ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাবর্ষ হলো সৌরপঞ্জিকাকেন্দ্রিক একটি বর্ষ। ইতিহাসসূত্রে জানা যায়—মোগল সম্রাট আকবর এই বর্ষের প্রবর্তক। ৯৬৩ হিজরি, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর আকবর দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই সালের প্রবর্তন করেন। এটাও জানা যায় যে, কৃষিকাজের সুবিধার্থে তিনি এই সালের প্রবর্তন করেন। কৃষিপণ্যের খাজনা আদায়ে মোগল সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকার দিন-তারিখ অনুসরণ করতেন বিধায় কৃষকরা খাজনা পরিশোধে নানা অসুবিধার সম্মুখিন হচ্ছিল। এ কারণে চন্দ্রের ওপর হিজরি সালের নির্ভরতা। ফলে তিনি ওই সালের প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। এই সালের দিন গণনা শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। তাই একে সৌরদিনও বলা হয়।
ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, ৯৯৮ হিজরি, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ রাজ জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী আকবরের নির্দেশে হিন্দু সৌর সাল এবং আরবি হিজরি সালের ভিত্তিতে যখন বাংলা সাল উদ্ভাবন করেন, তখন এই সালের বয়স ধরা হয় ৯৬৩ বছর। তখন নতুন সালটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল। বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয় পরবর্তীকালে। বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। নক্ষত্রের নামের ওপর ভিত্তি করেই এই নামকরণ। যেমন, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে মার্গশীষ বা অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন, চিত্রা থেকে চৈত্র। বাংলা সালের সপ্তাহের সাতদিনের নামকরণ হয় গ্রহ ও দেবতাদের নামের আশ্রয়ে। যেমন, সোম বা শিব দেবতা থেকে সোমবার, মঙ্গল গ্রহ থেকে মঙ্গলবার, বুধ গ্রহ থেকে বুধবার, বৃহস্পতি গ্রহ থেকে বৃহস্পতিবার, শুক্র গ্রহ থেকে শুক্রবার, শনি গ্রহ থেকে শনিবার, রবি বা সূর্য দেবতা থেকে রবিবার।
বাংলা সন প্রবর্তিত হওয়ার আগে হিন্দু সৌরপঞ্জিকার আমলেও নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালিত হতো। ঐতিহাসিকদের মতে, অনেক অনেককাল আগে থেকে এই সৌরপঞ্জিকায় বাংলার বারো মাস অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন বৈশাখের প্রথম দিন আসাম, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, বঙ্গ, নেপাল, উড়িষ্যা, কেরালা, মনিপুর, ত্রিপুরায় পালন করা হতো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশরূপে। কৃষিকাজ ঋতুনির্ভর ছিল বিধায় আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে তখন এই নববর্ষ উদযাপিত হতো ।
বাংলা সনের প্রবর্তনের পরে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা ঘটে। এটাও আকবরের আমলে। তখন চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে জমিদার-তালুকদারদের কাছে বাংলার চাষাদের খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। তখন বাংলা নববর্ষের প্রকৃত উৎসব বলতে হালখাতাকেও বোঝানো হতো। ব্যবসায়ীরা চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে পুরনো খদ্দেরদের থেকে প্রাপ্য বা বাকি অর্থ বুঝে নিয়ে পুরনো হিসাবের খাতা বন্ধ করে পরদিন পহেলা বৈশাখে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। নতুন-পুরনো খদ্দেরদের মাঝে সেদিন মিষ্টি ও অন্যান্য খাবার পরিবেশন করতেন । সেদিন জমিদার-তালুকদার-ভূস্বামিরাও নিজ নিজ অঞ্চলের চাষা ও অধিবাসীদের মাঝে একই কাজ করতেন। তারা মেলা ও বিভিন্ন উৎসবেরও আয়োজন করতেন।
দুই.
বাংলা সনের প্রবর্তনের পরে যেভাবে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়, এখন হুবহু সেভাবে পালন করা হয় না। জমিদার-তালুকদার-ভূস্বামীরা না-থাকার কারণে তাদের কাছে বাংলার চাষাদের খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করার রীতির বিলুপ্তি ঘটেছে। ফলে তারা পহেলা বৈশাখে যে ধরনের মেলা ও উৎসবের আয়োজন করতেন, সেগুলোও বিলুপ্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব আছে বিধায় হালখাতা খোলা হয় ও পুরনো-নতুন খদ্দেরদের মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। এছাড়া গ্রামে-গঞ্জে আগের মতোই ঘরে ঘরে পাচন রান্না করা হয়, ভালো খাওয়া-ভালো পরা-প্রাতস্নান করা-ঘরের জিনিসপত্র ধোয়ামোছা ও ঘর পরিষ্কার রাখা হয়। অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য ঘরে ঘরে নানা লোকজ খাবারও প্রস্তুত করা হয়।
তিন.
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে আধুনিকভাবে বাংলা নববর্ষ পালন আরম্ভ হয়। তখন পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশের বিজয় কামনার উদ্দেশ্যে ছিল এই আয়োজন। পরবর্তীকালে ১৩৭২ বঙ্গাব্দে, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ছায়ানট ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ শীর্ষক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটি গেয়ে রমনার বটমূলে, আসলে একটি পুরনো অশ্বত্থ গাছের ছায়ার নিচে উক্ত বর্ষকে বরণ করে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ছায়ানট অনেক জাঁকজমকপূর্ণভাবে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতা কিংবা সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদেই এভাবে আয়োজন করা হয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই তা পালিত হয়ে আসছে বলা যায়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট, বর্তমান চারুকলা অনুষদ পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন করে। এর বৈশিষ্ট্য হলো, পহেলা বৈশাখ সকালে চারুকলা থেকে শোভাযাত্রাটি বেরিয়ে ঢাকা শহরের নানা সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার ফিরে আসে সেখানে। তাতে অজস্র রঙিন মুখোশ ও প্রাণিমূর্তির সমাহার থাকে। এভাবে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। শুধু তা’ই নয়, তাতে একেক বছর হাতি কিংবা বাঘ কিংবা কুমির প্রভৃতিকে থিম হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এমনকি এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিবাদও জানানো হয়।
চার.
আধুনিকভাবে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হওয়ার পর থেকে এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মেলা। নতুন ধাঁচের এসব মেলায় শিশুদের বিভিন্ন খেলনা, লোকজ নানা খাবার, লোকজ নানা দ্রব্য ও পণ্য বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন লোকজ গান গেয়ে মেলাকে আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করা হয়। মেলায় যেসব গান গাওয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে কবিগান, গাজির গান, জারি গান, মাইজভান্ডারি গান, পালাগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, আস্কর আলী পণ্ডিতের গান, সেকান্দর গাইনের গান, হাছন রাজার গান, কীর্তন, বাউল, মুরশিদি, মারফতি, ফকির ইয়াছিন শাহর গান, রমেশ শীলের গান প্রভৃতি। লোকনৃত্য ও সার্কাসও প্রদর্শন করা হয়। মেলাগুলোয় এসব গান, লোকনৃত্য ও সার্কাস দেখতে ভিড় জমায় শিশু, নারী ও বুড়ো-বুড়িরা। জানা যায়, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে প্রায় তিন শতাধিক মেলা বসে। কোনো কোনো মেলা বৈশাখ মাসজুড়ে চলে। এসব মেলায় পুতুল নাচ, বলি খেলা, লাঠি খেলা, ষাঁড়ের ও মোরগের লড়াই, হা-ডু-ডু ও কাবাডি খেলার আয়োজন করা হয়। পহেলা বৈশাখের পরেও বৈশাখী মেলার আয়োজন চোখে পড়ার মতো। ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের লালদিঘির পাড়ে বিরাট মেলা বসে। তাতে জব্বারের বলি খেলার যে-আয়োজন হয়, তা সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয়।
পাঁচ.
বাংলাদেশে উপজাতীয়দের মধ্যেও মহাসমারোহে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। বিশেষ করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা অর্থাৎ খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের এ উৎসব বৈসাবি নামে পরিচিত। তবে ত্রিপুরাদের কাছে তা বৈসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমাদের কাছে বিজু নামে আদরণীয়। বৈসু থেকে বৈ, সাংগ্রাই থেকে সা, বিজু থেকে বি নিয়েই বৈসাবি নামের উৎপত্তি। তিন জেলার উপজাতীয়দের কাছে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বৈসাবি অত্যন্ত বড়ো উৎসব। পুরনো বছরকে বিদায় দেওয়ার উদ্দেশ্যে বছরের শেষ দু’দিন এবং নববর্ষকে বরণ করার জন্য নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ পালনের মধ্য দিয়ে বৈসাবি উদযাপন শেষ হয়। এ উৎসবে উপজাতীয়রা নানা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। আদিবাসী মেলারও আয়োজন হয়। এছাড়া নববর্ষের দিনে মারমারা পানিখেলায় মেতে উঠে। মারমারা পানিকে নির্মলতার প্রতীক মেনে থাকে। মারমা তরুণরা সেদিন মারমা তরুণীদের পানি ছিটিয়ে নির্মল করে নেয়।
তথ্যসূত্র
১। বাংলাপিডিয়া
২। উইকিপিডিয়া
৩। পহেলা বৈশাখের কথকতা, জামিউর রহমান রনিম, ১৩.০৪.২০১৪, বিডিনিউজ২৪.কম।