আমাদের নগর অন্ধকারে ডানা মেলেছে। অন্ধকার তার সবটুকু রঙ নিয়ে জেগে ওঠে রাত্তিরে। আর আমাদের চাটগাঁ শহর- আরও বেশি চাটগাঁ হয়ে ওঠে। এখানে ওখানে যদি বা চাটি জ্বলে কি জ্বলে না—আমি তা দেখতে চাই না। কাটা গলা মুণ্ডু ও ধড় থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের মতো নয়, মেঘের আবিলতায়, কোমলতায় অমল-তুমুল বেরিয়ে আসে আঁধার আমাদের শহর চাতালে। আকাশ থেকে নেমে আসে কালো সামিয়ানা। তার ভেতরই কতো দৃশ্য-দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আমি চোখজোড়া খুলে রাখি। একটা নীরব সুতো বেঁধে রেখেছে সর্বাঙ্গ যেন ‘রুমাল চোর’ খেলার মতো দৃশ্যমান সবকিছু হারিয়ে ফেলে কেবল অনুভব করি—‘শিপ্রা নদী তীরে / আরতি থামিয়া গেল শিবের মন্দিরে’।
তখন থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসে থাকি আমিই আমার। অনুভূভির ঘুঁটি এমন নাড়ায়, আমি কেবল তার নিমিত্ত হয়ে উঠি; দৃশ্য পরম্পরায় খুলে যেতে থাকে স্মৃতি-বিস্মৃতির দুয়ার। অন্ধকার কি তবে নিসর্গের সবচেয়ে সৌন্দর্যময়ী আবেদন নয়?
একবার রাঙামাটির এক বনে হঠাৎ দলছুট হয়ে পড়েছিলাম। কাঠবেড়ালী আর হাড়িচাঁচা পাখির পিছু পিছু দৌঁড়ে হঠাৎ দেখি—আমি একা। পায়ের নিচের শুকনো পাতার শব্দে নিজেই চমকে উঠছি। সোঁদা গন্ধ, ঘোর লাগা আলো-অন্ধকারে বিশাল গাছগাছালীর ভেতর আমার কোনও সঙ্গীকেই দেখা যাচ্ছে না। চিৎকার করে ডাকাতেই দূর পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলো সেই ডাক। দুই-একটি বনমোরগ নিরাপদ দূরত্ব থেকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে রইলো। পরমুহূর্তে মনে হলো—কেমন হবে যদি বন মানুষ হয়ে যাই! চাদ্দিকের গাছে গাছে পাখির গুঞ্জন, বাতাসের শাঁ-শাঁ শব্দ, দূরে পাহাড়ি ঝিরি, আরও দূরে কোথাও জলপথে ভট্ভটি যাচ্ছে। সাপ, ব্যাঙ, জোঁক, বানর, হাতি, শেয়াল—সব মিলিয়ে নিজেকে ভাবতে চাইলাম। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছিল, ততই ওই সব রোমান্টিকতা—গাছের কালো থেকে কালো হয়ে ওঠা ছায়ার ভেতর উবে যেতে লাগল। মনে হলো, এ যেন এক রাক্ষসপুরী। সন্ধ্যা নামলেই গাছগুলো সব এক একটি রাক্ষস হয়ে উঠবে। আহা, লালকুমার আর নীলকুমার এসে যদি আমায় নিয়ে যেত। ভাগ্যিস বন্ধুরা সেদিন খুঁজে পেয়েছিল।
আর একবার ইনানী গেলাম, সমুদ্রকে নিবিড় করে পাওয়া মুশকিল। মানুষেয় স্রোতে যেন সমুদ্রের স্রোত হারিয়ে যায়্। সে জন্যে দূরে ইনানীর সমুদ্র তীরে তাঁবু বাঁধলাম। সারাদিন আধবোঁজা চোখে আধশোয়া শরীরে সমুদ্র সিথানে। শরীর ভেজাই শুকোই। সমুদ্রের ঢেউয়ে পানকৌড়ির মতো মাথা উচুঁ করে রাখি, গায়ের নিচে সরসর করে বালি সরে যায়। দুই-একটি সমুদ্র বক খুব কাছে এসে অবাক তাকিয়ে থাকে। জল খুঁটে খায়। ইনানীর পাহাড় ঘেঁষে ঝাউ আর বাবলার বন সবুজ আলো ছড়ায়। বিস্তীর্ণী বাদামি বালি আর নীল জলে উপুড় করা নীলাকাশ, আরও দূরে দিগন্তত যেখানে জলে একাকার—ওখানে সিন্ধুর টিপের মতো সোনাদিয়া দ্বীপ হাতছানি দেয়। কোত্থাও কেউ নেই!
মনে হয় এই গ্রহ মানুষের নয়।
জলের জিহবার নিচে বালুকনা, প্রবাল বিবরে
কী এক সুর ভাসে অলৌকিক পাখোয়াজে
আলোর তীরে বিদ্ধ ইনানী পাহাড়
সমুদ্র পায়ে রেখে আকাশের নিচে
নিঃসীম শূন্যতা
. শূন্য শূন্যতা
. এই সমুদ্র সিথানে।
. এতটা হাহাকার
. জলে জলে
. বাতাস ও বালুকায়নৈঃসঙ্গ প্রণয় পিঁড়ি পাতা সবখানে
ব্যস্তবেদন জীবনের নিকেশ ভুলে যাই
মনে হয় কেউ নেই- আমি এক একক মানব,
রতিক্লান্ত কাছিমের পাশে শুয়ে রই
এমন মহিমা আজ সমুদ্রের ঘরে
মুক্ত হস্ত নিসর্গ তারাজ্বলা রাতেআমাকেই জন্ম দিই ঘোর শঙ্খযামে।
শামুকের মেয়ে আমি, ঝিনুকের বুকে শুই
সাগর সিথানে, মাছের চোখের মত তারা হই
আকাশের গায়ে
ইনানী পাহাড় চুড়োয় গাছ হয়ে শেকড় ছড়াই
যাবো না মনুষ্য কূলে…
মানুষেরা কাঁটাগাছ মদের পিঁপের মতো চলে,
আমি আর আমি নই, ঝিনুকে শামুকে জলে-
‘আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।’
চাটগাঁ আমার জন্ম শহর। আমার আঁতুড় ঘর। এই শহরে জন্মের পর ঠিক জল পড়ে পাতা নড়ের মতো কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না। শুধু প্রায়শ বা প্রায় প্রতিদিন যখনি আকাশ দেখি, মনে পড়ে, কৈশোরে তেতালায় ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে মেঘ দেখতাম। শাদা শাদা তুলোর মতো আলুথালু। উজ্জ্বল নীল আকাশে শাদা মেঘ কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো নজরুল, কখনো ভয়ঙ্কর ডাইনী বুড়ির মতো ভেসে উঠত—যেন দুয়োরাণী তার আসল চেহারায় জেগে উঠেছে। খুব প্রিয় খেলা ছিলো ওটা। আজো মনে মনে—রোদের ছাদে শুয়ে শুয়ে মেঘের ভাঙচুর দেখা। আজ এতটা দীর্ঘ বছর পরও মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে আমার সেই কৈশোর কাল। আকাশের যে রঙ বিভা আর মেঘের শুভ্রফেনা স্মৃতির ভেতর—তা থেকেই মনে হয়, আমি বোধ হয় শরতের আকাশ দেখতে ভালোবাসতাম। আজও শরৎই আমার প্রিয় ঋতু। শরতে পুরোপৃথিবী থরে থরে সাজানো থাকে লাবণ্য-সুধা! কী সুন্দর তার হাসি, কী তার রোদ আর মেঘ, কেমন জ্যোস্না! কাশফুল, পাহাড় নদী সব কেমন যেন আদুরে হয়ে ওঠে। আমার ভেতর থেকে আমি উড়ে যাই—দূ-উ-র পাহাড়ে, জিলেপির পাহাড় তার নাম। ওখানে ব্যাঙ্গমা পাখির বাসা, ওর পিঠে চড়ে তবেই না আমি সমুদ্র উড়াল দেব।
আমার বারান্দা জুড়ে রোদে মেঘে চুমোচুমি হয়—
বামে সারি সারি পাহাড়, তার সবুজ বিভা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞাপনী বিল বোর্ড, ক্লিপখোলা চুলের ঐশ্বরীয়াও ভারী বেমানান ওই সবুজ পাহাড়ে। আর ডানে সমুদ্র, মাথা উচুঁ করে চাতকের মতো দাঁড়িয়ে আছে শত শত ক্রেন। নিয়ন বাতির আলো ডান থেকে বাঁয়ে জ্যামিতিক জ্যা এর মতো সমুদ্র থেকে কর্ণফুলী—একটি উজ্জ্বল কমলা রেখার দিগন্ত তৈরি করেছে। কখনো কখনো সমুদ্র থেকে সারি সারি বক উড়ে আসে। আমি ওদের গায়ের নোনা গন্ধে বিভোর হয়ে থাকি। বলি, ও বক, আজ সমুদ্রের রঙ কি নীল ধূসর? এই সব নিয়েই তো আমার জন্ম শহর।
স্ফটিক ভোর ফোটে, ফোটে দিনানুদিনের কণা
জন্মান্ধ মাছির মতো এ শহর বন বন ঘোরে,
জীবিকার গ্লানি থেকে
. যাপনের গ্লানি থেকে
. জীবনের রোদ ফুটে ওঠে।
এ বড়ো সবুজ শহর, সমুদ্র প্রবণ
পাহাড়ী স্তন চিরে বয়ে যায় স্বচ্ছ তোয়া
নৈঃশব্দ্যই কবিতা বলে…এ শহরে সকলেই কবি
এ বড়ো জন্ম শহর
নাড়ী গন্ধী, দুগ্ধগন্ধী মায়া—
আয়েশী যাপনে তার নেচে ওঠে খোল,
করতালপাহাড়ের খাঁজ কাটা নাগরিক সড়কের ধাপে
শরীরি পসরা নিয়েও এ শহর মেতে ওঠে রাতে।
যেখানে অঢেল প্রেম, মাতুলগন্ধী হাওয়া
সেখানেও বয়ে যায় কামের কোলাজ।
এ শহর বুনো বড়ো
জাহাজের ভেঁপু শুনে ঘুম ভেঙে গেলে
যুগল রাত্রি বাড়ে প্রগাঢ় চুম্বনে…
এ শহর আশ্চর্য শহর যাদুটোনা জানে
এ বড়ো জন্ম শহর সবুজ কাব্যখামে।
আদতে আমার এই জন্ম শহরকে দিয়েই আমি পুরো বাংলাদেশকে চিনি, পাঠ করি। চট্টগ্রাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর, শ্রেষ্ঠ নিসর্গ পুস্তক। আমি তো সমুদ্র কন্যা, কর্ণফুলী আমার বোন। যত দূরেই যাই—এ শহরে বুঝি থাকে শান্তি-প্রশান্তি, প্রতিবার, বারবার। আমার বারান্দার দিগন্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে যে জিলাপি নামের পাহাড়, তার চূড়োয় দাঁড়িয়ে আমি পুরো চাটগাঁ শহরকে দেখতে পাই। কর্ণফুলীর বাঁক আর ইলিশ মাছের পেটির মতো ঝকঝ্কে সমুদ্রকে আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ভোরে সাদা ভাতের মতো নক্ষত্রগুলো মিলিয়ে গেলে, রোদের জামা গায়ে পরে বলে ওঠে জিলাপি পাহাড়। ‘সুপ্রভাত’ আমিও বিছানা ছেড়ে চুপিচুপি বলি—বেঁচে আছি বেঁচে আছি আরও একটি সকাল!
ভাবি এই বুঝি সে-ই পাহাড়, যেখানে বাস করতো শবর-শবরী, থাকত ডোম্বী। নাগরিক সমাজের কাছে অস্পৃশ্য, রাতে তারই কাছে আসে মুখোশধারী লম্পট ব্রাহ্মণ সমাজপতি। কারণ, ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী।’ মহুয়ার মদে মাতাল হয়ে ওই বুঝি নেচে চলেছে শবর-শবরী গলে পড়া চাঁদের নিচে।
উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালি
মোরাঙ্গ পীচছ পরিহান গীবত গুঞ্জরী মালি।
(সবর পা )
মাঝে মাঝে অকারণেই মন ভার হয়ে ওঠে। যেন ডানা ভেজা কাক। উড়তে পারি না, ঘুরতেও। পল্লবিত রোদের পালকে ওড়ার আগে ফিরে যাই সমুদ্রবিলাসে। আমার সারা গা জুড়ে তো সমুদ্রেরই নুন। যে সমুদ্র উগরে দেয় দিগন্তের সীমায় যন্ত্রদানব, সে আমার বড় চেনা। এই জলের স্বর, সুর, স্বপ্নে বেড়ে উঠেছে আমার কৈশোর। জল তরঙ্গের ফ্সফরাস্ মুক্তোদানার মতো জ্বলের নিচে, ওপরে তারকার ঝাড়বাতি—যেন তারই প্রতিচ্ছবি জলের অঙ্গে-বিভঙ্গে। জল জোছনায় মাখামাখি পাতলা অন্ধকারে প্রাণ গান গেয়ে ওঠে। সেই গান আলিঙ্গন করে নিয়ে যায় আলো আবছায়ায়। আকাশ ও অসীমে। অনন্তের সঙ্গে এভাবেই বাঁধা পড়ি এক টুকরো অনন্ত হয়ে। আমার মন ভালো হয়ে যায়। অথবা বেদনাই যাপন করি। কেননা আমিতো বেদনা বিলাসী, তখন নিম অন্ধকার নামে। বাতাস নানা শব্দে স্পর্শিক হয়ে ওঠে। শব্দগুলো ভাসতে থাকে, বকের ডানায়, চামচিকে আর বাঁদুরের স্বরে। কোথাও শুকনো পাতা ওড়ে। গঙ্গা ফড়িঙ ওড়ে। আকাশ মেঘের কাঁচুলী খুলে হেসে ওঠে। নিম আলোয় মনে হয় নিকট সমুদ্রের ভেজা ঘ্রাণ বৃষ্টি স্নাত পৌরুষে এগিয়ে আসে। বিনম্র প্রার্থনার মতো রচিত হয় পঙ্ক্তি, পঙ্ক্তির পর পংক্তি। কবিতা—একটি বোধ বিস্তৃত হতে হতে বিশাল ব্রহ্মাণ্ড হয়ে যায়। সেই ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কোন মহাকালের অনন্ত থেকে উড়ে আসে সেই ঘুম আমি জানি না। ঘুমোতে ঘুমোতে ভাবি—এই ঘোর লাগা গহন গভীর নিসর্গের ভেতর থেকে যদি আর জেগে না উঠি! জিলেপি পাহাড় যদি ডাকে ‘সুপ্রভাত’ ঘুমফোটা ভোরে কে বলবে তখন ‘বেঁচে আছি, বেঁচে আছি আরও একটি সকাল।’