বাঙালি যে বাকপটু এতে কোনো সন্দেহ নেই। হাঁটের হকার থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক—সবাই সুযোগ খোঁজে কথা বলার। কথা কম বলার শিক্ষা দিতেও হাজার বাক্যের খরচ করতে দ্বিধা করে না কেউ কেউ। চায়ের দোকানের আড্ডা, টিভির টক-শো কোথায় কথার কমতি আছে? কেউ প্রয়োজনে, কেউ অপ্রয়োজনে, কেউ পেশার খাতিরে, কেউ নেশার বসে; কথা বলতে যেন ক্লান্তি নেই কারও। হালের ফেসবুক দুনিয়া তো রয়েছেই খোলা। কেউ শুনুক, না শুনুক; অন্তত কেউ নিষেধ করে না। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে—এত কথার ভেতরও প্রয়োজনীয় কথাটি বলার মানুষ খুবই কম। অনেক ক্ষেত্রে কেউ-ই বলে না।
এই যে, কক্সবাজারের চকরিয়ায় গরু চোর সন্দেহে মা-মেয়েকে এক রশিতে বেঁধে নির্যাতন করা হলো, সেখানে একজন মানুষও ছিলেন না কথা বলার মতো? ওই গ্রামেও নীতিকথা বলার মানুষের অভাব নেই নিশ্চয়। চায়ের দোকানেও আড্ডা জমে। ফেসবুকে নীতিকথার স্ট্যাটাসও হয়তো দেয় ওই গ্রামের তরুণরা। কিন্তু দু’জন নারীকে নির্মমভাবে পেটানোর সময় কারও মুখে একটি কথা ফুটলো না! তাহলে কী হবে এত কথার ফুলঝুরি দিয়ে? এই ভেবে আপনি-আমিও চুপ হয়ে যাই। আসলে চুপ হয়ে যাচ্ছে পুরো জাতি। চোখসওয়া হয়ে গেছে সব। এই চুপ থাকার রহস্যও অবশ্য সবার জানা। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে কথা বলতে পারেন না এখন। অথবা কাজ না হওয়ায় অনেকের ইচ্ছেটাও আর অবশিষ্ট নেই।
উল্লিখিত ঘটনা থেকেই যদি শিক্ষা নেই পরবর্তী সময়ে কথা বলার ইচ্ছে বা সাহস থাকবে ক’জনের? গরু চোর আখ্যা দিয়ে মা-মেয়েকে বেঁধে পেটানো হলো, গ্রাম ঘোরানো হলো, শেষে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে নিয়ে আবারও পিটিয়েছেন চেয়ারম্যান হারবাং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম। স্থানীয়দের বক্তব্যে এমন খবরই প্রকাশ হয়েছে। যদিও চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম পেটানেরা কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, এ সময় তিনি এলাকায় ছিলেন না। স্থানীয় জনতা গরু চোর আটক করলে তিনি পুলিশ ও ইউএনওকে ফোন দিয়ে সহায়তা করেছেন। ফেসবুকে বলা হচ্ছে—‘মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন চেয়ারম্যান মিরানুল। ব্যর্থ হয়ে ক্ষোভের বশীভূত হয়ে তিনি এই ঘটনা ঘটান।’ ফেসবুকে ঘোরা কথাটির সত্য-মিথ্যা এখনো প্রমাণিত হয়নি। তবে পুরো ঘটনার পর্যবেক্ষণে চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততা স্পষ্ট।
চড়া গলায় শোনাবেন নীতিবাক্য। চুপচাপ আমরা তা শুনতে থাকবো। শুনতে শুনতে ভুলে যাবো—‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবাদটি প্রচলিত ছিল এই বাংলায়।
যে উদ্দেশ্যেই করুক তিনি অপরাধটি করেছেন। যদি মা-মেয়ে কথিত গরু চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেনও (এটিও প্রমাণিত নয়) তাদের এভাবে নির্যাতন করার অধিকার একজন জনপ্রতিনিধির নেই। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও চেয়ারম্যান অপরাধী। অপরাধটি চেয়ারম্যান ও তার লোকজন করেছেন প্রকাশ্যে। বহু মানুষের উপস্থিতিতে এমন একটি ঘটনা ঘটলেও এটি যে অন্যায়, এমন কথা বলার মানুষ একজনও পাওয়া যায়নি। তাৎক্ষণিক কেউ কথা না বললেও পরবর্তী সময়ে কেউ একজন ওই ভিডিও এবং ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করেন। এরপরই ছড়িয়ে পরে। সব শ্রেণীর মানুষই নিন্দা জানাচ্ছে এই ঘটনার। চেয়ারম্যানের এমন কর্মের বিচারও চাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্যাতনে জড়িত চেয়ারম্যান বা কাউকে আটক-গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং জেল হাজতেই রয়েছেন নির্যাতনের শিকার মা-মেয়ে। এই পর্যন্ত শেষ হলেও হয়তো কিছু মানুষ কথা বলার ইচ্ছে জিইয়ে রাখতে পারতেন। কিন্তু অভ্যাসবশত আমরা (বাঙালি) যখন ঘটনাটি ভুলে যাবো।
আমাদের সামনে যখন হাজির হবে অন্য কোনো হট-ইস্যু, আমরা মেতে উঠবো সেটি নিয়ে। তখন চেয়ারম্যান কোনো প্রকাশ ঝামেলা ছাড়াই শায়েস্তা করবেন ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া লোকটিকে (যদি শনাক্ত করতে পারেন)। নানা কায়দায় নির্যাতিত পরিবারটিকে নির্যাতন করে চলবেন নির্দ্বিধায়। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে এরচেয়ে ভয়াবহ নির্যাতন দেখে চুপ থাকার অভ্যাসটা রপ্ত করে ফেলবেন অন্যরা। এভাবে একে একে চুপ হয়ে যাবে বাকপটু জাতি। কারণ তারা জানে—‘কথা বলবে যে, দরজা বন্ধ করবে সে।’ কারণ তারা জানে—‘বোবার কোনো শত্রু নেই।’ তারা এও জানে—‘জ্ঞানীরা কম কথা বলেন।’ আর জাতির এই চুপ থাকার সুযোগে টক-শো দখল করবেন সাহেদরা। চড়া গলায় শোনাবেন নীতিবাক্য। চুপচাপ আমরা তা শুনতে থাকবো। শুনতে শুনতে ভুলে যাবো—‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবাদটি প্রচলিত ছিল এই বাংলায়।
লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক