কবিতা একজন কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি নেই কিন্তু আমার কথা আছে। নিজের স্বপ্ন, সাধ, আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা সবার হৃদয়ে বপন করে দিয়ে মরে গেলেও তা বৃক্ষের মতো ডাল-পালা বাড়াতে থাকবে; ভাবতেই ভালো লাগে। এসব গভীর ভাবনা ছোটবেলায় ছিল কি না, মনে পড়ে না। মনে পড়ে মায়ের মুখে লালনের গান শুনে শুধু তার অর্থ খুঁজতাম। ‘সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে, পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে’, ‘খাঁচার ভিতর আচিন পাখি কেমন আসে যায়’, ‘চাতক থাকে মেঘের আশে মেঘ বরিষণ অন্য দেশে’, ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর, সেথা এক ঘর পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’ এমন অসংখ্য গান মা মুখস্থ গাইতেন। এই গানগুলোর অর্থ খুঁজতে খুঁজতে স্কুলে পড়া শুরু করি।
স্কুলের পাঠ্য বইয়ের ছড়াগুলো পড়ে আমার মনে হতো আমিও এ রকম লিখতে পারবো। একদিন কাজী নজরুল ইসলামের অনুকরণ করে একটা ছড়া লিখলাম। সবাইকে দেখালাম। কেউ বিশ্বাস করলো না আমি লিখেছি, কিন্তু মা বিশ্বাস করলেন এবং খুব খুশি হলেন। বললেন, ‘যারা লেখেন তারা ভাবুক। মহাজ্ঞানী।’ তার মনে হয়, নজরুল ইসলামও একজন নবী। আমি উৎসাহ পেলাম। রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে ভাই, ভাবি রূপকথার কেচ্ছা শোনাতো। আমি ছিলাম, কেচ্ছার ভক্ত। তখন অবাক হতাম, এই কাহিনিগুলো কে লিখেছে? তারা কত বুদ্ধিমান! ইচ্ছারা মনে খেলা করতো, গল্প লেখার স্বাদ জাগতো।
আমাদের স্কুলের মাঠে বিশেষ দিনগুলোতে মঞ্চনাটক হতো। ভিলেজ ল্যাবরেটরি ক্লাবের সদস্যরা সব আয়োজন করতো। সেখানে আমার ভাইয়েরাও অভিনয় করতো। আমি একদিন একটা নাটক লিখে ফেললাম। আর নাটকের মধ্যে গানও লিখলাম। তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী আমি। গ্রামের খেলার সাথীদের নিয়ে (জুয়েনা, আলপনা, রঞ্জু, হাসি) মাটি, মায়ের শাড়ি, বাঁশ দিয়ে মঞ্চ বানালাম আমাদের বাড়ির সামনে। সবাইকে বলে এলাম, আমরা নাটক করছি; বিকেলে, দেখতে এসো। আমি নাটকে অভিনয়ও করলাম। গ্রামের ছেলে মেয়েরা নাটক দেখে খুব বাহবা দিলো। এই খবর আমার স্কুলের স্যারের কাছে পৌঁছে গেলো। আমার স্যার খুশি হয়ে আমাকে সিরাজ-উদ্দৌলা নাটকে অভিনয়ের জন্য মনোনীত করলেন। যা মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনে। পরে অবশ্য সেটা মঞ্চস্থ হয়নি। এরপর আমি স্কুলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করে কয়েকবার প্রথম হলাম আর বারবার কবিতার বই গিফট পেলাম। শুরু হলো ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের বাইরের কবিতা পড়া আর লেখা। স্কুলের লাইব্রেরি আর নতুন পোস্ট অফিস আমার গ্রামের বাইরে উড়ে যাওয়ার কৌশল শেখালো।
পাঁচ-ভাইয়ের আদরের একটা ছোট বোন ছিলাম আমি। পড়াশোনার বাইরে দুষ্টামির কোনো জগৎ ছিল না আমার। তবে প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে যেমন হাদিস-কোরানের আসর বসতো মা’কে ঘিরে, তেমনি পুরো গ্রামের একমাত্র রঙিন টিভি আর ভিসিআর-এ সিনেমা দেখার জন্য প্রতিদিনই আমাদের বাড়িতে মানুষের মেলা বসতো। মা বিখ্যাত মানুষ এবং নবীদের জীবনী শুনিয়ে সৎ হওয়ার শিক্ষা দিতেন। এত কিছুর মধ্যে থেকে আমি মনে মনে উড়ে যেতাম কল্পনার সাহিত্য রাজ্যে। আমার আশেপাশে কোন কবি-সাহিত্যিক ছিল না। আমাদের বাড়িতে পেপার রাখা হতো না, বড় ভাই মাঝে মাঝে তার দোকান থেকে পেপার নিয়ে আসতেন। প্রিয় জিনিস খাওয়ার মতো গোগ্রাসে পড়ে ফেলতাম পছন্দের লেখাগুলো। এমনকি ঝালমুড়ির ঠোঙ্গার কবিতা গল্প যত্ন করে পড়তাম।
টাকা পাঠানো আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়। কারণ তারা কষ্ট করে বই ছাপাবে আর আমি ক্রয় করবো, তাতে দোষ খুঁজে পাই না। সত্যি সত্যি কিছুদিন পর আবার কবি তিথি আফরোজের নামে বই চলে আসে।
আমার সাহিত্য জীবন কেউ হাত ধরে শুরু করে দেয়নি কিন্তু এসব কিছুই আমাকে প্রভাবিত করেছে। আমার গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুলসীগঙ্গা নদীর চারপাশের সৌন্দর্য আমাকে প্রকৃতিপ্রেমী করে তোলে। আমি আকাশ, বাতাস আর সবুজ গাছ-পাতার প্রেমে বুঁদ হয়ে ধ্যানী বুদ্ধ হয়ে যাই সেই শিশুবেলায়। স্কুল থেকে ফিরেই নদীর ধারে চলে যাই আমি আর আমার বাল্যসঙ্গী জুয়েনা। নদী আমাকে চুম্বকের মতো টানে। ছবি আঁকি আর লিখি নিজের অজান্তেই। কী লিখি, কেন লিখি জানি না। একসময় নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। হলুদ খামে লেখা পাঠাই। সেই দুস্পাপ্য দৈনিক পত্রিকা থেকে লেখা পাঠানোর ঠিকানা পাই। ক্লাস এইটে পড়তে প্রথম আলোর বন্ধু সভায় প্রথম প্রকাশ হয় আমার নানিকে নিয়ে স্মৃতিমূলক একটি লেখা। একই সময়ই পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই, ‘কবিতা চাই’।
ঢাকার বাংলাবাজারে প্রিয়তমেষু নামে একটা যৌথ বইয়ে আমার লেখা ছাপা হবে বলে একটা চিঠি পাই। হলুদ খামের ওপর টাইপ করে ‘কবি তিথি আফরোজ’ লেখা দেখে আমি খুশিতে প্রায় অজ্ঞান। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, বই প্রকাশের পর তিন কপি আমার ঠিকানায় পাঠাবেন তারা কিন্তু সেই বইয়ের দাম বাবদ তাদের অগ্রিম তিন শ টাকা পাঠাতে হবে। আমি তখন স্কুলে তিন শ টাকা করে উপবৃত্তি পেতাম। সেই উপবৃত্তির টাকা পোস্ট অফিস থেকে পাঠাতে গেলে, পোস্ট মাস্টার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে হেসে, নিষেধ করে। বলে, এসব ভুয়া। তারা লেখা ছাপাবে না। আমি প্রায় কেঁদে ফেলি কিন্তু দৃঢ়বিশ্বাস থেকে এক পাও নড়ি না। টাকা পাঠানো আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়। কারণ তারা কষ্ট করে বই ছাপাবে আর আমি ক্রয় করবো, তাতে দোষ খুঁজে পাই না। সত্যি সত্যি কিছুদিন পর আবার কবি তিথি আফরোজের নামে বই চলে আসে।
আমার স্কুলের বন্ধু, শিক্ষক সবাই বিস্ময় প্রকাশ করে। এরপর আরও আরও চড়াই-উৎরাই পার করি। বিশাল বড় উপন্যাস লিখে ফেলি স্কুলের গণ্ডি না পেরুতেই। উপন্যাসটি আমি হারিয়ে ফেলেছি। হয়তো ভালো কিছু হয়নি। তবু জানতে ইচ্ছা করে কী লিখেছিলাম। এরপর লিখি অসংখ্য কবিতা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্ন পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশ হলে অনেক কবি বাহবা দিয়ে চিঠি পাঠায় আমার ঠিকানায়। আমি প্রথম নারী লেখক সেই পত্রিকার। তারপর আমার আকাশ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এভাবেই এক সময় সারাদেশের লিটলম্যাগ আর দৈনিকে কবিতা প্রকাশ হতে থাকে। আমার মা আর ভাইয়েরা খুশি হয় আমার লেখা পড়ে। আমার উৎসাহ বেড়ে যায় অফুরন্ত লেখার। এক সময় দেশর সীমানা পার হয়ে কলকাতা, দিল্লি, আগরতলা, লন্ডন, কানাডা, উগান্ডা, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে বাংলা ইংরেজি কবিতা প্রকাশ হয়।
আমন্ত্রণ পাই দেশের ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে। বিভিন্ন সাহিত্য উৎসবের সম্মাননাসহ পুরস্কার পাই ভারত থেকে—‘কবি জসীমউদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার’, ‘প্রিয়বাসিনী সাহিত্য পুরস্কার’। এছাড়া, দেশ-বিদেশের বিখ্যাত মানুষদের স্নেহ ও প্রশংসা। আমার পাঁচটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যন্ত। গল্প, উপন্যাস, গান ইত্যাদি লিখছি। মানুষের ভালোবাসায় বাঁকি জীবন অফুরন্ত লিখে যাবো, এটাই জীবনের প্রধান লক্ষ্য।