অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। বিশেষ করে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনমেলা। বইমেলায় প্রাণ খুঁজে পায় বাংলা ভাষাভাষি। লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে অচ্ছেদ্য সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বর্ধিত অংশ।
বইমেলা মূলত পাঠকের মেলা হওয়া উচিত। পাঠক অগণিত লেখকের মাঝে খুঁজে নেবেন তার প্রিয় লেখককে। হাজারো বইয়ের ভীড়ে খুঁজে নেবেন তার প্রিয় বইটি। পার্থক্য করতে শিখবেন ভালো-মন্দের। ভালো গল্পের যেমন একটা প্রভাব থাকে, তেমনি মন্দ লেখারও একটা প্রভাব কিন্তু থেকেই যায়। লেখক-প্রকাশক থাক অলক্ষ্যে। পাঠক হয়ে উঠুক মুখ্য। তারা খুঁজে নিক তাদের স্বপ্ন ও সফলতার দিক-নির্দেশনা।
গত কয়েক বছরে এত-এত পাঠকের ভীড়ে কিছু অপাঠকের আনাগোনাও থাকে। ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে অভিজিৎ পর্যন্ত জীবন দিতে হলো। অজস্র মানুষের ভীড়ে দানবের থাবায় নিভে গেল তাজা দুটি প্রাণ। তাহলে কোথায় খুঁজে পাব প্রাণ? আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার একটি অপচেষ্টা। মতামতের স্বাধীনতা আছে বললেও আমার জীবনের নিরাপত্তা নেই—একথা এখন সবাইকেই স্বীকার করতে হয়। শীতের মিষ্টিমধুর পরিবেশে গড়ে ওঠা বইমেলা এখন রক্তের দাগে সমাপ্ত হয়। এক খুনের দাগ শুকাতে না শুকাতেই আবার ঝরে পড়ে খুন।
তাই বইমেলার সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট থাকতে হবে প্রশাসনকে। যদিও এ বছর ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পুরো এলাকাজুড়ে থাকবে উজ্জ্বল আলো। যেন কেউ অপরাধের চেষ্টাও করতে না পারে। কেন এই উদ্বিগ্নতা। কেন ভয়ে ভয়ে পা ফেলতে হয় প্রাণের উৎসবে। আমরা চাই প্রাণের ছোঁয়া লাগুক প্রতিটি প্রাণে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মানুষকে উদার হতে সহায়তা করুক। দিন দিন বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে কী লাভ? মানুষ যদি মানুষ না হয়। মানুষের মতো মানুষ সৃষ্টি এখন সময়ের দাবি।
বইমেলায় বই কিনতে হবে। বুকসেল্ফ ভরে রাখবো। সৌন্দর্য্য বাড়লো। অথচ একটা পৃষ্ঠাও তার পড়ে দেখা হয়নি। এমন ক্রেতার খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বই পড়া কিংবা বই কেনা প্রসঙ্গে অনেক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তবুও আমাদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠেনি। অথচ ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইউটিউবে যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে আবার অনেকের সহমতও রয়েছে। এসব মাধ্যমে আমরা অনেক শিক্ষণীয় বিষয় জানতে পারি। আমি স্বীকার করছি—তবে, আমরা ইতিবাচক দিকগুলোর চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলোই গ্রহণ করি বেশি। হয়তো এমনও সময় আসবে যখন কাগজে ছাপা বই বাজারে পাওয়া যাবে না। ই-বুক আকারে তা ঘুরবে মানুষের হাতে-হাতে। শিল্পের প্রসার হোক। শিল্পের ধরন পরিবর্তন হোক। তবু শিল্প হয়েই টিকে থাকুক শিল্প। এখন হয়তো হাজার-হাজার কপি বিক্রি করে লেখক-প্রকাশকের লাভ হয়। তখন ব্লু-টুথ ও শেয়ারইটের মাধ্যমে বিনামূল্যে পৌঁছে যাবে সবার ল্যাপটপ, মোবাইল কিংবা ট্যাবে। সে যা-ই হোক, তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে—জাতির লাভ হবে কিসে? সে ব্যবস্থাই জরুরি।
বর্তমানে প্রচুর লেখকের আনাগোনা। হাজার বিশেক টাকা হলেই একটা বই বের করা যায়। প্রকাশনীও মুখিয়ে থাকে লেখকের টাকায় বই বের করতে। বই বিক্রি হলো কি না—এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এছাড়া, বর্তমান ফেসবুকের কল্যাণে বইমেলার আগেই প্রচ্ছদ জাহির করে অসংখ্য লাইক-কমেন্ট পেয়ে নিজেকে আহামরি লেখক ভাবতে শুরু করেন অনেকেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এত লাইক-কমেন্ট যারা দিচ্ছেন, তাদের শতকরা দশজনও ওই বই কিনছেন না। বস্তাপচা গল্প, উপন্যাস আর খিঁচুড়ি মার্কা কবিতার ছড়াছড়ি দেখে দ্বিধায় পড়ে যাই। তাই এখনও প্রকাশনা ও লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর থেকে উত্তরণ দরকার। সচেষ্ট হতে হবে লেখক ও প্রকাশকদের। প্রকাশনার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। লেখক-প্রকাশক উভয়ের আন্তরিক প্রয়াসে দেশের প্রকাশনা জগৎকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে হবে।
সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, ‘যে বই জনপ্রিয়তার কাছে দাসত্ব করছে সে বই খারাপ। যে বই মননকে স্পর্শ করে, ঋদ্ধ করে সে বই ভালো। ফলে ভালো বইয়ের সংজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আজেবাজে প্রকাশনার ভিড়ে ভালো বই হারিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সম্পাদনা ও পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইসহ মানসম্পন্ন লেখকদের বই প্রকাশ ও লেখক সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে পুস্তকের মানোন্নয়নে সরকার, লেখক-প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।’ (যুগান্তর, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬)
_________________________________________________________________________________________________
বইমেলা এলে কোনো কোনো লেখক একটা রিভিউ লিখে দিতে বলেন। পাণ্ডুলিপির সফট কপি মেইল করেন। পড়া শেষে মনে হয়—এমন লেখা লিখি যেন পাঠক লেখককে খুঁজে-খুঁজে পেটাবে সাহিত্য নিয়ে তামাসা করার জন্য। গতানুগতিক রিভিউও কম ছাপা হয় না। সেখানে প্রচ্ছদের প্রশংসা, লেখকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, ক্ষমতা, দক্ষতা উঠে আসে। লেখার কতটুকু ক্ষমতা যোগ্যতা দক্ষতা আছে—তা আর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে না।
________________________________________________________________________________________________
তবে, মানসম্পন্ন লেখা পেলেই মানোন্নয়নের প্রশ্ন আসে। আমাদের প্রকাশনা শিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। একটু যত্নবান হলেই ভুল দূর করা সম্ভব। তাই লেখার মানের দিকে নজর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। লেখক-প্রকাশকরা নিজেরা যদি সচেতন না হন, তাহলে বাজে বই প্রকাশ বন্ধ হবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে কিছু ভালো বই বের হয়। খারাপ বই নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ভালো বই যেন প্রকাশিত হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।
বইমেলা এলে কোনো কোনো লেখক একটা রিভিউ লিখে দিতে বলেন। পাণ্ডুলিপির সফট কপি মেইল করেন। পড়া শেষে মনে হয়—এমন লেখা লিখি যেন পাঠক লেখককে খুঁজে-খুঁজে পেটাবে সাহিত্য নিয়ে তামাসা করার জন্য। গতানুগতিক রিভিউও কম ছাপা হয় না। সেখানে প্রচ্ছদের প্রশংসা, লেখকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, ক্ষমতা, দক্ষতা উঠে আসে। লেখার কতটুকু ক্ষমতা যোগ্যতা দক্ষতা আছে—তা আর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে না।
বইমেলার নজরুল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচনের হিড়িক পড়ে যায়। উন্মোচনের জন্য বড় মাঝারি ও ছোট মাপের সেলিব্রেটিরাও পাঞ্জাবি-পাজামা পড়ে উপস্থিত হন। অথচ তিনিও হয়তো লেখকের বইটির দুটি পাতা উল্টে পড়ে দেখেননি। অথচ একগাল প্রশংসা আর সাহিত্যের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করে বইগুলো বগলদাবা করে বিদায় নেন।
তবে আশার কথা হলো—এত-এত হতাশার মাঝেও ভালো বই আসছে বাজারে। সারা বছরই আসছে। তবে হৈচৈ পড়ে বইমেলায়। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ কথাটা সত্য। কিন্তু এখন কথাটা একটু পাল্টে যাচ্ছে। এখন বলা যায়, ‘বই প্রকাশ করে কেউ কেউ দেউলিয়া হয়।’ ভালো মানের লেখক যারা তাদের সেই ভয়টা থাকে না। বইমেলা এলো, বই না এলে কেমন লেখক তুমি? আমাকে লেখক হতে হবে—তাই বই বের করছি। এমন মনোভাব না রেখে ভালো লেখক হতে হবে—এর জন্য ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। বেশি-বেশি পড়ার-জানার চেষ্টা করতে হবে।
কথায় আছে—‘দেশে কাক আর কবির সংখ্যা সমান।’ আমি কবিকে কখনোই কাকের সঙ্গে তুলনা করব না। কবির সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। তাতে জাতির জন্যই মঙ্গল। জাতীয় জীবনে কিছু স্বপ্নদ্রষ্টার আবির্ভাব হবে। কিন্তু আশ্চর্য়ের বিষয় হলো—‘আকাশে উড়িয়া চলে একপাল হাতি’ মার্কা কবিতার সংখ্যাই দিনদিন বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের অনুসারী দরকার। শেলি, বায়রন, কিটসের ভাবাদর্শ লালন করা জরুরি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ নুরুল হুদা, সৈয়দ শামসুল হকরা তাদের যোগ্য উত্তরসূরি কি তৈরি করতে পেরেছেন? একজন বিদগ্ধ পাঠক হিসেবে এটা আমার ব্যক্তিগত প্রশ্ন।
লেখালেখিতে বরাবরই তরুণের সংখ্যা বেশি। পরে হয়তো সে সংখ্যাটা কমে আসে। অনেকেই নানাবিধ জটিলতায় পড়ে কাব্য বা সাহিত্য চর্চার মতো অতীব জটিল বস্তুটিকে ধরে রাখতে পারেন না। হয়তো এই বহুসংখ্যক লেখক-কবির মধ্য থেকেই আগামীর পথপ্রদর্শক কেউ বেরিয়ে আসবে। জাতি সেই অপেক্ষায় আয়োজন করে বইমেলার। ফসলের মাঝে কিছু আগাছা থাকে। তাই বলে তো আর ফসল ফলানো বন্ধ হবে না। আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
কিছুদিন আগে ফকির ইলিয়াস একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, বছরজুড়েই বই প্রকাশিত হওয়া দরকার। ইউরোপ আমেরিকায় সেটাই হয়। তাড়াহুড়োর মাঝে ভালো বই পাঠক বাছাই করতে পারেন না। এর জন্য সময় দরকার। আলোচনাবহুল রিভিউ দরকার। মেলার একমাসে কি সেই সুযোগ হয়? না হয় না। হয়তো কিছু ব্যবসা হয়। ব্যবসা আর পরিশুদ্ধ সাহিত্যের প্রসার কিন্তু এক নয়।’
মানোন্নয়ন সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেছেন, ‘প্রকাশনা সংস্থাগুলোয় শিক্ষিত রুচিশীল সম্পাদক নিয়োগ দিতে হবে। সারাদেশে প্রচুর ভালো লেখক রয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করতে হবে।’
সম্প্রতি আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেছেন, ‘বইমেলা একটা আলতু-ফালতু বিষয়।’ জানি না তিনি কেন এ কথা বলেছেন। হয়তো যুক্তিযুক্ত কোনো কারণও থাকতে পারে। শুধু একমাসকে ঘিরে সাহিত্য চর্চা হবে তা নয়—সাহিত্য চর্চা সর্বকালের সর্বসময়ের। তাকে কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। বা ঠিকও নয়। কিন্তু বইমেলাকে ঘিরেই আমাদের প্রকাশের প্রসব বেদনা অতিমাত্রায় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
তাই বলতে চাই—পাঠকের মতো পাঠক বাড়ুক। মানুষের মতো মানুষ বাড়ুক। লেখকের মতো লেখক বাড়ুক। বইয়ের মতো বই বাড়ুক। বাড়ুক ভালোবাসা, বাড়ুক উচ্ছ্বসিত প্রাণ। দীর্ঘ-দীর্ঘ বছর বেঁচে থাকুক প্রিয় গ্রন্থমেলা। বেঁচে থাকুক লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের ভালোবাসায়। বেঁচে থাকুক প্রাণের ছোঁয়ায়। জয়তু গ্রন্থমেলা। সাহিত্যের জয় হোক। বাংলা সাহিত্য প্রসারিত হোক।