কথাতেই বেড়ে চলে দিন। সময়ের হাত ধরে কথায় কথায় পা ফেলে এগিয়ে চলা। কথাতেই লুকিয়ে থাকে কত কথার প্রাণ। কথাতেই তারা প্রাণ পায় পৃথিবীর বুকে। তবু একসময় থেমে যায় সব কথা। পৃথিবীর বুকে নেমে আসে শান্ত শীতল সন্ধ্যা। কবির সঙ্গে তার দেখা হয়। কবি তার বুকে কান পাতেন। এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য তখন সমগ্র চরাচরে। কবি আর নৈঃশব্দ্য মুখোমুখি। কবি তন্ময় হয়ে শুনতে থাকেন নৈঃশব্দ্যের গান। তিনি তখন এক অচিনপুরের কল্পদেশে। হয়তো তখন আমাদের চক্ষে প্রতিভাত হয় কবিকে ঘিরে নিত্য নৈমিত্তিকের কোলাহল। প্রত্যেকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত বার্তা পৌঁছে দিতে চান কবির কর্ণকুহরে। অথবা কবিকে দেখি পার্থিব চাহিদার অপ্রাপ্তিজনিত জনরোষের মাঝে। কিন্তু কবি তখন কোথায়? তিনি তো তখন আমাদের স্পর্শের অতীত। সামান্য কিছু ধুলোবালিকে সম্বল করে তিনি তখন সবুজের গানে মুখর। পৃথিবীর চন্দ্রালোকিত রাতের বাতায়নে তার অনন্ত রাত্রিযাপন।
কী করে ছোঁয়া যায় নৈঃশব্দ্যের এই শীর্ষদেশ? কে পড়ে নিতে পারে নৈঃশব্দ্যের এই অনন্ত কথামালা? যে কথামালার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে রয়েছে নৈঃশব্দ্যের এক অযুত বর্ণমালা। আসলে এ যেন এক নতুন নতুন দ্বারোদ্ঘাটনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা। এক অবস্থানের সঞ্চয় আর এক অবস্থানের পাথেয় হয়ে ওঠে। জরাথ্রুষ্টের একটি কবিতায় আমরা এই নৈঃশব্দ্যকেই প্রত্যক্ষ করি:
নৈঃশব্দ্যের ভেতর যে নৈঃশব্দ্য
তার স্পর্শ পেলে
সমস্ত কোলাহলের ভেতর
যে পূর্ণ নৈঃশব্দ্য
শুধু তাকেই শুনতে পাবে।
যে অস্তিত্বের হাত ধরে আমাদের প্রাত্যহিক দিনযাপন, সেখান থেকেই আগ্রহী মন নৈঃশব্দ্যের শান্ত শীতল অস্তিত্বকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। প্রত্যহ চলতে থাকে নৈঃশব্দ্যের পাঠগ্রহণ। এই পাঠের অভ্যন্তরেই নিহিত থাকে নৈঃশব্দ্যের ফল্গুধারা। একটু একটু করে আগ্রহীরা এই ধারায় নিজেকে সমর্পণের অঙ্গীকার করে বসে। নৈঃশব্দ্যের প্রবাহে নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জনের উদগ্র ইচ্ছা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফেরে। কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগে এক নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন চলতে থাকে। নৈঃশব্দ্যের প্রথম কক্ষের সফলতা জনিত যে সঞ্চয় তার বলে বলীয়ান হয়েই দ্বিতীয় কক্ষের প্রবেশের ছাড়পত্র প্রাপ্তি।
দ্বিতীয় কক্ষের নৈঃশব্দ্য আরও গভীর। এখানে সব কথাই যেন হারিয়ে ফেলে পথ। এই কক্ষেই আমাদের চোখে পড়ে নৈঃশব্দ্যের আর এক ইমারত।
উপত্যকা থেকে শুরু হয় যাত্রা সানুদেশের উদ্দেশে। পথিমধ্যে আমরা শিশির পতনের শব্দ, আলোর সমুদ্র ভেঙে ভেঙে সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা, অস্তমিত সূর্যের ক্লান্তির সংস্পর্শে আসি। শব্দহীনতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা যে শব্দ তা আমাদের মননের ওপর এক আস্তরণ বিছিয়ে দেয়। এই আস্তরণের গভীরতা আমাদের আরও এক নৈঃশব্দ্যের মুখোমুখি করে দেয়। আমরা তখন এক রূপান্তরিত মানবসত্তা। যে সত্তার হাত ধরে আমরা পৌঁছে যাই নৈঃশব্দ্যের প্রায় সানুদেশের কাছাকাছি। হাজার কোলাহলের মধ্যে থেকেও আমরা তখন আপন হৃদয়পুরে সদ্য নির্মিয়মান নৈঃশব্দ্যের ভূমিগৃহের স্থায়ী বাসিন্দা হতে চলেছি। আমাদের চোখে তখন একে একে ভেসে উঠছে নৈঃশব্দ্যের স্বর্গপুরে পারিজাত বৃক্ষসকল।