একটি অক্ষরের একটি শব্দ ‘মা’। এই শব্দটিই পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দ। এই একটি শব্দে সমস্ত ভালোবাসা-আবেগ এসে মিলিত হয়েছে। আমাদের সমাজে নানা রকম সম্পর্কের বেড়াজাল রয়েছে। সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন করে কেউ দূরে চলে গেলে মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি হতেও পারে; কিন্তু ‘মা’-এর স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন কখনো ছিন্ন হয়েছে- এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। মা একটি সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান। আবার সেই মা-ই সন্তানকে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করে একটু একটু করে বড় করে, পরিপূর্ণ মানুষ করে তোলেন। ফলে মায়ের অবদান যে কত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ, তা কিছুতেই লিখে শেষ করার নয়।
একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে তার বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত সময়কালটি আবর্তিত হয় মাকে ঘিরে। প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে নারী হবে মা। এটি নারীর প্রকৃতিগত প্রাপ্তি। নারীর মা হওয়া তার জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। একটি সদ্যজাত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে তাকে তিল তিল করে বড় করে তোলার দায়িত্বটি পরম যত্ন-নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন মা। যে মা সন্তানকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করেন, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অপরিসীম মায়া-মমতায় পৃথিবীর বুকে ধীরে ধীরে বড় করে তোলেন, মানুষের কোনো ভাষাতেই, কোনো কথাতেই বুঝি সেই মায়ের অবদানের পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরা যায় না। মা তো মা-ই। মা’র কোনো তুলনা হয় না। শ্রদ্ধা, সম্মান, ভক্তি, সেবা, ভালোবাসা দিয়ে মা’র প্রতি হয়তো কিছুটা দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। এরপরও ‘মা-এর ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়’।
পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব
মাগো, বলো কবে শিতল হব
কত দূর আর কত দূর বল মা
আঁধারের ভ্রূকুটিতে ভয় নাই,
মাগো তোমার চরণে জানি পাব ঠাঁই,
যদি এ পথ চলিতে কাঁটা বিঁধে পায়
হাসিমুখে সে বেদনা সবো॥
মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের চেয়ে মধুর সম্পর্ক আর নেই। নদীর মতো প্রবহমান মানুষের জীবন। নদী প্রবাহ যেমন থেমে থাকে না, মানুষের জীবনও সে রকমই। জীবন চলার পথে মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে। এ চলমান জীবনের একটি পর্যায়ে নারী এসে পুরুষের সঙ্গে বিবাহের অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে। জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। প্রেম-ভালোবাসা-সংসারের দিনযাপন আর অভিজ্ঞতার পথ বেয়ে পুরুষ হয় বাবা আর স্ত্রী হয় মা। মাতৃত্ব হচ্ছে নারীর চিরন্তন রূপ। সে মাতৃত্বের সার্বিক প্রকাশ ঘটে তার সন্তানকে লালন করার মধ্যে। এক বা একাধিক সন্তানকে ঘিরে রচিত হয় স্নেহ-মমতা-ভালোবাসায় মায়ের এক নতুন পৃথিবী। বাবা-মায়ের জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, অপূর্ণ স্বপ্ন সন্তানদের ঘিরে ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হয়।
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষকে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেখা যায়। সব কালে, সব দেশে চিরকালই মায়ের ভূমিকা এক ও অভিন্ন। প্রতিটি মা’ই সন্তানের প্রতি যেমন যত্নবান তেমনি তার অমঙ্গলের ব্যাপারে শঙ্কিত। সভ্যতার আদি যুগে পুত্র যখন জঙ্গলে শিকার করতে গেছে তখন উদ্বিগ্ন মা তার পথ চেয়ে বসে থেকেছেন। পরবর্তীসময়ে সন্তান যখন লড়াই করতে গেছে তখন মায়ের বুক শঙ্কায় দুরু-দুরু করেছে। আধুনিক যুগে সন্তান যখন পড়াশোনা করতে দূর দেশে যায়, তখন মমতাময়ী মা তার ফেরার আশায় দিন গোনেন। এখন সংসারে একটু সচ্ছলতা আনার আশায় ছেলে যখন হাজার হাজার মাইল দূরের দেশে চাকরি নিয়ে চলে যায়, তখন ফোনে তার কণ্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন মা। পৃথিবীর সব দেশের মা’ই সন্তানের মৃত্যুতে বুক চাপড়ে কাঁদেন, তার আহাজারিতে ভরে ওঠে আকাশ-বাতাস। কোনো প্রলোভন দিয়েই কোনো মাকে তার সন্তানের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত করানো যায় না। সন্তান বড় হলেও তার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবন দিতেও দ্বিধা করেন না কোনো মা।
বিশ্বের নামি-দামি, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা নিজের মা সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। মাকে বসিয়েছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাকে নিয়ে অসামান্য অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন- ”আমার মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তিনি কোনো দিন আমার আব্বার সাথে শহরে থাকতেন না। তিনি সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন, আর বলতেন, ‘আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে তাঁর বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।’’ আবার আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, ‘যার মা আছে সে কখনই গরীব নয়।’ আমাদের কবি-সাহিত্যিকরাও মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা জানাতে রচনা করেছেন শত শত কবিতা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মা’ কবিতায় মায়ের যে অপরূপ ছবিটি এঁকেছেন তা অতুলনীয় :
যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!
কবি কাজী কাদের নেওয়াজ ‘মা’ কবিতায় বলেছেন-
মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।
কবিদের কলমের আঁচড়ে মায়ের যে রূপটি ফুটে উঠেছে তা মিষ্টি-মধুর, চিরচেনা। শুধু কবিতা বা সাহিত্যেই নয়, পৃথিবীর সব ধর্মেও মাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেকালে বা অতীতে প্রায় সব মা’ই অশিক্ষিত ছিলেন। আর আজকের এ ডিজিটাল বিশ্বেও অনেক মা’ই নিরক্ষর। কিন্তু শিক্ষা বা অশিক্ষার সঙ্গে মাতৃস্নেহের কোনো সম্পর্ক নেই। মায়ের স্নেহ ফল্গুধারার মতো স্বতঃউৎসারিত এবং অফুরন্ত সম্পদ। ধনী বা দরিদ্র অবস্থার ওপরও মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা নির্ভর করে না। মা সর্বংসহা ধরণীর মতোই সন্তানকে শত বিপদে সন্তানকে আগলে রাখেন।
এবার মা-দিবস পালনের দিকটি খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। সর্বংসহা মাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে বিশ্বে মা দিবস পালনের প্রথম উদ্যোগ নেয় ব্রিটেনের মানুষ। তখন প্রতি বছর মে মাসের চতুর্থ রবিবারকে ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে পালন করার রেওয়াজ চালু হয়। এর অনুসরণে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় আসা লোকেরা সতেরো শতকে ‘মা দিবস’ উদযাপন প্রথম চালু করে। অবশ্য তা পরে টিকে থাকেনি। এরপর ১৮৭২ সালে জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামের একজন নারী সমাজকর্মী ২ জনকে শান্তির জন্য মা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে মায়েদের প্রতিবাদী হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি দিবসটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করানোর জন্য চেষ্টা করেন। তবে সফল হতে পারেননি। তার চেষ্টা ছিল বোস্টন শহরকেন্দ্রিক। ১৮৮০ ও ’৯০-এর দশকেও মা দিবস প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলে। তবে স্থানীয় পর্যায়ের বাইরে তার আন্দোলন বিস্তৃত হতে পারেনি। পরবর্তীকালে মা দিবস উদযাপনের কৃতিত্ব যার প্রাপ্য তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার অ্যানা জারভিস। ১৯০৫ সালে তিনি এ দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করানোর জন্য চেষ্টা শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তিনি ভার্জিনিয়া ও পেনসিলভানিয়ার কয়েকটি গির্জা প্রধানদের কাছে আবেদন জানিয়ে সেসব গির্জায় মা দিবস উদযাপন করাতে সক্ষম হন। তার আন্দোলনের ফলে যুক্তরাজ্যের কয়েকটি রাজ্য ১৯১০ সালে মা দিবস উদযাপন শুরু করে যেগুলোর মধ্যে ছিল তার নিজের রাজ্য পশ্চিম ভার্জিনিয়া। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯১৪ সালে প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার ‘মা দিবস’ ঘোষণা করে এদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। তখন থেকেই সারা বিশ্বে মা দিবস পালিত হয়ে আসছে। আরো পরে ১৯৬২ সালে মা দিবস আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫০টি দেশে প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্ব মা দিবস পালিত হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের জীবনে যার ভূমিকা অতুলনীয়, তিনি হলেন আমাদের মা। সন্তানকে ঘিরে যে মায়ের স্বপ্নময় ভুবন রচিত হয়, সে মা এক সময় বার্ধক্যে উপনীত হন। সন্তানের জীবনে ততদিনে কাঙ্ক্ষিত নারী বা পুরুষের আগমন ঘটে, সেখানে সূচিত হয় জীবনের বাড়-বাড়ন্ত। কিন্তু তারপরও মা যে মা, সেই মা-ই থেকে যান। সন্তানের মঙ্গল-অমঙ্গল, কল্যাণ-অকল্যাণের চিন্তা-উদ্বেগ তখনো তাকে ঘিরে থাকে। বলা দরকার, বিশ্বের সব দেশে সব মা-ই এক, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের মায়েরা যেন তারপরও আলাদা। মনে হয়, আমাদের মায়েরা সন্তানের জন্য বুকের সবটুকু স্নেহ-ভালোবাসা নিঃশেষে উজাড় করে দেন। বাঙালি মায়েরা শাড়ির আঁচলে সন্তানকে ঢেকে রাখেন। মা নিজের ঘুম, সুখ বিসর্জন দিয়ে মাটির চুলায় ছেলেকে দু’মুঠো ভাত রেঁধে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মা সন্তানের জন্য কী করেছেন, কিভাবে মুখে তুলে খাইয়েছেন, মল-মূত্র নির্দ্বিধায় পরিষ্কার করেছেন, অসুস্থতায় না ঘুমিয়ে না খেয়ে সন্তানের সেবা করেছেন, কচি হাত ধরে পা পা করে হাঁটতে শিখিয়েছেন, স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন, রোদ-বৃষ্টি-ঠাণ্ডা সহ্য করে ছুটি না হওয়া পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন- এসব কোনো সন্তানেরই ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ভুলে যাওয়াও ঠিক নয়। তাই প্রতিটি সন্তানেরই উচিত মাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। বিশেষ করে বার্ধক্যে সব-সময় মায়ের পাশে থাকা। প্রতিটি সন্তানেরই এটা মনে রাখা উচিত যে তার জীবনের প্রথম উচ্চারিত শব্দ ‘মা’। পৃথিবীতে মায়ের জয় হোক। বিশ্বে ‘মা দিবস’ আরও মর্যাদাময় হোক- এটাই প্রত্যাশা।