ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক ছিলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন। উড়িষ্যার বালেশ্বরে বুড়িবালামে তিনি মাত্র চার জন সহযোদ্ধা নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মরণযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সেটিই ছিল প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েন। ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে নিজের শরীরের সব সেলাই নিজে হাতে ছিঁড়ে আত্মাহুতি দেন।
বাঘা যতীন জেল থেকে বের হয়ে আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করেন। তিনি সহকর্মী কুষ্টিয়ার যদুবয়রার সন্তান অতুলকৃষ্ণ ঘোষ (১৮৯০-১৯৬৬)-এর নিকট দায়িত্ব অর্পণ করে সোজা যশোরে চলে আসেন। শুরু করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। এ-ব্যবসার আড়ালেই তিনি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তখন ব্রিটিশের শত্রু জার্মানি। জার্মানদের সাহায্যে সারা দেশের বিপ্লবীরা তখন আন্দোলনে অগ্নিরূপ দিতে চেষ্টা করছিলেন। বাঘা যতীন তাদের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বাঘা যতীনের বার্তাবাহক জিতেন লাহিড়ী আমেরিকা থেকে খবর আনেন যে, জার্মান জাহাজ ম্যাভারিক ত্রিশ হাজার রাইফেল, আট লাখ কার্তুজ ও দুই লাখ টাকা নিয়ে জুন মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে যাত্রা করবে। পথে অ্যানি-লারসেন ও হেনরি এস. নামে আরও দুটি জাহাজ ম্যাভারিকের সঙ্গে যোগ দেবে। জাহাজের এ-সব জিনিসপত্র বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে বিপিন গাঙ্গুলি, নরেন্দ্র ভট্টাচার্য (এম. এন. রায়) ও বাঘা যতীনের ওপর।
এরকম সময়ে একটি ঘটনা ঘটে। ফরিদপুর ষড়যন্ত্র মামলায় বিপ্লবীরা সব মুক্তি পাওয়ায় পুলিশ প্রশাসন খুশি হতে পারেনি। পুলিশ প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্নভাবে বিপ্লবী ও তার অভিভাবকদের অতিষ্ঠ করে তোলে। এ রকম অস্থির এক সময়ে বাঘা যতীন পূর্ণচন্দ্র দাসের কাছে অতি বিশ্বস্ত চারজন কর্মী চান, যারা হবে তার ভয়াবহ দুঃসময়ের সঙ্গী। পূর্ণচন্দ্র দাস পাঠালেন জ্যোতিষ, চিত্তপ্রিয়, নীরেন্দ্র এবং মনোরঞ্জনের মতো চার বিপ্লবীকে। তারা এসেই বাঘা যতীনের নিরাপত্তা ও নির্দেশ পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইংরেজ শাসনের শক্ত ঘাঁটি কলকাতা শহরে। বিপ্লব ঘটানোর আগে এটিকে দুর্বল করে দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য কলকাতায় বাঘা যতীন কয়েকটি ঘটনা ঘটান। ঘটনাগুলো হলো: ১৯১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচ ডাকাতি, ২২ফেব্রুয়ারি বেলেঘাটা ডাকাতি, ২৪ ফেব্রুয়ারি পাথুরীঘাটায় যতীন্দ্রনাথের গুপ্তাবাসে গুপ্তচর নীরদ হালদারকে গুলি করে হত্যা, ২৮ ফেব্রুয়ারি হেদোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সুরেশ মুখার্জির হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। কলকাতার মানুষ এসব ঘটনায় জয়োল্লাস করেছে। ইংরেজ ও তার অনুচর ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠে। এ রকম একটি পরিবেশই বাঘা যতীনেরা তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
কলকাতায় ইংরেজদের ভয়াবহ আতঙ্কে ফেলে বাঘা যতীন চার সঙ্গী নিয়ে অধ্যাপক প্রতুল সেনের বাগনারের বাড়ি থেকে বালেশ্বরের দিকে রওয়ানা দেন। সময়টা তখন মার্চের শেষ দিকে।
বাঘা যতীন চার সঙ্গী নিয়ে গোপাল ডিহার আস্তানায় ওঠেন। গোপালের আসল নাম শ্রী নলিনী কর। বাঘা যতীনের একান্ত ভক্ত মণি চক্রবর্তী গোপালের নামে নিজের কিছু জমি দান করেন। এ জমিতেই গড়ে তোলা হয় আস্তানা। এই আস্তানাতেই বাঘা যতীনের গোপন বাস ছিল। চিত্ত, নীরেন, মনোরঞ্জন ও জ্যোতিষ তালডিহায় আরও একটি গোপন আস্তানা গড়ে তোলেন। সেখানে থাকতেন নীরেন ও জ্যোতিষ। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর গভীর উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন অদম্য এই স্বাধীনতাকামী মানুষটি। তখন দুঃসহ কঠিন এক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছে তার প্রতিটি মুহূর্ত। কিন্তু তখনো তিনি জানেন না তার সব পরিকল্পনার জাল ছিঁড়ে গেছে, ফাঁস হয়ে গেছে ম্যাভেরিকের খবর। ইংরেজবাহিনী তার সব পরিকল্পনা জানার পর দ্রুত আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ৭ সেপ্টেম্বর মি. টেগার্ট, মি. রাদারফোর্ড ও মি. কিলভি বিশাল বাহিনী নিয়ে গোপালডিহায় আক্রমণ চালায়। কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর দুর্ভাগ্য, গোপনে বিশাল বাহিনী নিয়ে অভিযান চালিয়েও বাঘা যতীন ও তার সঙ্গীদের তারা গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। গোয়েন্দারা ছায়ার মতো বাঘা যতীনের পিছু লেগে থাকে। কিন্তু তাকে কিছুতেই ধরতে পারে না। এক পর্যায়ে ডেনহ্যাম বড় লাটহার্ডিংস-এর কাছে বাঘা যতীন সম্পর্কে লেখেন, Jatin Mukherjee, Perhaps the boldest and the most actively dangerous of all Bengal revolutionaries. ব্রিটিশদের কাছে বাঘা যতীন কী ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছিলেন, তা বোঝা যায় বড়লাট হার্ডিংসের কথাতেও। বালেশ্বরের যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে তিনি বলে ওঠেন, Nothing can be more Praiseworthy than the action of Kilby and Sergeant Rutheford.
মহান এই বিপ্লবীর মাত্র ৩৬ বছরের জীবন যখন থেমে গেলো, যখন দেশের মানুষ জানলো তিনি দেশের জন্য ব্রিটিশবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করে জীবন আহুতি দিয়েছেন, তখন স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষ ব্যথিত হয়েছে, শোকাভিভূত হয়েছে এবং নীরবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছে।
বালেশ্বরের যুদ্ধের কথায় আর একটু পরে আসছি। বাঘা যতীন নিজেও জানতেন গোয়েন্দারা তাকে হন্যে হযে খুঁজছে। খোঁজ পেলেই ব্রিটিশ বাহিনী ঈগল পাখির মতো তাকে ছোঁ মেরে ধরবে। সে কারণে তিনিও ইংরেজ সাহেবদের গতিবিধি ৪ সেপ্টেম্বর থেকে লক্ষ করছিলেন। তাদের আচরণে অন্য গন্ধ পেয়ে তিনি ৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে গোপালডিহা ত্যাগ করে তালডিহি চলে যান। আবার ৭ সেপ্টেম্বরে ফিরে আসেন মহুলডিহায় জঙ্গলের মধ্যে মণি চক্রবর্তীর বাড়িতে। তখন তার কাছে কোনো টাকা ছিল না। মণি চক্রবর্তীর কাছে তখন মোট টাকাই ছিল পঞ্চাশটি। তিনি পঞ্চাশ টাকাই বাঘা যতীনের হাতে তুলে দেন। এরপর মণি চক্রবর্তী তাকে আবার গভীর অরণ্যের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। বাঘা যতীন তখন তাকে নিজের সংকল্পের কথা জানিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, জনারণ্যের মধ্য দিয়েই আমার পথ, এবার সে পথ দিয়েই যাব।’ ৮ সেপ্টেম্বর তিনি কাটান নীলগিরির গোপন অঞ্চলে নিরালায়। ৯ সেপ্টেম্বর ভোর হওয়ার অনেক আগেই চার সঙ্গীকে নিয়ে রওয়ানা দেন বালেশ্বরের দিকে। ম্যাভিরিক জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার জন্য। কিন্তু পথে অবরোধের শিকার হলে রাজ মোহান্তিকে হত্যা করে অবরোধ মুক্ত করেন। সঙ্গীদেরসহ তিনি ময়ুর-ভঞ্জের বন এলাকার কাপ্তিপোদায় পৌঁছান। এ-খবর সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের কর্তাদের কাছে পৌঁছে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের ডিআইজি জি. ডি. ডেনহাম, কলকাতার ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ চার্লস টেগার্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ড অব পুলিশ এল. এন. বার্ড বালেশ্বরে যায়, ১৯১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এরপর কোনদিকে বা কোথায় পুলিশবাহিনী যাত্রা করবে, কোথায় বিপ্লবীদের অবস্থান, অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তারা। বালেশ্বরে ‘ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম’ নামে একটা দোকান ছিল। এই দোকানের সঙ্গে বিপ্লবীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পুলিশ তা জানতে পেরে দোকানটি তল্লাশি চালায়। তল্লাশি করে পুলিশ একটুকরো কাগজ পায়, যাতে লেখা ছিল ‘কাপ্তিপোদা’। এটি একটি জায়গার নাম। পুলিশের কাছে ‘কাপ্তিপোদা’ নামটি এক বিরাট আবিষ্কার ছিল। এরপর কাপ্তিপোদার দিকে যাত্রা করে গোয়েন্দা কর্তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বালেশ্বর শহরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর.জি.কিলভি, চন্দ্রীপুরের পুলিশ বিভাগের সার্জেন্ট রাদাসবোর্ড এবং বিহার ও উড়িষ্যার ডিআইজি ইসি রাইল্যান্ড।
মি. টেগার্টের অনুরোধে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। তারা জানতো, বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়েও বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবীকে ধরা সহজ নয়। সে কারণে তারা বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। চতুর্দিকে তাদের লোকজন ছড়িয়ে দেয়। গ্রামে-গঞ্জে বাঘা যতীনদের নামে অপপ্রচার চালায় ‘একদল ডাকাত এই পথ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা যেন তাদের পাকড়াও করবার জন্য প্রস্তুত থাকে।’ সহজ-সরল সাধারণ গ্রামবাসীরা প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের তৈরি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে বাঘা যতীন ও তার সহকর্মীদের কাপ্তিপোদায় পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু তাদের খুব নিকটে। সহকর্মীরা উদ্বেগে ব্যাকুল হয়ে বারবার বাঘা যতীনকে অনুরোধ করছিলেন তাকে নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যেতে। সহকর্মীরা জানতেন, বাঘা যতীনের মতো মহামূল্য প্রাণকে হারানো দেশের পক্ষে এক অপুরণীয় ক্ষতি। কিন্তু তিনি সহকর্মীদের অনুরোধ শোনেননি।
বরং তখন তিনি বলেছেন, ‘এ কি আমি কখনো করতে পারি? তোমরা কি আমাকে চেনো না।’ গ্রামবাসীর মারমুখী ধাওয়া খেয়ে, দীর্ঘ বুড়িবালাম নদী সাঁতরে পার হয়ে তারপর বিরাট ধান ক্ষেত পেরিয়ে ক’দিনের প্রায় অনাহারী বাঘা যতীন তার সহকর্মীদের নিয়ে চাষাখণ্ডের একটা বনের মধ্যে যখন পৌঁছান, তখন নীরেন অসুস্থ। বাঘা যতীন বনের ভেতর ঘুরেফিরে একটা টিলা বেছে নেন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্যে।
ব্রিটিশের বিরাট বাহিনী গুলি ছুড়তে ছুড়তে কাপ্তিপোদার চাষাখণ্ডের টিলার কাছাকাছি পৌঁছতেই বাঘা যতীন চার সঙ্গী নিয়ে গুলি ছুড়ে জবাব দিতে থাকেন। ব্রিটিশবাহিনী হতভম্ব হয়ে পড়ে। মৃত্যু আর আর্তনাদে দিকহারা হয়ে পড়ে এই বিশালবাহিনী। কিন্তু যুদ্ধ তারা চালিয়েই যেতে থাকে।
বাঘা যতীন মাত্র চারজন সহকর্মী নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে তিন ঘণ্টা যুদ্ধ করেন। গুলি শেষ হয়ে যায়। বাহুমূলে ও পেটে গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীন যখন ধরা পড়লেন, তখন ব্রিটিশ অফিসাররা তার রণকৌশলে বিস্মিত হন। বিস্ময় প্রকাশ করে ব্রিটিশবাহিনী প্রধান বলেই ফেললেন, ‘আমরা এতক্ষণ মাত্র পাঁচ জনের সঙ্গে যুদ্ধ করলাম!’ চিত্তপ্রিয় যুদ্ধস্থলেই মারা যান।
গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীনকে বালেশ্বর গভর্নমেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসংখ্য পুলিশ, অশ্বারোহী আর মিলিটারিতে ঘিরে রাখা হয় হাসপাতাল। হাসপাতালে পুলিশের বড় কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। জনসাধারণ্যের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পুলিশবেষ্টিত হয়ে হাসপাতালে ঢোকেন প্রবীণ বিজ্ঞ সার্জন ডা. খান বাহাদুর রহমান এবং তার সহকারী সার্জন গাঙ্গুলি। সঙ্গে একজন মহিলা ডাক্তার, দুজন কম্পাউন্ডার, চারজন অভিজ্ঞ নার্স, তিনজন কুলি ও দুজন মেথর।ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন, বাম হাতের বুড়ো আঙুল ও দুটি মেটাকার্পাল অস্থি গুঁড়ো হয়ে গেছে। তলপেটে ও নাভিতে বুলেটের ক্ষত। তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত বমি হচ্ছে ঘন ঘন। সহকারী সাজর্ন এ অবস্থা দেখে লিখেছেন, ‘যেন যবনিকা পতনে আর দেরি নেই।’
এ অবস্থায় যতীনকে অপারেশন রুমে নেওয়া হয়। তখনো প্রচুর রক্ত তার শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছে। রক্তবমি হচ্ছেই। ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি অস্থির হয়ে উঠলেন। এই মর্মান্তিক চেহারা তিনি নিজেও সহ্য করতে পার ছিলেন না। কিলবি জানতে চাইলেন, ‘কেন এত রক্তবমি হচ্ছে? খানিক সফট ড্রিংক দিলে কেমন হয়, ডাক্তার?’কিলবি লেমনেড আনালেন। নিজে হাতে করে যতীনের গলায় অল্প অল্প করে ঢ়েলে দিলেন। কিন্তু তাতেও রক্তবমি কমলো না। তখন কয়েকটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ডাক্তার তাকে ড্রিপ স্যালাইনের ব্যবস্থা করেন। অপারেশনের আগে কিলবি ডাক্তারকে বললেন, ‘যতীনবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখুন আমার কাছে তিনি আর-কিছু বলবেন?’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব, ‘হ্যাঁ, বলবো, মি, কিলবি!’ বাঘা যতীন বলেন, ‘আবার বলবো: See that no injustice is done to those boys under the British Raj. Whatever has happened. I am responsible for all that-’বাঘা যতীনের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করে নিলেন ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি।
গুলির আঘাতে যতীনের ডান হাত তখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে অবশ। বাঘা যতীন মৃদু হাসলেন। তারপরই তিনি অপারেশনের অনুপতিপত্রে টিপসই করে দিলেন।
পরদিন ভোরে তাকে দেখতে এলেন চার্লস টেগার্ট। সঙ্গে এলেন ডেনহাম, ব্যর্ড, রাদার্সফোর্ড, মেজর ফ্লিথ। মি. আর.জি. কিলভি আরও আগেই এসে বাঘা যতীনের পাশে অবস্থান করছিলেন। সার্জনের অনুমতি নিয়ে টেগার্ট ও অন্য সাহেবরা বাঘা যতীনের রুমে ঢোকেন। বাঘা যতীন তাদের দেখে রসিকতা করে বললেন, ‘Good morning Mr. Tegart.তোমাদের সঙ্গে দেখা হলো, ভালোই হলো। আমি তো চললাম।’
এরপরই বাঘা যতীন গম্ভীর হয়ে যান। এর একটু পরই আবার তিনি টেগার্টকে বললেন, ‘আমি চললাম, যারা রইলো, তারা নিরপরাধ। আমার দোষেই তারা এভাবে ধরা পড়লো। দেখো, এদের ওপর যেন অন্যায় অত্যাচার না হয়।’
টেগার্ট বিচলিত বোধ করলেন। বিনীত স্বরে বললেন, Tell me Mukherjee, What can I do for you? বাঘা যতীন শান্তস্বরে উত্তর দিলেন, No thanks! AllÕs over, Good bye. চার্লস টেগার্ট ও তার সঙ্গীরা বের হয়ে যাওয়ার পরপরই বাঘা যতীন নিজেই তার ব্যান্ডেজ, অপারেশনের সেলাই ছিঁড়ে ফেললেন। ফিনকি দিয়ে তীব্রবেগে ছুটে বেরিয়ে এলো রক্তস্রোত। খবর পেয়ে দৌড়ে আসেন ডাক্তার ও নার্স। দ্রুত নতুন করে তার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ দেওয়ার চেষ্টা হলো। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। কিছুক্ষণ পরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দিনটি ছিল ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। আর তখনই রচিত হলো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহাকাব্য।
খবর পেয়ে আবারও ছুটে এলেন চার্লস টেগার্ট। বাঘা যতীনের নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে নিজের মাথার ক্যাপ খুলে গভীর শ্রদ্ধা জানান তিনি। বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর টেগার্ট কলকাতায় ফিরে গেলে তার কাছে ব্যারিস্টার জে. এন. রায় জিজ্ঞেস করেন, ‘ব্যাপারটা সত্যিই, না কি সরকারের এ-ও একটা কৌশল?’
টেগার্ট তখন দুচোখ নিচের দিকে করে অভিভূত কণ্ঠে বলেন, Unfortunately he is dead. ব্যারিস্টার জে. এন. রায় টেগার্টের কথাটি যেন চেপে ধরলেন। বললেন, Why do you say- Unfortunately? টেগার্ট শ্রদ্ধাবনত কণ্ঠে বললেন, I have high regard for him. I have met the bravest Indian, But- I had to perform my duty. বাঘা যতীনের মৃত্যু সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটাবিশ্বে। বিপ্লবীরা শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা ভারতবর্ষ।
মহান এই বিপ্লবীর মাত্র ৩৬ বছরের জীবন যখন থেমে গেলো, যখন দেশের মানুষ জানলো তিনি দেশের জন্য ব্রিটিশবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করে জীবন আহুতি দিয়েছেন, তখন স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষ ব্যথিত হয়েছে, শোকাভিভূত হয়েছে এবং নীরবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছে। আর একইসঙ্গে দৃঢ়প্রত্যয়ে গ্রহণ করেছে ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষের মহান কর্মধারাকে, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার অপ্রতিরোধ্য অঙ্গীকার।
আরও পড়ুন: বাঘা যতীনের গ্রাম ও গড়াই নদী: বেদনাকাব্য ॥ রকিবুল হাসান