নিলক্ষা আকাশ নীল
হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর
নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে ঊনসত্তর হাজার
ধবল দুধের মতো জোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ-পূর্ণিমার।
নষ্ট মাঠ, নষ্ট ক্ষেত, নদী নষ্ট বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার
তখন কেন দেখা দেয় নীলক্ষার নীলে তীব্র শিষ দিয়ে এত বড় চাঁদ?
অতি অকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি?
কোন শব্দ?
কিসের প্রপাত?
(নূরলদীনের সারাজীবন)
আমি তাঁকে চিনি না। চিনি কেবল তাঁর ভেতরের মানুষ, যে মানুষ কবিতায় কথা বলেন, আঁকেন মানুষের ভেতরের অবিকল সত্য মানুষ। যে মানুষ বুকের যাতনা ঢেলে হৃদয় কাড়েন, হৃদয়ে মন্থন করে তুলে আনেন নীল বিষ–যা অশেষ-বিশেষ হয়ে জেগে রয় আমারও অন্তরাত্মায়।সে মানুষ তাঁর বিষাদে মিলায় আমারও বিষাদ। চিরকাল ধরে বলে যান, কেবলই মানুষেরই কথা। যে মানুষ দু’হাতে লেখেন। লেখেন কালঘুম, লেখেন জেগে ওঠা, লেখেন অনাচার, লেখেন নিপীড়িত শোষক আর শোষণের অপরূপ রূপকথা। লেখেন ইতিহাস ইশতেহার আরও লেখেন দেহ-কাম-প্রেম আর পুরাণ এবং মানবের জৈবিক বাসনাও। কিন্তু যার সবই ডানামেলা পাখি, উদাস করে আকাশ, সুন্দর করে মন, পরিষ্কার করে দেশ, জাগিয়ে দেয় দ্রোহ-বিদ্রোহ, নাড়িয়ে দেয় শাসকের বেদী, তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তিনি সব্যসাচী, তিনিই তো সামলাবেন দুই হাতে জীবন আর মরণ। কে তারে পারে দেখাতে মরণের ভয়!
তাইতো মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছেন প্রিয় জন্মভূমিতেই। মৃত্যুরে জয় করে নেবেন তিনি ভালোবেসে, কিন্তু সুদূর প্রবাসের দারুণ বিলাসে নয়। হত-দরিদ্র এই মাটিরই বুকে। মৃত্যুরে পরাজিত করেছেন যিনি অসীম প্রেমে, মাতৃভূমিকে দিয়েছেন স্থান মাথার ওপরে। এই মুহূর্তে তাই বলতে চাই কবি চিরকাল সত্য বলেছেন। যা তিনি ধারণ করেছেন অন্তরে বেসেছেন ভালো তারই কথা তার কবিতায় যা অপরূপ এক সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে মৃত্যুর আগে আগে তাঁর কর্মে জীবনাচরণে:
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে একসাথে বাঁচবোই
এই তো প্রকৃত কবি। কবিকে প্রথমে হতে হবে মানুষ। মানুষ কারে বলি আমি? যে ভালোবাসে প্রথমে মা, তারপর মাটি-স্বদেশ, দেশের মানুষ। ভাষা সংস্কৃতির প্রতি যার অবাধ অগাধ ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসার তাড়নায়ই তিনি যাপিত জীবনের পরতে পরতে কখনো নীল বিষের মতো দাহ্য। কখনো অপরূপ আনন্দে নেশাতুর হয়েছেন আসক্ত। তবু আশা নিয়ে প্রত্যাশা নিয়েই বেঁচেছেন, প্রতীক্ষা করেছেন মৃত্যুর। তাই মরণ নিশ্চিত জেনেও ভাবছিলেন নতুন কোনো নাটক লেখার কথা। আমেরিকা থেকে ডাক্তারের শেষ উত্তর নিয়ে ফিরে আসার সময় নাসির উদ্দিন ইউসুফকে বলেছিলেন কি যেন একটা নাটক লিখবেন, নতুন। খুব দ্রুত শেষ করতে হবে সেটা। তাঁর (নাসির উদ্দিন ইউসুফ) সঙ্গে কাজ করবেন আবার। আবার থিয়েটার বুঝি তিনি মাতিয়ে তুলবেন। নতুন করে নূরলদীন আঁকবেন বুঝি ইতিহাসের পাতা ছিঁড়েখুঁড়ে। দোর্দণ্ড প্রতাপে আর স্যাটায়ারে লিখেছেন ‘খেলারাম খেলে যা’। লিখেছেন শ্রেণিবৈষম্যের করাল গ্রাসে বিলীন নিপীড়িত মানুষের যাতনার কাব্যনাটক ‘নূরলদীনের সারা জীবন’। আর সেই যে জীবন প্রদোষে পড়তে শুরু করেছিলাম তার ‘পরানের গহীন ভিতর’ তার কথা লিখতে গেলেই চিরকাল চোখ ভরে ওঠে জলে। আজ সেই পরানের গভীরে তাঁর বিরাজ। তাঁরই কথাগুলো একদিন যা বিরহী মনের যাতনার নির্বিশেষ হয়ে জ্বলে উঠেছিল। হৃদয় মন্থন করে তুলেছিল ক্রম অসীম—আজ তাঁরই বিরহে তাঁরই প্রকাশে যেন হৃদয়ে বইয়ে দিল এক হিম ঝরনা।
পাখি উড়াল দিয়া গ্যাছে গিয়া
এখন বিরান
এখন যতই আমি ছড়া দেই কালিজিরা ধান
সে কি আর আঙিনায় ফিরা আসে
আর কি সে খায়
(পরানের গহীন ভিতর)
চিরকাল দারুণ সত্য ভাষণে কথা বলেছেন। সমালোচনা করেছেন নির্ভিকচিত্তে দেশনেতা কিংবা সাহিত্যের। একইভাবে উন্নত রেখেছেন শির পৃথিবীর কিংবা সাহিত্যের ইতিহাসে। বলেছেন:
পরিচয়ে আমি বাঙালি আমার ইতিহাস আছে গর্বের
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস,
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ
একই হাসিমুখে বাঁশি বাজায়েছি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপস করিনি কখনোই আমি—এই হলো ইতিহাস।
(আমার পরিচয়)
আমি বলি এই হলো কবির অহং। ঠিক একই অহংবোধে তিনি চলেও গেলেন অজস্র মৃত্যুরে যেন জয় করে। ভালোবাসা প্রিয়, প্রিয় কবিরে জানাই শত শ্রদ্ধা আর প্রণাম।