বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে সমৃদ্ধ। সেই প্রাচীনযুগ থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিকযুগে এসেও একচ্ছত্রভাবে বরাবরই আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে কাব্য। একইভাবে বাংলা কবিতায় আধিপত্য বিস্তার করে আছে প্রেম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় মনোভাব, যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবী, সামাজিক অবক্ষয়, মানসিক অস্থিরতা ও সমকালীন সমস্যার পাশাপাশি চিরকালীন মানবীয় প্রেম-বিরহও স্থান করে নিয়েছে কাব্যে। নিঃসঙ্গ কবির ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-দুর্দশা তাকে প্রেমের কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
কবিতা লিখতে গিয়ে কবিকে প্রেমে পড়তে হয়েছে। অথবা প্রেমে পড়ে তাকে কবিতা লিখতে হয়েছে। দু’টি বিষয়ই চিরন্তন সত্য। কবিমনে প্রেম জাগ্রত না হলে কবিতা হয় না। কাব্যচর্চার জন্য প্রেম অনিবার্য। আর সে চর্চাকে অব্যাহত রাখতে হলে বেছে নিতে হয় বিরহকে। কারণ মিলনের চেয়ে বিরহই কবিকে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করে। নবসৃষ্টির উন্মাদনা জাগ্রত করে। কবি বলেছেন—‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠেন।’ কবিতার সঙ্গে যেন প্রেমের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। লোকে বলে- কবি মানেই প্রেমিক। আর প্রেমিক মানেই কবি। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জীবনে অন্তত এক লাইন প্রেমের কবিতা রচনার চেষ্টা করেননি। সবার জীবনে একবার প্রেম আসে—কথাটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনি জীবনে অন্তত একবার কাব্য রচনা বা সাধনা করেননি একথাও অস্বীকার করার জো নেই। কেউ যদি মনে-প্রাণে, ধ্যানে-জ্ঞানে কবি হন, তবে তো কথাই নেই।
বাংলা সাহিত্যে প্রেমের কবিতা বা কবিতায় প্রেম বিষয়ে পরিসংখ্যান করা খুবই দুঃসাধ্য। দ্রোহ-সংঘাত বা অস্থিরতার মধ্যেও বাংলা কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গ অগণিত। মধ্যযুগের পদাবলি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অধিকাংশ কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গ এসেছে অসংখ্যবার। বর্তমানে যারা খ্যাতনামা কবি বা যারা প্রতিষ্ঠার জন্য কাব্যচর্চা করছেন, তাদের প্রত্যেকেই হয়তো প্রথম জীবনে কোনো বালিকার উদ্দেশে প্রেমকাব্য রচনার মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন।
প্রাচীন যুগের (৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও কিঞ্চিৎ প্রেমের আভাস পাওয়া যায়। সেটা কূলবধূর পরকীয়ার অভিসার। বাহ্যিক দৃষ্টিকোণে পরকীয়া প্রেমে নিষিদ্ধ আনন্দ থাকলেও এর গূঢ়ার্থ ভিন্ন। চর্যার ২ নম্বর পদে পদকর্তা উল্লেখ করেছেন-
‘দিবসহি বহুড়ী কাউ হি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরূ জাই।।’
যার সরল অর্থ হচ্ছে- ‘দিনে বধূ কাকের ভয়ে ভীত আর রাতে কামরূপ (অভিসারে) চলে যায়।’
মধ্যযুগে (১২০১-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) ধর্মাশ্রিত কাব্যসাধনা থেকে বেরিয়ে এসে কবিরা মানবাত্মার জয়গান গাইতে শুরু করলেন। সে সময়কার বৈষ্ণব পদাবলির কবিদের ধর্ম—প্রেমধর্ম। যে প্রেমের কোনো হেতু নেই, যে প্রেম কোনো বাধা মানে না, কোনো প্রতিদান চায় না, যে প্রেমে আত্মসুখের কামনা নেই, যে প্রেম ইন্দ্রসম ঐশ্বর্যকেও তুচ্ছজ্ঞান করে, যে প্রেম মৃত্যুকেও ভয় করে না। বৈষ্ণব কবিদের প্রেম, সেই প্রেম। কবি চণ্ডীদাস বলেছেন—
সই, কেমনে ধরিব হিয়া
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙিনা দিয়া।
এ রকম প্রেমের অনুষঙ্গ সেই বৈষ্ণব কবিতাতেই প্রথম উচ্চারিত হয়।
জীবের মধ্যে যে সুখ বাসনা আছে, তা ইন্দ্রীয়জ বা সাংসারিক সুখভোগে চরিতার্থতা পায় না। ভগবানের প্রেম হৃদয়ে লাভ করতে পারলেই মানুষ যথার্থ আনন্দিত হতে পারে। তাই শ্রীকৃষ্ণকে পরমাত্মা ও রাধাকে জীবাত্মার প্রতীকে বৈষ্ণবেরা এ প্রেম ব্যক্ত করেছেন। কবি চণ্ডীদাস বলেছেন—
এমন পিরীতি কভূ দেখি নাই শুনি
পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা-আপনি।
দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।’
মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার ছবি আঁকতে গিয়ে কবিরা বরাবরই প্রেমকে করেছেন উপজীব্য। এমনকি মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও প্রেমের ভারে আক্রান্ত হয়েছে। ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচারের চেয়ে বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তা হয়ে উঠেছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি। পরমাত্মা ও জীবাত্মার প্রেমকাহিনি প্রতীকী ব্যঞ্জনার কারণে তৎকালীন সাহিত্য সমালোচকদের কাছে অশ্লীলতার দোষেও দুষ্ট হয়েছে।
আধুনিক যুগে এসে সমকালীন বিভিন্ন উপাদানের মধ্যেও প্রেম হয়ে উঠেছে কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের আড়ালে প্রেমকেই উচ্চকিত করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বিদ্রোহের জন্য প্রেম অনিবার্য। তাই বাংলা কবিতায় অনিবার্যভাবেই প্রেম তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। কবিরা সুন্দরের পূজারি। প্রেমের সৌন্দর্য্য অপরিসীম। প্রকৃতি ও নারী কবিমনে প্রেমের উন্মেষ ঘটান। কবিরা ভালোবাসতে গিয়ে নারী ও প্রকৃতিকে একাকার করে ফেলেন। যেমনটা করেছেন জীবনানন্দ দাশ। ‘বনলতা সেন’ তার অমর কাব্য। হোক সে নারী বা প্রকৃতি। কবি ভালোবেসেছেন। প্রেমে পড়েছেন, তারই অভিব্যক্তি—
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
বাংলা কবিতার প্রেমকেও বিভাজিত করা যায়- হতে পারে সেটা প্রকৃতি প্রেম, দেশপ্রেম, স্রষ্টার প্রতি প্রেম, মানবপ্রেম ও নারীর প্রতি প্রেম। প্রেম সর্বজনীন। ভালোবাসার অধিকার সবার। কবি ত্রিদিব দস্তিদার ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর হয়ে যাবার’ কথা বলেছেন। হতে পারে সেটা ক্ষেত্রবিশেষ। জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনিবার। সৃষ্টিকর্তাও নারীকে সৃষ্টি করেছেন অপরিমেয় সৌন্দর্যের সমন্বয়ে। সঙ্গত কারণেই পুরুষ নারীর প্রেমে পড়ে। নারী পুরুষের প্রেমে পড়ে। আর এজন্যই যুগে যুগে রচিত হয় প্রেমকাহিনি। প্রেমের কবিতা পাঠককেও আকৃষ্ট করে তাড়াতাড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার— ‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/ দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড় / বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম’-এর মতো প্রেমের পঙ্ক্তি প্রচারিত হয় প্রেমিক পুরুষের মুখেমুখে। একজন নেহায়েত বেরসিক মানুষও প্রেমের কবিতা পাঠে অপ্লুত হন। এটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তাই কবিরাও প্রেমের কবিতা লেখাতেই বেশি মনোযোগী হন। কখনো সাম্প্রতিক বা ঐতিহাসিক ঘটনাবলিও কবিতার উপজীব্য হয়। তবু যুগ যুগ ধরে পাঠকের হৃদয়ে গতিবেগ সঞ্চার করে প্রেমের কবিতা।
বাংলা কাব্যে উল্লেখযোগ্য বা বিখ্যাত যত কবিতা রয়েছে তার বেশির ভাগই প্রেমের কবিতা। মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তণ, বৈষ্ণব পদাবলি, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের মধ্যে লাইলি-মজনু, পদ্মাবতী, ইউসুফ-জুলেখা প্রভৃতি প্রেমের উল্লেখযোগ্য কাহিনিকাব্য। আধুনিক যুগের কাহিনিকাব্যের মধ্যেও জসীমউদদীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ উল্লেখযোগ্য প্রেমকাহিনি। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কবি জসীমউদদীনের প্রথম কাহিনিকাব্য। গ্রামবাংলার দুটি তরুণ-তরুণী রূপা আর সাজুর অনাবিল প্রেম আর করুণ পরিণতি এ কাব্যে উপস্থাপিত হয়েছে।’ ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাহিনিকাব্যে দুটি ভিন্ন সমাজের দুটি কিশোর-কিশোরী সোজন ও দুলীর প্রণয়কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
পৃথিবী যতদিন থাকবে; ততদিন মানুষ থাকবে। মানুষ যতদিন থাকবে; ততদিন ভালোবাসা থাকবে। এসব কিছু যতদিন থাকবে; কবিরাও ততদিন থাকবে।