নামটি পরিবর্তন করে বড় ভাইয়ের দেওয়া নাম মায়ার সঙ্গে স্বামীর পদবি অ্যাঞ্জেল্যু জুড়ে দিয়ে হয়ে ওঠেন মায়া অ্যাঞ্জেল্যু। এদিকে, সফল নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তার জন্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ মসৃণ হয়ে যায়। এরপর তিনি ১৯৫৪-৫৫ সালে ‘পোর্গি অ্যান্ড বেস’ অপেরা নিয়ে ইউরোপ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এসময় প্রতিটি দেশের ভাষা মনোযোগ দিয়ে শেখার চেষ্টা করতে লাগলেন। একসময় তিনি বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন, যা পরবর্তী সময়ে তার সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৫৭ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন গানের অ্যালবাম করার। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয় তার প্রথম অ্যালবাম ‘মিস ক্যালিপসো লেডি’। এই অ্যালবামটি ১৯৯৬ সালে আবারও নতুন করে প্রকাশিত হয়েছিল। একই সালে অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে অ্যাঞ্জেল্যু ‘ক্যালিপসো হিট ওয়েভ’ নামক সিনামায় নিজের কম্পোজিশনে অভিনয় করেন ও গান পরিবেশন করেন।
চার.
মায়া অ্যাঞ্জেল্যু ছিলেন এমনই একজন অসাধারণ কর্মী, যিনি তার জীবনের সম্ভাব্য প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সাতটি আত্মজীবনী, তিনটি প্রবন্ধের বই, বেশকিছু কবিতার বই, বহু নাটকের স্ক্রিপ্ট, সিনামার স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। একইসঙ্গে টেলিভিশনের শোগুলোয় কৃতিত্বের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। তবে তিনি তার সাতটি আত্মজীবনীমূলক ধারাবাহিক সিরিজের জন্যই সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন। তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক বই ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ (১৯৬৯)-এ তার ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত ঘটে যাওয়া জীবনকাহিনীর সবকিছু তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন। এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দুনিয়াব্যাপী পাঠক-সমালোচক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যা তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও প্রশংসা এনে দেয়। লেখক হয়ে ওঠার আগে তরুণ বয়সে তাকে ফ্রাই কুকের (ভাজাভাজি করে এমন রাঁধুনি) কাজ থেকে শুরু করে যৌনকর্মী, নাইটক্লাবের নর্তকি, অভিনেত্রী, টেলিভিশনের সিরিজের অভিনেত্রী, পোর্গি ও বেস অপেরার মঞ্চ অভিনেত্রী ইত্যাদি পেশায় কাজ করতে হয়েছিল। এছাড়া তিনি দক্ষিণের খ্রিষ্টান নেতৃত্ব সম্মেলনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতা শেষ হওয়ার সময়ে ( ১৯৫০- ১৯৬০ সালে) মিসর ও ঘানার একজন সাংবাদিক হিসেবে কয়েকবছর কাজ করেছিলেন।
পাঁচ.
ঔপন্যাসিক জন অলিভার কিলেন্সের সঙ্গে ১৯৫৯ সালে ঘটনাচক্রে অ্যাঞ্জেল্যুর দেখা হয়ে যায়। তার অনুপ্রেরণায় মায়া লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নিউইয়র্কে যান। এখানে এসে ‘হারলেম রাইটার্স গিল্ড’ ও ‘নাগরিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন’-এ যোগ দেন। এরপর থেকেই সৃষ্টি হয় ইতিহাস। ক্রমশ উঠতি কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের মধ্যে আলোচিত ও অন্যতম হয়ে ওঠেন মায়া। একইসময় জন হেনরিক ক্লার্ক, রোসা গাই, পল মার্শাল ও জুলিয়ান মেফিল্ডের মতো বিখ্যাত আফ্রো-আমেরিকান লেখকদের সঙ্গেও পরিচিত হন। ১৯৬০ সালে মানবাধিকারকর্মী মারটিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি সাউদার্ন ক্রিশ্চিয়ান লিডারশিপ কমিউনিটির কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬১ সালে ছেলেকে নিয়ে অ্যাঞ্জেল্যু মিসরের কায়রোতে গিয়ে ইংরেজি সাপ্তাহিক কাগজ ‘দ্য আরব অবসারভার’-এর অ্যাসোসিয়েট এডিটর হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর ঘানার আক্রায় চলে যান। ঘানার নাট্য ও নৃত্য আকাদেমিতে প্রশিক্ষক ও পরিচালকের ভূমিকা ছাড়াও ‘দ্য আফ্রিকান রিভিউতে’ ফিচার সম্পাদকের কাজ করেন। এসময় তার পরিচয় হয় নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। ম্যান্ডেলার জীবনের শেষসময় পর্যন্ত অ্যাঞ্জেল্যুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বজায় ছিল। ফলে ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে মায়ার লেখা ‘স্টিল আই রাইজ’ কবিতাটি পড়েছিলেন ম্যান্ডেলা। ঘানায় আসার পর ছেলের অসুস্থতার কারণে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তাকে সেখানে থাকতে হয়। এ সময় তিনি ঘানা ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবেও কাজ করেন। এছাড়া ‘দ্য আফ্রিকান রিভিউ’তে ফিচার এডিটর হিসেবে এবং ‘দ্য ঘানাইয়ান টাইমসে’ ফ্রিল্যান্স রাইটার হিসেবে কাজ করেন। একইসঙ্গে তিনি ঘানার ন্যাশনাল থিয়েটারে পারফর্ম করেন এবং ঘানা রেডিওতে কাজ করেন। ঘানার আক্রাতে থাকার সময় তার সঙ্গে ম্যালকম এক্সের গভীর বন্ধুত্ব ঘরে ওঠে। এরপর ১৯৬৫ সালে অ্যামেরিকায় ফিরে এসে তিনি ও ম্যালকম এক্স মিলে ‘অর্গানাইজেশন অব আফ্রো-অ্যামেরিকান ইউনিটি’ গড়ে তোলেন। তার কিছুদিন পরই ম্যালকম এক্স গুপ্ত ঘাতকের হাঁতে নিহত হলে তাদের সেই অর্গানাইজেশনটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তিনি নিজের লেখক-ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য লসএঞ্জেলসে ফিরে যান।
ছয়.
বিদেশে থাকাবস্থায় তিনি ইতালিয়ান, আরবি, ফ্রেঞ্চ, আফ্রিকান ভাষার ওপর দক্ষ হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি নানাদেশের সাহিত্য পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলেন। লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেই তিনি ১৯৬৭ সালে আবারও নিউ ইয়োর্কে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি তার সারাজীবনের প্রিয় বন্ধু রোসা গাইকে ফিরে পান। এরপর ১৯৫০ সালে প্যারিসে দেখা হওয়া জেমস বল্ডউইনকেও খুঁজে পান। যাকে তিনি নিজের ভাইয়ের মতো সম্মান করতেন। এদিকে তার বন্ধু জেরি পার্সেল তাকে নির্বিঘ্নে লেখালেখি করতে পারার জন্য স্টাইপেন জোগাড় করে দেন। এভাবেই জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাতে এবং বন্ধুদের সহযোগিতা, অনুপ্রেরণায় তিনি নিজেকে একজন পূর্ণ লেখক হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। জীবনের এই পর্যায়ে এসেই মূলত অ্যাঞ্জেল্যুর সাংস্কৃতিক প্রতিভা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি আফ্রিকান ঐতিহ্য বহনকারী কালো আমেরিকানদের সঙ্গে ব্লুস মিউজিকের সম্পর্ক নিয়ে ১০টি ডকুমেন্টারি সিরিজ তৈরি করেন, যা আমেরিকার জাতীয় শিক্ষা টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। একইসঙ্গে তিনি প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেইজড বার্ড সিংস’ বইটিও লেখেন।
এদিকে, সেসময় মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার ফলে ‘সাউদার্ন ক্রিশ্চিয়ান লিডারশিপ কমিউনিটি’-এর দেখভাল করার দায়িত্বও তার ঘাড়ে এসে পড়ে। কিন্তু ভীষণ দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৬৮ সালে যখন মায়া তার ৪০ বছর পূর্তি জন্মদিনের অনুষ্ঠান উদযাপনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন লুথার কিং আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। যা মায়ার পক্ষে কখনোই মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে পরবর্তী ৩০ বছর মায়া আর তার কোনো জন্মদিন পালন করেননি।
যারা তাকে বুদ্ধিজীবী না ভেবে সেলিব্রেটি ভাবতো, তাদের সমালোচনাকে তিনি কখনোই গায়ে মাখতেন না
সাত.
১৯৬৯ সালে তার প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ বইটি প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বইটি পরবর্তী দুবছর ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে ছিল। তিনি কালো মানুষের মুখপাত্র হিসেবে সমাজে সম্মানিত হতেন। ফলে তার কাজকে কালো মানুষের প্রতিরক্ষকের কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যদিও তার বইগুলো একসময় আমেরিকার লাইব্রেরিগুলোর জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তবু সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও পৃথিবীব্যাপী স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোতে তার কাজ ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়েছে। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তার আত্মজীবনীর ধরনকে একেবারে বদলে দিয়েছিলেন। বইটিতে বর্ণবাদ, আত্মপরিচয়, পরিবার ও ভ্রমণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তিনি আরও ছয়টি আত্মজীবনী লেখেন। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত তার ‘জাস্ট গিভ মি অ্যা কুল ড্রিঙ্ক অব ওয়াটার বিফোর আই ডাই’ নামক কবিতার বইটি পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ১৯৭২ সালে প্রথম কালো নারী হিসেবে ‘জর্জিয়া জর্জিয়া’ নামক সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। পরবর্তী ১০ বছর তিনি একাধারে নানা পত্রিকায় আর্টিকেল লেখা থেকে শুরু করে ছোটগল্প, কবিতা, আত্মজীবনীমূলক লেখা, টিভি স্ক্রিপ্ট, ডকুমেন্টারি এবং নাটক তৈরির কাজ করেন। একইসঙ্গে নানা কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন। ধীরে ধীরে তিনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠায় তার কবিতাগ্রন্থ, নাটক, ডকুমেন্টারি ফিল্ম, আত্মজীবনীমূলক বইগুলো অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হতে থাকে। এই সময়ে একজন মানবতাবাদী কর্মী ও আন্তর্জাতিক বক্তা হিসেবে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছায়। ১৯৭৪ সালে তিনি তার দ্বিতীয় আত্মজীবনী ‘গ্যাদার টুগেইদার ইন মাই নেম’ (Gather Together in My Name -1974) প্রকাশ করেন।
আট.
১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘সিংগিং অ্যান্ড সুইংগিং অ্যান্ড গেটিং ম্যারি লাইক ক্রিস্মাস’ ( Singin’ and Swinging’ and Gettin’ Merry like Christmas-1996) বইটি। ১৯৭৭ সালে যখন তিনি টেলিভিশনের জনপ্রিয় সিরিজ রুটসের সহযোগী অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করছেন, ওই সময়েই আবার তিনি নানা ধরনের পুরস্কারসহ প্রায় ত্রিশটির মতো কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে টেলিভিশনের জনপ্রিয় উপস্থাপিকা অপ্রাহ উইনফ্রের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর দু’জনের মধ্যে সারাজীবন ধরে গভীর বন্ধুত্ব বজায় থাকে।
এদিকে, ১৯৮১ সালে প্রকাশ করেন চতুর্থ বই ‘দ্য হার্ট অব এ ওমেন’ (The heart of a women-1981)। এই বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই দক্ষিণ আমেরিকায় ফিরে আসার পর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাচেলর ডিগ্রি না থাকা অবস্থায়ও ১৯৮২ সালে নর্থ ক্যারোলিনার ইউন্সটন সালেমের ‘ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটি’তে অ্যামেরিকান স্টাডিজের ওপর আজীবন প্রোফেরসরশিপের সম্মাননা পান। এদিক থেকে বিবেচনা করে তিনি নিজেকে এমন একজন শিক্ষক মনে করতেন, যিনি মূলত লেখালেখি করেন। অ্যাঞ্জেল্যু দর্শন, নীতিশাস্ত্র, ধর্মবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, নাট্যতত্ত্ব, জার্নালিজম ও লেখালেখি বিষয়ক ক্লাস নিতেন। যারা তাকে বুদ্ধিজীবী না ভেবে সেলিব্রেটি ভাবতো, তাদের সমালোচনাকে তিনি কখনোই গায়ে মাখতেন না।
এদিকে ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় স্বামী পল ডি ফুর সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর ৮৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘অল গডস চিলদ্রেন নিড ট্র্যাভেলিং সুস-১৯৮৬’ (All God’s children need Travelling Shoes) বইটি। বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি ১৯৮৮ সালে থিয়েটার ডিরেক্টর হিসেবে লন্ডনের এলমেইডা থিয়েটারে এরোল জনের ‘মুন অন এ রেইনবো শাল’ নাটকটি পরিচালনা করেন। এছাড়া ‘দ্য ডেল্টা’ নামক একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার, জাতিগত দ্বন্দ্ব, প্রচলিত কুসংস্কারের বিষয়গুলো ছিল এই চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য। পারিবারিক বন্ধনের প্রয়োজনীয়তা, সুশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার সুফল ও সামাজিক দৃষ্টি উন্মোচনের জন্য তার এই চলচ্চিত্রটি ছিল দুর্দান্ত একটি প্রয়াস।এছাড়া, তিনি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও ম্যালকম এক্সের সঙ্গে সিভিল রাইট মুভমেন্ট নিয়ে সক্রিয় পদে কাজ করেন। একারণেই তাকে বিশ্বের একজন সেরা মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি কালক্রমে একজন শ্রেষ্ঠ বক্তাও হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৯০ সালের শুরু থেকে মায়ার ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিবছরে ৮০টির মতো বক্তৃতা তিনি জনসম্মুখে পেশ করেন। ২০০০ সালে তিনি ‘ন্যাশনাল মেডেল অব আর্ট’ ২০০৮ সালে ‘ লিংকন মেডেল’ এবং ২০১১ সালে আমেরিকার সর্বোচ্চ সম্মান ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ পান। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় তার ষষ্ঠ বই ‘এ সং ফ্লাং আপ টু হেভেন-২০০২’ (A Song Flung Up to Heaven) বইটি।
এ সময় তিনি নিজের সঙ্গে কাজ করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেতাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষ আত্মজীবনীটি লিখছিলেন
নয়.
দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিক হওয়ায় তিনি ২০০৮ সালে ডেমোক্রেসি পার্টির হয়ে হিলারি ক্লিনটনের জন্য ক্যাম্পেইন করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হিলারির বদলে বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি বলেন, আমেরিকা দিন দিন বর্ণবাদ ও যৌনবাদের ঊর্ধ্বে উঠে আসছে। ২০১০ সালে অ্যাঞ্জেল্যু তার ব্যক্তিগত সব কাগজপত্র এবং কর্মজীবনের স্মৃতিচিহ্ন, স্মারকপত্র সবকিছু হারলেমে ‘স্কমবার্গ সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ব্যাংক কালচার’-এ দান করে দেন। এসব ডকুমেন্টারি ৩৪০টিরও বেশি বাক্সে বোঝাই করা ছিল। এগুলোর ভেতর বহু হাতে লেখা নথিপত্র, ব্যক্তিগত হাস্যরসের চিঠিপত্র এবং পেশাগত চিঠিপত্র ছিল। এছাড়া, এগুলোর মধ্যে তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক বই ‘আই নো হোয়াই কেজড বার্ড সিংস’-এর লিগ্যাল ইয়ালো প্যাডে নেওয়া হাতে লেখা অনেক নোট আছে। অ্যাঞ্জেল্যু ২০১১ সালে ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটিতে তার শেষ কোর্সটি নেন। কিন্তু ২০১৪ সালের শেষের দিকে তিনি আরেকটি কোর্স নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। যদিও ২০১৩ সালে ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সম্পর্কিত শেষ বক্তব্যটি তিনি দিয়েছিলেন। ১৯১৩ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি তার আত্মজীবনীর শেষ খণ্ড ‘মম অ্যান্ড মি অ্যান্ড মম-২০১৩’ ( Mom & Me & Mom) বইটি প্রকাশিত হয়।বইটিতে নিজের মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিশদ বর্ণনা দেন তিনি। এছাড়া তার দীর্ঘ ঘটনাবহুল জীবনের অসামান্য সৃষ্টি কবিতার বইয়ের সংকলনগুলো। যথাক্রমে—(1) Just Give me a Cool Drink of Water for I Diiie, (2) Oh Pray My Wings Are Gonna Fit Me Well, (3) And Still I rise, (4) Shaker, Why don’t you sing?, (5) Now Sheba Sings The Song, (6) I shall Not Be Moved, (7) On the Pulse of Morning, (8) The Complete Collected Poems of Maya Angelou, (9) Phenomenal Women: Four Poems Celebrating Women, (10) A Brave and Starting Truth, (11) Celebrations, Rituals of Peace and Prayer, (12) Mother: A Cradle to Hold Me.
মায়া তার প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ থেকে শুরু করে লেখক জীবনের শেষ পর্যন্ত বহুবছর তিনি লেখালেখির জন্য একই নিয়ম মেনে চলেছিলেন। তিনি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বিছানায় শুয়ে শুয়েই লিগ্যাল প্যাডে প্রতিদিন ১০-১২ পৃষ্ঠা লিখতেন। সন্ধ্যায় তিনি সব কাজ শেষ করে লেখাগুলোকে সম্পাদনা করতেন। লেখার আগে প্রথম একঘণ্টার মতো চিন্তাশক্তি প্রখরতা ও মনকে চাঙ্গা করার জন্য সলিটিয়র কার্ড খেলতেন। মায়া তার লেখার মাধ্যমে জীবনের শুধু সততাই তুলে ধরেছেন বলে দাবি করতেন। জরা, অসুস্থতা, বার্ধক্য, সমালোচনা কোনোকিছুই তাকে তার উদ্দেশ্য থেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানবতার কথা বলেছেন, সাম্যের কথা বলেছেন। তার এই বিশ্বজোড়া খ্যাতি, সম্মান বা বৈভব তাকে বিনয়ী ও নিরহংকারী করেছিল। তার আত্মজীবনীতে দেখা যায়, জীবনের প্রয়োজনে একসময় তাকে গণিকা হিসেবেও কাজ করতে হয়েছিল। এমনকি একসময় তিনি সমকামী গণিকাদের মধ্যস্থতাকারীও হিসেবেও কাজ করেছেন।
১৯৯৫ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যৌনবিষয় নিয়ে লেখার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, আমি আমার জীবনের বাস্তব সব অভিজ্ঞতার কথাই শুধু লিখেছি। এগুলো কোনোটিই নিছক গল্প ছিল না। আমার মনে হয় না আমি কখনো ভুল কিছু করেছি বা লিখেছি। আমার কুঠুরিতে কোনো কঙ্কাল নেই। আসলে আমার কোনো কুঠুরিই নেই।
দশ.
২০১৪ সালের ২৮ মে সকালে অ্যাঞ্জেল্যু চিরনিদ্রায় চলে যান। বেশকিছুদিন থেকেই তিনি ক্রমাগত অসুস্থ হতে থাকেন। ফলে তার সব সিডিউল ক্যানসেল করতে হচ্ছিল। এ সময় তিনি নিজের সঙ্গে কাজ করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেতাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষ আত্মজীবনীটি লিখছিলেন। তার মৃত্যুতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বারাক অবামাসহ সারা পৃথিবীর অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী-সাহিত্যিক, বিশ্ববরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। অ্যাঞ্জেল্যুর মৃত্যুকে আমেরিকার জনগণ তাদের ইতিহাসের একটি বড় ধরনের বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে।
আজ ৪ এপ্রিল। তার ৯১তম জন্মদিনে তাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।