গ্রামের নাম গড়পাড়া।
ছবির মতো হোক বা না হোক, প্রত্যেকের নিজের জন্ম-গ্রাম তার নিজের কাছে অসাধারণ দীপ্তিময় এক অনিবর্চনীয় আনন্দের আধার। শৈশবের সব স্মৃতি-বিস্মৃতি জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকে ওই মাটির সুধায়, মায়ের মমতায়। খড়ের গাদায় বাস করে জোনাক পোকার মৃদু আলোর মতো নতুন এক মানবসভ্যতা। তাকে ভোলা যায় না, আমৃত্যু সে থাকে হৃদয়ের গভীর কন্দরে।
এ রকম এক গ্রামে জন্মেছিলাম আমি, পদ্মার শাখানদী কালিগঙ্গার বিপুল জলরাশির অতুলনীয় সৌন্দর্যে বিপন্ন। তবু দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষের সংগ্রামে ছিল অনন্য। যাকে অজপাড়াগাঁ বললে ভুল হতো না কিছুকাল আগেও। একটি মাত্র ফ্রি প্রাইমারি স্কুল ছাড়া আর কোনো বিদ্যাপীঠ ছিল না সেখানে। আমাদের পরিবারের অধিকাংশ মেয়ে এই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া শেষ করে বসে থাকতো। সেলাই শিক্ষা আর রান্না-বান্নার প্রশিক্ষণে কাটতো বিবাহ-পূর্ব সেই অনিন্দ্য সময়। এরপর বিয়ের জন্যে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে। এক সময় বিয়েও হয়ে যেত এমএ-বিএ পাস কোনো পাত্রের সঙ্গে।
আমাদের বাড়িটি ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। দাদার আমলের তালুকদারি, বাবার আমলে কেনা জমিদারি–সব মিলিয়ে আমাদের বাড়ির আলাদা এক মর্যাদা ছিল গ্রামবাসীদের কাছে। বাবা ছিলেন পুরো গ্রামের বিচারক। এমনকী একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বও পালন করতেন তিনি। সেই প্রাইমারি স্কুলেই আমার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। যতটা মনে পড়ে, আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
আমাদের সবার বড় বোন, ডাকনাম মায়া। আমরা তাকে বড়’পা ডাকতাম। এক চমৎকার বিকেলে যাকে বলে গোধূলিলগ্ন, সেই সোনালি সূর্যডোবা কাঁচা হলুদ আভায় বড়’পা একদিন আমাদের বড় ঘরের উঁচু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন শাড়ি পরে। সকলের উদ্দেশে বড়’পা কপালে হাত তুলে সালাম ঠুকে দিলেন নত মুখেই।
তিনি আমাদের পরিবারে নিয়ে এসেছিলেন বাড়তি জ্ঞানের আলো। প্রতিদিনের নিত্যতার বাইরে আমার মায়ের সংসারে প্রথম যুক্ত হলো মেয়ে-জামাইয়ের যুগল জীবনের বাড়তি এক নতুন আনন্দময় জীবনধারা। যা ওই বাড়ির ছোট শিশুদের মনেও খুশির জোয়ার এনে দিলো।
বরসহ ৭/৮ জন অতিথি নিচে চেয়ার পেতে বসে কনের মুখদর্শন করলেন। কিছু না বুঝেই আমার সে কী আনন্দ! নতুন বর্ষার পানিতে পানা ফুলের মতো কেবলি নেচে যাচ্ছি। অচেনা নতুন অতিথিদের ঘুরে ঘুরে পরিমাপ করে দেখছি পরম বিস্ময়ে।
কনের মুখ দর্শন করে বরের সঙ্গে তার বড়ভাই ও স্বজনেরা মিলে কিছুক্ষণ ফিসফাস করে তাদের সম্মতির কথা জানালো, সেই রাতেই বড়’পার বিয়ে হয়ে গেলো ইংরেজি সাহিত্য-পড়া এক সুদর্শন যুবকের সঙ্গে। তিনি আমাদের পরিবারে নিয়ে এসেছিলেন বাড়তি জ্ঞানের আলো। প্রতিদিনের নিত্যতার বাইরে আমার মায়ের সংসারে প্রথম যুক্ত হলো মেয়ে-জামাইয়ের যুগল জীবনের বাড়তি এক নতুন আনন্দময় জীবনধারা। যা ওই বাড়ির ছোট শিশুদের মনেও খুশির জোয়ার এনে দিলো।
বিয়ের দুই তিন বছরের মাথায় আপা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন, আমাদের বাড়ির আঁতুড় ঘরে।
প্রথম সন্তানের জন্ম সংবাদ পেয়ে দুলাভাই ঢাকাতে সেই রাতেই তিনি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গান-বাজনার এক বিশাল আয়োজন করেছিলেন বলে পরদিন এসে আমাদের জানালেন।
সোনার চেইন গলায় পরিয়ে সন্তানের মুখদর্শন করেছিলেন। পুত্রের নাম রাখলেন ডিটো। শিশুটির বয়স যখন ৫/৬ মাস, খানিকটা ঝরঝরা হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে—তখন দুলাভাইর পোস্টিং খুলনায়, সোনালি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে। বড়’পাকে সন্তানসহ স্বামীগৃহে পাঠাবেন বলে স্থির করলেন আমার মা।
বিদেশ বিভূঁইয়ে একা একা নতুন মা কিভাবে সন্তানটি বড় করবে—সেই ভাবনা থেকে আমার বোনকে সন্তান লালন পালনে সামান্য সাহায্য করার জন্যে আমাকে তার সঙ্গে খুলনা শহরে পাঠিয়ে দিলেন কিছু সময়ের জন্যে। ঢাকার পরে সেই আমার প্রথম দেখা দ্বিতীয় শহর।
সেই সময়ে যদি কখনো হারিয়ে যাই, ঠিকানাটি বলে যেন ফিরে আসতে পারি, সে জন্যে আমাদের দু’ভাই বোনকে ভালো করে তা মুখস্ত করানো হয়েছিল। এই বয়সে অনেক কিছু ভুলে গেলেও মনে রয়ে গেছে আব্বার প্রেসের ঠিকানা—দ্যা বখশীআর্ট প্রেস, ৪/২ বাদামতুলি, সদরঘাট, ঢাকা।
বড়’পার বাসায় যে মহিলা হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোশন পরিষ্কার করার কাজ করতো, ঠিকা ঝি হিসেবে, আমার বয়েসী তার এককন্যা ছিল—নাম হাসি। সেই হাসি আমার বন্ধু হয়ে গেলো কয়েক দিনের মধ্যেই। আপা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়িওয়ালির বছর খানেক বয়সের ছোট কন্যাটিকে কোলে রাখার দায়িত্ব ছিল হাসির। শিশুটিকে কোলে নিয়েই পুরো খুলনা শহর হেঁটে বেড়াতো সে। ছেলেদের পরিত্যক্ত সিগারেটের মুড়ো কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিজে খেতো, আমাকেও অফার করতো। হাসির সঙ্গে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আমিও ওর অনুরোধ রক্ষা করে ফুঁকে ফুঁকে সিগারেট খেয়েছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু আমার বড়’পা যেন জানতে না পারে, সে ব্যাপারে সাবধান করেছি হাসিকে। হাসিও তা রক্ষা করেছে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে।
ঝি-চাকরের সন্তানদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করতেন না দুলাভাই। আমাদের সামনে আর একটি দ্বিতল ভবনের নিচতলায় বাস করতো এক বনেদি হিন্দু পরিবার। দুলাভাই খুব আসা-যাওয়া করতেন সেই বাড়িতে। সেই বাসায় আমার সমবয়েসী জয়ন্তী নামের এক মেয়ে ছিল। দুলাভাই চাইতেন, আমি জয়েন্তীর সঙ্গে খেলাধুলা করি, বন্ধুত্ব করি। কিছুতেই হাসির সঙ্গে নয়।
সে জন্যে দুলাভাই আমাকে অনেক সময় জোর করে কোলে তুলে নিয়ে যেতেন জয়েন্তীদের বাসায়। আমার কিন্তু ভালো লাগতো না ওদের নাগরিক কৃত্রিম আচার-আচরণ। গ্রামে বেড়ে ওঠা শিশুদের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার অভাব এখানে মুহূর্তেই অনুভূত হয়। কাজেই কিছুক্ষণ বসেই আমি ফিরে আসতাম বাসায়। অতপর হাসির সঙ্গেই আমার হাসাহাসি রাজ্যের ঘোরাঘুরি, পায়ে হেঁটে শহর দেখা—পুকুরের ঘাটলায় বসে অবাক বিস্ময়ে দেখি তেলাপিয়ার ছানাপোনা। সেই প্রথম কৃত্রিম উপায়ে চাষের মাছের নাম শুনেছিলাম আমি হাসির মুখেই। টেংরা, খলশে, পুঁটি, তিতপুঁটির নামও জানতাম, কিন্তু তেলাপিয়ার নাম শিখিয়েছিল হাসি। প্রাচীন দুটো আমগাছের তলায় শান বাঁধানো ঘাটলা, বাসার সামনেই সেই ঘাটে বসে অনেক সময় পার করেছি আমি আর হাসি।
পুকুরের স্বচ্ছ কালোজলে তেলাপিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোনার সাঁতরানো দেখে কী যে অনাবিল আনন্দে দু’জন হাসাহাসি করতাম এ যুগে তা ভাবাই যায় না হয়তো। সারাক্ষণ সব কিছুর সঙ্গী আমার হাসি। আমার স্বাধীনতা, সাব-অর্ডিনেট, কখনো আবার আমার শিক্ষকও বটেন।
শ্রেণী-বৈষম্যকে অগ্রাহ্য করে আমাদের অমলিন এই বন্ধুত্ব পালতোলা নৌকার মতো ভেসে বেড়াতো রূপসা নদীর এপার ওপার।
একদিন সকালবেলা বাড়িওয়ালির দেড় বছরের কন্যাকে কোলে তুলে নিয়ে হাসি আমাকে ডাকতে এলো।
চলো, আজ চিড়িয়াখানায় যাব তোমাকে নিয়ে। বড়’পাকে কিছু না বলে আমিও ভোঁদৌড় হাসির পেছন, পেছন।
যেতে যেতে পথের ধারে লাল টুকটুকে বধূর মতো নতমুখে বসে থাকা এক বাক্স দেখিয়ে হাসি বললো, এটা হলো চিঠির বাক্স। চিঠি লিখে এই বাক্সে ফেলে দিলে ঠিকানা মতো চলে যাবে। সেই প্রথম দেখা লাজে নম্র নববধূর মতো চিঠির বাক্সখানা মনের অজান্তেই কেমন যেন বিস্ময়ভারাতুর করে তুললো আমাকে। সঙ্গে সঙ্গে আমার আব্বার একহারা ছিপছিপে গড়নের ছায়াচিত্র এসে সামনে দাঁড়ালো, তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা ভেসে উঠলো কল্পনালোকে।
আব্বা ঢাকায় থাকেন, লেটারহেড প্রেসের ব্যবসায় আজীবন নিমজ্জিত, মহাব্যস্ত মানুষ। কতদিন আব্বাকে দেখি না। মনের মধ্যেমুহূর্তেই দীর্ঘশ্বাসের এক ঘূর্ণি তুলে তা আবার হারিয়ে গেলো নিমিষে।
মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম, তাহলে আব্বাকে তো আমিও চিঠি লিখে জানাতে পারি সব। আমার যে এখানে আর ভালো লাগছে না, এখানকার পানি খেয়ে পেট খারাপ হচ্ছে আমার ও ছোট বাবুটার, আমিও চলে যেতে চাই বাড়িতে। চিঠিতে এসব খবর জানতে পারলে আব্বা নিশ্চয় এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। সত্যি সত্যি বাসায় ফিরে রোলটানা আমার খাতার একটা পৃষ্ঠায় গোটাগোটা অক্ষরে পেন্সিল দিয়ে চিঠি লিখতে বসে গেলাম। প্রথমেই আব্বা আমার শত কোটি সালাম নেবেন বলে শুরু করে খুলনা শহরে আমার আর থাকার ইচ্ছে যে নেই, তা জানিয়ে শেষ করলাম।
চিঠির কাগজটি চার ভাঁজ করে তার ওপরেই ঠিকানা লিখে পরের দিন হাসিকে সঙ্গে নিয়ে ফেলে এলাম লাল ডাকবাক্সে। এনভেলাপ বা কোনো খামে ঢেকে যে চিঠি পাঠাতে হয়, সে সবের কোনো ধারণাই ছিল না আমার। ঢাকায় আব্বার প্রেসের ঠিকানাটি যে মুখস্ত ছিল, তার কারণ হলো, স্কুল ছুটি হলেই গ্রাম থেকে আমি আর ছোটভাই সেলিম আব্বার কাছে এসে থাকতাম কিছুদিন। সেই সময়ে যদি কখনো হারিয়ে যাই, ঠিকানাটি বলে যেন ফিরে আসতে পারি, সে জন্যে আমাদের দু’ভাই বোনকে ভালো করে তা মুখস্ত করানো হয়েছিল। এই বয়সে অনেক কিছু ভুলে গেলেও মনে রয়ে গেছে আব্বার প্রেসের ঠিকানা—দ্যা বখশীআর্ট প্রেস, ৪/২ বাদামতুলি, সদরঘাট, ঢাকা।
এক সময় আমার ছোট্ট বাম হাতটি নিয়ে খেলা করতে করতে তার শিশ্নকে আমার হাতের মুঠোতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের হাতে আমার ছোট্ট হাতের ওপর চাপ দিতে শুরু করে দিলো। হঠাৎ করে ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ভ।
ডাক টিকেট ছাড়া চিঠিকে বিয়ারিং চিঠি বলে, সেটিও জানা ছিল না সেই বয়সে। চিঠির প্রাপক ডাকহরকরাকে ডাকটিকিটের যথামূল্য পরিশোধ করে তবেই চিঠি গ্রহণ করে থাকেন। আমার আব্বাও তাই করেছিলেন। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন এই ভেবে যে, তার ছোট্ট পুঁচকে মেয়েটি যে বাবাকে চিঠিও লিখতে পারে, সেই আনন্দ তাকে আপ্লুত করেছিল ভীষণভাবে। পরের দিনই তিনি প্রেসের সব কাজ ফেলে বাড়িতে চলে এসেছিলেন, খুলনা গিয়ে আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে যাবেন মনে করে।
এদিকে, প্রতিদিনই ‘বাড়ি যাব’ বলে বড়’পাকে খুব জ্বালাতন করতাম। রাগ করে ভাত খেতাম না। খালি পায়ে হাসির সঙ্গে খুলনা শহর চষে বেড়াতাম। বাধ্য হয়ে দুলাভাইকে বলে আপা আমাকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ট্রেনে, দুলাভাইয়ের একবন্ধুর সঙ্গে। তার বাড়িও আমাদের পাশের গ্রামে। আমাদের বাড়ি যাওয়ার পথিমধ্যে ‘ঘিওর হাট’ বলে একটা সাপ্তাহিক বড় হাট বসে। সেই হাটে গভীর রাত অবধি বিকিকিনি চলে। আমাদের প্রতিবেশী হাদু-বাদুর বাবা নিয়মিত আখের গুড় নিয়ে আসেন, এই হাটে বিক্রি করতে। তার হাতে তুলে দিয়ে দুলাভাইয়ের বন্ধুটি চলে যাবেন তার গন্তব্যের দিকে, এভাবেই সম্ভবত দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। যদিও যাত্রার আগ পর্যন্ত আমি কোনোদিন লোকটিকে দেখিনি।
তাতে কী?
দুলাভাইয়ের বন্ধু তো!
আমি বাড়ি যেতে পারছি, সেই আনন্দেই নবীন লতাটির মতো লক লক করছি ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ওঠে। খুশির জলস্রোতে ভেসে যাচ্ছি, বিভোর।
এখনো মনে আছে, ট্রেনটি খালিশপুর থেকে দুপুর নাগাদ ছেড়েছিল। পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত আটটা বেজে গিয়েছিল। সন্ধ্যা গড়াতেই দুলাভাইয়ের বন্ধুটি ট্রেনের বাংকারে গিয়ে শুয়ে পড়লো, আর আমাকে তুলে নিয়ে বসিয়ে রাখলো তার পাশে। এক সময় আমার ছোট্ট বাম হাতটি নিয়ে খেলা করতে করতে তার শিশ্নকে আমার হাতের মুঠোতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের হাতে আমার ছোট্ট হাতের ওপর চাপ দিতে শুরু করে দিলো। হঠাৎ করে ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ভ। বারবার হাতটি সরিয়ে আনতে চাই, তিনি আবারও আমার হাতটি নিয়ে অকুস্থলে ধরিয়ে দেন। দুই তিন বার এ রকম ঘটার পরে আমি বেশ জোরেই উড়িমুরি করাতে ছেড়ে দিলেন আমার হাত। রেগেমেগে তখন আমাকে নিচে নামিয়ে অন্য যাত্রীদের মধ্যে ঠাস করে বসিয়ে দিয়েই নিজে ওপরে গিয়ে পুনরায় শুয়ে রইলেন।
প্রথম এরকম একটি শিশ্নশরীরের ধাক্কায় মনের মধ্যে কেমন যেন অনৈতিক এক আবিলতার সৃষ্টি হলো, কিন্তু কী করে যেন ওই বয়সে মনে হলো, এই কথা কাউকে বলা যাবে না, এমনকি মাকেও না।
ট্রেন যথাসময়ে পৌঁছুলে আমাকে গুড়-বিক্রেতাদের কাতারে খুঁজে খুঁজে হাদুর বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো দুলাভাইয়ের বন্ধু পরিচয়ের ওই লোকটি।আমার সমবয়েসী হাদু-বাদু দুই ভাইকে দেখেই আমি পরম আপ্লুত। দু’জনেই আমার কাছাকাছি বয়েসী প্রায়। কিন্তু ওরা স্কুলে যায় না, আমি তখন স্কুলে যাই।
হাদুর বাবাও বিক্রিবাট্টা শেষ। অবশিষ্ট গুড়সহ হাঁড়িগুলো মোটা রশিতে পেঁচিয়ে বেঁধে নিজের মাথায় বড়টি, ছোট হাঁড়ি হাদুর মাথায় আর আনুষঙ্গিক তৈজসপত্র বাদু মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে পা চালিয়ে দিলো আগে আগে।
ওদের বাবাকে সাহায্য করতে প্রতি সপ্তাহে ওরাও যে হাটে আসে, আমি জানতাম না। ফলে ওদের দেখতে পেয়ে আমি খুশিতে প্রায় আত্মহারা। ওদের চোখে-মুখে তাকিয়ে যেন আমার আস্ত গ্রামটিকে দেখতে পেলাম। উত্তর পাড়ার যে পথে দৌড়ে দৌড়ে ওদের বাড়ি থেকে সময়ে-অসময়ে চারআনা পয়সা হাতে নিয়ে এক সের আখেরগুড় কিনে আনতাম, সেই সবুজ লতানো পথটি যেন বয়ে নিয়ে এসেছে দুই ভাই মিলেই। খুব আনন্দ হলো আমার। ওদের গায়ে যেন আমার জন্মভূমির মাটির গন্ধ ফিরে পাচ্ছিলাম, ঘরে ফেরার অর্ধেক আনন্দ উছলে পড়ছিল সে রাতের জ্যোৎস্নামুখর চাঁদের আলোয়। বড়’পার কিনে দেওয়া আমার হাতের ছোট্ট ব্যাগে রাখা চুলের ক্লিপ, লিপিস্টিক, ছোট্ট আয়নাসহ যা যা ছিলো আমি এক এক করে ওদের বের করে দেখাচ্ছি, মনে হচ্ছে এসব নতুন জিনিস দেখে ওরাও খুব বিস্মিত হচ্ছে। যখন আমার লাল লিপিস্টিকখানা বের করে দেখালাম, কিভাবে লিপিস্টিকের গোড়ায় হাতদিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওপরে তুলে এনে ঠোঁটে মাখতে হয়, তা দেখামাত্র দুভাইয়ে সে কী হাসি, হেসেই খুন।
হাসতে হাসতে হাদু মন্তব্য করলো, ‘অ্যা। এহাবারে গুঁড়ার দনের মতো রে বাদু।’
ওদের আদি অকৃত্রিম এই ভাষার ব্যবহার শুনে আমি যেন নিজের অজান্তেই লজ্জায় আনত হলাম। প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে খুলনাশহরে চিড়িয়াখানা দেখার গল্প বলতে শুরু করলাম। দুভাই মনোযোগ দিয়ে বিস্ফারিত নয়নে আমাকে দেখছে, আর সুদূর পরবাসথেকে আসা সুগন্ধময় আমার কথা শুনছে। ততক্ষণে হাটুরেদের শতকণ্ঠের কলরব যেন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও। হাদুর বাবাও বিক্রিবাট্টা শেষ। অবশিষ্ট গুড়সহ হাঁড়িগুলো মোটা রশিতে পেঁচিয়ে বেঁধে নিজের মাথায় বড়টি, ছোট হাঁড়ি হাদুর মাথায় আর আনুষঙ্গিক তৈজসপত্র বাদু মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে পা চালিয়ে দিলো আগে আগে।
আমারও অপেক্ষার পালা শেষ। পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলাম হাদু-বাদুর সঙ্গে। ছোট্ট দুপায়ে হেঁটে যাচ্ছি বিরামহীন, কখন পৌঁছাবো, জানি না তার কিছুই। কেবলি হাঁটছি ওদের পিছু পিছু। ওরাই আমাকে পৌঁছে দেবে মায়ের কাছে, সেই আশায় হাঁটছি—এর আগে আধা মাইল হেঁটে একবারই শুধু বৈশাখী মেলায় যেতে দিয়েছিলেন মা। সেটি ছিল আমাদের পাশের গ্রামে হিন্দুঅধ্যুষিত পাঞ্জোনখাড়া এলাকা। বিভিন্ন পালা-পার্বণে ওখানেই মেলা বসতো সাধারণত। সেই মেলায় গিয়ে বিন্নিধানের খই, চিনির হাতি-ঘোড়া, আর কিনেছিলাম বঙ্কুল ফলের মালা। সেই মালা যে গলায় পরার মালা নয়, সুমিষ্ট বন্য মজাদার ফল দিয়ে এমন সুহাসিনী মালা, মেলায় বিক্রি হয়, সেটিও প্রথম জেনেছিলাম ওই মেলায় গিয়ে। তালপাতার বাঁশি না কিনে পাঁচ ছিদ্রের আড়বাঁশি কিনেছিলাম ছোটভাই সেলিমের জন্যে। তবে আজও সেই বঙ্কুল ফলের মালার জন্যে মন পড়ে থাকে।
ভেতরে আব্বা আমাদের পাশে নিয়ে খেতে বসতেন, হৈচৈ করে আমরা খাওয়া শেষ করলে, তবে মা খেতে বসতেন। আব্বার অনুরোধে কখনো-কখনো মা আমাদের সঙ্গেই বসে যেতেন খেতে।
সব সময় শুনে এসেছি সাপ্তাহিক ঘিওয় হাট, অনেক দূরের পথ। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সব কিনতে পাওয়া যায় সেখানে।আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এবার ৩/৪ মাইল হাঁটা পথ। এত পথ হেঁটে কখনো যাইনি কোথাও। অভ্যেসও নেই। কেননা, বাড়ির আশপাশ ছাড়া দূরের কোনো আত্মীয় বাড়িতে হেঁটে যেতাম না কখনো।
আব্বা অপেক্ষা করতেন বর্ষাকালের জন্যে। বর্ষাকাল ছিল তার প্রিয় ঋতু। অবশ্যই খুবই প্রিয়। বর্ষাঋতুতে আব্বা আমাদেরসহ মাকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। মাসাধিক কালের জন্যে পানসি নৌকা ভাড়া করে আব্বা আমাদের নিয়ে বাস করতেন সদর ঘাটের বুড়িগঙ্গার জলের ওপর।
বাদামতলি থেকে আব্বার প্রেস কর্মচারীরা রান্না করে আমাদের প্রতিবেলার গরম খাবার দিয়ে যেতো নৌকায় তুলে। একজন কর্মচারী পানসী নৌকার ঘাটেই দাঁড়িয়ে থাকতো, কখন কী প্রয়োজন পড়ে মায়ের—সেই হুকুম তামিল করার জন্যে। ভেতরে আব্বা আমাদের পাশে নিয়ে খেতে বসতেন, হৈচৈ করে আমরা খাওয়া শেষ করলে, তবে মা খেতে বসতেন। আব্বার অনুরোধে কখনো-কখনো মা আমাদের সঙ্গেই বসে যেতেন খেতে।
জলভরা মেঘের খোলা আকাশের তলায় বিকেলে পানসি নৌকায় ছাদে বসে আব্বা নিমগ্ন হয়ে সেতার বাজাতেন, মা একমনে শুনে যেতেন ভাবুক শ্রোতা যেন এক।
এছাড়া প্রতিবছর গ্রামের বাড়ি এসে আব্বা বড় গয়নার নৌকা ভাড়া করে অপরাপর গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে ভালোবাসতেন খুব। বছরে একবার অন্তত আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর করার উদ্দেশ্যটিও নিহিত ছিল এই ভ্রমণ উদ্দেশ্যের অন্তর্জমিনে।
স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, ভাই-ভাবি-ভাতিজাদের নিয়ে আব্বা দীর্ঘ নৌকা ভ্রমণে বের হতেন প্রতিবছরই। ভাসমান জেলের খড়াজাল থেকে মাছ কিনে নৌকায় রান্না-বান্না হতো। আব্বা খুব উপভোগ করতেন উদার আকাশতলে জলের ওপরে বসে খাবার খেতে। শুকনা মৌসুমে একমাত্র বড়’পার শ্বশুর বাড়ি যেতাম ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে।
মায়ের সঙ্গে রাতটি কাটিয়ে আব্বা ভোর সকালেই গোয়ালন্দ হয়ে খুলনা যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন, সেই সোনালি সুপ্তিমাখা ভোর সকালেই সূর্যোদয়ের মতো পিতার বুকে উদিত হয়েছিল কন্যা।
উঁচু-নিচু-ভাঙা বেশুমার সেই দীর্ঘ পথে ঝাঁকি খেতে খেতে অকুলান হয়, তবে পৌঁছাতাম বড়’পার শ্বশুর বাড়ি। সকালে যাত্রা করে সন্ধ্যায় পৌঁছুতে হতো। কতবার যে গাড়ি থেকে নামতে উঠতে হতো, তার ঠিক ছিল না। বড়’পার মুখখানা দেখার পরে আমাদের সব ক্লান্তি চলে যেতো। অধিকন্তু বড়’পার হাতের চমৎকার লেবু শরবত খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে যেতো।
এইসব স্মৃতির দীপ জ্বালিয়ে সেই আলোতে ক্লান্তিবিহীন পথে হাঁটছি তো হাঁটছি। এই দীর্ঘ হাঁটার অভিজ্ঞতাও প্রথম। রাতটিও ছিল চমৎকার চন্দ্রাকৃত, জ্যোৎস্নায় সমুজ্জ্বল। আলু পাতা মাড়িয়ে চীনা-কাউনের পুষ্প ছুঁয়ে লাফিয়ে লাফিয় হাঁটছিলাম বাড়ির উদ্দেশে। কখন মাকে দেখবো, দরোজার খিল খুলে দিয়ে আমাকে দেখে কিভাবে চমকে উঠবেন মা, মায়ের মুখশ্রীর—সেই সব জাদুবাস্তবতা কল্পনা করতে করতে চাঁদের আলোয় পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম। শেষপর্যন্ত বাড়ি পৌঁছুলাম শেষরাতের কিনারে গিয়ে। হাদুর বাবা জোরে কড়া নাড়ায় ধড়মড় করে আব্বা-মা দু’জনেই উঠে পড়েছেন।
আব্বা খিল খুলে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছেন। হাদুর বাবা তার পেছনের আড়াল থেকে আমাকে আব্বার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেহেন মিয়া সাব কারে নইয়্যা আইচি।’
আব্বা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাকে বললেন, ‘দেখো, দিলুর মা আমার দিলু ফিরে আসছে, আমার দিলু ফিরা আসছে। এরপর মাও জড়িয়ে নিলেন বুকের মধ্যে। ঘিওর থেকে আমাদের যাত্রাপথের কাহিনী অল্প কথায় বর্ণনা করেই হাদুর বাপ তার পুত্রদের নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। মা আমার হাত-পা ধুয়ে খেতে দিলেন।
আব্বা, আমার বিয়ারিং চিঠি পেয়ে ঢাকা থেকে সেদিনই বাড়ি এসেছেন সন্ধ্যে বেলায়। কন্যা সন্তানের এক চিঠির আনন্দে উদ্বেলছিল মা-আব্বা দু’জনেই। মায়ের সঙ্গে রাতটি কাটিয়ে আব্বা ভোর সকালেই গোয়ালন্দ হয়ে খুলনা যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন, সেই সোনালি সুপ্তিমাখা ভোর সকালেই সূর্যোদয়ের মতো পিতার বুকে উদিত হয়েছিল কন্যা।
আহা! দুরন্ত শৈশব আমার!