চলচ্চিত্র যে নাটক, টেলিফিল্ম নয়—এটাই বুঝতে চান না এদেশের বর্তমান প্রতিভাবান (?) অনেক নির্মাতা। অথচ চলচ্চিত্র যে নাটক, উপন্যাস, চিত্রকলা বা টেলিফিল্ম নয় এটা শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গ্রেট স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়। তার ‘পথের পাঁচালী’ থেকে শুরু করে ‘আগুন্তুক’-এ তিনি তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন সিনেমা দর্শকদের। এটা এতদিনেও বুঝতে পারছেন না আমাদের নির্মাতারা।
কারা কী বলেন, আভিধানিক ভাষা কী, তা আমিও স্পষ্ট নই, তবু বলি সিনেমাকে আমরা এখনো ‘ছবি’ই বলি। ছায়াছবিও বলেন কেউ কেউ। আগে এই বঙ্গ দেশে একে ‘বই’ও বলত। এর একটা কারণ ছিল তখন। বই থেকেই তখন বেশির ভাগ সিনেমা হতো। বিখ্যাত সব গল্প উপন্যাসকে রূপান্তর করার চেষ্টা করা হতো সিনেমায়। এখনও সিনেমাকে চলচ্চিত্র খুব কম মানুষই বলে। দু-একজন শুদ্ধচারী একে বায়োস্কোপ বলেও মানতে রাজি।
তো অনেক বছর পর একটি সাধারণ, সনাতন সিনেমা হলে যাওয়া হলো সিনেমা দেখার জন্য। হলের নাম আনার কলি সিনেমা। টিকিটের গায়ে ওপরে লেখা—‘অবসরের আনন্দ’। নিতান্তই সাবেকি ঢংয়ের কাঠামো। শীতাতপ ব্যবস্থা আছে কি না—বোঝা গেল না, চারদিকে ফ্যানের দৌরাত্ম্য দেখে। বন্ধ ঘর থেকে বের হলে মাথাধরা একটা ভাবের সৃষ্টি হয় তাও ভর করল শরীর আর মনে। আর আসন ব্যবস্থাও এমন যে পেছনের জনের পা গিয়ে ঠেকে সামনের জনের ঘাড়ে। আর কেউ যদি পা নাচায়, তাহলে পুরোসারি কাঁপতে থাকে বাইব্রেশন দেওয়া মোবাইল ফোন সেটের মতো। ডিসি মানে ড্রেস সার্কেলের একটি টিকিটের মূল্য ৬০ টাকা। ঢাকার খুব কাছে, মাত্র একটা নদী—তুরাগ। এই নদীতীরের শহর টঙ্গী। সেই শহরের সিনেমা হল আনারকলি। টিকে আছে অনেক সংগ্রাম করে। সেই হলে ২৫ অক্টোবর, শনিবার সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম সিনেমা দেখতে। সনাতন ঢংয়ের রূপালী পর্দার সঙ্গে যোগাযোগ এখন খুব কম। মাঝে মাঝে অবশ্য যেতে হয় মাল্টিপ্লেক্সে। আর কলকাতায় গেলে সিনেমা দেখা হয় সাধারণ হলেই। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে ওখানে অবশ্য সিনেমা হলগুলো আধুনিক করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছে ঢাকার বলাকা, মধুমিতা।
ঢাকার আরেকটি পুরনো সিনেমা হল আনন্দ’র কথা জানি না। মাঝে কিছুদিন ওই হলটির জমি বেচাকেনার সাইনবোর্ড ঝুলেছে। ডেসটিনি নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আনন্দ সিনেমা হলের জমির মালিকানা দাবি করেছিলো ক্রয়সূত্রে, সেই ডেসটিনিই এখন বিপন্ন। ‘ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক’ কাপড়ে টাঙানো ডেসটিনির এই ব্যানারটি আর এখন নেই আনন্দ সিনেমা হলের গায়ে। ঢাকা শহর থেকে অনেক সিনেমা হল বিলুপ্ত হয়ে গেছে ব্যবসায়িক সুবিধা না পেয়ে। গুলিস্তান-সাবিস্তানতো এখন ইতিহাসের পাতায় জায়গা নিয়েছে। তো এমন এক সময়ে আমি সিনেমা হলে গেলাম একটি বাংলা সিনেমা দেখার জন্য। ছবির নাম ‘পিঁপড়াবিদ্যা’। সান্ধ্য শো শুরু হওয়ার কথা সাড়ে ছড়ায়। শুরু হলো অনেক পরে। কেন? আমাদের সনাতনী হলগুলোর ছবি চালানোর ইতিহাস হলো ৩ ঘণ্টায় এক শো-এই হিসেবে। সেখানে পিঁপড়াবিদ্যা যদি সেই সময়ে অর্ধেক দৈর্ঘ্যের হয়, তাহলে গ্যাপ পূরণ হবে কী করে? তাই প্রায় অর্ধঘণ্টা ধরে অনেক আগে মুক্তি পাওয়া সিনেমার ট্রেলার দেখানো হলো। সুরেশ সরিষার তেলের যে বিজ্ঞাপন দেখানো হলো, তা অশ্লীলতা বললেও কম বলা হয়। সিনেমা হলে জাতীয় পতাকা প্রদর্শন আর জাতীয় সংগীত বাজানো নিয়েও এখন কথা বলা প্রয়োজন। এটা কোন সরকারের আমলে কেন প্রচলন করা হয়েছিল জানি না, তবে তখন হয়তো একটা ভালো কারণ ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে প্রহসনে। আমি বসেছিলাম মাঝামাঝি এক জায়গায়। দুদিকে সব তরুণ দর্শক। সিনেমা ঠিক সময়ে শুরু হচ্ছে না কেন, এই নিয়ে তারা তুমুল হৈ চৈ করছে থেকে থেকে। তারপর যখন সিনেমা শুরুর আগে শুরু হল জাতীয় সংগীত আর রূপালী পর্দায় তুলে উঠল ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত লাল-সবুজ পতাকা তখন কেউ দাঁড়ালো, কেউ বসে থাকলো, কেউ হাত নাড়লো। আমি জানি সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজার সময় দাঁড়ানো নাগরিক বাধ্যবাধকতা বা কর্তব্য। তার প্রতি তরুণদের এই অবহেলা কেন? সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টা খতিয়ে দেখতে পারেন। এমন সম্মান দেখানোর চেয়ে সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বন্ধে করে দেওয়ার পক্ষে আমি।
যাই হোক, অতপর শুরু হলো পিঁপড়াবিদ্যা। ইম্প্রেস টেলিফিল্মের এই সিনেমার নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানোর প্রয়াস করে থাকেন তিনি। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু কথা হলো পর্দায় চলছে পিঁপড়াবিদ্যা। আমি শুনছি আমার দুদিকে তরুণ দর্শকরা বলছে ‘হতাশ’। আমি একবার কান পাতছি সিনেমার সংলাপের প্রতি। কিন্তু সব শব্দ ছাপিয়ে হলের ভেতর রব উঠছে ওই হতাশ শব্দটি। এবং সিনেমা মানে পিঁপড়াবিদ্যা যখন শেষ হলো, তখনও হল থেকে বের হওয়ার পথে একই শব্দ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল।
ফারুকীর প্রথম সিনেমা ‘ব্যাচেলর’ প্রিমিয়ার শো দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার বলাকা সিনেমা হলে। সেদিন আমার পাশের আসনে ছিলেন খ্যাতিমান সাংবাদিক, সিনেমা সমালোচক মাহমুদা চৌধুরী। তিনি ব্যালেচর সম্পর্কে বলেছিলেন, এটা বড়জোর টেলিফিল্ম বলা যেতে পারে। এরপর ফারুকী আরও সিনেমা নির্মাণ করেছেন। আমার দেখা হয়নি। তার টেলিভিশন তো দেখলাম দেশের বাইরে অনেক কিছু জয় করে এনেছে। তবে পিঁপড়াবিদ্যা দেখে আমার মনে হলো ফারুকী এখনো নাটক আর টেলিফিল্ম থেকে বের হতে পারেননি। এমন কথায় তিনি হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন সিনেমা বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি? আমি এর কোনও উত্তর দিতে পারব না। তবে পিঁপড়াবিদ্যা দেখে আমার কোনওভাবেই তা সিনেমা বলে মনে হয়নি। ভালো লাগেনি, মনে ধরে রাখার মতো কিছু ছিলো না—এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমার মতো হয়তো এমনি লেগেছে ওই তরুণ দর্শকেদের। না হলে তারা থেকে থেকে হতাশ-হতাশ ধ্বনি তুলছিল কেন?
হলফেরত এক দর্শককে আমি জিজ্ঞেস করি কেমন লাগলো পিঁপড়াবিদ্যা? তিনি অনেকটা সময় নিয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ফারুকী বাংলা সিনেমার ধারাটা বদলে দিয়েছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে এখন মানুষ হলে আসে সিনেমা দেখতে। পিঁপড়াবিদ্যা দেখে কেমন লাগলো, কিছু শেখা গেল, ভালো লাগলো? আসলে ফারুকী সমাজের বাস্তব জিনিস তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এই যেমন এই ছবিটায়। যুবক, ডেসটিনির মতো তো কিছু কোম্পানিতে ইনভেস্ট করে সাধারণ মানুষ যেমন নিঃস্ব হয়েছে, তেমনি এর সঙ্গে জড়িয়ে অনেক তরুণ বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই সিনেমার কাহিনিতে তাদের মতোই এক তরুণ জড়িয়ে পড়ে এক অনৈতিক জালে। সেই লোভের জাল তার নিজের নির্মিত। সেই সর্বনাশা জাল থেকে সেই তরুণ আর বের হতে পারে না। এসব দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে পিঁপড়াবিদ্যায়। আমি ওই তরুণ দর্শকের কথা শুনি আর ভাবি একি ফারুকীর প্রতিষ্ঠানের কোনও লোক। যদি হয় তাহলে তার কাছে সঠিক মূল্যায়ন পাওয়া যাবে না। একটু আগে হলের ভেতরে আর বাইরে কজন তরুণকে দেখেছি হাতে ক্যামেরা। তাদের গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট তাতে লেখা পিঁপড়াবিদ্যা। তারা ভেতরে এবং হলফেরত দর্শকদের ছবি তুলছিল। এখন যুগটাই এমন। ছবি বানালেই চলে না। তা চলার জন্য দেশে-বিদেশে প্রচারণা চালাতে হয়। এটা কেবল আমাদের সিনেমার ক্ষেত্রে নয়, হলিউড, বলিউড সবখানেই প্রচারের ডামাঢোল পেটাতে হয়।
আমাদের দেশেও প্রমোশন বা প্রচারণার নতুন নতুন কৌশল শুরু হয়েছে। সেই সন্ধ্যায় আনার কলি সিনেমা হলের ডিসির প্রথম সারির দর্শকদের আচরণ এবং ক্যামেরার সামনে তাদের পোজ দেওয়ার কায়দা দেখে মনে হচ্ছিল—এরা ফারুকীর ‘ভাই-ব্রাদার’। আর আমি যার সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাকেও ওই দলের সদস্য মনে হলো। তবে তিনি স্বীকার করলেন আমাদের দেশে কাহিনির বড় অভাব। ইদানিং কলকাতায় যে বাংলা সিনেমা হচ্ছে তার মান অনেক অনেক উপরে। অটোগ্রাফ, চলো বদলাই, জাতিস্মর, ফড়িং, চোখের বালি, সব চরিত্র কাল্পনিক, রঞ্জনা আমি আর আসব না, দত্ত ভার্সেস দত্ত, ভূতের অভিষ্যত, বাইশে শ্রাবণ, চাঁদের পাহাড়—কলকাতায় সম্প্রতি নির্মিত এসব সিনেমার নাম উল্লেখ করে ওই দর্শক বলেন, সে তুলনায় আমাদের এখানে কিছুই হচ্ছে না। আমি তার সঙ্গে সহমত দেখাই এবং ভাবি আসলে ফারুকী বা অন্য যারা এখানে বলছেন তারা সিনেমা করেন, তারা কি আদৌ সিনেমা বোঝেন? সত্যজিৎ রায় একটা সাবেকি আমলের নটখটে ক্যামেরা দিয়ে পথের পাঁচালী নির্মাণ করে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ‘অপরাজিত’ বানানোর সময়ও নিশ্চয় তিনি ভালো কোনও টেকনোলজি পাননি। তারপরও অমন সিনেমা, এখনো যতবার দেখি ভাবায়, চোখ জুড়িয়ে যায় দৃশ্যের ডিটেইল কাজ দেখে।
আর আমি, ১৪২১ বঙ্গাব্দের কার্তিকের সন্ধ্যায় ৬০ টাকা খরচ করে তুরাগপাড়ের শহর টঙ্গির সিনেমা হলে বসে কী দেখলাম? সিনেমাটার একটা দৃশ্যও মনে দাগ কাটলো না। আলোচনা করার মতো মিউজিক নেই। সিনেমাটোগ্রাফ মোটেও আলাদা কিছু নয়। কাহিনি একটা আছে। নানা সময়ের নানা ক্ষত থাকে। তেমনি এ সময়ের একটি ক্ষতকে উপজীব্য করা হয়েছে। আমি দিব্যি করে বলতে পারি, পিঁপড়াবিদ্যা দেখতে দেখতে আমার মাথা ব্যথা হয়েছে। আমি জানি না এ ছবি নিয়ে ফারুকী কত দূর যাবেন। তবে এটা বলতে পারি এতদিনেও আমাদের সিনেমা দাঁড়াতে পারলো না। সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, আলমগীর করিব, বেবী জামান, রাজ্জাক, রহমান, খান আতা, সত্য সাহারা হামাগুড়ি দিতে শিখিয়েছিলেন এ বাংলার চলচ্চিত্রকে। তারপর আমরা ধীরে ধীরে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছি। এখন ফারুকী আর তার ভাই-ব্রাদাররা কী করছেন একবার বিশ্লেষণ করে দেখা বড় প্রয়োজন।