ওমর খৈয়ামের কথা ধার করে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ‘রুটি ও মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা-যদি তেমন বই হয়।’ তেমন একখানা বই নয়, ডজন-ডজন বই সঙ্গী হয়ে এসেছে আমার এবং এখনও সে ধারা অব্যাহত আছে। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে নানা আয়োজন—মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, খেলাধূলার সঙ্গী, সাঁতারের সঙ্গী, রাখাল-বন্ধু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সতীর্থ, প্রেমিকা, সহকর্মী, জীবনসঙ্গী, সন্তান, হিতাকাঙ্ক্ষী, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং এমন আরও কত জন! আর আছে প্রকৃতি—সঙ্গে নিয়ে আকাশ-বাতাস-সমুদ্র-নদী-বনভূমি-সূর্য-তারা-গ্রহ-চাঁদ এবং অসংখ্য প্রাণী। এদের কারুর সঙ্গই গুরুত্বহীন নয়; কারও অবদানই খাটো নয়। মানুষের নিকট মানুষের সঙ্গ—এর সঙ্গে তো অন্য কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। আমার জীবনে মানুষের পরে তিনটি বিষয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে শুরু থেকে আজতক। প্রকৃতির অজস্র উপাদান-উপকরণের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ও সবচেয়ে নিবিড় সঙ্গী হচ্ছে নদী; আর মানব-সৃষ্ট সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিবিড় ও নিত্য সঙ্গী হচ্ছে বই এবং সঙ্গীত।
বই কেন এত গুরুত্বপূর্ণ—তার ব্যাখ্যা তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মনীষী দিয়েছেন। শুরুতেই আমরা ওমর খৈয়ামের অভিমত জেনেছি। একজন মানুষের জন্য এই ছোট পৃথিবী অনেক বড় একটি স্থান। আর মহাবিশ্ব তো বিরাট—যে কোনো মানদণ্ডেই। কিন্তু মানুষ ইচ্ছা করলেও তার একজীবনে সমগ্র পৃথিবী অথবা তার অর্ধেকও পরিভ্রমণ করে দেখতে পারে না। ক’জনের সুযোগ হয় সমুদ্র বা মাঝ-সমুদ্র দর্শনের? ক’জনের সুযোগ হয় নায়াগ্রা জলপ্রপাত বা আফ্রিকার বনভূমি দেখার? ক’জন দেখেছে পিরামিড/তাজমহল/আইফেল টাওয়ার/চীনের মহাপ্রাচীর/অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহো/সাহারা মরুভূমি/হিমালয় পর্বত/নীল নদ/আমাজন নদী/সাইবেরিয়া হিমভূমি! এক পৃথিবীতে কত ভাষাভাষী মানুষের বসবাস! কত ধর্ম-বর্ণ-আকৃতির মানুষের বসবাস! কত সভ্যতা! কত সংস্কৃতি! কত কীর্তি! কত ধ্বংস! কত ইতিহাস! কত কিংবদন্তী! কোনো মানুষের পক্ষেই সশরীরে এতকিছু দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু বই পড়ে ঘরে বসেই পৃথিবীর বহুকিছু দেখা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের ‘ঐকতান’ কবিতায় আমরা এমত ভাবনার চমৎকার কাব্যরূপ দেখি:
বিপুলা এ পৃথিবীরে কতটুকু জানি!
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী—
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে—
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।
জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষলব্ধ ধনে।
আমার বই পড়ার পেছনে কারণটি আরও ব্যাপক ও বিচিত্র। আমার বাবার ছিল বই পড়ার দুরন্ত নেশা। মাঠ থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বসে পড়তেন বই নিয়ে; শরীরে না কুলালে শুয়ে শুয়ে পড়তেন তার বিভিন্ন প্রিয় বই। মা মাঝে মাঝে বারণ করতেন। কিন্তু নেশার টান তো কোনো বাধাই মানতে চায় না। তাছাড়া সেটাই ছিল তাঁর অবসর-যাপন। আমার রক্তে সেই গ্রন্থপাঠনেশা; সেই আবসর-উদ্যাপন অভ্যাস। তার সঙ্গে আরও নানা কারণে বই পড়া—অজানাকে জানার আগ্রহ, হতাশা, একাকীত্ব, সিদ্ধান্তহীনতা, বঞ্চনা, প্রেম—এক এক সময় এক এক কারণ বই পড়তে প্ররোচনা জুগিয়েছে।
বই পড়ার জগতে আমাকে প্রথম পাগল করেছিল ‘আরব্য উপন্যাস’। অত্যাচারী এক খেয়ালি বাদশাহ আর সেই বাদশাহর তলোয়ার থেকে এক যুবতীর নিজেকে বাঁচানোর এবং নারীজাতিকে রক্ষার দুঃসাহসী প্রাণপণ চেষ্টা! একটির পর একটি রোমাঞ্চকর ভয়াল কাহিনী! শেষ হয়েও শেষ না হওয়া! দম বন্ধ হয়ে আসে ভয়ে—শিহরণে-উত্তেজনায়-রোমাঞ্চে! মগজ ও শিরার অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে অতঃপর সবশেষে সেই যুবতীর হাতে অভাবিত সাফল্য! ‘আরব্য উপন্যাস’ পড়েই প্রথম শিখেছিলাম: ‘সৌভাগ্যের দ্বার খোলা অনিবার/আছে সকলের তরে/ উদ্যোগী যে জন/ কর্মপরায়ণ/ প্রবেশিতে সেই পারে।’
অতঃপর শরৎচন্দ্রের উপন্যাস—গিলে খাওয়া একটার পর একটা। মনে গভীর দাগ কেটে বসে, ‘দেবদাস’ এবং ‘দত্তা’। কিন্তু যাযাবর এর ‘দৃষ্টিপাত’ মনের মধ্যে সৃষ্টি করে ভালো লাগার নতুন রেকর্ড। আহা, বেচারা আধারকার! তার জন্য আজও মুষড়ে ওঠে মনটা। শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-স্থাপত্য-ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে যাযাবরের গভীর, নিবিড়, সূক্ষ্ম ও পক্ষপাতমুক্ত অভিজ্ঞান মুগ্ধ করে রেখেছিল আমার মনকে বছরের পর বছর। জানি না, কবে প্রথম যৌবনে পা পড়েছিল আমার। শুধু মনে আছে, প্রথম যৌবনের কোনো একদিন হাতে আসে নিমাই ভট্টাচার্য্যের ‘মেমসাহেব’। এক নিশ্বাসে পাঠশেষ। আমার আবেগ ও ভাবনার নদীতে এমন জোয়ার তোলে সেই ‘মেমসাহেব’ যে, আমি মনেমনে পণ করে বসি—মেমসাহেবের মতো কোনো নারী হবেন আমার প্রেমিকা এবং প্রেমিকা থেকে সারাজীবনের জীবনসঙ্গী। সুদূর সে পরিকল্পনা কোনোদিনও মুখ দেখেনি বাস্তবতার। বাস্তবতা তো স্বপ্নের প্রতিপক্ষ হতেই অভ্যস্ত বেশি। কিন্তু ‘মেমসাহেব’-এ পড়া সেই নারী বহুদিন দখল করে রেখেছিল আমার মুগ্ধভাবনার প্রাতিস্বিক জগৎ। অবশ্য আমার জীবনসঙ্গীনিকে তার নানাভাই ‘মেমসাহেব ‘বলে ডাকতেন তার ছোটকাল থেকেই। সে হিসেবে ঘরেই আমার ‘মেমসাহেব’। প্রসঙ্গত একটা ঘটনার কথা বলি।
একসময় এক বিদূষী মানবীর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কবিতা ও সঙ্গীত নিয়ে আমাদের কেটে যেতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একদিন তর্ক দুজনের মধ্যে। ঠিক হলো—সে জিতলে তাকে আমি কিনে দেবো আমার প্রিয় ‘মেমসাহেব’ বইটি; আর আমি জিতলে আমাকে সে কিনে দেবে এম আর আখতার মুকুলের তখন সদ্য-প্রকাশিত ‘কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ নামক একটি বই। আমি জিতলাম। পেলাম ‘কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ নামের অসাধারণ বইটি। বইয়ের একস্থানে সে লিখে দিলো, ‘প্রভূত আনন্দদায়কেষু আমিনুলের কাছে তর্কে হেরে—হেরে যাবার স্মৃতিস্বরূপ তাকে দেওয়া হলো কাঙ্ক্ষিত বইটি।‘ বইটির উৎসর্গপাতার ওপরের দিকে সে লিখল একটি উদ্ধৃতি—Some books are to be tested; others to be swallowed; and some few to be chewed and digested. আমাকে দেওয়া বইটি to be chewed and digested ধরনের ছিল। বইটি পড়ে সে সময় আমার নিকট ইতিহাসের অনেক অন্ধকার গলি আলোকিত হয়ে উঠেছিল। আজ ২৭/২৮ বছর যায়। বইটি সযত্নে রয়ে গেছে আমার সংগ্রহে। এটি একটি আনন্দিত অভিজ্ঞতার অমূল্য সঞ্চয়।
একদিন ‘মেমসাহেব’-কে হটিয়ে সেই স্থান দখল করে নেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর দুধে-আলতায় ধোয়া ‘শবনম’। শবনমের প্রেম একইসঙ্গে রোমান্টিক ও রোমাঞ্চকর। আফগানিস্তানের জনহিতৈষী ও জনপ্রিয় বাদশাহ আমানুল্লাহকে সিংহাসনচ্যুত করতে ব্রিটিশদের দীর্ঘ ষড়যন্ত্র, গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ পরিবেশ আর সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে নায়ক ‘মজনুন’ আর নায়িকা ‘শবনম’ এর দুঃসাহসী দুর্দান্ত প্রেম, শবনম-মজনুন এর অনুপম সুন্দর কথোপকথন, এবং সর্বোপরি দুরন্ত আশাতাড়িত এক ট্রাজিক উপসংহার উপন্যাসটিকে বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠতম রোমান্টিক উপন্যাস হওয়ার গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করে রেখেছে। দুজনের পাগলপারা মেলামেশার পর্যায়ে নায়িকার মুখের, ’আমার মিলনে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না।’ এবং বিচ্ছেদের ঘ্রাণ আঁচ করতে পারা অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ‘আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না।’— উক্তি পাঠকের মন ও ভাবনাকে পাগল করে দেয়। আহা ‘শবনম’! পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ প্রচুর আনন্দলাভ ও ভালো লাগার কারণ হয়েছে আমার গ্রন্থপিপাসু মনের কাছে। আমার প্রথম বইটি লীনাকে উৎসর্গ করে ‘শেষের কবিতা’ থেকে ধার নিয়ে লিখেছি—‘যে আমারে দেখিবারে পায়/ অসীম ক্ষমায় ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি।’ আর একইসূত্রে পঞ্চম কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছি, ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’।
_________________________________________________________________________________________________
সমস্ত পৃথিবীর ভাষা, কবিতা, গল্প, রূপকথা, প্রবাদ, কিংবদন্তী, সাহিত্য—যেন আনন্দের আড্ডা আর নান্দনিক রসের মাহফিল বসিয়ে রেখেছে ‘দেশে বিদেশে’-এর পাতায় পাতায়। আর ওরহান পামুকের ‘ইস্তানবুল’ পড়ে মনে হয়েছে, আকাশ-পাতালব্যাপী ছড়িয়ে-থাকা একটি ঐতিহাসিক মহা-শহর তার যাবতীয় গভীরতা ও গাম্ভীর্য, প্যাসন ও পবিত্রতা, রুচি ও বিকৃতি, সুস্থতা ও অসুখ, মায়া ও নির্মমতা, ঐতিহ্য ও বর্তমান, মিথ ও বাস্তবতা, অতীত ও ভবিষ্যৎ—এই সব সহকারে উঠে এসেছে এক মহান লেখকের মহাকলমে যার কোনো তুলনা বইয়ের জগতে নেই।
_________________________________________________________________________________________________
লেখক হিসেবে আমার প্রধান কাজ কবিতা রচনা করা এবং তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ ব্যাপক কাব্যপাঠ। বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি, ফরাসি, আরবি, উর্দু, ল্যাটিন আমেরিকান—ইত্যাদি বহু ভাষার বিখ্যাত কবিদের কবিতার একটা বড় অংশই পড়া হয়ে গেছে আমার, যদিও অপঠিত অংশটাই অনেক বেশি বড়। জালাল উদ্দিন রুমীর ‘মসনবী’, ওমর খৈয়ামের ‘রুবাইয়াৎ’, হাফিজের ‘দেওয়ান’, র্যাবো ও শার্ল বোদলেয়ারের শ্রেষ্ঠকবিতা, টিএস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’, ইকবালের ‘শেকওয়া’ ও ‘জওয়াবে শেকওয়া’, ইমরুল কায়েসের শ্রেষ্ঠ কবিতারাজি, কহলিল জিবরানের ‘প্রফেট’সহ প্রায় সব কবিতা, জন কীটসের শ্রেষ্ঠ কবিতা, শেক্সপিয়ারের কাব্যনাটকসমূহ পড়ার সুযোগ হয়েছে; আর বাংলা ভাষার প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ কবির কবিতা একাধিকবার পড়েছি। কিন্তু আমাকে যদি অপশন দেওয়া হয় যে— আমি শুধু দু’জন কবির ‘কবিতাসমগ্র’ নিতে পারব, তবে নির্দ্বিধায় নেব জীবনানন্দ দাশ ও আল মাহমুদ—এই দুজনের কাব্যসমগ্র। অতঃপর সুযোগ থাকলে নেব শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ সম্পাদিত বিদেশি কবিতার সংকলন ‘সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত’ এবং বুদ্ধদেব বসু অনূদিত ‘শার্ল বোদলেয়ার ও তার কবিতাসমূহ’, ওমর খৈয়ামের ‘রুবাইয়াৎ’ এবং রুমীর ‘মসনবী’। আর যদি প্রবন্ধের বই নিই তবে নেব— বুদ্ধদেব বসু,অন্নদাশংকর রায়, সৈয়দ আলী আহসান ও আহমদ ছফার প্রবন্ধের বইগুলো। সঙ্গে থাকবে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’।
অবশ্য গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইটির প্রতিও লোভ আছে আমার। সাহিত্যের মানুষ হিসেবে সাহিত্যের বইয়ের প্রতিই ঝোঁক বরাবর বেশি আমার। বিশেষ করে কবিতার বই। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছি বারবার। এখনও পড়ি, এখনও সমানভাবে মুগ্ধ হই। পরবর্তী সময়ে যখন দেশি-বিদেশি খ্যাতিমান পণ্ডিত-ইতিহাসবিদ-সমাজবিজ্ঞানী-অর্থনীতিবিদদের সম্মিলিত মেধায় রচিত ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস’ নামক সাড়ে বারোশ’ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থটি পাঠ করেছি, মনে হয়েছে এটি ‘সোনালি কাবিন’-এরই সম্প্রসারিত গদ্যরূপ। জীবনানন্দ দাশের প্রায় সব কাব্যগ্রন্থই আমার বারবার পাঠ্য। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, গান, প্রবন্ধ কতকিছুই তো পড়েছি, ভালোও লেগেছে প্রচুর, এখনও লাগে। কিন্তু তাঁর ‘ছিন্নপত্র’ পড়ে বিস্মিত হয়েছি সবচেয়ে বেশি। প্রকৃতির সঙ্গে অভিন্নতায় এক হয়ে যাওয়া এবং সেই এক হয়ে যাওয়ার অনুভূতি ও অনুভবকে মানুষের ভাষায় জীবন্ত রূপ দান—এককথায় বিস্ময়কর; তুলনাহীন। ‘ছিন্নপত্র’ পড়লেই আমার মন রাজধানী থেকে পালিয়ে যেতে চায়—প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রসারিত কোলে—নদীর কাছে—মাঠের মাঝে—আমবাগানের সবুজ অরণ্যে। আসুন ‘ছিন্নপত্র’এর একটু পাঠ করি:
যখন আমার ওপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কত দূর দূরান্তর—কত দেশ-বিদেশের জল স্থল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম—তখন শরৎসূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস, একটি জীবনশক্তি, অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ডভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে। আমার এই যে মনের ভাব—এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে—সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থরথর করে কাঁপছে। এই পৃথিবীর ওপর আমার যে একটি আত্মীয়বৎসলতার ভাব আছে, ইচ্ছে করে সেটা ভালো করে প্রকাশ করতে—কিন্তু ওটা বোধ হয় অনেকেই ঠিকটি বুঝতে পারবে না, কী একটা কিম্ভূত রকমের মনে হবে।
তো ‘ছিন্নপত্র’-এর রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই ‘ফুলের গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরিছে গলে গো’, ‘ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে/ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে’ —চরণসমূহ লেখা সম্ভব।
মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদের ’আমার শিল্পীজীবনের কথা’ পড়ে মনে হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম-আব্বাসউদ্দিন জুটির জন্ম না হলে বাঙালি মুসলমান একটি ‘সংস্কৃতিশূন্য’ নির্জীব মানবগোষ্ঠীতে নেমে পরিণত হতো। সংস্কৃতিবিমুখ বাঙালি মুসলমানকে সংগীতের জগতে টেনে আনার জন্য
`শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল’ ফর্মুলায় তারা কি না করেছেন। আব্বাসউদ্দিনের লেখনীতে শুনি, `আমি ভাবছি—রাজ-রাজড়ার সভাগায়ক হওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়নি বটে, কিন্তু বাংলাদেশে এ জীবনে অন্তত পাঁচ হাজার সভায় যোগদান করার মহাসৌভাগ্য তো হয়েছিল। আর সেসব সভায় শ্রোতা ছিল দেশের আপামর জনসাধারণ। তাদের মাঝে গানে গানে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি দেশাত্ববোধ, আত্মসচেতনতা, বাঁচার অধিকার; জাগিয়ে দিয়েছি হারিয়ে যাওয়া পল্লির কথা, পল্লির গাঁথা, পল্লির সুর; তাদের অবচেতন মনে জিজ্ঞাসা জাগিয়ে দিয়েছি।’
বইটি পড়ে জানা যায়— কীভাবে নজরুল-আব্বাস জুটি ‘ইসলামি গান’ দিয়ে সে-সময়ের সঙ্গীত-বৈরী বাঙালি মুসলমানদের সংগীতের প্রতি বৈরী মনোভাব ঝেড়ে ফেলে তাদেরকে সংগীতানুরাগী করে তুলেছিলেন।
মহাভারত, বাইবেল, কুরআন-ইত্যাদি মহাগ্রন্থ পড়েছি গভীর মনোযোগ সহকারে। আমার কবিতা লেখায় এসবের জ্ঞান বহুভাবেই সহায়তা করে আসছে আমাকে। ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ আজও আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ। সমস্ত পৃথিবীকে এই একটি বইয়ে ধারণ করেছেন মুজতবা আলী। সমস্ত পৃথিবীর ভাষা, কবিতা, গল্প, রূপকথা, প্রবাদ, কিংবদন্তী, সাহিত্য—যেন আনন্দের আড্ডা আর নান্দনিক রসের মাহফিল বসিয়ে রেখেছে ‘দেশে বিদেশে’-এর পাতায় পাতায়। আর ওরহান পামুকের ‘ইস্তানবুল’ পড়ে মনে হয়েছে, আকাশ-পাতালব্যাপী ছড়িয়ে-থাকা একটি ঐতিহাসিক মহা-শহর তার যাবতীয় গভীরতা ও গাম্ভীর্য, প্যাসন ও পবিত্রতা, রুচি ও বিকৃতি, সুস্থতা ও অসুখ, মায়া ও নির্মমতা, ঐতিহ্য ও বর্তমান, মিথ ও বাস্তবতা, অতীত ও ভবিষ্যৎ—এই সব সহকারে উঠে এসেছে এক মহান লেখকের মহাকলমে যার কোনো তুলনা বইয়ের জগতে নেই। ওই বইয়ের অসাধারণ গভীর, নিবিড় ও সূক্ষ্ন ভাবনাসমৃদ্ধ ‘হুজুন’ নামক অধ্যায়টি পড়ে ওরহান পামুকের প্রতি আমার সমীহ ও শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে গেছে। আমি সেখান থেকে উপকরণ ধার নিয়ে আমার একটি কবিতায় লিখেছি, `যে-ব্যথা ইস্তানবুলে রচে আছে গভীর হুজুন/ অথবা যে-ব্যথা আজো সোমপুর বিহারের ইঁটে/তেমন কিছু কি আজ ঘ্রাণে পায় পেঁচা বা শকুন/প্রবল ভূতের কিল—প্রেম খোঁজে বিকৃতির ভিটে।’
আধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়া সত্ত্বেও তা একইসঙ্গে কুটিল এবং জটিল। আধুনিক শিক্ষিত মানুষ তার পৃথিবীকে করে ফেলেছে বহুধা বিভক্ত, বেহুদা-বৈরী। সে আলোকায়নের নামে, সভ্যতার সংঘর্ষের নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, প্রগতির নামে— পৃথিবীকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, যুদ্ধ এবং হানাহানিজনিত অশান্তিতে ভরে তুলেছে। দূষণে আক্রান্ত পৃথিবী দিনদিন প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। না মানুষ, না পশু, না নদী,— কেউই আজ এই পৃথিবীতে প্রগাঢ় শান্তির অধিকারী নয়। এই নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপ আর আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের খেলাও চলছে সমানে। মিডিয়া হয়ে পড়েছে পুঁজিসর্বস্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাস। লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশই পক্ষপাতদুষ্ট : ‘বিবেক বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত এদেশের ( বাস্তবে সবদেশের) পণ্ডিতসমাজ।’ কিন্তু এডওয়ার্ড সাঈদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ পড়ে মনে হয়েছে—অন্তত একজন ‘বিশ্ব-বুদ্ধিজীবী’ বিবেক বিক্রি করেননি, অন্তত এই একটা মাথা কিনে নিতে পারেনি সাম্রাজ্যবাদী আর পুঁজিবাদী চক্র। এডওয়ার্ড সাঈদের শুভবাদী ভাবনার গভীরতায়, মহামানবিক উপলব্ধির নিবিড়তায়, মেধাবী চিন্তার সূক্ষ্মতায়, বিচারের পক্ষপাতহীন ন্যায়বোধে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পঠন-পাঠনের ব্যাপকতায়, বিশ্লেষণের নির্মোহ সাধুতায়, প্রকাশের দুরন্ত সাহসে এবং উপযুক্ত ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায় ‘ওরিয়েন্টালিজম’ অনন্য, অতুলনীয় এবং অনতিক্রম্য। এই একটি বইয়ের জন্য তাঁকে ১০বার নোবেল পুরস্কার দেওয়া যেতো। কিন্তু যারা নোবেল পুরস্কার দেয়, এডওয়ার্ড সাঈদের অবস্থান তো তাদের কায়েমী স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে। যারা বর্তমান পৃথিবী এবং তার সংকট নিয়ে ভাবতে চান, যারা জানতে ও বুঝতে চান—মৌলবাদ কী, সাম্প্রদায়িকতা কী, সভ্যতার সংঘর্ষ কী, সাম্রাজ্যবাদ কী, পুঁজিবাদ কী, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কী এবং এসবের প্রকৃত স্বরূপ ও উৎস কী—তাদের জন্য ‘ওরিয়েন্টালিজম’ অবশ্যই পাঠ্য বলে আমি মনে করি।
পণ্ডিত নেহেরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, মহাত্মা গান্ধীর ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি, দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’, আইউব খানের ‘ফ্রেন্ড, নট মাস্টার’, সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ আমরা বহু আগেই পড়েছি। এখন আমাদের পড়া প্রয়োজন—বারাক ওবামার ‘অডাসিটি অব হোপ’, নেলসন ম্যান্ডেলার ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’, এ পি জে আবদুল কালামের ‘উইংস অব ফায়ার’, জয়া চ্যাটার্জীর ‘বাংলা ভাগ হলো’, যশবন্ত সিংহের ‘জিন্নাহ ইন্ডিয়া-পার্টিশান-ইন্ডিপেন্ডেন্স’, বেনজির ভুট্টোর ‘ডটার অব দ্য ঈস্ট, ক্যাথরিন ফ্রাঙ্কের ‘ইন্দিরা’, হিলারি ক্লিন্টনের ‘লিভিং হিস্টরি’, আকবর আলি খানের ‘ডিসকভারি অব বাংলাদেশ’, ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’, ‘অন্ধকারের উৎস হতে’। এইসব বই আমাদের ভাবনাকে নতুন দিগন্ত দেখায়, আমাদের বিবেচনাবোধকে শাণিত করে, আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। বারাক ওবামার ‘অডাসিটি অব হোপ’ একটি অসাধারণ বই। রাজনীতি, বর্ণভেদ, সিভিল রাইট মুভমেন্ট, মূল্যবোধ, সুযোগ, ধর্মবিশ্বাস, পরিবার-প্রথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, পররাষ্ট্রনীতি—প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর আন্ডারস্টান্ডিং অনেকটাই অনন্য এবং নতুন দিক-নির্দেশনামূলক। তাঁর ভাষা কাব্যময় অথচ শাণিত যুক্তিতে পরিপূর্ণ। তিনি অনেক জটিল-কুটিল বিষয়কে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করেছেন; কিন্তু তাঁর ভাষার গুণে সে-বর্ণনা হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে। পাঠক বইটি পাঠ করলে এক ধরণের আলো পাবেন—সে পাঠক রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, দার্শনিক, কবি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যেই হোন না কেন। উদাহরণস্বরূপ—বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন পড়ে মুগ্ধ ও বিস্মিত হতে হয়। এ’দুটি প্রতিষ্ঠানের নেতিবাচক পলিসি সংক্ষেপে তুলে ধরে তিনি বলেছেন,
Another branch of the international financial system, the World Bank, has reputation for funding large expensive projects that benefit high-priced consultants and well-connected local elites but do little for ordinary citizens—-although it’s these ordinary citizens who are left holding the bag when the loans come due. Indeed, countries that have successfully developed under the current international system have at times ignored Washington’s rigid economic prescriptions by protecting nascent industries and engaging in aggressive industrial policies.The IMF and World Bank need to recognize that there is no single, cookie-cutter formula for each and every country’s development.
এ ধরনের বইপাঠের অভিজ্ঞতা নানাভাবে আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি আমার হাতে হয়ে উঠতে চেয়েছে কবিতা অথবা কবিতার অলঙ্কার: `বর্গীর রেকর্ড মোছে বিশ্বব্যাংক ধূর্তহাতে জলে ও ডাঙ্গায়।’ কিংবা `ও আমার ভালোবাসার বিশ্বব্যাংক,/উষ্ণখনির লোভে আর কত লোন চাপাবে ভাই! /দ্যাখো, তুবও ফলিয়েছি রাতজাগা শ্রমের ফসল। / কিন্তু ফাস্টফুডের বাজারে কি হবে এসব দিয়ে? / ফলে তো আমি এভাবে ফতুর হয়ে গেলে,/ তুমিই বলো—সেদিন কে নেবে আমার চক্রবৃদ্ধি বেদনার দায়?` —ইত্যাদি।
আবার এ পি জে আবদুল কালামের ‘উইংস অব ফায়ার’ পড়তে পড়তে মনে হয়— কোনো রূপকথার রাজ্যে আছি! এ যেন আরব্য উপন্যাসের আলাদীনের নতুন চেরাগ আবিস্কারের কাহিনী। ভারতের একটি মধ্যবিত্ত গ্রামীণ সংখ্যালঘু পরিবারের একটি ছেলে এ পি জে আবদুল কালাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একদিন এক ব্রাহ্মণ শিক্ষক তাকে বেঞ্চের প্রথম সারি থেকে তুলে দিয়ে পেছনের সারিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন; সেখান থেকে শিক্ষা ও সাধনা বলে ভারতকে ‘অগ্নি’, পৃত্থী’, ‘নাগ’, ‘ত্রিশুল’, ‘আকাশ’ প্রভৃতি ক্ষেপণাস্ত্রের মালিক হতে সাহায্য করা এবং সে পথ ধরে ভারত-রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাব ‘ভারতরত্ন’ অর্জন এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হওয়া। এক বিস্ময়কর জীবন ও কর্মসাধনা! বইটি পড়ে আরও অবাক হতে হয় এ কারণে যে, প্রকৌশলী থেকে রকেট-বিজ্ঞানী হওয়া একজন মহাব্যস্ত মানুষ কি করে একইসঙ্গে এতটা কবিতাপ্রেমিক হতে পারেন, সঙ্গীতপিপাসু হতে পারেন, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি গভীরভাবে কর্তব্যপরায়ণ হতে পারেন! বইটির প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে বিশ্ব-কবিতা, বিভিন্ন মনীষীর উক্তি এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি। তিনি নিজেও অবসর পেলে ডায়েরির পাতা ভরে তুলেছেন স্বরচিত কবিতায়। তিনি বিজ্ঞানের কাহিনীকে রসঘন করে তুলেছেন মায়াবী উপস্থাপনায়। তাঁর ‘অগ্নিডানা’য় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত কবিতার ছন্দ ও তাল, ভাব ও ব্যঞ্জনা এবং ধর্মের অমেয় বাণীর সুধা। তাঁর জীবনাভিজ্ঞতার একটি বিবরণ তুলে ধরছি:
`অধ্যাপক সারাভাইয়ের কাছ থেকে যা আমি অর্জন করেছিলাম ড. ব্রহ্মপ্রকাশ শুধু তাকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন তাই নয়, তাকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতেও সহায়ক হয়ে উঠেছিলেন। সর্বদা তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলতেন তাড়াহুড়া না করতে। তিনি আমাকে বলতেন, ‘বৃহৎ বৈজ্ঞানিক প্রকল্প পর্বতের মতো। তাতে আরোহণ করতে হবে যতদূর সম্ভব কম আয়াসে এবং মনে কোনও আকাঙ্ক্ষা না রেখে। তোমার অগ্রগতি কত দ্রুত হবে, সেটা নির্ভর করছে নিজের প্রকৃতির ওপর। যখন অস্থির লাগবে গতি বাড়িয়ে দাও; যখন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বেশি হচ্ছে গতি কম করো। পর্বত আরোহণ করবে অস্থিরতা এবং অবসন্নতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে। তোমার প্রকল্পের প্রত্যেকটি কাজ যখন, কোনও লক্ষ্যে পৌঁছাবার উপায় না হয়ে নিজেই হয়ে উঠবে একটি ঘটনা, তখনই বুঝবে, সব ঠিক ঠিক মতো চলছে।’ ড. ব্রহ্মপ্রকাশের উপদেশের প্রতিধ্বনি শোনা যায় ‘ব্রহ্মা’ সম্পর্কে এমারসনের কবিতায়:
যদি রক্তমাখা খুনী মনে করে সে খুন করে,
কিংবা যদি নিহত মনে করে সে নিহত,
তারা জানে না আমার দুর্নিরীক্ষা নীতি,
কেমনভাবে আমি যাই, কেমনভাবে আবার ফিরে আসি।শুধু কোনও অজ্ঞাত ভবিষ্যতের জন্যেই বাঁচা, তার মধ্যে কোনও গভীরতা নেই। এ-যেন পর্বতের শিখরে পৌঁছাবার জন্যেই পর্বতারোহণ, পর্বতগাত্রের কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়াই। শিখরে নয়, পর্বতগাত্রেই জীবনের অস্তিত্ব। নানা জীবের সেখানেই জন্ম , অভিজ্ঞতা সেখান থেকেই আসে, প্রযুক্তি সেখানেই আয়ত্ত হয়। শিখরের মূল্য একমাত্র এই কারণে যে পর্বতগাত্রের সীমা তার দ্বারা নির্ধারিত হয়। অতএব আমি এগিয়ে চললাম, শিখরের অভিমুখে, কিন্তু যে পর্বতগাত্র বেয়ে উঠছি, অভিজ্ঞতায় সেটাও ধরা থাকছে। অনেক অনেক দূর আমাকে যেতে হবে, কিন্তু আমার কোনও তাড়া ছিল না, শুধু একটির পর একটি পা ফেলে যাওয়া, কিন্তু প্রত্যেকটি পদক্ষেপ শিখরের দিকে।`
কী অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি! কী অসাধারণ এই উপস্থাপনা! এই জীবন-নির্দেশনা কবিতা-রচয়িতাদের জন্যেও সমানভাবে প্রযোজ্য হতে পারে।
আর যখন হিলারি ক্লিন্টনের ‘লিভিং হিস্টরি’ এবং বেনজির ভুট্টোর ‘ডটার অব দ্য ইস্ট’ পড়ি, তখন দেখতে পাই—আজও তথাকথিত ‘অগ্রসর বিশ্বে’ এবং ‘অনগ্রসর বিশ্বে’ নারীজাতি পুরুষতন্ত্রের কায়েমি বাধার সম্মুখীন রয়ে গেছে । হিলারি ১৯৬৯ সালে যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যান, তখন সেখানকার এক প্রখ্যাত পুরষ অধ্যাপক বলেছিলেন, We don’t need any more women at Harvard. হিলারি ভর্তি হতে পারেননি। তিনি ভর্তি হন অন্য প্রতিষ্ঠানে। তার কয়েকবছর আগে তিনি যখন Maine Township Highschool South-এ পড়ার সময় সেখানে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ান, তখন তাঁর এক ছাত্রবন্ধু বলেছিল (হিলারির ভাষায়), I was really stupid if I thought a girl could be elected President. বইটি হিলারির আসাধারণ মানবী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফাস্ট লেডি হয়ে ওঠার এবং আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থার বহু ঘটনার অমূল্য বিবরণে সমৃদ্ধ। বেনজির ভুট্টোর ‘ডটার অব দ্য ইস্ট’ আরও বেশি সমৃদ্ধ। পুরুষ-প্রযোজিত সামরিকতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র, তালেবান-তন্ত্রকে মোকাবেলা ও পরাজিত করে ১৯৮৮ সালে মুসলিম বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন বেনজির। তারপর ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্র। ক্ষমতাচ্যুত। অতঃপর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত। সামরিক বাহিনীর চাপে দেশছাড়া। তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনা সৃষ্টি। তাঁকে হত্যার নানামুখী ষড়যন্ত্র ও আশঙ্কা। অসংখ্য শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার বর্ণনা। প্রজ্ঞা, সাহস ও সাবলীলতা তাঁর বর্ণনাকে করে তুলেছে হৃদয়গ্রাহী ও নান্দনিক।
`পাকিস্তানের মানুষ গোঁড়ামি ও কুসংস্কার প্রত্যাখ্যান করে একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছে। এটা একটা বিশাল সম্মান এবং সমভাবে অসীম দায়িত্ব। আমার কাছে, প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য শপথ গ্রহণ ছিল একটা যাদুর মতো, অধিবাস্তব মুহূর্ত। আমাকে এই সময়ে, এইখানে, এই পদে নিয়ে আসার জন্য আমার ভাগ্যকে স্মরণ করা ছাড়া আর সেদিন কিছুই করতে পারিনি। আমি আজ তাদের সবাইকে স্মরণ করি, যারা আমার সঙ্গে ছিল, দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছে, মার খেয়েছে, নির্বাসনে গেছে এবং অনেকে যারা এই গণতন্ত্রের জন্য নিহত হয়েছেন, বিশেষভাবে আমার পিতাকে স্মরণ করি। আমি এইরূপ ভূমিকা চাইনি, আমি এই বিপুল বৈভব আশা করিনি, কিন্তু আমার ভাগ্য ও ইতিহাসের শক্তিই আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে। আমি নিজেকে বিশেষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত ও শঙ্কিত বোধ করছি। আমার নির্বাচনে মুসলিম বিশ্বে বিরাট প্রভাব পড়বে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পশ্চাদমুখী ব্যক্তিরা যারা প্রচার করে যে নারীর ভূমিকা শুধু চার দেয়ালের অন্তরালে, তারা দারুণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। পাকিস্তান এবং সেইসঙ্গে গোটা মুসলিম বিশ্ব নতুন এক সাহসী ব্যবস্থার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যেখানে লিঙ্গ সমতার নীতি বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে।’
পুরো বইটিতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক ধর্মীয় চরমপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানসহ বহুবিধ অপকর্মের দুঃসাহসী বর্ণনা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে—তিনি জানতেন যে দেশে ফিরলে তাকে হত্যা করা হতে পারে, তথাপি তিনি দেশে ফিরেছিলেন। বইটি একজন সাহসী, প্রজ্ঞাবান, সুদক্ষ, জ্ঞানী নারীর দৃষ্টিতে পুরুষশাসিত পাকিস্তান এবং পৃথিবীকে দেখার এবং সেই পাকিস্তান—সেই পৃথিবীকে সমভাবে নারীরও পাকিস্তান, নারীরও পৃথিবী করে নিতে দুঃসাহসী ও দূরদর্শী কর্মকাণ্ড গ্রহণের চমৎকার দলিল। তাঁর নির্মোহ মূল্যায়ন :
`১৯৭০-এর শেষ দশক থেকে ৮০-এর দশকে পশ্চিমারা সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউল হক-কে পরম যত্নে লালন পালন করেছে—যতদিন পর্যন্ত জিয়া আফগানিস্তানে আইএসআই-কে সিআইএ-এর ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। আইএসআই সিআইএ মোজাহেদিনদের হাতে শুধু আধুনিক অস্ত্র এবং প্রযুক্তিই এনে দেয়নি। তারা আমার জন্মভূমিকে, একটি শান্তিপ্রিয় দেশকে কালাশনিকভ, হেরোইনসমৃদ্ধ এবং উগ্রপন্থী ইসলামিক সমাজে রূপান্তরিত করেছে। এবং পাকিস্তানের সম্পদ এবং ক্ষমতা সামাজিক সেক্টর থেকে অপসারিত হয়ে সেনাবাহিনীর হস্তগত হওয়ায় পাকিস্তানের সমাজাভ্যন্তরে যে অসন্তোষের আগুন সঞ্চারিত হচ্ছে, তার বহিঃপ্রকাশ এখনও ঘটেনি। সরকার জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং সামাজিক সেবা প্রদান বর্জন করার ফলে মানুষ পরামুখাপেক্ষী হয়। যার অনিবার্য ফলস্বরূপ দেশের চারটি প্রদেশে দশ হাজারেরও বেশি রাজনৈতিক মাদ্রাসা গড়ে ওঠে।
এটা তো ঠিক যে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বই পড়ে পৃথিবীকে জানার অনেকটা বিকল্প হয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে আকাশ-সংস্কৃতির ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ওয়েবসাইট। সংবাদপত্রগুলোও টাটকা বইয়ের মতো। এসবের অনেককিছুই ‘জীবন্ত, সচিত্র এবং রঙিন’। ‘ম্যান ইটার অব সুন্দরবন’ পড়ার আর দরকার কি যখন ‘ডিসকভারি’ ‘অ্যানিমাল প্লানেট’, ‘জিওগ্রাফি’—ইত্যাদি চ্যানেল ‘জীবন্ত, সচিত্র এবং রঙিন’ জঙ্গল-সমুদ্র-আকাশ-জনপদকে তুলে ধরছে আমাদের চোখের সামনে? তাহলে কি বইপড়ার প্রয়োজন ফুরোতে বসেছে? না! বইয়ের শব্দ কথা বলে; তার সঙ্গে কথা বলে শূন্যস্থান, ইঙ্গিৎ ও ব্যঞ্জনা। কোনো টিভি চ্যানেল কিংবা ওয়েবসাইট, কিংবা সিনেমাই ‘গীতাঞ্জলি’-এর নিবিড় অনুভূতি, ‘শবনম’ উপন্যাসের ভালোবাসার আনন্দ-বেদনার নিবিড়তা, ‘ওরিয়েন্টালিজম’-এর প্রগাঢ় জ্ঞান-বুদ্ধিভিত্তিক সততা-উৎসারিত গভীর-নিবিড় ছবি কিংবা ‘মসনবী’-এর আধ্যাত্মিকতাকে ধারণে বা উপস্থাপনে সক্ষম নয়। অভিনয় এবং সচিত্র প্রতিবেদন—দুয়েরই সীমাবদ্ধতা অনেক। একটি ভালো বই অনুভব-অনুভূতি-উপলব্ধি-বিশ্বাস-কল্পনা-স্বজ্ঞা-আনন্দ-বেদনার মহাসমুদ্র। এই মহাসমুদ্র অভিনয় কিংবা ধারা বর্ণনায় অনুবাদযোগ্য নয়—উপস্থাপনযোগ্য নয়। মহাসমুদ্রকে বুঝতে হলে—তার মজা পেতে হলে—তার বুকেই সাঁতার কাটতে হবে, তার স্রোতে-ঢেউয়েই নাও ভাসাতে হবে, তার গহীনেই ডুব দিতে হবে। তাহলেই মিলবে—প্রকৃত আনন্দ ও বেদনা, প্রকৃত উত্তেজনা ও শিহরণ। এমন কোনো অভিনয় নেই অথবা উপস্থাপনা নেই—যার দ্বারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি` কিংবা নজরুলসঙ্গীতের ‘কথার কুসুমে গাঁথা গানের মালিকা কার/ ভেসে এসে হতে চায় গো আমার গলার হার!’ চরণগুলো ফুটিয়ে তোলা যায়। অথবা—
কান পাতো, এই মুহূর্তে আমার ভাষা বদলে যাচ্ছে
নর্থবেঙ্গল ট্র্রেনের হুইসেলে।
দিগন্ত বিস্তৃত আখখেতের মতো
আমাকে নিঙড়ে নিচ্ছে মাড়াইয়ের কল,
আমার ভাষা রস হয়ে
গুড় হয়ে
চিনি হয়ে
ছড়িয়ে গেল কোটি কোটি প্রভাতের পেয়ালায়।
তোমার চকলেট রঙের ঠোঁট থেকে উড়িয়ে দিও না
মৌমাছির ঝাঁক।
আল্লার কসম, আমার ভাষা এখন একলক্ষ রানী মৌমাছির গুঞ্জন।
(তুমি, আমার প্রথম উচ্চারণ/আল মাহমুদ)
এই কবিতা অন্য কোনো মাধ্যমে অনুবাদযোগ্য নয়, অভিনয়যোগ্য নয়। কবিতায় ধারণকৃত অনুভূতি এবং চিত্রকল্প ও কল্পচিত্রের ব্যঞ্জনা শুধু পাঠ দ্বারাই উপলব্ধি করে নেওয়ার ব্যাপার। এসব ব্যাখ্যারও অতীত অনেকখানি। অতএব বই পাঠ ছাড়া এই অমেয় স্বাদ উপভোগের—এই নান্দনিক রস আস্বাদনের— অন্য কোনো পথ নেই।
বই পড়ার কতগুলো বাড়তি সুবিধাও আছে। আমরা বসে থেকে বই পড়তে পারি; আমরা চলন্ত গাড়িতে, জাহাজে কিংবা উড়োজাহাজে বসে বই পড়তে পারি; আমরা শুয়ে শুয়ে বুকের ওপর বই নিয়ে বই পড়তে পারি। এতে কোনো শব্দ হয় না, কিংবা কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রয়োজন হয় না। বৈদ্যুতিক আলো থাকলে বই পড়তে পারি, না থাকলেও প্রাকৃতিক আলোতে অথবা প্রদীপের নিচে বই পড়তে পারি। টেলিভিশন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার কোনোটাই চোখে সয় না বেশিক্ষণ। আধুনিক আবিস্কারের অতিব্যবহার এবং অপব্যবহার আমাদের বসবাসের প্রতিবেশ,পরিবেশ, ঘরবাড়ি, অফিস, যানবাহন— সবকিছুকেই করে তুলেছে যান্ত্রিক, সবখানেই ধাতবগন্ধ। তার সঙ্গে পরিবেশন দূষণ। অথচ বইয়ের আলমারী সজ্জিত একটি কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র আমাদের মনের মধ্যে মুক্তির আনন্দ ফুটে ওঠে। একটি ভালো বই নিজের বুক সেল্ফে থাকা মানে হচ্ছে—হাতের কাছে একটি স্থায়ী আনন্দের উপকরণ থাকা। নিজ বাড়িতে বা ভাড়াবাসায় একটি পারিবারিক লাইব্রেরি সন্তানাদিসহ পরিবারের লোকজনের আনন্দিত জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে নীরবে নিভৃতে কাজ করে যায় সারামাস—সারাবছর।
জয়তু বই! জয়তু বই পড়া! জয়তু গ্রন্থাগার!