এবারের বইমেলায় আপনার বই প্রকাশিত হচ্ছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
না, এ মেলায় আমার কোনো বই আসছে না। ভেবে দেখলাম প্রত্যেক বছর বই প্রকাশ করা ঠিক না। যে বই আগের মেলায় বেরুলো সে বই নিয়েই পাঠক একটু রসঘন হোক, পাঠঘন হোক। লেখকও তাঁর বিষয় পরিবর্তন করুক, ভাবুক। এটা দরকারি।
সারাবছর লেখক প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। বইমেলা কেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সারাবছরই টুকটাক বই প্রকাশিত হয়, তবে তা বইমেলার মতো সরগরম অবস্থায় নয়। এই মেলায় অনেক মানুষের আগমন ঘটে, তাদের উপস্থিতি থাকে। একটি কেন্দ্রে প্রায় সব প্রকাশনীর বই পাওয়া যায়। পাঠক না কিনুক, কিন্তু নতুন বইয়ের প্রতি তার একটি আলাদা আকর্ষণ থাকে। সে নেড়ে-চেড়ে দেখে বইটি। এই কারণেই লেখক, প্রকাশকরা প্রতিয়োগিতায় নামেন। এখান থেকে কতটি গুণগতমানের বই বেরুলো তা মেলা শেষে লেখক, পাঠক জেনে যান। আরও জানেন, যে আশা নিয়ে তারা বই প্রকাশ করলেন তা পূরণ হলো কি হলো না। বই বিক্রি হলো কি হলো না। লেখককে আরও ভালো লিখতে হবে। কেউ কেউ হতাশ হয়ে লেখা ছেড়ে দেন। অনেক শিক্ষাই আসে লেখক ও প্রকাশকের।
এখন যে পাঠক তারা কিন্তু মৌলিক বইয়ের থেকে সমালোচনার বইয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে। অন্যরা কী আলোচনা করলো, কী বই নিয়ে আলোচনা করলো, এ পড়েই বিজ্ঞ হচ্ছে বর্তমানের অনেক পাঠক। তারা মূল বইয়ের কাছে কম যায়। তারা পড়ে লোকমুখে। আড্ডায় হোক বা অন্য কোনো পথে শোনা কথায় তারা তৃপ্ত থাকে সাহিত্য বিষয়ক জ্ঞানে। হুমায়ুন আজাদ, আহমাদ মাযহার, আহমদ ছফা, আহমদ শরীফ প্রমুখ কার কার সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন, অনেক পাঠক আছে কেবল সেটুকুই জানেন। তাঁরা যদি বাংলাদেশের সব লেখক নিয়ে আলোচনা করতেন তাহলে ওই শ্রেণীটাও জানতো প্রত্যেককে। নিজে কষ্ট করে মূল টেক্সটা পড়তে তাদের আলসেমি। তবে এর ভেতরেও অনেকেই পড়েন, তারাই রিয়্যাল পাঠক। বইমেলা কেন্দ্রিক না হয়ে আমাদের সারাবছরের প্রকাশক ও লেখক হওয়াটাও জরুরি।
একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। বইমেলার প্রভাব বাংলাদেশের সাহিত্যে বেশি না হোক, কম হলেও আছে। এই মেলাকে ঘিরেই যেমন ফেলে দেওয়া কিছু বই আসে, তেমনি আসে দরকারি বইগুলোও। এই মেলাতেই দেখতে পাই শত ধরনের বই। আমরা পাই শত ধরনের পাঠক। মেলায় পুরস্কারও দেওয়া হয়। এই পুরস্কার ভালো বই প্রকাশের জন্য। প্রকাশকও চেষ্টা করেন তার স্টলে ভালো বই আসুক। লেখকও চায় ভালো বই পাঠককে দিতে। পাঠকও চায় এমন বই যা পড়ে সে তৃপ্তি পাবে। এই যোগসূত্রের ভেতর দিয়ে আমাদের সাহিত্য এগিয়ে যাচ্ছে। যাবে।
একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
তরুণরা বই বের করতে গিয়ে যে ‘ছেঁচড়ানি’ খায় তাতে উৎসাহের বদলে অনুৎসাহই ঝুলিতে বেশি থাকে। তবে এ সত্ত্বেও অনেকের বই বাজারে আসছে। তরুণদের উৎসাহিত করতে পারে প্রকাশক, পাঠক ও কর্তৃপক্ষ। প্রকাশক তার বইয়ের পাবলিসিটি করবে। পাঠক কিনবে বই। কতৃপক্ষ একটি নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তে আসবে। এ পথেই একজন তরুণ উৎসাহিত হতে পারে তার পরের পদক্ষেপে।
প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষযটাকে আপনি কী ভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
কোনো কিছু নীতিতে বেঁধে দিলে তা আর যাইহোক শিল্প হতে পারে না। এই বাঁধা-বাঁধি না করে লেখককে ভেবে চিন্তে আগাতে হবে। একটি বই প্রকাশিত হলে অনেক আনন্দ ভেতরে জমা হয়। সেই আনন্দ যেন নিজেকে পড়ে নতুনভাবে প্রকাশের জন্য সঞ্চারিত হয়। সংখ্যা গুরুত্ব পাওয়ার কোনো বিষয় নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ সংখ্যায় খুব বেশি বইয়ের স্রষ্টা নন। কিন্তু তাঁরা বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েই সাহিত্যে জেগে আছেন। আমাদেরও এ দিকটি খেয়ালে রাখতে হবে। একমাত্র লেখকই নিজের ভেতর নীতিমালা তৈরি করে নিজেকে, নিজের গুণগতমানকে উন্নত করতে পারে। তবে এটি ঠিক যে, আমরা যাদের লেখা সারাবছর কোনো পত্রিকায় দেখি না, দেখি সে বই বের করে ফেলেছে। তাদের টাকা আছে, বই বের করছে। তার পরিবার, কলিগরা কিনছেও। আবার কারোটা কিনছে না। নিজের একটা ভাবও বৃদ্ধির বিষয় থাকে এখানে। ভাবটি এমন যে, মেলায় তার বই এসেছে। অনেককেই বলতে পারছে। ক্রেডিট নিচ্ছে। এটি প্রকৃত সাহিত্যচর্চা নয়। পাঠকও বোঝে সেসব।