আজকের বাংলা ভাষাভাষী ভূগোল বাংলা ভাষা বিকশিত হওয়ার পূর্ব থেকেই গ্রামপ্রধান সমাজব্যবস্থার অনুসারী ছিল। ইংরেজদের আগমন ও দখলের পর মূলত কলকাতাকে কেন্দ্র করে নগরজীবন-ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু সেই নগরজীবনের অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে যায় বৃহত্তর গ্রামবাংলা। মোগল আমলে ঢাকা মোগল বাংলার রাজধানী ছিল বটে কিন্তু তা ছিল গ্রামবাংলার আলো, হাওয়া, শ্বাস ও শব্দ পরিবেষ্টিত জনপদ। ইয়ং-বেঙ্গল মুভমেন্ট বাংলা ভাষায় এক ঝাঁক সাহসী ও অগ্রসর ভাবনার আধুনিক মানের লেখক উপহার দেয়। তারা ছিলেন ইউরোপীয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ইউরোপিয়ান সাহিত্য-সংস্কৃতির সমঝদার পাঠক ও গুণমুগ্ধ অনুসারী। তবু আমাদের আধুনিক সাহিত্য মূলত গ্রামীণ জীবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন শহর কলকাতার সন্তান—জন্মগত অর্থেও। তিনি বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের প্রবর্তক ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প বিচিত্র ধরনের। সেসব ছোটগল্পে গ্রামবাংলার জীবন-সংস্কৃতি প্রাধান্য পেয়েছে বটে; তবে একই সঙ্গে ‘নষ্টনীড়’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ইত্যাদি নগরজীবন-কেন্দ্রিক ছোটগল্পও তিনি রচনা করেছেন। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে নগরজীবনের উল্লেখযোগ্য ছবি ফুটে ওঠে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচ্চিত্র’ উপন্যাসে। সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান প্রমুখদের কথাসাহিত্যে গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নগরজীবনও গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করতে থাকে। পুরুষ লেখকদের পাশাপাশি নারী লেখকরাও এগিয়ে আসেন কথাসাহিত্য রচনায়। সে-পথেই বিপুল অবদান রেখেছেন দিলারা হাশেম, রাবেয়া খাতুন, রাজিয়া খান, রিজিয়া রহমান, দিলারা মেসবাহ, সেলিনা হোসেন, নাসরীন জাহান, মনিরা কায়েস ও নাসিমা সুলতানা। তাদের পথ থেকে এগিয়ে চলেছেন শাজনাজ মুন্নী, রুমা মোদক, শিল্পী নাজনীন, নূর কামরুন নাহার, রাশিদা সুলতানা, সাদিয়া সুলতানা, ম্যারিনা নাসরীন, এলিজা খাতুন, নাহিদা আশরাফী, ইশরাত তানিয়া—প্রমুখ কথাসাহিত্যিকও। তাদের ছোটগল্পে ও উপন্যাসে নগরজীবন গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে। আজ নূর কামরুন নাহারের ছোটগল্প নিয়ে কথা বলবো।
নূর কামরুন নাহার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প রচয়িতা, কবি ও প্রাবন্ধিক। পেশাগত জীবনে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরি করেন। তার কর্মক্ষেত্র আগাগোড়াই রাজধানী ঢাকা । আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে মতিঝিলের গণিরোডে অবস্থিত সচিবালয় সংলগ্ন একটি ভবনে তার অফিস। তিনি দেশের বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠান, কবি-কথাশিল্পীদের জন্মদিনের অুনষ্ঠান ইত্যাদিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। নিজের জন্মদিন পালন করেন ঘটা করে। সেখানে কবি-সাহিত্যিক এবং মিডিয়ার লোকজন অংশগ্রহণ করে থাকেন। তিনি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সঙ্গেও জড়িত হন মাঝে মাঝে। এভাবে দেশের প্রায় সব স্তরের কবি-কথাশিল্পী ও সাংবাদিকদের একটা অংশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে থাকেন তিনি। অন্যদিকে তার অফিসটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে নান স্তরের সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও মত-বিনিময়ের সুযোগ পেয়ে থাকেন তিনি। এতে করে উভয়বিধ কারণে শহরের বসবাসকারী ও কাজ উপলক্ষে শহরে যাতায়াতকারী মানুষজনের মন-মানসিকতা, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর ও নিবিড় ধারণ লাভে সুযোগ পেয়েছেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অফিসের কাজকাম, কাজের পরিবেশ, পুরুষ ও নারী সহকর্মীদের মাঝের সম্পর্ক, ঘরের বাইরে এসে অফিস আদালতে নারীদের কাজ করার পরিবর্তনশীল ছবি, অফিসের কাজে নিয়োজিত নারীদের বিষয়ে আধুনিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত পুরুষ কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের মনোভাব ও মানসিকতা প্রভৃতি বিষয় সূক্ষ্ণভাবে ও খুঁটিনাটি মাত্রায় পর্যবেক্ষণ করেছেন নূর কামরুন নাহার। তিনি ঠিক যাপিত জীবনের অডিটর নন কিন্তু জগৎ ও জীবনের আড়ালে থাকা অনেক অন্ধকার দিকে তার টর্চলাইটের আলোর মতো সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের চোখে ধরা পড়েছে। তার উপন্যাসে ও ছোটগল্পে তার প্রত্যক্ষ জীবনাভিজ্ঞতা, শানিত স্বজ্ঞা ও সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তির ছাপ পড়েছে একাকার ব্যঞ্জনায়। তিনি জাদুবাস্তবতার হুজুগে ভেসে যেতে চাননি বরং দেখা পৃথিবীর অদেখা রূপ ও চেনা মানুষের অচেনা স্বরূপকে উদ্ভাসিত করে তুলেছেন রঙিন আড়াল ও প্রতারক মুখোশ সরিয়ে। তিনি কবিতা লেখেন বলে কল্পনা শক্তি তার বড়ো একটা সহায়। কারণ সাহিত্য কেবল বাস্তবের ফটোকপি কিংবা ক্যামেরায় তোলা ছবি নয়। সাহিত্য একটি উন্নতমানের সৃজনশীল কাজ বলে সেখানে বাস্তবের ক্যানভাসে কল্পনার রঙ কমবেশি মেশাতেই হয়। নূর কামরুন নাহার বাস্তব আর কল্পনার সাযুজ্যপূর্ণ সংশ্লেষ ঘটিয়ে গল্প রচনা করেন, গড়ে তোলেন উপন্যাস।
কয়েক বছর আগে নূর কামরুন নাহারের ‘আলো’ নামক উপন্যাসটি পড়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিছু কথা লিখেছিলাম একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতায়। ওই উপন্যাসে তিনি নগরবাসী ও অফিসকেন্দ্রিক কয়েকজন নারী-পুরুষের ব্যক্তিত্ব, প্রেম, লাম্পট্য, উচ্চ মানবিকতায় উজ্জ্বল ‘আলো’ নামক এক চাকরিজীবী নারীর সংস্পর্শে এসে একজন ভোগবাদী পুরুষের প্রেমিক হয়ে ওঠা এবং বাহ্যিক চাকচিক্যময় জীবনের খোলস পালটিয়ে নিজের ভেতর থেকে অন্তরের আলোকে আলোকিত প্রকৃত জীবনে জেগে ওঠার মতো ঘটনা তুলে ধরেছেন শুভবাদী ভাবনার আলোকে এবং শিল্পসাহিত্যের ব্যাকরণগত শর্তাদি প্রতিপালন করে। প্রকৃত প্রেম থেকে বঞ্চিত প্রিন্সেস ডায়ানা একবার বলেছিলেন, ‘আমি দামি দামি উপহারে বিক্রি হতে চাই না। আমি চাই সরল মনের একটা মানুষ যাকে আমি বিশ্বাস করবো, মন উজাড় করে ভালোবাসবো।’ নূর কামরুন নাহারের ‘আলো’ উপন্যাসে নায়িকা আলো তেমনি একজন মানুষ আর উপন্যাসের বার্তাটিও প্রায় অনুরূপ। তার অন্য দুটি উপন্যাস ‘চিল’ ও ‘জলরঙে আঁকা’ মানুষের বাইরের চেয়ে ভেতরের ছবি তুলে ধরেছে বেশি । তার ছোটগল্পের বইগুলোর নাম ‘বৃক্ষ ও প্রেমিকের গল্প’, ‘মৃত্যু ও একটি সকাল’, ‘শিস দেয়া রাত, ‘বাঘের আঁচড়’। গ্রন্থগুলোতে অন্তর্ভুক্ত গল্পসমূহ ২/১টি বাদে সবই নগরজীবনকে কেন্দ্র করে রচিত। তার বেশ কয়টি গল্পে অফিসে কর্মরত উচ্চশিক্ষিত পুরুষ সহকর্মীদের চরিত্রের আলোকিত রূপের আড়ালে থাকা অন্ধকার রূপটি উন্মোচন করা হয়েছে শক্তিমান শিল্পীর নিপুণ হাতে। তেমন একটি উৎকৃষ্ট মানের গল্প ‘ছবিঘর’। এই গল্পের নায়ক ‘রাহাত’ একটি অফিসের বস। তিনি পরিমিতবোধসম্পন্ন উজ্জ্বল আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কথাবার্তায় স্মার্ট ও স্বল্পভাষী, আধুনিক আবার ধার্মিক। অফিসের সবাই তাকে সমীহ করেন, শ্রদ্ধা করেন এবং একজন ১ নম্বর খাঁটি মানুষ হিসেবে জানেন। অন্যদিকে লুবনা একজন অধস্তন কর্মচারী, কথাবার্তায় রিজার্ভ, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ও স্কুলপড়ুয়া একটি সন্তান আছে তার। দেখতে মোটামুটি। তাকে অফিসে সবাই একজন ২ নম্বর চরিত্রের নারী বলে জানে। রাহাত বিবাহিত, তার স্ত্রী সুদর্শনা ও স্মার্ট। স্বামীর ওপর তার অগাধ আস্থা। রাহাত বাসায় নিজ স্ত্রীর সঙ্গে আচার-আচরণে মিষ্টভাষী ও অন্তরঙ্গ। অথচ তিনি নানা ছলে ও কিছুটা অফিসের অবস্থানগত প্রভাব খাটিয়ে অতি গোপনে লুবনার সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলা খেলে তার শরীর ভোগ করতে চেষ্টা করেন। অনেকখানি অগ্রসর হয় তাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে লুবনার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও নীতির কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় রাহাতের যৌনভোগ আকাঙ্ক্ষা। উচ্চশিক্ষিত, বড় পদধারী ধার্মিক, আধুনিক , স্মার্ট ও স্বল্পভাষী একজন পুরুষের ১ নম্বর মানুষের ইমেজের আড়ালে থাকা ২ নম্বর মানুষের কদর্য রূপটি গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সার্থকভাবে। এসব পুরুষের কাছে উচ্চশিক্ষিত স্মার্ট স্ত্রীরাও প্রতারিত হন, সংসারে তারা হয়ে থাকেন শোপিস বা ছবির মতো। গল্পটির মধ্যে কোনো নারীবাদী প্রগল্ভতা নেই। ঘটনাবলির বিশ্বাসযোগ্যতা, বর্ণনার স্বাভাবিকতা, কথপোকথনের সাবলীলতা এবং নাটকীয় উপসংহার গল্পটিকে একটি সার্থক সৃষ্টি হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে।
দুঃসাহসী কলমে লেখা এই ভয়ঙ্কর সুন্দর গল্পটি পড়ার পর নূর কামরুন নাহারের প্রতি সমীহে নত হয়ে আসে মাথা এবং একইসঙ্গে একজন পুরুষ হিসেবে ঘৃণা জন্মে স্বজাতি তথা পুরুষজাতির প্রতি।
অনুরূপ ভাবনা ও বিশ্বাসের আরেকটি গল্প ‘পরিভাষা’ । এটার ঘটনাস্থল অফিসচত্বর। গল্পের পুরুষ একজন সচিব। অতবড় চেয়ারে ও দায়িত্বে থেকেও তিনি অধঃস্তন অফিসের জুনিয়র নারী সহকর্মীকে ঘিরে লালসার দৃষ্টি মেলে অতিদূর থেকে যৌনলিপ্সার জাল বোনেন। এই গল্পটি ‘ছবিঘর’ গল্পটির মতো বিচিত্র শৈল্পিক কারুকাজে অতখানি সমৃদ্ধ নয় কিন্তু ঘটনা হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ । ‘বন্ধু’ শব্দটিও যে অফিসের আঙিনায় পুরুষের অনৈতিক ও পরিশীলিত যৌন লালসার পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, কেবল এই একটি আপাত দৃষ্টিতে ছোট ও গুরুত্বহীন বিষয়কে গভীর ভাবনার মিশেলে উপস্থাপন করা হয়েছে গল্পটিতে। গল্পটি যাপিতজীবন ও জগৎ বিষয়ে নূর কামরুন নাহারের সূক্ষ্ণ ও শানিত দৃষ্টির স্বাক্ষর বহন করে। এই গল্পদুটির কাছাকাছি আরেকটি সুন্দর গল্প ‘প্রেমিক’। প্রেমিক আরেকটি বহুলভাবে অপব্যবহৃত পরিভাষা। কোনো নারী অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গভাবে মিশলেই পুরুষটি ভাবতে শুরু করে ওই নারীর প্রেমিক তিনি। অথচ একজন মানুষ হিসেবে নারীটি তাদের সঙ্গে মিশে স্বাভাবিক সুস্থ অন্তরঙ্গতায়। পরিণামে নারীটিকে পড়তে হয় নানারকমের মানসিক বিড়ম্বনায়, কখনো কখনো তা তার সুস্থ স্বাভাবিক সামাজিক জীবনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। ‘প্রেমিক’ গল্পটিতে এই বিষয়টিকেই বিশ্বাসগ্রাহ্যরূপে ও শৈল্পিক সৌকর্যে উপস্থাপন করা হয়েছে।
অফিস প্রাঙ্গণের মানুষ ও ঘটনাবলি এবং ঘটনাগুলোর আড়ালের ছবি নিয়ে রচিত ‘এলেন’ নামক গল্পটি একটি দুর্দান্ত সুন্দর সৃষ্টি। বহুদিন ধরে শোনা যায় যে সুন্দরী নারীদের ব্যবহার করে বড়-বড় অফিস থেকে বড়-বড় কাজ হাসিল করে ঠিকাদারসহ নানা শ্রেণির লোক। ‘সচিবালয় সুন্দরী’ বলে একটা কথা বহুদিন ধরেই প্রচলিত আছে অফিস পাড়ায়। আবার অফিসের বসকে ম্যানেজ করে নিজস্ব পদোন্নতি, পদায়ন, নিজেদের লোকের চাকরির ব্যবস্থা ইত্যাদি স্বার্থ উদ্ধার করে নেন এক শ্রেণীর নারী চাকরিজীবী। কিন্তু অধিকাংশ নারী চাকরিজীবী নীতিগত কারণে এটা করতে পারেন না। এমন ঘটনার শৈল্পিক উপস্থাপন হচ্ছে ‘এলেন’ নামক গল্পটির বিষয়। কিন্তু এটি কোনো সাদামাটা বর্ণনা নয়, মজবুত বিন্যাস, সুচারু গাঁথুনি, নাটকীয়তা, মানসিক টানাপড়েন, সিদ্ধান্তহীনতা, ক্লাইমেক্স, আকর্ষণীয় কথোপকথন ও টানটান উপসংহার—এসবের সাহায্যে নূর কামরুন নাহার ‘এলেন’কে একটি উৎকৃষ্ট মানের ছোটগল্পের পরিণতি দিতে পেরেছেন। তার প্রায় অনুরূপ আরেকটি গল্পের নাম ‘ব্যবহৃত’। ‘ব্যবহৃত’ গল্পটির আরও বেশি অর্থব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ। অফিস প্রাঙ্গণে পুরুষ চাকরিজীবীরা তাদের নারী সহকর্মীদের কাউকে কাউকে সেক্সচুয়ালি এক্সপ্লয়েট করেন; বিনিময়ে সেসব নারী সহকর্মী নিজেদের জন্য আদায় করেন অন্যায্য পদোন্নতি, উপার্জন করে নেন বাড়তি অর্থ এবং চাকরি জুটিয়ে নেন নিজেদের লোকদের জন্য। বাস্তবে দুই প্রান্তের মানুষই ‘ব্যবহৃত’ হন অন্যপ্রান্তের মানুষ দ্বারা, লাভ হয় দুই গ্রুপেরই, কেবল ক্ষতি হয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার। দূষিত হয় অফিসের কর্মপরিবেশ আর অসুস্থ হয়ে ওঠে সমাজব্যবস্থা। গল্পটির নামকরণ আসাধারণ সুন্দর।
শারীরিক কামনাবাসনা সর্বস্ব পুরুষের হাতে নারীর শারীরিক-মানসিকভাবে নিষ্পেষিত-নিপীড়িত-শোষিত হওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ অঙ্কিত হয়েছে নূর কামরুন নাহারের ‘অন্ধকার’ এবং ‘বাঘের আঁচড়’ নামক গল্প দুটিতে। ‘অন্ধকার’ গল্পটিতে মোট চারটি চরিত্র, জব্বার, তার স্ত্রী অসুস্থ হালিমা, তার কিশোরী মেয়ে তরু এবং গ্রাম থেকে কিছুদিনের জন্য তার বাসায় আসা ভালো পরিবারের কৈশোর পেরুনো মেয়ে হনুফা। জব্বার ঢাকায় একটা অফিসের কেরানি। পদোন্নতি পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা। হনুফা তার মেয়ের বান্ধবীতুল্য এবং সংসারের কাজে সহায়তা করে থাকে। তবে সে প্রচলিত অর্থে কাজের মেয়ে বা বুয়া নয়। জব্বার প্রচলিত অর্থে চরিত্রহীন লোক ছিল না। তার স্ত্রী হালিমা একসময়ের ডাকসাইটে ও প্রভাবশালী নারী। বর্তমানে পক্ষঘাতগ্রস্ত , কাজকর্ম করতে অপারগ কিন্তু সংসারে তার প্রভাব এখনো সবার ওপরে। জব্বার অন্য কোনো নারীতে আসক্ত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম পুরুষ কিন্তু তার স্ত্রী হালিমা শারীরিক মিলনে অক্ষমপ্রায়। যৌনক্ষুধা জব্বারকে তাড়িত করে ভেতরে ভেতরে। অষ্টাদশী হনুফার বাড়ন্ত ও পুষ্ট শরীর এবং প্রথম যৌবনের দোলাচল তাকে মাতোয়ারা করে দিতে থাকে আড়ালে। তরু ও হনুফা একই ঘরে মেঝেতে মশারির নিচে শোয়। একই ঘরের খাটের ওপর রাত কাটায় জব্বার ও হালিমা। কিছু দিন যেতেই জব্বার হনুফার প্রতি তার ভালো লাগার প্রকাশ নানাভাবে ঘটাতে থাকে নানাভাবে—হনুফার কাছে। একদিন রাতের বেলা হনুফা ও তরু শুয়ে ছিল নিচে। জব্বার হাত বাড়িয়ে হনুফার স্তন টিপে দেয়। চিৎকার করে ওঠে তরু। জেগে ওঠে হনুফা এবং হালিমা। আসলে জব্বার ভুল করে নিজ মেয়ে কিশোরী তরুর বুকে হাত দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তরু লজ্জায় ও পরিবারের মানসম্মানের কথা ভেবে বাপের অমন কুকীর্তির কথা চেপে যায়। লাইট জ্বালাতেও বাধা দেয়। তারা শুয়ে থাকে। তাদের ঘিরে থাকে অন্ধকার। গল্পটির ‘অন্ধকার’ নামকরণ প্রতীকী। পুরুষজাতির মনের ও চরিত্রের অন্ধকার দিকটি গল্পে উন্মোচন করা হয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপে ও সবচেয়ে কঠিন ব্যঞ্জনায়। জব্বার একজন শিক্ষিত মানুষ। চাকরিজীবী। তার মেয়ে তরু কিশোরী ও পড়াশোনায় নিয়োজিত। স্ত্রী হালিমাও একজন কর্তৃত্বপরায়ণ স্মার্ট নারী। বাড়িতে চার জন মানুষ। তিন জনই নারী। একজন মাত্র পুরুষ। কিন্তু একজন পুরুষ মানুষই তিন জন নারীর সঙ্গে গোপনে গোপনে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। নিজের যৌনক্ষুধাকে জিতিয়ে দিতে মেয়েতুল্য হনুফার পিছু নিচ্ছে এবং অন্ধকারে হনুফার বুকে হাত দিতে গিয়ে নিজ কিশোরী মেয়ের বুকটা ডলে দিয়েছে। পুরুষের যৌনলিপ্সার সামনে কোনো নারীই নিরাপদ নয়, নিরপাদ নয় এমনকি নিজের কন্যাও, এমন অবস্থার চূড়ান্ত শিল্পরূপ নূর কামরুন নাহারের ‘অন্ধকার’ গল্পটি। ঘটনার পরম্পরা নির্মাণে , কল্পনার যৌক্তিতায়, ব্যবহৃত ভাষার যথার্থতায়, কথোপকথনের বিশ্বাসযোগ্যতায়, উপসংহার নির্মাণের সুচারুতায় এবং নামকরণের বিচক্ষণতায় ‘অন্ধকার’ একটি উৎকৃষ্ট মানের গল্প।
‘বাঘের আঁচড়’ গল্পটিও প্রতীকী চরিত্রের। বাঘ হচ্ছে যৌনলিপ্সু পুরুষ, বাঘের শিকার হচ্ছে নারী; আঁচড় হচ্ছে নারীর শরীরে-মনে-অনুভবে নারীলিপ্সু লম্পট পুরুষের আগ্রাসনের অদৃশ্য ছাপ। শহরে চাকরিজীবী অফিস প্রধান রেহানা আক্তার, রেহানা আক্তারের মা, জুনিয়র সহকর্মী তাবাসসুম, কানাডাপ্রবাসী বান্ধবী শাহনাজ, নাম উল্লেখ না করা চর্মচিকিৎসক এদের নিয়ে গড়ে উঠেছে গল্পটির চারপাশ। রেহানা অফিসে হঠাৎ একদিন লক্ষ করে, তার চোখের নিচে কালির মতো দাগ। ডাক্তার জানান বহুদিনের দাগ। তো এতদিন রেহানার চোখে পড়েনি কেন? মনে পড়ে অতীতের কথা। রেহানা তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। একদিন খালাতো ভাই তাকে নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ঘুম ভেঙে উঠে দেখে তার হাফ প্যান্ট খোলা। নাভির নিচে নখের আঁচড় এবং চিনচিনে যন্ত্রণা। তখন তার বুঝে ওঠার বয়স হয়নি বলে সে কিছু বুঝতে পারেনি। সে তার মাকে বললে মা পরীক্ষা করে দেখে এবং বলে যে তাকে বাঘে আঁচড় দিয়েছে, সে নষ্ট হয়ে গেছে। সে এখন নষ্ট মেয়ে। চোখের নিচে কালো দাগ তাকে সেই বাঘের আঁচড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। বান্ধবী শাহনাজ আসে কানাডা থেকে। তার মুখে মেকাপের নিচে কালো দাগ চোখে পড়ে রেহানার। অতঃপর যে নারীরই দিকে সে তাকায়, সব নারীর মুখে বাঘের আঁচড় দেখে। রেহানার বয়স এখন ঊনপঞ্চাশ। তার মেয়ের বয়স চব্বিশ। এতদিন লক্ষ করেনি সে কিন্তু এখন তার মনে হয় এই দাগ আর সেই বাঘের আঁচড় একই জিনিস। এটা বিলম্বিত বোধোদয় বা সত্যনিষ্ঠ চেতনায় জেগে ওঠার ব্যাপার। সে স্বস্তি পায় না কিছুতেই। অফিসের এক্সিকিউটিভ রিভলিং চেয়ার, তিনটি টেলিফোন, অনেক কয়জন অধীনস্থ সহকর্মী, উচ্চ বেতনভাতা, গাড়ি, প্রশংসিত পারফরমেন্স, উচ্চশিক্ষিত সন্তান, সহকর্মীদের প্রশংসা ও সহযোগিতা, বান্ধবীদের আদর ইত্যাদি সবকিছুরই আনন্দ মাটি করে দেয় মনের দৃষ্টিজুড়ে জেঁকে বসা সেই বাঘের আঁচড়ের চিত্রকল্প এবং চেতনায় সৃষ্ট আর্ত অনুভূতি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা, ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য বৈশিষ্ট্য, সাবলীল ভাষা, চরিত্রসমূহের আকর্ষণভরা বৈচিত্র্য ও সর্বোপরি অসাধারণ সুন্দর কাব্যিক চিত্রকল্পময় উপসংহার ‘বাঘের আঁচড়’ গল্পটিকে একটি অনন্যসাধারণ সৃষ্টিতে উন্নীত হতে সফল সহায়তা প্রদান করেছে। পুরুষতন্ত্রতাড়িত পুরুষের সীমাহীন ও অনৈতিক নারীলিপ্সা গল্পটির উপসংহারে এসে বৈশ্বিক ও সর্বমুখী ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। গল্পরচয়িতা হিসেবে নূর কামরুন নাহার তার ঈর্ষণীয় শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন গল্পটির সবখানে এবং তা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে উপসংহারে। উপসংহারটুকু পাঠ করা যায়:
হেমন্তের হলুদ বিকেল। বন্ধুর সাথে কাটানো দুপুর, কেনাকাটা সবকিছুই খুব চমৎকার। এখন এই হলুদ বিকেল দেখে দেখে বাসায় ফেরাটাও খুব ভালো, আনন্দময়। সে শহর দেখে , বিকেল দেখে, মানুষ দেখে, নারী, পুরুষ, শিশু দেখে। মানুষের ঢল নেমেছে এই ছুটির বিকেলে। নগরীর মানুষেরা কেউ হাসছে, কথা বলছে, কেউ ছুটছে। সুসজ্জিত নারী-পুরুষে বর্ণিল হয়ে আছে রাজপথ। কিন্তু আশ্চর্য! উজ্জ্বল, শোভন নারীদের চেহারায় বাঘের আঁচড় কেন? সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। নিজেকে শাসায়, কোথাও কোনো বাঘের আঁচড় নেই। কিন্তু না, তার চোখ দেখতেই থাকে অগণিত নারীর গায়ে, মুখে ফুটে ওঠা বাঘের আঁচড়। নেশার মতো সে দেখতে থাকে দৃশ্যমান আর অদৃশ্য আঁচড়। কালো দাগগুলো হলুদ বিকেলের গায়ে লেগে যায়। চোখের সামনে তার প্রিয় নগরী কালো আর হলুদের ডোরাকাটা বাঘ হয়ে যায়।
নারীদের পদে পদে ঘরে বাইরে পথে ঘাটে অফিসে আদালতে সবখানে পুরুষ কর্তৃক শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়িত হওয়ার মনোবেদনার বিষয়গুলো খুঁটিনাটিসহ লক্ষ করেছেন নূর কামরুন নাহার। তার দেখার দৃষ্টি শানিত ও সূক্ষ্ণ। কিন্তু তিনি উগ্র নারীবাদীদের মতো কেবল নারীর ভূগোলে আটকা পড়ে থাকেননি। তিনি একজন শিক্ষিত সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে রাজনীতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, মানসিকতা এসবকে বিষয় করে শৈল্পিক নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ সুন্দর সুন্দর গল্প লিখেছেন। অমাদের দেশের রাজনীতিকরা নিজেরাই বলেন যে- রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নেই। ফলে তাদের কোনো কথাকেই বাইবেল বা অপরিবর্তনীয় জ্ঞানে বিশ্বাস করার যুক্তি নেই। তাদের মধ্যে অনেকের কথার মতোই তাদের অনেকেরই ব্যক্তিজীবন অবিশ্বস্ততা, অনৈতিকতা, অপ্রেম ও অনির্ভরযোগ্যতায় আকীর্ণ এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুসরণের অযোগ্য। তাদের অনেকেই নিজেদের মানুষ বা ভোটারদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভোট আদায় করেন কিন্তু ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর তারা তাদের আসল রূপে আবির্ভূত হন। প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও চিরতরে নিশ্চিহ্নকরণের চেষ্টা, অনৈতিক ভোগবিলাসে ডুব দেওয়া ইত্যাদি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজকামের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এরপরও সাধারণ মানুষকে বিপদে আপদে প্রয়োজনে ও প্রত্যাশায় রাজনীতিবিদদের কাছে যেতে হয়। তারা যায়। অতঃপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ভয়ংকরভাবে প্রতারিত হয়, নারীরা হয় যৌন নিপীড়নের শিকার। এসব নিয়ে নূর কামরুন নাহার লিখেছেন ‘বিনিময়’, ‘বাড়ি , নারী ও মন্ত্রী মহোদয়’, ‘এককাপ চা’ শিরোনামের তিনটি ভয়ংকর সুন্দর গল্প। ‘বিনিময়’ গল্পে এলাকার জনসাধারণের কাছে পরোপকারী ও অমায়িক আচরণের অধিকারী বলে খ্যাত বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতার নারীভোগলিপ্সু ভয়ংকর চরিত্র উদঘাটন করা হয়েছে। বয়সের কারণে তিনি যৌনক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন কিন্তু যুবতী নারীদের কাজের পক্ষে তদবির করেন তাদের উলঙ্গ শরীর দেখার বিনিময়ে। আর আজকাল সবাই না হলেও অনেক নারীই রাজনীতিতে প্রবেশ করে অনেকটা পুরুষ রাজনীতিকদের মতোই অবৈধ ধনসম্পদ ও বহুগামী যৌনজীবনে জড়িয়ে যাচ্ছেন সচেতনভাবেই ইত্যকার বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে গল্পটিতে। ‘বাড়ি , নারী ও মন্ত্রী মহোদয়’ গল্পটি ভয়ংকর সুন্দর। শিল্পপতি তমিজউদ্দিন, মন্ত্রী এহসান পাটোয়ারি এবং স্বামীহারা সুন্দরী নারী নিশিতা চৌধুরী, এই তিনটি চরিত্র নিয়ে রচিত গল্পটি। শিল্পপতি তমিজউদ্দিন ও মন্ত্রী এহসান পাটোয়ারি এখন এক গ্লাসের ইয়ার। নিশিতা চৌধুরীকে ছাত্রজীবনে ভালোবাসতেন এহসান পাটোয়ারি। কিন্তু এহসান ছিল গ্রামের গরিব চাষা কলিমুদ্দিনের ছেলে, অন্যদিকে নিশিতার বাবা নিশিতার বিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকার মালিবাগের হাইফাই এক চৌধুরীবাড়ির ছেলের সঙ্গে। স্বামী মারা গেছে। নিশিতা তার বিশ্বদ্যিালয়ে অর্থনীতিতে পাঠরত সুন্দরী ও স্মার্ট মেধাবী মেয়ে মৌমিতা চৌধুরীকে নিয়ে বসবাস করেন। কিন্তু সেই বাড়িটি বেদখল করে নেওয়ার চেষ্টা করছে শশুর পক্ষের অন্য লোকেরা। একদিন নিশিতা সেই মন্ত্রীর সহায়তা চান। মন্ত্রী মদ খেয়ে রাতের বেলা সেই বাড়িতে যান। বাড়িটি নিষ্কণ্টক করে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন কিন্তু বিনিময়ে শরীর চান। প্রাক্তন প্রেমিকা নিশিতা চৌধুরী এখনও সুন্দরী ও স্মার্ট কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে—মন্ত্রী এহসান চৌধুরী প্রেমিকার যুবতি কন্যা বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্রী মৌমিতার সঙ্গে রাত কাটাতে চান ও নিশিতাকে সেই প্রস্তাব দেন খোলাখুলিভাবেই। গল্পটি এখানেই শেষ হয়ে যায় একটা অসমাপ্ত মোহনায়। পুরুষ প্রথমে টাকা চায়, টাকা হলে চায় ক্ষমতা; ক্ষমতা হাতে এলে তখন চায় মদ ও নিত্যনতুন নারী। দুঃসাহসী কলমে লেখা এই ভয়ঙ্কর সুন্দর গল্পটি পড়ার পর নূর কামরুন নাহারের প্রতি সমীহে নত হয়ে আসে মাথা এবং একইসঙ্গে একজন পুরুষ হিসেবে ঘৃণা জন্মে স্বজাতি তথা পুরুষজাতির প্রতি।
তাহলে জয় হয়েছে কার? লেখক সেটা বলেননি। ধরে নেওয়া যায়—বাইরের নারীর ব্যক্তিত্বের ও নীতির জয় হয়েছে অবশেষে। অথবা সংসারের সর্বসহা নারীটির ধৈর্যসহ্য ক্ষমতার জয় হয়েছে শেষতক।
নূর কামরুন নাহারের জন্ম ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ। তার মানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুধের শিশু ছিলেন। প্রকৃত অর্থে তিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি সেরা গল্প লিখেছেন যা বিষয়ভাবনায় ও উপস্থাপনা কৌশলে অনন্য ও অতুলনীয়। নূর কামরুন নাহার কথাসিহিত্যের পাশাপাশি কবিতাও লেখেন। স্বভাতবই তার কল্পনাশক্তির চর্চা চলে সামন্তরালে। সৃজনশীল কল্পনাশক্তি তাকে কবিতা গল্প উপন্যাস লিখতে সহায়তা প্রদান করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের টাটকা গল্প তো অবশ্যই শুনেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমা দেখেছেন, এ সংক্রান্ত গল্প-উপন্যাস পড়েছেন। সেসব পরোক্ষ অভিজ্ঞানের সঙ্গে আপন কল্পনা মিশিয়ে তিনি ‘নক্ষত্রের হাত’ নামে একটি অতুলনীয় সুন্দর গল্প লিখেছেন। ঘটনার বছর হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ঊনিশ শ একাত্তর সাল। ঘটনাস্থল ঢাকার টিকাটুলি। বাড়ির মালিক অ্যাডভোকেট ফাহাদ চৌধুরী, তার স্ত্রী প্রাক্তন জমিদার বাড়ির কন্যা রাহেলা; তাদের বড় ছেলে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আসাদ, কলেজ পডুয়া ছোট ছেলে এবং একই বাড়ির ভিন্ন তলায় ভাড়াটিয়া কলেজ শিক্ষকের কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় পডুয়া আনিকা, আনিকার মা আলেয়া—তাদের ঘিরে গল্পটি রচিত। মেধাবী ছাত্র আসাদ আবার ভালো একজন লেখক। মা-বাবাকে না জানিয়েই আসাদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। একদিন পাকবাহিনী তার খোঁজে এসে তাকে না পেয়ে তার বাবা ফাহাদ চৌধুরী এবং তার কলেজপডুয়া ছোট ভাইটিকে তার মায়ের সামনেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হয়। আসাদ ফিরে এসে সব ঘটনা জানে। তার মা রাহেলা স্বামী-সন্তানের শোকে পাথরবৎ হয়ে পড়ে। আসাদের সঙ্গে কোনো কথা বলে না। আসাদের ভেতরে একটা প্রচণ্ড বেদনাবোধ এবং এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে যে, তার বাবা-ভাইয়ের অকাল ও শোচানীয় মৃত্যু এবং তার মায়ের বর্তমান ভয়াবহ যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের জন্য সে-ই দায়ী। আসাদের কোনো কথার জবাব দেয় না তার মা। এড়িয়ে যায়। শুধু মরার মতো বেঁচে থাকে। আনিকা ধীরে ধীরে আসাদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং আসাদের নির্লিপ্ত ও উদাসীন আচরণ তাকে মনে মনে অনুসন্ধিৎসু ও জেদি করে তালে। আনিকা একসময় আবিষ্কার করে এই আসাদই তার প্রিয় লেখক আসাদ চৌধুরী। আসাদ প্রথম দিকে একদম পাত্তা না দিলেও সময়ান্তরে দুজনার মধ্যে একটা সম্পর্ক একটু একটু করে দানা বাঁধে। একদিন আসাদকে জড়িয়ে ধরে আনিকা। অমনি আসাদের গা থেকে চাদর সরে যায় এবং তার একটি কাটা হাত বের হয়ে আসে। আসাদ মুক্তিযুদ্ধে তার একটি হাত হারিয়েছিল। উন্মোচিত হয় রহস্য। আনিকা বেশি করে জড়িয়ে যায় আসাদের প্রেমে। আসাদও একহাতে জড়িয়ে ধরে আনিকাকে। আসাদের আগে আনিকাকে আর একবার জড়িয়ে ধরেছিল বলে আনিকার মনে পড়ে। আনিকার বিস্ময় উৎসারিত প্রশ্নের উত্তরে আসাদ জানায় যে—সেই আরেকটি হাত ছিল নক্ষত্রের হাত। একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধে মারাত্মকভাবে জখম হওয়া এবং ফলে বাহু থেকে কেটে ফেলা কাটা হাতটিকে নূর কামরুন নাহার নক্ষত্রের হাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঘটনার বিন্যাস, উপস্থাপনা, কথোপকথন, উপসংহার ও নামকরণ সবকিছু মিলিয়ে একটি অসাধারণ সমৃদ্ধ ও সুন্দর গল্প ‘নক্ষত্রের হাত’। টুপি পরিহিত নামাজি দাড়িওয়ালা মানুষকে নির্বিচারে রাজাকার বানানোর সস্তা কৌশল বাদ দিয়ে নূর কামরুন নাহার নতুন আঙ্গিকে গল্পটি লিখেছেন এবং গল্পটি সকল অর্থেই বিশ্বাসযোগ্যতায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। গল্পটি উপসংহার খুবই আকর্ষণীয় ও কাব্যিক। আসুন পাঠ করি:
আনিকা অস্ফুট কণ্ঠে বলে- আমি শুধু তোমার।
কাঁধে হাত দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে আসাদ। কয়েক মিনিট নিশ্চুপ। হাত নামিয়ে গায়ের চাদরে হাত রাখে আসাদ। আস্তে আস্তে খুলে ফেলে পুরোটা।
বিস্ময়ে কষ্টে আনিকা হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে। আসাদের বা হাত কাঁধ থেকে কাটা।
আনিকা দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখে কিছুক্ষণ। জোছনায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে আসাদ। আনিকার হাত খোলে। চোখের জলে সিক্ত মুখ তোলে। আসাদের বুকে মুখ গোঁজে- পারবো চিরদিন। ঐ একটা হাতেই তুমি ধরে রাখবে আমাকে, জগৎ ধরে রাখবে, তোমার লেখাকে ধরে রাখবে। পারবে না?তুমি পাশে থাকলে সব পারবো।
আনিকা মুখ গুজে দাঁড়িয়ে থাকে।
অকেক্ষণ পর বলে- একটা কথা বলবো?
বল।
ঐ যে নক্ষত্রের ঐ রাতে যেদিন তোমাকে আমার করে পেয়েছি। তুমি আমাকে দুহাতে কাছে টেনে নিলে। আমি স্পর্শ পেয়েছি তোমার দু’হাতের। ঐ হাতটা তবে কার ছিল?আনিকার গালে গাল ঘষে গাঢ় কণ্ঠে বলে আসাদ-ওটা ছিল নক্ষত্রের হাত।’
আমাদের পীরদের অপকর্ম নিয়ে আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ পড়ে এসেছি। আরও উপন্যাস এবং ছোটগল্প লেখা হয়েছে একই বিষয়ে। সেগুলোর ঘটনার বিবরণ ও উপস্থাপনা প্রায় একই রকমের। তবে নুর কামরুন নাহার পীরতন্ত্র নিয়ে একটি অগ্রসর ভাবনাতাড়িত দুঃসাহসী গল্প রচনা করেছেন। গল্পটির নাম ‘তোফা’। তোফা অর্থ উপহার। এই গল্পের ঘটনাগুলো অনেকটাই পরিচিত। তিন জন যুবক রাশেদ, শামীম ও তাদের বন্ধু গল্পের নায়ক-কথক। পীর ও তার মেয়ে। গল্পের নায়ক তার কলেজের তৃতীয় বর্ষের সুন্দরী স্মার্ট ছাত্রী মেহেরিনকে ভালোবাসে, তাকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু মেয়েপক্ষ রাজি নয়। শেহরিনও পাত্তা দেয় না। কিন্তু তাকে পেতেই হবে। অতএব বন্ধুর পরামর্শে সে তার দুজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকাই বাইরের ‘ঘাড়ভাঙা পীর’ এর কাছে যায়—বহু অচেনা পথঘাট ও নদী পেরিয়ে। সঙ্গে পীরের জন্য তোফা কয়েক হাজার নগদ টাকা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একদল মানুষ মেরে ওই পীরের ঘাড় ভঙে দিয়েছিল। সেজন্য তখন থেকে তার নাম ‘ঘাড়ভাঙা পীর’। যাবতীয় বর্ণনা পড়ে আটরশির পীরের কথা মনে আসে সচেতন পাঠকের। আর সব ফরমালিটি পালন এবং পীরকে কয়েক হাজার ঠাকা সালামি দেওয়া শেষ হলে পীর তাকে ওই বাসায় একটি ঘরে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে। রাতে একসময় একটি সুন্দরী যুবতি মেয়ে মশারি টানিয়ে দেওয়ার কাজ নিয়ে সেই রুমে ঢুকে। জিজ্ঞাসার জবাবে সে জানায়: ‘আমি আপনের তোফা’ এবং ‘আমি ইয়াসমিন—পীর বাবার মেয়ে।’ এই অভূতসুন্দর উপসংহার এবং নামকরণের জন্যই গল্পটি অতুলনীয় অর্থব্যঞ্জনা ও শৈল্পিক সৌন্দর্য লাভ করেছে। ধান্দাবাজিনির্ভর পীরতন্ত্রের কুপ্রভাব থেকে কেউই নিরাপদ নয়, এমনকি পীর-মুরিদদের নিজেদের পরিবার-পরিজনও, তারই এক চমৎকার গল্পরূপ নূর কামরুন নাহারের ‘তোফা’ গল্পটি।
আমাদের দেশে সাহিত্যজগতের পীর হচ্ছেন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকদের কেউ কেউ। তারা সাহিত্য সম্পাদকের চাকরি ও দায়িত্বটাকে নিজের বাহাদুরি প্রদর্শন ও লাম্পট্য চরিতার্থ করতে কাজে লাগায় নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে। লেখক হয়ে উঠতে প্রত্যাশী কিশোরী ও যুবতি নারীদের কারও কারও লেখা ছাপানোর সুযোগ করে দেওয়ার বিনিময়ে তারা তাদের সেক্সচুয়াল এক্সপ্লয়টেশনের শিকার বানাতে চেষ্টা করে, কখনো সফল হয়, কখনো হয় না। উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রয়োজনে অথবা সামাজিক নিন্দাবাজের ভয়ে মুখ খোলে না সেসব নারী। নূর কামরুন নাহার অমন একটি ঘটনা নিয়ে রচেছেন ‘সম্পাদক’ শিরোনামের একটি ছোটগল্প। কেবল বিষয়ভাবনার অনন্যতাই নয়, গল্পটির রচনা কৌশলও চমৎকার। পুরুষশাসিত অনগ্রসর সমাজে এ ধরনের গল্প রচনায় কেবল সাহস নয়, অনেক সময় দুঃসাহসেরও প্রয়োজন হয়।
আমাদের আধুনিক শিক্ষিত সমাজের একটা অংশের এক ধরনের বিদঘুটে পশ্চাৎপদ মানসিকতা আছে। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে সেটা আরও প্রকট। আধুনিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত, শিল্পসাহিত্যের সমঝদার প্রগতিশীল পুরুষদের অনেকেই তাদের লেখায় কথাবার্তায় বক্তৃতায় অনুষ্ঠানে টকশোতে নারীদের মুক্ত জীবনের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে দাবি তোলেন জোরেসোরে এবং নারীদের পিছিয়ে থাকার জন্য ‘মৌলবাদীদের’ ঘাড়ে সব দোষ চাপান হাততালি সহযোগে। কিন্তু তারা নিজেরাও নারীকে যৌনতার সঙ্গী, ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখে মন থেকে। তাদের ঘরে থাকা নারীদের বিশেষত স্ত্রীদের সমানাধিকার মেনে নিতে পারেন না তারা। শিক্ষিত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও প্রতিষ্ঠিত স্ত্রীদের সঙ্গে এই নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে এবং অনেক সময় তা বিবাহবিচ্ছেদে গড়ায়। স্ত্রী যতই শিক্ষিত হোক, যতই প্রতিষ্ঠিত হোক শিল্পে-সাহিত্যে-চাকরিতে-ব্যবসায়-রাজনীতিতে, বাসায় স্বামী পুরুষের কাছে তিনি ‘মেয়েমানুষ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার কোনো কোনো পুরুষ তাদের স্ত্রীকে ব্যবহার করেন নিজেদের সামাজিক স্ট্যাটাসের শোপিস হিসেবে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় স্ত্রী রূপী নারীরা তাদের স্বামীদের কাছে পুরুষের মতোই সম্মান ও মর্যাদা পাচ্ছেন। সে সব লোক দেখানো বা বাইরের রূপ মাত্র। বাস্তবে সেই নারীরা তাদের স্বামী বা নিজস্ব পুরুষদের হাতে মানসিকভাবে নির্যাতিত ও পারিবারিকভাবে হেয় অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। এসব প্রগতিশীল স্বামীরাও অঘোষিতভাবে নিজ স্ত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করে গোপনে অন্য নারীদের সঙ্গে পরকিয়া প্রেমে ও শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়। অনেক নারী এসব বোঝেন, কষ্ট পান। নানা কারণেই নারীদের সংসার করতে হয়, তাই যারা বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারেন না, তারা সংসার করেন অগত্যা। আর চাইলেই-বা তারা যাবেন কই? স্বামী, প্রেমিক পুরুষ, পুরুষ বন্ধু, অফিসের পুরুষ সহকর্মী- নারীদের ক্ষেত্রে সবারই মানসিকতা ও চরিত্র প্রায় অভিন্ন। নূর কামরুন নাহারের ‘শোপিস’ গল্পটিতে আধুনিক শিক্ষিত প্রগতিশীল সমাজের অগ্রসর পুরুষদের ভোগবাদসর্বস্ব হীন মানসিকতা, নিজ নারীর প্রতি অবিশ্বস্ততা ও বহুগামিতার ছবি তুলে ধরা হয়েছে নৈপুণ্যের সাথে।
নূর কামরুন নাহার একজন গভীর-নিবিড় জীবনশিল্পী। তিনি সমাজের উপরিতল দেখেন আর দশজনের মতোই তবে শানিত চোখে, সূক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে। কিন্তু বাইরে থেকে বিচার করলে অনেকসময় ঠিক হয় না সেই দেখা, সেই বিবেচনা, সেই বিচার। অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার আড়ালে ঘটনা থাকে, দৃশ্যের আবরণে থাকে আরও দৃশ্য। বড় ঘটনার পেছনে থাকে কোনো সূক্ষ্ণ বাসনার তাড়না। সে-সব সঠিকভাবে বুঝতে মানবমনের নিবিড় পাঠ দরকার হয়, মানুষের কামনা বাসনার বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করা লাগে। নূর কামরুন নাহারের সেই পাঠাভ্যাস, সেই পর্যবেক্ষণ আকাঙ্ক্ষা আছে। তিনি পুরুষতন্ত্র, পুরুষের বহুগামিতা, নারীর পরাধীনতার কষ্ট, বিবাহ, রাজনীতি, অফিস আদালত এসব বড় বড় বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছেন। অনুরূপভাবে তিনি মানুষের পিতা হওয়ার দুর্বার বাসনা, ভালোবাসা ও পেশাগত স্বার্থের টানাপড়েন, পুরুষ সঙ্গী বিষয়ে ‘নাই মামার চেয়ে কানামামা ভালো’ জাতীয় অনুভব, নারীর ভালোবাসার সংস্পর্শে এসে দুর্জন পুরুষের প্রেমভালোবাসার কাঙাল হয়ে ওঠা, মুক্ত ও সবুজ প্রকৃতির সাহচর্যে নারীর ভেতরের সত্তাটির প্রেমে ও কামে, প্রাণে ও প্রাচুর্যে জেগে ওঠা, অপরাধবোধ থেকে নিজেকে পরিবর্তন করে সঠিক পথে পরিচালনার তাড়না বোধ করা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অনেক সংখ্যক প্রজ্ঞাদীপ্ত ছোটোগল্প লিখেছেন। ‘তাঁর সাথে দেখা ও পরাজিত তিনটি মুখ’, ‘অগ্নি, জল ও প্রতিশোধের গল্প’, ‘শিস দেয়া রাত’, ‘অসময়ে বৃষ্টি’, ‘বর্ণচোরা’, ‘বিছানার বা পাশটা খালি’, ‘অবয়ব’, ‘জলছাপ’, ‘শরীর’, ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’, ‘মৃত্যু ও একটি সকাল’, ‘ছবিঘর’, ‘এক কাপ চা’ প্রভৃতি ছোটোগল্পে নূর কামরুন নাহার নানাবিধ ঘটনা দিয়ে প্লট নির্মাণ করেছেন কিন্তু সেসব প্লট বা ঘটনার চেয়ে গল্পগুলোতে উপস্থাপিত বা উদ্ভাসিত মানুষের বিচিত্র মন, মানবমনের রহস্য, আকুলতা, ভয় ও ভাবনা, আন্তঃসলিলা প্রেমাকাঙ্ক্ষা, সন্তানবাসনা, শ্রেয়বোধ ও কামনাবাসনার দ্বন্দ্ব, প্রতিশোধ আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে শাব্দিক বর্ণনার আড়ালে। এটা হচ্ছে কথাসাহিত্যিক হিসেবে নূর কামরুন নাহারের গভীর ও নিবিড়, সূক্ষ্ণ ও শানিত জীবনবোধ ও অর্জিত অভিজ্ঞানের প্রমাণক। ‘তাঁর সাথে দেখা ও পরাজিত তিনটি মুখ’ গল্পটিতে তিনি আসাধারণ কয়েকটি নারীচরিত্র নির্মাণ করেছেন দক্ষহাতে। একজন পুরুষ, স্বভাবে স্বৈরাচারী ও বহুগামী, তার সর্বসহা স্ত্রী, গোপন পরকীয়া প্রেমিকা ওরফে দ্বিতীয় স্ত্রী ও সচেতনতায় সক্রিয় একটি শিক্ষিত মেয়ে। প্রচলিত মূল্যবোধে পুরুষটি তো খারাপ মানুষই, তা গোপন পরকীয়া প্রেমিকা বা দ্বিতীয় স্ত্রীকেও সবার ঘৃণা করার কথা। কিন্তু নূর কামরুন নাহার সেই নারীর চরিত্রের মধ্যে অসাধারণ গুণাবলি আবিষ্কার করেছেন। প্রথমত সেই দ্বিতীয় নারী দেখতে মোটেও সুন্দরী বা আকর্ষণীয়া না হওয়া সত্ত্বেও কেন একজন উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী বিবাহিত ও সন্তানের পিতা পুরুষ তার সঙ্গে অমন গভীরভাবে জড়ালেন? শেষপর্যন্ত সেই নারীকে একদিন নিয়ে আসেন তিনি মূল সংসারে। প্রথম স্ত্রী তাকে সহজভাবে গ্রহণ করেন এবং তার খাতির-যত্ন ও খাওয়া দাওয়ার উত্তম আয়োজন করেন। তিনি বাড়ির উচ্চশিক্ষিত মেয়েটির সঙ্গেও কথা বলেন। অতঃপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই পুরুষের সঙ্গে আর মেলামেশা করবেন না। এমন সোনার সংসার দেখে তিনি পুরুষ লোকটির প্রেমপ্রেম আচরণের অনুমোদন প্রত্যাহার করে নেন বিনা ঘোষণায়। বাহ্যিক বিচারে জয় হয় সমাজসিদ্ধ ঘর-সংসারের। কিন্তু লেখক বলছেন ‘পরাজিত তিনটি মুখ’ । অর্থাৎ বাইরের একজন নারীর কাছে হেরে গেছে সংসারের কর্তা, গিন্নি ও তাদের সন্তান। তাহলে জয় হয়েছে কার? লেখক সেটা বলেননি। ধরে নেওয়া যায়—বাইরের নারীর ব্যক্তিত্বের ও নীতির জয় হয়েছে অবশেষে। অথবা সংসারের সর্বসহা নারীটির ধৈর্যসহ্য ক্ষমতার জয় হয়েছে শেষতক। কিন্তু জয়-পরাজয় নয়, গল্পে নূর কামরুন নাহার কয়েকটি মানুষের মনের অবস্থা, টানাপড়েন, অব্যক্ত বেদনা, মানবমনের রহস্যময়তা, চাওয়া না চাওয়ার অচিহ্নিত দ্বন্দ্ব ইত্যাদিকে উপস্থাপন করেছেন—সেসব বিষয়ে কোনো কথা সরাসরি না বলে। এই গল্পে পাঠকের জন্য নিজেদের মতো ভেবে দেখার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের শৈল্পিক স্পেস আছে।
তাদের বড় অংশটাই বাইরে একরকম , মনে ও মানসিকতায় অন্যরকম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক অন্ধকার জমে আছে তাদেও অনেকেরই আলোকিত চেহারার আড়ালে।
নূর কামরুন নাহারের আরেকটি অদ্ভুত সুন্দর গল্প ‘শিস দেয়া রাত’। এটি হচ্ছে দুজন নর-নারীর দাম্পত্য জীবন নিয়ে এক অপূর্বসুন্দর গল্প নির্মাণ। জাফর, তার স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন। দুজনই দুজনার প্রতি বিশ্বস্ত ও দায়িত্বশীল। তাদের মাঝখানে হঠাৎ ঝামেলা পাকাতে বসে জাফরের অফিসের এক মহিলা সহকর্মী লুনার প্রসঙ্গ। লুনা একজন ডিভোর্সি যুবতী। তার আনন্দ-বেদনার প্রতি জাফর গভীরভাবে সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী। জাফরের স্ত্রী একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও উদার মনের মানুষ। দুজনই শারীরিক মানসিকভাবে ষোল আনা ফিট। তাদের মধ্যে সেক্সচুয়াল সম্পর্ক মজবুত ও নিত্যজীবন্ত। তারপরও লুনাকে কেন্দ্র করে জাফরের পরিবর্তিত আচরণে তার স্ত্রী মানসিকভাবে অস্থিরতার শিকার হয়। কিন্তু জাফরের সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও সর্বোপরি স্ত্রীর প্রতি তার প্রবল যৌন আকর্ষণ ও তার সঙ্গে ঘনঘন সফল শারীরিক মিলন করা ইত্যাদি দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝখানে জমে উঠতে চাওয়া সকল শীতকে তাড়িয়ে দেয় দূরে। গল্পকার বলেননি কিন্তু এটাই সত্য যে সফল যৌনমিলন দাম্পত্য সম্পকর্কে জীবন্ত ও সাবলীল রাখার অন্যতম অস্ত্র। নূর কামরুন নাহার মানসিক টানাপড়েনের বিষয়টি গল্পের ভাঁজে ভাঁজে চমৎকারভাবে গুঁজে দিয়েছেন। যেমন একস্থানে গল্পকার বলেছেন :
জাফর বিশ্বস্ত। পুরোপুরি আমার ওপর নির্ভরশীল। ও আমাকে ভালোবাসে এই বিষয়ে সামন্যতম সংশয় না থাকার পরেও জাফর ঐ লুনাকে পছন্দ করে। এবং এই পছন্দের মধ্যে অনৈতিক কোন কিছুর গন্ধ না থাকার পরেও বিষয়টি মৃত মানুষের খোলা চোখের মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
গল্পটির উপসংহার আরও বেশি সুন্দর। আসলে লুনাকে ভালোবাসে না জাফর। তার প্রতি সহানুভূতিশীল সে মানবিক কারণে। তারপরও তারা দুজন ছুটিতে বাইরে যায় প্রকৃতির কাছে, সেখানে রাত কাটায়। প্রকৃতি তাদের আরও জীবন্ত ও তরতাজা করে তালে শারীরিক মানসিক উভয়ভাবেই। জাফর নিজ স্ত্রীর প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কথা সেখানে পুনর্ব্যক্ত করে, স্ত্রীও তার প্রতি তার গভীর বিশ্বাসের কথা জানায়। দুজনার অন্তরঙ্গ আবেগে গল্প করার মাঝে গড়িয়ে চলে রাত, গাছের ডালে শিস দিয়ে ডেকে ওঠে পাখি। দুজন বাড়তি আবেগে ও ভালোবাসায় ভেসে চলে মিলনের মোহনায়। একটি চিরতাজা সফল দাম্পত্য জীবনের বিশ্বাস জাগানিয়া সুন্দর শৈল্পিক ছবি ‘শিস দেয়া রাত’।
‘এক কাপ চা’ গল্পটিও বিষয়ভাবনা ও শিল্পের গাঁথুনি উভয় বিবেচনায় সুন্দর সৃষ্টি। যথার্থ জীবন মানে পদ, পদোন্নতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থ, নাকি ভালোবাসার এক কাপ চা? একজন ছাত্রনেতার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার, অর্থ উপার্জনের বদ নেশা এবং ওপরে ওঠার জন্য অপকর্মমূলক তৎপরতার বিপরীতে একজন অসাধারণ মনের সাধারণ যুবতী ছাত্রীর মায়াময় ভালোবাসা ও অকাল মৃত্যু পথভ্রষ্ট ছাত্রনেতাকে প্রকৃত জীবনের সন্ধান এনে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে সেই জীবন তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবৈধ টাকা কিভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে মানুষের মনে, তার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় নূর কামরুন নাহারের ‘হাইরাইজ’ নামক ছোটগল্পে। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন ও প্রকট পুঁজিবাদ প্রযোজিত ও পরিচালিত আধুনিক জীবন মানুষের ভেতরের সবুজ সত্তাটিকে কেড়ে নিচ্ছে যেভাবে হাইরাইজ বিল্ডিং গ্রাস করে নিচ্ছে সবুজ প্রকৃতির সচ্ছলতা, নূর কামরুন নাহার এমন তুলনা রচতে চেয়েছেন গল্পটিতে। অবশ্য ‘হাইরাইজ’ গল্পটির বেলী নামের নারী চরিত্রটি যতখানি বাস্তবানুগ, তার চেয়ে বেশি আরোপিত বলে মনে হয়েছে আমার।
নূর কামরুন নাহার একজন সচ্ছল কথাসাহিত্যিক। তিনি অনেক সংখ্যক ছোটগল্প লিখেছেন এবং তার লেখালেখি অব্যাহত রয়েছে সমান তালে ও গতিতে। তিনি একাধিক উপন্যাসও লিখেছেন। সংখ্যায় বেশি বটে কিন্তু তার লেখার মান সমুন্নত থেকেছে সবখানে। লেখককে তার জেন্ডার দিয়ে বিচার করা যুক্তিসঙ্গত নয় জেনেও বলতে হচ্ছে, নূর কামরুন নাহার একজন নারী কথাসাহিত্যিক। পুরুষের হাতে চিরনিপীড়িত নারীজাতির প্রতি তার একটা দায়বোধ আছে, গভীর শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু উৎকটভাবে নারীবাদী নন যদিও নারীবাদী হওয়া দোষের কিছু নয়। তিনি শহরে বসবাস করেন, চাকরি করেন গুরুত্বপূর্ণ অফিসে ও পদে। সে-কারণে তার কথাসাহিত্যে অফিস প্রাঙ্গণের বাইরের ও ভেতরের নানা ছবি চিত্রিত হয়েছে সত্যনিষ্ঠ সৌন্দর্যে। এটা আমাদের কথাসাহিত্যের ভূগোলে গুরুত্বপূর্ণ উঠোন ও প্রান্তর যোগ করেছে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই যে, তিনি শুধু নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সীমায়িত করে রাখেননি তার সবখানি ভাবনা—সবটুকু কলম। বলা যেতে পারে, পৃথিবী, সমাজ ও মানুষকে তিনি কেবল নারীর চোখেই দেখেননি, লিঙ্গনিরপেক্ষ দৃষ্টিতেও পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফলে তার দেখার, ভাবনার ও সৃষ্টির জগৎ সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি কোনো বিশেষ ধরনে কিংবা নির্দিষ্ট ভূগোলে। তিনি চরিত্র চিত্রণে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নানা পেশার, নানা সামাজিক অবস্থানের এবং নানা জীবনদর্শনে বিশ্বাসী মানুষের ছবি এঁকেছেন তিনি নিপুণতার সঙ্গে। তার হাতে নির্মিত চরিত্রগুলো বাস্তবনিবিড় সত্যে জীবন্ত। তবে নারী চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে নারীজাতির প্রতি তার বাড়তি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা জনিত সূক্ষ্ণ পক্ষপাত ঘটেছে অনেক গল্পে। কিন্তু সেই পক্ষপাত দৃষ্টিকটু নয়, ফলে পাঠকের মন সহজেই মেনে নেয় তা স্বতঃস্ফূর্ত অনুমোদন সহকারে।
উপন্যাস-গল্প এসবের পাশাপশি কবিতাও লেখেন নূর কামরুন নাহার। সেজন্য তার গল্প-উপন্যাসের ভাষা সাবলীল, সচ্ছল ও প্রাণময়, কখনো-বা অন্ত্যমিলহীন কবিতার মতো। তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাতিদীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করেছেন। অফিস আদালত নিয়ে গল্প রচনার ক্ষেত্রে অফিস আদালতের পরিভাষা ব্যবহার করেছেন এবং এতে করে উপস্থাপিত ঘটনার বা দৃশ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লেখায় সুন্দর সুন্দর ও জুতসই চিত্রকল্প এবং উপমা তার প্রায় প্রতিটি ছোটোগল্পকে উপভোগ্যতার ঐশ্বর্য দান করেছে। গল্পের চরিত্রগুলোর ভৌগোলিক ও সামাজিক অবস্থান, শিক্ষার হাল ও পেশাগত চৌহদ্দি এসবকিছুর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নির্মিত হয়েছে বর্ণনার ভাষা ও ডায়ালগ। চরিত্রের প্রয়োজনে গল্পের ভাষায় ঢুকে পড়েছে প্রশাসনিক পরিভাষা, ইংরেজি শব্দ, প্রযুক্তিগত টার্মিনলজি কিংবা আঞ্চলিক কথ্য সংলাপ। তিনি সহজাত ক্ষমতায় গল্প রচনা করেন। ফলে গল্পের প্লট নির্মাণে কোথাও কষ্টকল্পনা কিংবা জোরাজুরি নেই। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে কবি বলে তার কথাসাহিত্যের কাহিনি ও ভাষা দুই-ই বাস্তর ও কল্পনার সুষম সংশ্লেষে প্রশংসনীয়ভাবে সরস ও শিল্পোত্তীর্ণ।
বাাংলাদেশ এখনো গ্রামপ্রধান সমাজের ধারক বাহক। নূর কামরুন নাহার গ্রামের বর্তমান জীবন যাপন নিয়েও দু’একটি গল্প লিখেছেন। তার ‘সালিশ’ গল্পটি গ্রামীণ জীবন নিয়ে রচিত একটি শক্তিশালী সৃষ্টি। কিন্তু গ্রামীণ জীবন নিয়ে তার সৃষ্টি খুবই কম। নূর কামরুন নাহার মূলত ও প্রধানত শহরজীবনের শিল্পী। তিনি শহরে বসবাসকারী রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবী, এনজিওকর্মী, ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী, দালাল, ছাত্রছাত্রী প্রভৃতি প্রায় সব শ্রেণীর ও অবস্থানের মানুষের জীবনাচরণ ও মন-মানসিকতাকে সামনে রেখে গল্প রচনা করেছেন। গল্পের মধ্যে বড় কিংবা ছোট ঘটনা আছে, পরিবর্তিত সময়ের শহর জীবনের ছবি আছে কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেসব শহরের মানুষের চরিত্র, মন-মানসিকতা, কামনা বাসনা, নিষ্ঠা, সততা, অনৈতিকতা, ভণ্ডামি, যৌনজীবন, জীবনদর্শন ইত্যাদির চিত্র অঙ্কন। এসবের কোনো কোনোটা মোটা দাগে অঙ্কিত আবার কোনো কোনোটি সূক্ষ্ণতার আঁচড়ে রেখায়িত। তিনি শহরের বাইরে থেকে দৃশ্যমান ছবির অবয়ব এঁকেছেন কিন্তু ছবির রঙে ও রেখায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে অন্দরের মন ও মানসিকতা, সৃজনশীলতা ও বন্ধ্যাত্ব, বাহ্যিক একনিষ্ঠতার আড়ালে লুক্কায়িত দ্বিচারী কামনা বাসনা। শহরের শিক্ষিত মানুষকে কেবল তাদের বেশভূষা দেখে ও কথাবার্তা শুনে বোঝা যায় না। তাদের বড় অংশটাই বাইরে একরকম , মনে ও মানসিকতায় অন্যরকম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক অন্ধকার জমে আছে তাদেও অনেকেরই আলোকিত চেহারার আড়ালে। উপরিস্থ আবরণ বা মুখোশ সরিয়ে টর্চলাইটের দৃষ্টি নিয়ে দেখতে হয় সেসব অন্ধকারের রূপ। শহরজীবনকে ভেতর থেকে দেখার জন্য যে শানিত সূক্ষ্ণ ও অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রয়োজন, সেটা আছে নূর কামরুন নাহারের। নূর কামরুন নাহারের ছোটগল্পসমূহ ও উপন্যাসাদি সাক্ষ্য দেয়, তিনি বাংলাদেশের শহরের অন্দরমহলের ও নাগরিক মনস্তত্ত্বের নিবিড় কথাশিল্পী।