কবি চিৎকার করবেন বৈকি যখন দরকার। কবি ছিনিয়ে নেবেন বৈকি যখন অন্ধ চারপাশ। যখন সময়, তখন কবি লিখবেন কিছু স্নিগ্ধ বাতাস। যখন দরকার কবি দেশদ্রোহীর বুকে বসাবেন তীক্ষ্ণ খঞ্জর। যখন প্রয়োজন, অন্ধ রাষ্ট্র কিংবা সমাজের চোখ থেকে খুলে নেবেন বাঁধা কালো কাপড়। সে এক কবি-নির্মলেন্দু গুণ। জীবনের সোনালি প্রদোষে শুরু হয়েছিল তাঁর লেখা ‘হুলিয়া’ দিয়ে। কালেকালে সুনন্দাদিও হয়ে পড়েন একসময় তাঁরই এক আনন্দ প্রতিভূ আমার জীবনে। তাঁর কবিতা যেন এক ইতিহাস। তাঁর কবিতা যেন এক প্রত্নগাথা। তাইতো লিখলেন সেই অমর কবিতা:
চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত
নিম্ন-মধ্যবিত্ত, করুণ কেরাণী
নারী বৃদ্ধ বেশ্যা ভবঘুরে আর
তোমাদের মতো শিশু পাতকুড়ানীরা দলবেঁধে
একটি কবিতা লেখা হবে
তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের!
কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?
তার চোখে নতুন রাষ্ট্রজনক, তিনিও এক কবি। কি দারুণ উল্লাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে তাঁর লেখায় একইসঙ্গে একজন বিশ্ববিশ্রুত কবি আর একজন রাষ্ট্রনায়ক আর অবিসংবাদিত নেতার কথা বাজে:
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন।
কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠবাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি
শোনালেন তার অমর কবিতাখানি:
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
সহজিয়া সাধনে গেছেন বহুকাল। মৈমনসিংহ গীতিকার স্রোতধারা রক্তে তাঁর। লিখেছেন অজস্র সরল মনোমুগ্ধকর কথা-গাথা-কবিতা। কবিতার ভাষায় সারল্য তাঁর কবিতার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। কখনো তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো রোমান্টিক-ফল্গুহারা। কখনো তিনি যেন সুধীন্দ্রনাথ প্রভাবিত। কোথাও কোথাও দেখা গেছে দীর্ঘ প্রাচীন ক্রিয়াপদের বহুল ব্যবহার তাঁর কবিতায়। অনুষঙ্গে যেন রবীন্দ্রনাথ। তাই কখনো সাধু আর চলিতের ইচ্ছাকৃত মিশ্রণও করেছে তাঁর কবিতাকে সুখপাঠ্য:
তুমি লহ নাই ভালোবাসিবার দায়
দু’হাতে শুধুই কুড়ায়েছ ঝরা ফুল
কৃষ্ণচূড়ার তলে, আমি বসে একা
বুনিয়াছি প্রেম ঘৃণা বুনিবার ছলে।
কিংবা শাশ্বতীর ছায়া নিয়ে:
আমরা দুজনে রচনা করেছি একে অপরের ক্ষতি
প্রবাসী প্রেমের পাথরে গড়েছি
অন্ধ অমরাবতী।
আমরা নিশিদিন বিহ্বলতায়
শুত্রে-শোণিতে-স্বেদে,
আমাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে
বেদনায় বিচ্ছেদে ।
আজ স্বল্প পরিসরে আর দীর্ঘ আলোচনা নাই করি। শুধু বলি, কবিতায় মুগ্ধ করেছেন আমার মতো এক সাধারণ পাঠকেরেও। সবশেষে মুগ্ধ হয়েছি তার নতুন কবিতায়। আমি একে কবিতাই বলি। কবি সত্যদ্রষ্টা। কবি বলে যাচ্ছেন হৃদয়ের যাতনার কথা, চির প্রেমে অমলিন প্রদীপের কথা। এই পোড়খাওয়া সমাজের অন্ধ ঠুলিটিকে খুলে ফেলতেও আজ তিনিই নিলেন দায়িত্ব। ছিনিয়ে নিলেন স্বাধীনতা পদক। সবাই বলে চেয়ে নিলেন। তাই নিয়ে কত কত যে পর্যালোচনা, কত যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। এরই ফাঁক গলে আমি দেখি এক চমৎকার কবিতাশরীর। পড়ি এক অদ্ভুত কবিতা্। যা এগিয়ে দেয় নিবিষ্টকর্মীকে তার ন্যায্য পাওনা ছিনিয়ে নিতে। নষ্টসমাজ যখন দেখে না আলোর রশ্মি, যোগ্যতার খাঁড়া মাপকাঠিতে যখন জমে আছে এক অদ্ভুত আঁধার, তখন আমি মনে করি এ তাঁর একলার নয়। ব্যক্তিগত কিছু সম্পদ হরণ নয়। সামনে চলার পথ দেখানো। নতুন পথের দিশা। ধুলায় গড়ানো পরশ পাথরের মাথা তুলে নিজস্ব অস্তিত্ব ঘোষণা। আর তাই জানাই কবিকে শত সহস্র প্রণাম। স্যালুট কবি। স্যালুট আপনাকে। আজীবন এই যুদ্ধে-দ্রোহে-প্রেমে-বিদ্রোহে আর নৃশংসতায় জন্ম হতে থাক তাঁর হাতে শত-শত অজর-অমর অক্ষয় কবিতা।
জন্মদিনে আমার প্রিয় কবিকে জানাই সহস্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। তাঁরই নিজের ভাষায় বলে যাই:
আমি জানি মানুষের জয় হবে, সে তো মৃত্তিকার মতো
কিন্তু আমি সে–আনন্দের ভোজে অপাঙ্ক্তেয় রয়ে যাব।
আমি ভালোবাসার চোখ ভিজিয়েছি ঘৃণায়
আমি তার মুখে ছড়িয়ে দিয়েছি বেদনার কালো ছায়া।
তোমার পতাকা আমি বইতে পারিনি, এই বাস্তব সত্যের
মধ্যে লুপ্ত হোক আমার অর্জিত সব মিথ্যে পরিচয়।