বইমেলার মানুষ নিয়ে, বই নিয়ে, সাড়া নিয়ে সচরাচর কথা হয় বলে আমি ওসব নিয়ে বলব না ঠিক করেছি। আমার কথার বিষয়বস্তু হবে প্রকৃতি। বইমেলায় প্রকৃতি তার পেতে রাখা বুকের ওপর মানুষগুলোকে চলতে ফিরতে দিয়েছে, গৌরব করে বেড়াতে দিয়েছে, আর মিটিমিটি হাসছে সারাক্ষণ। প্রশ্রয়ী দাদুভাই যেভাবে নবীন নাতনিটার প্রগলভতা দেখে হাসে।
বইমেলায় পৌঁছুতে বরাবরই সন্ধ্যা হয়ে যায় আমার। অফিসের সময়সূচির সঙ্গে তাল রেখে সপ্তাহে দুই একদিন শুধু বিকালের সোনালি রোদ ওখানে আমি ধরতে পেরেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় ওই সময়টাই বইমেলায় শ্রেষ্ঠতম। সূর্য কোমল সোনালি যে আলোটা তখন ছড়ায় এর কোনো তুলনা ভুবনে নেই। স্টলগুলোর টেবিলে আধোঢালে সাজিয়ে রাখা বইগুলোয় সোনালি আলোর গুঁড়ো লেগে যায়। সবকটা মলাট সোনালি হয়ে ওঠে। স্টলগুলোর ভেতরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা মানুষের হাতগুলো সোনালি দেখায়। হালকা বাতাস যে বসন্তের মনে হয় ওটাও সোনালি হয়ে ত্বকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লোম মাথার ওপর শুয়ে থাকা চুল, প্রেমিকাকে জড়িয়ে রাখা শাড়ি প্রেমিকের পরে থাকা পাঞ্জাবি সব সোনালি করে দেয়। ওই বাতাসে শ্বাস নিয়ে ফুসফুসটাও আমার সোনালি হয়ে গেছে মনে হয়। উদ্যানের আমমুকুলগুলোর লাজহীন সুঘ্রাণ ফুসফুসের ভেতর আটকে থেকে আয়ু আমার বাড়াতে থাকে। কী যে ভালো লাগে!
ওই সময়টায় ধীর পায়ে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে গিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাতে খুব আনন্দ হয়। দুয়েকটা বাক্য যখন আমের মুকুলঘ্রাণের মতো ভালো লেগে যায় সোনালি বসন্তের মতো ভালো লেগে যায় তখন ওসব বাক্যধারী বই আমি হাতে রাখি। ওগুলো আমার চাই। কোনো কোনো বই হাতে তুলে নিয়ে দাম দেখে মনটা খারাপ করে আবার রেখে দিতে হয়। খুব খারাপ হয়ে যায় মনটা তখন। প্রতিজ্ঞা করি যেভাবে হোক নিজেকে বেচে কি বন্ধক রেখে ওই বই আমি জোগাড় করব। কয়েক পা পিছিয়ে এসে প্রকাশনীর নামটা দেখে মনে রাখার চেষ্টা করি, ভরসা রাখি মগজের ওপর।
মগজ বিশ্বাসঘাতকতা করে। মেলা থেকে বেরোলেই সব ভুলে যাই। শুধু সোনালি আবেগের রেশ অনুরাগবসন্তের হাওয়ায় মিশে চুল ওড়াতে থাকে। আমার ভারি আনন্দ হতে থাকে আবার। মেলা থেকে বের হয়ে হাসতে হাসতে কিছুক্ষণ পিচকালো রাস্তায় হেঁটে বেড়াই। মানুষ দেখি। কিছুক্ষণ বেড়িয়ে মেলায় ঢুকে পড়ি। এভাবে বারবার। ভাবি, মেলাটা শেষ হয়ে গেলে আমি বাঁচব কী করে?
মাঝে মাঝে মন খারাপ করা অনেক কথা ধারালো অস্ত্র হয়ে আমাকে আঘাত করে, অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। গোপন আগুনে শত শত বই পোড়ানো, অভিজিৎ রায়কে পুলিশের সামনে হত্যা, আবারও অগ্নিসংযোগ, মেলাপ্রাঙ্গণে অনাহূত অনাকাঙ্ক্ষিত চক্রের আস্ফালন, গোপন খর দৃষ্টিতে মেধা চিহ্নিত করে বাতাসে মিশে যাওয়া, ধারক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির মন খারাপ করা ভাষ্য, নৈতিক অবস্থান আমার সুখানুভূতিগুলো নষ্ট করে দেয়। আমার শরীর মন তখন কুঁকড়ে আসে। আমার শান্তি স্বস্তি আনন্দগুলো একটা মোটা কালো কাপড় দিয়ে যেন কেউ ঢেকে দেয়। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। প্রাণের এই মেলা তার তত্ত্বের জায়গা থেকে শেলফের যে উঁচু তাকে অবস্থান করছে ওখান থেকে এটাকে নামাতে কেউ পারবে না। তবু এর জোর প্রচেষ্টা! কি ব্যক্তিক কি প্রাতিষ্ঠানিক স্তর থেকে চলছে তো চলছেই দেখতে পাই। ভাবি আর ছটফট করি। দেখি প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
বইমেলার অলিতে গলিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কী মনে হতেই সিদ্ধান্তে এলাম— মূলত সন্ধ্যা নামায় ওই গাছেরা। সূর্য ডুবতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ওরা লুকিয়ে রাখা প্রাকৃতিক অন্ধকারটুকু ডালপালা থেকে ঝরে যেতে দেয়। ঝরতে থাকা অন্ধকার তাই মাটির কাছটা প্রথমে আঁধার করে ক্রমশ ওপরে উঠতে উঠতে আকাশটাকেও আঁধার করে তোলে। পরিদিন যখন সূর্য উঠবে গাছের পাতাগুলো সমস্ত অন্ধকার শুষে নিয়ে ফের বদ্ধ করে রাখবে নিজের ভেতর। এই প্রতীকী লুকোচুরি ভালো খারাপের সমতাবিধানসূত্রের সঙ্গে জড়িত। এই গাছগুলো প্রাকৃতিক রহস্যের সাক্ষী লোকরহস্যের সাক্ষী। ভীষণ রকম একরোখা ওরা মানুষকে অনুমান করতে দেয় বড়জোর। জানতে সহজে দেয় না। রহস্যের পাহারাদার গাছগুলো সারা বইমেলা জুড়ে আছে। কি বিরুৎ কি গুল্ম কি বৃক্ষ সব ধরনের। আমি হঠাৎ কোনো এক বৃক্ষের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। বসন্তকাল তো মাত্র এসেছে। শীত শীত ভাবটা চলে গিয়েও যায়নি এখনও। যেটুকু আছে সেটুকু এর মিষ্টতা দিয়ে বলতে চাইছে—আমিও যে ছিলাম, ওহে ওহে তোমাদের প্রিয় জীবনের মতো সত্য অথচ সদা পলাতক এই আমিও যে ছিলাম!
বৃক্ষগুলো পাতা ঝরিয়ে দিচ্ছে। ওরা বিজ্ঞান বইয়ের পত্রপতনশীল বৃক্ষ। খয়েরি সবুজ ধূসর কালো ওই পাতা। মুড়মুড়ে পাতাগুলো নাচতে নাচতে ঘুরতে ঘুরতে কোনোটা কোনোটা দুলতে দুলতে মাটিতে পড়ছে। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো শিশিরকণার মতো দুর্বল তরঙ্গবন্ধু অসংখ্য পাতা তিরতির ঝিরঝির করে পড়ছে তো পড়ছেই। ল্যাম্পোস্টের হলুদ আলোয় দেখি ওরা পড়ছে, কৃত্রিম চাঁদসাদা আলোর মধ্যে দেখি ওরা ঝরছে। আর প্রকৃতির অদৃশ্য সম্মার্জনী হাওয়া ওদের একবার এদিক থেকে সেদিকে নিয়ে যায় তো আরবার সেদিক থেকে এদিকে নিয়ে যায়। ওহ, কি দৃশ্য! মেলার অতিপ্রাকৃতিক ওই দৃশ্য দেখে আমার মনটা একেবারে স্থায়ীভাবে ভালো হয়ে যায়। পরদিন আমি আবার মেলায় যেতে পারি, আমি আবার স্টলে স্টলে ঘুরে ঘুরে বই দেখতে শুরু করি। স্টলের ওপারে সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে থাকা হাসতে থাকা মানব মানবীদের আমার ভীষণ সুন্দর মনে হয় ভীষণ আপন মনে হয়।
রমনা কালীমন্দিরের পকেটদরজা দিয়ে ঢুকে দেখি হাতের ডানে চাওয়ালা ব্যাটা জমিয়েছে বেশ। অনেক মানুষ ওখানে আনন্দ কিনছে। অন্ধকার এক কোণে দাঁড়িয়ে আমি জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকি আর চায়ে বেড়ালের মতো চুমুক দিই। এমন এক প্রিয় অন্ধকারে আমি দাঁড়াই যে আমাকে কেউ দেখতে পায় না অথচ আমি সবাইকে দেখতে পাই। চা পান শেষে বইমেলার আলোর স্বর্গে আমি সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলি। একবার এদিক যাই আরবার ওদিক। বন্ধুদের পেলে আমি জড়িয়ে ধরি। বলি, আরে বন্ধু ভালো আছিস? এই তো রে আমি আছি, তা বেশ, শোন শোন, আমি একটু ঘুরে আসছি বুঝলি, তুই তো আছিস আরো, তাই না? হাহাহা, সেই ভালো, সেই ভালো!
কেন সরে আসি যদিও বচনাতীত ভালো ওদের আমি বাসি? মেলায় আমার মগ্নতাকে আমি যে জাগিয়ে রাখতে চাই! এটাই কারণ। বইমেলা আমার কাছে স্বর্গ আমার কাছে বেহেশত। মনে খুব বড় একটা ব্যাপার নিয়ে ছোট্ট একটা আশা রয়েছে আমার। যেদিন প্রকৃতিতে মানুষ হয়ে শেষ নিঃশ্বাসটুকু ফেলবো সেদিন বইমেলার প্রাজ্ঞ এই আলো ঝলমলে স্বর্গে যেন আমি থাকি। আমাকে ঘিরে থাকবে প্রিয় বন্ধুরা যাদের কাছ থেকে মিষ্ট যৌবনে আমি পালিয়েছিলাম। (বুঝতেই পারছেন যৌবনেই মরতে আমি চাই না, আমি বার্ধক্যকে বুঝতে চাই, লেখায় ধরে যেতে চাই) সেদিনও ওদের বলব, এইতো রে, আমি একটু ঘুরে আসছি বুঝলি, তোরা তো আছিস আরও, তাই না? হাহাহা, সেই ভালো, সেই ভালো।