ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বৃহত্তর ফরিদপুরের বিপ্লবীদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। বিশেষ করে অম্বিকাচরণ মজুমদার, পুলিনবিহারী দাশ, আশুতোষ কাহালী, পূর্ণচন্দ্র দাস, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, নগেন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, স্বামী প্রণবানন্দ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, আশু ভরদ্বাজ, সন্তোষ ব্যানার্জী, কালিপদ রায়চৌধুরী, শান্তি সেন প্রমুখ বিপ্লবীর কথা স্মরণে আনা যায়। মাদারীপুরের পূর্ণচন্দ্র দাসকে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ!
ভেদ করি পুন বন্ধ কারার অন্ধকারের পাষাণ-ফাঁদ!
এস অনাগত নব-প্রলয়ের মহা সেনাপতি মহামহিম!
এস অক্ষত মোহান্ধ-ধৃতরাষ্ট্র-মুক্ত লৌহ-ভীম!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!….
ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!
না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।
জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান আবিষ্কার করেছেন যে, এই কবিতা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগান চয়ন করেছেন। তো এই পূর্ণচন্দ্র দাস গঠন করেছিলেন ‘মাদীরপুর সমিতি’, ‘শান্তি সেনা’ প্রভৃতি নামে কয়েকটি গুপ্ত সমিতি। এই সমিতির সদস্যরা বিপ্লবী মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ব্রিটিশবিরোধী শসস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পূর্ণচন্দ্র তার ঘনিষ্ঠ তিনজন সহযোদ্ধাকে বাঘা যতীনের হাতে তুলে দিয়েছেন। চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত আর নিরঞ্জন দাশগুপ্ত নামের এই বিপ্লবীদের নিয়ে ১৯১৫ সালে বালেশ্বরে বুড়ি বালামের তীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী সম্মুখযুদ্ধে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন আর অন্য দুজন ধরা পড়ে ফাঁসির দড়িতে শহিদ হন। চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী (১৮৯৪ – ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫), মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত (১৮৯৮ – ৩ ডিসেম্বর, ১৯১৫), নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (ডিসেম্বর ১৮৯২ – ৩ ডিসেম্বর, ১৯১৫)—বাঘাযতীনের এই তিন শহিদের আত্মত্যাগের শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে ২০১৫ সালে। তাদের অবদানকে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে চাই।
এবার তাদের কয়েকটি ঘটনার কথা জানা যেতে পারে। ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে বড় লাটের আসার কথা। তার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন পুলিস ইন্সপেক্টর সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি নিরাপত্তার কাজ দেখভাল করার জন্য হেদুয়ার (আজাদ হিন্দ্ বাগ) কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন সেখানে চারজন সঙ্গী নিয়ে উপস্থিত হন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। মাথায় হুলিয়া থাকায় চিত্তপ্রিয় বেশ কিছুদিন ধরে ছিলেন পলাতক। পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাকে। আজ একেবারে পুলিশে নাকের ডগায় এসে পড়ায় পুলিশ কি আর ছাড়ে? সুরেশচন্দ্র দৌড়ে এসে চিত্তপ্রিয়কে ধরতে যায়। কিন্তু চিত্তপ্রিয় পকেট থেকে পিস্তল বের করে সুরেশচন্দ্রকে গুলি করে। গুলি লাগে সুরেশের বুকে। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় সুরেশচন্দ্র। সুরেশের সহযোগী পুলিশের চিত্তপ্রিয়কে ধরতে ছুটে এলে চিত্তপ্রিয়র সহযোগীরা পাল্টা আক্রমণ করে। তখন পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যায়। চিত্তপ্রিয়র সঙ্গীরা তখন দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এই আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল বাঘা যতীনের। চিত্তপ্রিয় তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেন।
১৯১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেন রিচে বার্ড কোম্পানির সাউথ ইন্ডিয়া জুটমিলের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য ঘোড়ার গাড়িতে যে টাকা আনা হয়, তাতে ১৮ হাজার টাকা ছিল। বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ৮ জন বিপ্লবী একজন পাঞ্জাবির ট্যাক্সিতে এসে গার্ডেন রিচ সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে অপেক্ষা করে। ঘোড়ার গাড়ি এখানে এলে তারা গোড়ার গাড়ি থামিয়ে টাকার থলে ছিনিয়ে নেয়। বিপ্লবীদের হাতে রিভলবার থাকায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। কিন্তু ট্যাক্সিচালক তার ট্যক্সি চলাতে অস্বীকার করলে তাকে পিটিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং পতিতপাবন ঘোষ ট্যাক্সি চালিয়ে নিয়ে যায়। বারুইপুর আসার পরে ট্যাক্সি নষ্ট হয়ে পড়লে তারা জয়নগর হয়ে পিয়ালী নদী পার হয়ে হানসনাবাদ দিয়ে কলকাতা ফিরে আসে। এই দলে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী ছিলেন।
১৯১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বেলিয়াঘাটার চাইলপট্টি রোডে ললিতমোহন বৃন্দাবন সাহার দোকানে এক ডাকাতি হয়। বাঘা যতীনের নির্দেশে এখান থেকে ২২ হাজার টাকা ডাকাতি করা হয়। বিপ্লবীরা টাকা নিয়ে ট্যাক্সি করে পালানোর সময় চালক ট্যাক্সি চালাতে অস্বীকার করে। তখন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীর রিভলভার দিয়ে চালকের মাথায় গুলি করে। আরেক বিপ্লবী পতিতপাবন ঘোষ তখন ট্যাক্সি চালিয়ে বেলিয়াঘাটার খালের কাছে পৌঁছে চালকের মরদেহ ফেলে দেয়। তারপর বিপ্লবীরা বৌবাজার ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিটে নিজের আস্তানায় পৌঁছান।
বাঘা যতীন তার সহযোগীদের নিয়ে পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের ৭৩ নং বাড়িতে থাকতেন। বিপ্লবী ফণিভূষণ রায়ের নামে এটি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়। ১৯১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাঘা যতীন ও চিত্তপ্রিয় ঘরে বসে পিস্তল পরিষ্কার করছিলেন। এমন সময় সেখানে নীরদপ্রকাশ হালদার নামের এক গুপ্তচর তাদের ঘরে ঢোকেন। তিনি বাঘা যতীনকে দেখে অবাক হয়ে বলেন, ‘যতীনবাবু আপনি এখানে?’ বাঘা যতীন তকখ চিত্তপ্রিয়কে নির্দেশ দেন, ‘মার’। চিত্তপ্রিয় রিভলবার টিপলেন। গুলি নীরদপ্রকাশের কণ্ঠ ভেদ করে চলে গেল। বাঘা যতীন আর চিত্তপ্রিয় তখন দ্রুত ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। নীরদপ্রকাশ তখন মরা যায়নি। অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল। চেতনা ফিরলে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে আসে। হাসপাতালে তিনি পুলিশের কাছে যে জবানবন্দি দেন, তাতে বাঘা যতীন ও চিত্তপ্রিয়র নাম থাকে। দুদিন হাসপাতালে থেকে নীরদপ্রকাশ মারা যায়। তখন তাদের নামে হুলিয়া জারি হয়, এবং ধরিয়ে দিতে পারলে আড়াই হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়।
বালেশ্বরের বিচারক ছিলেন ম্যাকফারসন আর ট্রাইব্যুনালের সদস্য ছিলেন কটকের উকিল রায়বাহাদুর নিমাইচরণ মিত্র এবং সাবজজ রায়সাহেব দয়ানিধি দাস। ৩ ডিসেম্বর ১৯১৫ তারিখে বালেশ্বর জেলে তাদের দুজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
চার্লস মার্টিন ছদ্মনাম ধারণ করে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এপ্রিল মাসে ব্যাটাভিয়া যান অস্ত্র সংগ্রহ করতে। থেয়োডোর হেলফারিক নামের এক জার্মান ভদ্রলোকের কাছে তিনি জানতে পারেন যে, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসএস মেভারিক নামের একটি জাহাজ ২২ এপ্রিল সানপেড্রো বন্দর ছাড়বে। এবং প্রচুর অস্ত্র নিয়ে তা করাচি পৌঁছবে। মার্টিনের চেষ্টায় ওই জাহাজ করাচির বদলে বাংলা আনার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯১৫ সালের ২৪ জুন মার্টিন দেশে ফিরে আসেন। এই জাহাজে ছিল তিরিশ হাজার রাইফেল, প্রত্যেক রাইফেলের জন্য ৪ শত রাউন্ড গুলি আর ২ লাখ টাকা। বাঘা যতীন, যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়, অতুলকৃষ্ণ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (মার্টিন) প্রমুখ বিপ্লবী সভা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, অই অস্ত্র হাতিয়া দ্বীপে, কলকাতায় আর বালেশ্বরে খালাস করা হবে। অই সভায় বেঙ্গল নাগপুর রেলপথ, ইস্টইন্ডিয়ান রেলপথ, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলপথের প্রধান সেতুগুলো উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং এই অস্ত্র হাতে পেলে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখলের পরিকল্পনা করা হয়। বালেশ্বরে মেভারিক ভেড়ার কথা বাঘা যতীন চলে যান বালেশ্বরে, তার সঙ্গী হন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত । জুন মাসের শেষ দিকে মেভারিক আসার কথা ছিল। কিন্তু ২২ জুন মেভারিক জাভাদ্বীপে আটকা পড়ে। এই কজাহাজের অস্ত্র যে বাংলার বিদ্রোহীদের জন্য আনা হয়েছে, তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। জাহাজ আটকের খবর বাঘা যতীনের জানা ছিল না। তারা জুন মাস শেষ হলেও জাহাজ না আসায় খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। এদিকে কলকাতা পুলিশ বিপ্লবীদের অফিসে হানা দিয়ে অনেককে গ্রেফতার করে। বাগা যতীন যে বালেশ্বর গেছেন, পুলিশ সেখানেও হানা দিচ্ছে। তাই বালেশ্বর থেকে কুড়ি মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে কোপ্তাগোদা নামক এক গ্রামে তিনি আশ্রয় নেন। তার সঙ্গে থাকেন নীরেন্দ্রনাথ ও মনোরঞ্জন। আর সেখান থেকে আরও ১২ মাইল দূরে তালদিহি গ্রামে আশ্রয় নেন চিত্তপ্রিয় ও জ্যোতিষ পাল।
পুলিশের তৎপরতা টের পেয়ে বাঘা যতীন তার সঙ্গীদের নিয়ে ময়ূরভঞ্জের পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু জ্যোতিষ পাল অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ছেড়ে যেতে চাইলেন না তিনি। ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর তিনি সেখানেই থাকলেন। এই সুযোগ পুলিশ তাদের কাছে এসে পড়ে। তাদের পিছু নেয় পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. ডেনহ্যাম, তার দুই সহযোগী মি. টেগার্ট ও মি. বার্ড। ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি সাহেবর বিপ্লবীদের ধরার জন্য পুলিশ নিয়ে অগ্রসর হয়। এদিকে বাঘা যতীন তার সহযোগীদের নিয়ে বুড়ি বালামের তীরে গোবিন্দপুর নামক এক গ্রামে পৌঁছেন। এখানে জেলে নৌকায় নদী পার হয়ে বালেশ্বর স্টেশনের কাছে এক জঙ্গলে আশ্রয় নেন। কিন্তু ওই জেলে গ্রামের দফাদারকে জানিয়ে দেয় যে অপরিচিত কয়েকজন ‘জার্মান’ লোক জঙ্গলের মধ্যে গেছে। গ্রামবাসী, দফাদার ও চৌকিদার তখন তাদের পিছু নেয়। বাঘা যতীন দুপুরের দিকে দামুদ্রা নামক এক গ্রামে পৌঁছান। আস্তে আস্তে গ্রামবাসীর ভিড় বেড়ে যায়। তখন তাদের ভয় দেখানোর জন্য বিপ্লবীরা কয়েকটি ফাঁকা আওয়াজ করেন। আওয়াজ শুনে তারা সরে গেলেও চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করে। জনতার হাত থেকে নিস্তার পেতে তখন মনোরঞ্জন গুলি ছোঁড়েন। চৌকিদার ও জনতা তখন পাল্টা আক্রমণ করে। মনোরঞ্জনের গুলিতে রাজ মোহান্তি নামের এক ব্যক্তি নিহত হয় এবং সুদান গিরি নামের একজন আহত হয়। জনতা ছত্রভঙ্গ হলে তারা জঙ্গলে ঢুকে পড়েন। তারা ময়ূরভঞ্জের রাস্তা পেরিয়ে সাঁতরে নদী পার হয়ে চসকন্দ নামক এক গ্রামের পাশের গভীর জঙ্গলে পৌঁছান। এই জঙ্গলে বেশ কয়েকটি উঁচু বাঁধ দেখে তারা এখানেই নিরাপদ মনে করেন। এদিকে জনতার সঙ্গে তাদের খণ্ডযুদ্ধের খবর পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট মি. কিবলি সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে জঙ্গলের দুই দিক ঘিরে আক্রমণ করে। এদিকে, না খেয়ে না ঘুমিয়ে এবং পথের ক্লান্তিতে পাঁচ বিপ্লবীই অসুস্থ। তবু আত্মসমর্পণ করার চেয়ে সম্মুখ যুদ্ধেই অবতীর্ণ হন তারা।
সেই দিনটি হলো ৯ ই সেপ্টেম্বর ১৯১৫। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত শতাধিক পুলিশের সঙ্গে পাঁচ বিপ্লবীর অসম যুদ্ধ। তবু বাঘা যতীন আর তার চার অকুতোভয় সহযোদ্ধার কৌশলে বেশ কয়েকজন পুলিশ নিহত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ বাহিনি পিছু হটে। বিপ্লবীদের গুলি শেষ হচ্ছে আর পুলিশের নতুন গুলি জোগান হচ্ছে। তবু তারা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যান। হঠাৎ পুলিশের একটি গুলি লাগে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীর বুকে। বাঘাযতীন এবার আরও অগ্রসর হয়ে পুলিসের ওপর গুলি ছুড়তে থাকেন। পুলিশকে এক পা-ও অগ্রসর হতে দেননি এই বিপ্লবীরা। হঠাৎ একটি গুলি লাগে বাঘা যতীনের উরুতে। গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীন তবু যুদ্ধ চালিয়ে যান।গুলিবিদ্ধ চিত্তপ্রিয়র বুকের ক্ষতস্থান বেঁধে দেওয়ার জন্য তাকে কোলে তুলে নিচ্ছেন, এমন সময় আরেকটা গুলি এসে যতীনের পেটে লাগে। এবার তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বাকি তিনজনও তখন ক্লান্ত-অবসন্ন। তাই বাঘাযতীন তখন সহযোদ্ধাদের যুদ্ধবিরতির আদেশ দেন, সাদা চাদর উড়িয়ে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। ইতোমধ্যে চিত্তপ্রিয় শহিদ হয়েছেন। আহত বাঘাযতীন জল খেতে চাইলে বিপ্লবী মনোরঞ্জন তখন কাছের নদী থেকে চাদর ভিজিয়ে জল এনে মুখে তুলে দেন। জ্যোতিষ পালও সুস্থ নন।
তিনটি খাটিয়া এনে এই তিনজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আর মনোরঞ্জন ও নীরেন্দ্রনাথ তখন অনেকটাই শক্ত থাকায় তাদের থানায় নেওয়া হয়। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে বাঘাযতীন বলেন, ‘প্লিজ, সি দ্যাট নো ইনজাস্টিস ইজ ডান টু দোজ টু বয়েজ, হোয়াটএভার ওয়াজ ডান, আই অ্যাম ফুললি রেসপনসিবল ফর দ্যাট’। যতীনের অতুলনীয় সাহস দেখে টেগার্ট সাহেব তাকে শ্রদ্ধা জানান। পরের দিন ১০ সেপ্টেম্বর বাঘা যতীন শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। আর বালেশ্বরে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে নীরেন্দ্রনাথ, মনোরঞ্জন ও জ্যোতিষের বিচার হয় ১ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর। নীরেন্দ্রনাথ ও মনোরঞ্জনের ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয় এবং জ্যোতিষের হয় দ্বীপান্তর। বালেশ্বরের বিচারক ছিলেন ম্যাকফারসন আর ট্রাইব্যুনালের সদস্য ছিলেন কটকের উকিল রায়বাহাদুর নিমাইচরণ মিত্র এবং সাবজজ রায়সাহেব দয়ানিধি দাস। ৩ ডিসেম্বর ১৯১৫ তারিখে বালেশ্বর জেলে তাদের দুজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এই তিন বিপ্লবীকে আমার সদ্যরচিত গানে শ্রদ্ধা জানাতে পারি।
মনোরঞ্জন, নীরেন্দ্রনাথ এবং চিত্তপ্রিয়
অগ্নিযুগের হে বিপ্লবী, তোমরাই স্মরণীয়॥তোমরা তো ছিলে বাঘা যতীনের বিপ্লবী সহযাত্রী
ময়ূরভঞ্জে জলে-জঙ্গলে কত বিনিদ্র রাত্রি
যুদ্ধ করেই কাটিয়ে দিয়েছ, অস্ত্র করেছ সঙ্গী
জান দেবে তবু হারব না তাতে, এই ছিল মনোভঙ্গি
দেশের জন্য তোমরা শহিদ- আজ তাই বরণীয়॥তোমরা গড়েছ গুপ্ত সমিতি—বুকে বিপ্লবী মন্ত্র
তোমরা ছিঁড়েছ গোলামির জাল—ব্রিটিশের যড়যন্ত্র।
তোমরা তো ছিলে মাদারীপুরের পূর্ণ দাসের শিষ্য
তোমাদের কথা জানে এই দেশ আর জানে গোটা বিশ্ব
তোমাদের খুনে স্বাধীনতা আসে—তাই যুগযুগ জিঁয়ো॥বিপ্লবী বীর, দেশের জন্য করেছ আত্মদান
শতবর্ষের পরেও আজকে গাই সেই জয়গান
তোমরা অমর, চিরভাস্বর বাঙালির ইতিহাসে
তোমাদের ত্যাগে বাঙালি আজকে স্বাধীনতা-সুখে হাসে
আজকে তোমরা গর্বিত এই জাতির শ্রদ্ধা নিও।
- মাদারীপুরের ইতিহাস পরিষদ আয়োজিত ‘ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে মাদারীপুরের সন্তান তিন বিপ্লবীর আত্মোৎসর্গের শতবর্ষ’ শীষর্ক স্মরণ সভায় পঠিত