নির্মল নীল আকাশ আর সুনসান সবুজ উপত্যকায় হরিণ ও পাখির ওড়াউড়ি, পাথুরে পাহাড় আর উঁচু উঁচু টিলায় উজ্জ্বল ড্যাফোডিল ফুল, ঘন জলের লেক এবং সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা স্কটল্যান্ড। হাজার বছরের পুরনো শহর। প্রাচীন ক্যাসল ও স্থাপত্য শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন। আকাশ থেকে মনে হয় ঘাসের গালিচা। মাইলের পর মাইল সবুজে আচ্ছাদিত। একদিকে ব্রিটেন আর অন্য তিনদিকে সাউথ সি, আটলান্টিক ও নর্থ চ্যানেল। ঘুরে বেড়ানোর জন্য স্কটল্যান্ডের তুলনা মেলা ভার।
স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত একটি দেশ। এটি গ্রেট বৃটেন দ্বীপের উত্তর দিকের এক তৃতীয়াংশে অবস্থিত। দক্ষিণ-পূর্বে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৯৬ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত, উত্তর ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর-পূর্বে উত্তর সাগর, দক্ষিণে আইরিশ সাগর অবস্থিত।
স্কটল্যান্ড ছাড়াও প্রধান শহর গুলোর মধ্যে রয়েছে এডিনবরা, গ্লাসগো ও আবারডিন। এডিনবরা সে দেশের রাজধানী ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ১৮ শতকে স্কটিশ নব জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, যা স্কটল্যান্ডকে ইউরোপে বাণিজ্যিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শিল্প শক্তিকেন্দ্রগুলোর একটিতে রূপান্তরিত করে। গ্লাসগো স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম শহর। এক সময়কার বিশ্বের নেতৃস্থানীয় শিল্প শহর। স্কটিশ পানিসীমা উত্তর আটলান্টিক ও উত্তর সাগরজুড়ে বেষ্টিত। যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বৃহত্তম তেল মজুদ রয়েছে। এজন্যই এডিনবরাকে ইউরোপের তেল রাজধানী বলা হয়। আর স্কটিশদের কাছে আবারডিন হচ্ছে সিলভার সিটি উইথ দ্য গোল্ডেন স্যান্ড। ডি আর ডন এই দুটি নদীর উৎসমুখে অবস্থিত এই শহরকে ঘিরে আছে এক দীর্ঘ বালুময় উপকূল অঞ্চল।
৩১৩ বছর আগে ১৭০৭ সালে স্বাধীন স্কটল্যান্ড তাদের সংসদ ভেঙে যুক্তরাজ্যের অংশ হয়েছিল। ১৩ শতক থেকে ১৭০৭ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড ছিল স্বাধীন। ১৭ শতকের গোড়ায় দু’দেশের রাজপরিবারের মিলন ঘটে। ১৬৫৩ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের আমলে দুই সরকারের বন্ধন হয়। যার চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৭০৭ সালৈ। এই মিলনের নাম হয় গ্রেট ব্রিটেন। ইংরেজ রাজপরিবার দুই দেশের রাজপরিবার হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৮০১ সালে গ্রেট ব্রিটেনে যুক্ত হয় আয়ারল্যান্ড। সম্মিলিত ভূখণ্ডের নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য।
সর্বশেষ স্কটল্যান্ড গিয়েছিলাম ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। গেটউইক এয়ারপোর্ট থেকে ইজি জেটে ৪টা ১০মিনিটে যাত্রা করে ৫টা ২০মিনিটে এডিনবরা বিমান বন্দর পৌঁছাই। মাত্র ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটে চলে গেলাম। এনটিভির সিইও সাবরিনা হোসাইন, পরিচালক মোস্তফা সারওয়ারসহ বেশ কয়েকজন বন্ধু সঙ্গে ছিলেন।
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার অভিজাত ভেন্যু ব্রিটানিয়া স্পাইস লাউঞ্জে এক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের হোস্ট ছিলেন ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিবিসিসি) সাবেক প্রেসিডেন্ট ওয়ালি তসর উদ্দীন এমবিই। বর্তমানে তিনি ইউরোপিয়ান-বাংলাদেশ ফেডারেশন অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইবিএফ) প্রেসিডেন্ট। এক সময় স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল ছিলেন।
২০০০ সালে আমি বিলেত আসার পর সাংবাদিকতার পাশাপাশি এখানকার কমিউনিটির বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছেন ওয়ালী তসর উদ্দিন এমবিই। আমার ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি ও ইউকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ডিরেক্টরি প্রকাশের সময় তিনি সামগ্রিক সহায়তা করেছেন। তখন সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে লন্ডন ছুটে আসতেন। ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের কার্যক্রমসহ অন্যান্য শিক্ষা ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিতেন। শুরু থেকেই আমার সঙ্গে তার একটা সখ্য গড়ে ওঠে। ফলে লন্ডন এলে আমরা একসঙ্গে কিছুটা হলেও সময় কাটাই। সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণা করি।
ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স (বিবিসিসি) প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অন্যতম প্রধান বিষয় এবং চেম্বারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও সফল অনুষ্ঠান ছিল এক্সপো বাংলাদেশ ২০০৫। লন্ডনের অভিজাত ভেন্যু বার্বিকান সেন্টারে ১৫ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর তিন দিনব্যাপী এই বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তখন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুকিম আহমদ ও ডিজি ছিলেন স্বদেশপ্রেমী ওয়ালী তসর উদ্দিন এমবিই। লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও নতুন দিন সম্পাদক মহিব চৌধুরী বিসিসির ডিরেক্টর ছিলেন। পরে ডিরেক্টর জেনারেল হয়েছেন এবং বর্তমানে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ওয়ালী তসর উদ্দিন ও মহিব চৌধুরীর বিশেষ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমি সক্রিয়ভাবে এতে যুক্ত হই। একসময় বিবিসিসির প্রেস অ্যান্ড পাবলিসিটি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। বিবিসিসির উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডন ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সহায়তায় এক্সপো বাংলাদেশ বাণিজ্য মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলাকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য তখন বাংলাদেশ সফর এবং বিলেতে ও বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচার তৎপরতা পরিচালনা করেছি। এক্সপো বাংলাদেশের নির্বাহী প্রধান ওয়ালী তছর উদ্দিন এমবিই জেপি’র নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলাম আমি (সাঈদ চৌধুরী, সম্পাদক সময়), স্কটল্যান্ডের মেলান নেটওয়ার্কের এলান টুইডি ও বিবিসিসি স্কটিশ রিজিওনাল প্রেসিডেন্ট এমএ রউফ। ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাব এবং সিলেট প্রেসক্লাবে বিবিসিসির পক্ষ থেকে এক্সপো সম্পর্কিত মূল প্রবন্ধ আমি উপস্থাপন করি। এছাড়া আমরা (প্রতিনিধি দল) এক্সপো সফল করতে ব্রিটিশ হাই কমিশন ঢাকা, বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড, এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী নেতারা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় মিলিত হই।
এভাবে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট ওয়ালী তসর উদ্দিনের আন্তরিকতায় স্কটল্যান্ড সফরে ছিল অন্যরকম মুগ্ধতা। সেখানে তার ভাগনা নব নিযুক্ত স্কটিশ মেম্বার অব পার্লামেন্ট ফয়সল চৌধুরী এমবিই, মুক্তিযোদ্ধা শাহনুর চৌধুরী, চ্যানেল এস স্কটল্যান্ড এডিটর মিজান রহমান প্রমুখের আতিথেয়তা কখনো ভোলার মতো নয়।
আরও দু’মাস আগে ২০১৩ সালের ৫ মে ঘুরে গেছি আরেকবার। বিকেল ৯টা ৪৫মিনিটে গেটউইক থেকে যাত্রা করে ১ ঘণ্টায় এডিনবরা পৌঁছে গেলাম। ফ্লাইটে আমার সঙ্গে ছিলেন ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী শাহ জামাল, আহমদ আলী ও আব্দুল বাছিত খান। আমাদের স্বাগত জানালেন মিডলোদিয়ান এলাকার ইতিহাস রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী মতিন খান। সেখানে মাঝরাতে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল।
এই দুটি অনুষ্ঠানে স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে দেখা ও সেখানকার যাপিত জীবন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও খুব বেশি ঘুরে দেখা হয়নি। যদিও স্কটল্যান্ডের ল্যান্ডস্কেপ ও স্থাপত্যশৈলী আগের মতোই প্রাণ কেড়েছে।
২০০৩ সালে যখন প্রথম স্কটল্যান্ড সফর করি, তখন সেখানকার অপূর্ব নিদর্শনাবলী দেখা হয়েছে যথার্থভাবে। সাপ্তাহিক ইউরো বাংলার জন্য বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে সড়ক পথে গিয়েছিলাম। লন্ডনের কিংক্রস স্টেশন থেকে ট্রেন যাত্রা ছিল বেশ আনন্দের।
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার মতোই স্কটল্যান্ড। কবিতার কেন্দ্রবিন্দু ও শৈলী থেকে বোঝা যায়, নব্য ক্ল্যাসিক্যাল ধারা থেকে কবিতাটি রোমান্টিক ধারার দিকে ঝুঁকেছে। (THE PRELUDE OR, GROWTH OF A POET’S MIND; AN AUTOBIOGRAPHICAL POEM BY WILLIAM WORDSWORTH) অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত একটি আত্মজীবনী মূলক কথোপকথন। ১৭৯৮ সালে ২৮ বছর বয়সে ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই কবিতাটি রচনা শুরু করেন এবং সারা জীবন ধরে আপডেট করেছিলেন। তিনি এই কবিতার কোনো শিরোনাম দেননি। ১৮৫০ সালে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মৃত্যুর তিন মাস পর প্রথম প্রকাশিত হয় এবং শিরোনামটি দেন তার স্ত্রী মেরি।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের শহরে যাওয়ার সময় কবিতাটি অনলাইনে একবার দেখে নিলাম। গন্তব্যে প্রবেশের আগেই চোখে পড়লো বিশাল সমুদ্রের ওপর নান্দনিক ফোর্থ ব্রিজ। ১৮৯০ সালে নির্মিত এই রেলব্রিজ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষিত। ২০১৬ সালে এটি স্কটল্যান্ডের ‘গ্রেটেস্ট ম্যান-মেড ওয়ান্ডার’ হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। লাল রঙের ক্যান্টিলিভার রেলব্রিজ দেড় মাইল লম্বা ও ৩৬১ ফুট উঁচু। উত্তরে নর্থ কুইন্স ফেরি আর দক্ষিণে সাউথ কুইন্স ফেরি পর্যন্ত বিস্তৃত।
অসাধারণ রঙিন ও সৃজনশীলতায় সাজানো এডিনবরা ফ্রিঞ্জ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। প্রতিবছর আগস্টে ফ্রিঞ্জ উৎসব হয়। প্রায় ৩০০ ভেন্যুতে স্যান্ডআপ কমেডিয়ান, অ্যাক্রোবেট এবং বিভিন্ন জাতির সমাবেশ যেন বহুজাতিক সংস্কৃতি বিকাশের মাইল ফলক। বিরাট এলাকাজুড়ে দেখা গেলো শিল্পীদের নানা কসরত চলছে। পিয়ানো ও বাশি বাজাচ্ছেন কেউ কেউ। খ্যাতিমান অনেকে বিভিন্ন মঞ্চে নাটক আর ম্যাজিক দেখিয়ে চলেছেন অবিরাম। মেলায় আগত বহুজাতিক হাজার হাজার দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছেন তারা।
নানা রকমের বাহারি খাবার দেখে কিছুটা খিদে অনুভব করলাম। একটি এশিয়ান রেস্তোরাঁয় ধোঁয়া-ওঠা মচমচে চপ অর্ডার দিলাম। সঙ্গে রুটি আর লেবু ও মরিচ সংযুক্ত শসার সালাদ। সকলের সামনে তৈরি করে খেতে দেয়। লম্বা লাইন দেখে মনে হলো, গোস্তের চপ সেখানে বেশ জনপ্রিয়।
রেস্তোরাঁর সেফ আলু সেদ্ধ করে পিষে রান্না করা মাংস ঝুরি করে আলুর সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন। ডিমের সাদা অংশ আলাদা করে সামান্য লবণ দিয়ে নেন। এরপর বড় বাটিতে সব উপকরণ একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। পাউরুটি ছিঁড়ে ছোট টুকরো করে মিশ্রণের নরম ভাব কমালেন। এরপর অল্প অল্প করে চেপে গোল বল তৈরি করে চপের আকার দিলেন।
একটি ফ্রাইংপ্যানে তেল দিয়ে গরম করার পর পেটানো ডিমের সাদা অংশে চপগুলো ডুবিয়ে প্যানে দিয়ে হালকা থেকে মাঝারি আঁচে ভাজতে লাগলেন। একপাশ হয়ে গেলে অন্য পাশ উল্টে একইভাবে লালচে করে ভেজে নিলেন। সবশেষে একটি কিচেন টিস্যুতে মুছে খাবারের জন্য গরম গরম পরিবেশন করলেন।
মজাদার খাবার শেষে ক্যাসেল দেখার পালা। স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে এডিনবরা ক্যাসেল। প্রিন্সেস গার্ডেনের পাশেই রয়েছে এটি। সারিবদ্ধ কামানের দেওয়ালগুলো চোখে পড়ার মতো। প্রধান প্রবেশদ্বারের ভেতরে অনুপ্রবেশে চেষ্টারত শত্রুদের উদ্দেশে তোপ দাগার জন্য ব্যবহৃত হতো। পাথুরে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত দুর্গটি দ্বিতীয় শতকে রোমান সাম্রাজ্যের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য নির্মিত হয়।
দুর্গের একদিকে রয়েছে রয়্যাল প্যালেস, অন্যদিকে স্কটিশ ক্রাউন জুয়েলস। উৎসবের সময় এই দুর্গের সামনে আতশবাজির প্রদর্শনী হয়৷ দুর্গটি বিশ্বখ্যাত স্থাপত্যের জন্য ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া আঠারশ শতকে তৈরি নিউ টাউনও ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
স্কটল্যান্ডে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে এডিনবরা, আবারডিন, স্কটিশ হাইল্যান্ডস, গ্লাসগো, লক নেস, ইভারনেস ইত্যাদি। প্রতিটি এলাকায় ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় অনেক কিছু রয়েছে। এর মধ্য থেকে সম্যক কিছু দেখা হয়েছে। এগুলো পর্যটকদের কাছে বিপুলভাবে পছন্দের জায়গা।
স্থানীয় বাসে এবং হাঁটতে হাঁটতে শহর দেখার মজাই আলাদা। রাজধানী এডিনবরায় ওয়েভারলি ব্রিজের সামনে থেকে বাস যাত্রা। এক টিকিটে নগরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি সারাদিন। বাসগুলো প্রায় প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে নিয়ে গেলো। যেখানে ভালো লেগেছে নেমে পড়লাম। পরের বাসে নতুন গন্তব্যে যাত্রা করেছি। কুড়ি মিনিট অন্তর অন্তর বাস। তৃপ্তি সহকারে দেখে নিলাম সারাটা শহর।
স্কটল্যান্ডের আভিজাত্য হলিরুড প্যালেস ও স্কটিস পার্লামেন্ট। হলিরুড প্যালেস ব্রিটিশ রাজপরিবারের সরকারি বাসভবন। এর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী অপূর্ব দৃষ্টি নন্দন। পার্লামেন্ট ভবনটিও দেখার মতো। ১৯৯৯ সাল থেকে স্কটল্যান্ড স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে আসছে। তাদের নিজস্ব আইনসভা রয়েছে।
এডিনবরা ক্যাসল ও হলিরুড প্রাসাদের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে দেশের কথা মনে পড়ে। পাথরের ইট বাঁধানো রাস্তা। দু’পাশে অসংখ্য দোকানপাট। কাফে আর খাবারের রেস্তোরাঁ। সিলেটের সীমান্তবর্তী অঞ্চল আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদের মতো মনে হয়। লন্ডনের চেয়ে কিছুটা সরু পথ। এই রাস্তাটি ‘রয়্যাল মাইল’ নামে পরিচিত।
ওয়েভারলি রেল স্টেশনের অদূরে প্রিন্সেস স্ট্রিট গার্ডেনস। যেখানে রয়েছে ২০০ ফুট উঁচু মনুমেন্ট। ‘আইভ্যান হো’র লেখক ওয়াল্টার স্কটের স্মৃতিসৌধ। ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মনুমেন্ট দেখে বিস্মিত হলাম। ওয়াল্টার একজন স্কটিশ ঔপন্যাসিক। এই লেখকের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে, তাতে যেকোন লেখক উজ্জীবিত হবেন। সেখানে বিউট হাউসের সামনে সাররট স্কয়ারে প্রতি বছর বই মেলা হয়। হাই স্ট্রিটে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরী হয়। এডিনবরা ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেস্টিভাল খুবই জনপ্রিয়। এই উৎসবে স্কটল্যান্ড যেন নিজের প্রকৃতরূপে আবির্ভূত হয়৷
ওয়েভারলি স্টেশনের পাশেই রয়েছে গ্রাসমার্কেট। প্রতি শনিবার ‘ভেগান’ বাজার বসে৷ এক সময় গবাদি পশু কেনা বেচা হত। তারও আগে এখানে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত৷ বর্তমানে এলাকাটি রেস্তোরাঁ আর ক্যাফের জন্য সুপরিচিত৷
স্কটিশদের রক্তস্নাত ইতিহাস এবং বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের দক্ষতা সম্পর্কে জানার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে স্কটিশ জাদুঘর। এটি এডিনবরা ইউনিভারিসটি সংলগ্ন শহরের প্রাণকেন্দ্র চেম্বার স্ট্রিটে অবস্থিত।
লন্ডন থেকে সড়ক পথে এডিনবরা প্রবেশের পথে ডান পাশে পোর্টোবেলো সৈকত। এই সমুদ্র সৈকতটিকে বলা হয় স্নান করার স্বর্গোদ্যান৷ স্কটিশ উচ্চভূমির একটি লেকের নাম লকনেস। এ লেকে রয়েছে বিশাল দানব রয়েছে বলে মনে করা হয়। এটি নাকি দেখতে অনেকটা ড্রাগন আকৃতির। এমনকি এর পাখাও আছে। স্থানীয় ভাষ্য মতে, এটি প্রথম দেখা গিয়েছিলো ১৯৩৩ সালে। ভুত দেখার মত লোকেরা প্রতিদিন এখানে ভিড় জমায়।
এডিনবরার উত্তর অংশ নিউ টাউনে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন পৃথিবীর অন্যতম পুরনো ও সুন্দর রক গার্ডেন। ভিক্টোরিয়ান গ্লাস হাউজ, রডোডেনড্রন ও আজালিয়া ফুলের সমাহারে বর্ণময়।
সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গাগুলোর একটি স্কটিশ হাইল্যান্ড। পুরো হাইল্যান্ড জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শনগুলো।
শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক হিরো ম্যাকবেথে রচিত রাজা ডানকানকে মারার কুটিল ষড়যন্ত্র হয় ইনভারনেস এলাকায়। এটি হচ্ছে নেস নদীর উৎসমুখ। স্কটিশ হাইল্যান্ডে অবস্থিত। ইভারনেস স্কটল্যান্ডের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। শহরটি স্কটল্যান্ডের কঠিনতম যুদ্ধগুলোর স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে।
১৯৬২ সালে ড. নো চলচ্চিত্রে শন কনারি প্রথমবারের মতো জেমস বন্ডের নাম ভূমিকায় অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে জেমস বন্ড সিরিজে তিনি আরও চারটি, ফ্রম রাশিয়া উইদ লাভ (১৯৬৩), গোল্ডফিঙ্গার (১৯৬৪), থান্ডারবল (১৯৬৫) এবং ইউ অনলি লাইভ টুয়াইস (১৯৬৭) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। একটি অ্যাকাডেমি পুরস্কার, দুটি বাফটা পুরস্কার ও তিনটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন তিনি। কনারি সর্বপ্রথম অভিনেতা যিনি বিখ্যাত ‘জেমস বন্ড’ স্পাই থ্রিলারে ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের চরিত্র জেমস বন্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। মনকাড়া অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি যে শুধু দর্শকদের মন জয় করেছেন তা নয়, ২০০০ সালে ইংল্যান্ডের রাণীর কাছ থেকেও পেয়েছেন নাইট উপাধি।
এডিনবরার করণিক অ্যালান স্পেন্স মনে করেন, এই শহরের এক বিশেষ আভা রয়েছে৷ অ্যালান বলেন, ‘আমার মনে হয়, বাতাসেই সেই অনুভূতি পাওয়া যায়৷ তাতে অত্যন্ত গভীর আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে৷ কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকারসহ সব লেখকই সেই শক্তি অনুভব করতে পারেন৷ বুদ্ধিতে তার ব্যাখ্যা না মিললেও গভীর স্তরে কিছু একটা চলে, যার ফলে কল্পনাশক্তি তীব্র হয়ে ওঠে৷’
সব শেষে গেলাম স্কটল্যান্ডের ফাইভ রিজিয়নের ডানফার্মলিন এলাকায় রবার্ট লিন্ডসের (১৭৫৪-১৮৩৬) ঠিকানায়। ১৭৭৮ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত রবার্ট লিন্ডসে সিলেটের কালেক্টর ছিলেন। তিনি সিলেট থাকাকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় ১৭৮২ সালে। শাহি ঈদগাহ এলাকা সংলগ্ন টিলায় সংঘটিত এই হৃদয় বিদারক ঘটনা ‘মহররম বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন সিলেট নগরির কুমারপাড়া ঝরনার পারের সৈয়দ হাদী এবং সৈয়দ মাহদী ভ্রাতৃদ্বয়। হাদা মিয়া-মাদা মিয়া নামে তারা সমধিক খ্যাত।
রবার্ট লিন্ডসে (ORIENTAL MISCELLANIES: COMPRISING ANECDOTES OF AN INDIAN LIFE BY ROBERT LINDSAY) নিজের আত্মজীবনী লিখে গেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, আগে থেকেই পীরজাদা ভ্রাতৃদ্বয়ের বৃটিশ বিরোধী মনোভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। গুপ্তচরের মাধ্যমে বিদ্রোহের খবর জেনে ১০ মহররম বিকেলে ঘোড়ায় চড়ে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সেখানে যান।
রবার্ট লিন্ডসে প্রতিবাদী জনতাকে নিবৃত না হলে প্রতিরোধের হুমকি দেন। সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তা প্রত্যাখ্যন করেন। এরপর শুরু হয় সংঘাত। সৈয়দ হাদীর আঘাতে রবার্ট লিন্ডসের তরবারি খণ্ড বিখন্ড হয়ে যায় এবং তিনি ধরাশায়ী হন। এ সময় পেছন থেকে একজন ইংরেজ সৈনিক লিন্ডসের হাতে পিস্তল এগিয়ে দিলে তিনি সৈয়দ হাদী ও সৈয়দ মাহদীকে গুলি করে হত্যা করেন।
মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। মোগল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে ১৬৩৪ সালে বাংলায় ব্যবসা করার অনুমতি লাভ করে। এরপর তাদের ষড়যন্ত্রে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যার দেওয়ানি সনদ তথা রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। আর ওই সময়ই সিলেট বৃটিশ শাসনের অধীনে চলে আসে। ১৭৭২ সালে উইলিয়াম মাইকপিস থ্যাকারে সিলেটের প্রথম ইংরেজ ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তারপর ১৭৭৮ সালে রবার্ট লিন্ডসে সিলেটের ডেপুটি কালেক্টর হন।
সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লিন্ডসে সিলেট অঞ্চলে নিজের ব্যক্তিগত কারবারও পরিচালনা করতেন। তখন সরকারি কর্মকর্তাগণের জন্য নিজেদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নিয়োজিত হতে আইনগত বাধা ছিল না। রবার্ট লিন্ডসে বহু রকম বাণিজ্য করেছেন। চুনাপাথরের ব্যবসায় সাফল্যের কথা নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন। এছাড়া হাতি, বেত ও সুপারির কারবারেও জড়িত ছিলেন। শাসক হয়ে ব্যবসায় জড়িত থাকায় বিভিন্ন পেশার মানুষকে শোষন করেছেন এবং তাদের প্রতি তিনি অত্যাচারী হয়ে ওঠেন।
রবার্ট লিন্ডসের ডানফার্মলিন থেকে ফিরে এলাম এডিনবার্গ দূর্গে। এখান থেকে এডিনবরা বিমানবন্দর সাড়ে ৭ মাইল দূরে অবস্থিত। লন্ডনের উদ্দেশ্যে প্রায় ২০ মিনিটে বিমানবন্দরে পৌছি। পথিমধ্যে সুমধুর পাখির ডাক কানে বাজে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি এক অসাধারণ সুন্দর ইগল পাখি। হোয়াইট–টেলড ইগল। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসে যেটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। গোল্ডেন ইগল ট্রাস্টের সহায়তায় স্কটল্যান্ড থেকে এই প্রজাতির পাখি সংগ্রহ করে বৃটেনে অবমুক্ত করা হয়। সী ইগল নামে পরিচিত এই পাখির সংখ্যা বাড়াতে ৫বছরের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কাজটি করছে রয় ডেনিস ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশন ও ফরেস্ট্রি ইংল্যান্ড। হোয়াইট–টেলড নামীয় সী ইগলকে আকাশে উড়তে দেখতে পাওয়াটা ভীষণ আনন্দের।
ইতোমধ্যে সূর্য একেবারে পশ্চিম দিগন্তে। এডিনবরা বিমানবন্দরে স্কটল্যান্ডের স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে নানান গল্পেই সন্ধে হয়ে গেলো। ফ্লাইট ছাড়ার আগে তাড়াতাড়ি রাতের খাবারের পাট চুকিয়ে নিলাম। বিদায়ের পথে আকাশ থেকে স্কটল্যান্ড দেখার রোমাঞ্চই আলাদা। স্থাপত্য শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন স্কটল্যান্ডে বেড়ানো এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা।
আরও পড়তে পারেন:
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-৮॥ উদয় হাকিম