২০১০ সালের কথা। প্রথমা রঙ্গমঞ্চ হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে। দলটি বেশকিছু মঞ্চ নাটক উপহার দিয়েছে দর্শকদের। বাহবাও পেয়েছে। সেই সূত্রে বৈশাখী মেলামঞ্চে নাটক চাইলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। মাদারীপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্যপ্রশিক্ষক আ জ ম কামালের (কামাল খালু) মাধ্যমে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ‘বাসন’ নাটকের পাণ্ডুলিপি পেয়ে গেলাম। কিন্তু সেলিম আল দীনের নাটক মানেই তো ভাবনার বিষয়।
মফস্বল শহরের একটি দল প্রথমা রঙ্গমঞ্চ। নেই ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। মহড়াও করা যায় না নিয়মিত। স্থান ও শিল্পীসংকট। সবচেয়ে বড় সংকট অর্থ। হাতেও সময় খুব কম। এভাবেই নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে কাজ করতে হয়। শত বিপত্তি সত্ত্বেও সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন কামাল খালু। যদিও এবার উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে মহড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
মহড়ায় যাওয়ার আগে জানলাম, ‘বাসন’ নাটক মূলত ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর স্মৃতিধন্য একটি ‘বাসন’কে কেন্দ্র করে। কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর তথা শ্যামাইল গ্রাম। নাট্যপ্রশিক্ষক আ জ ম কামাল বললেন, নাটকের সংলাপ আঞ্চলিক। শিবচরের ভাষা। যেমন—‘ওরে আমার নাইয়ের নতারে নোইদ নাগরে ন্যাতায়ে যায়।’ যার প্রমিত উচ্চারণ—ওরে আমার লাউয়ের লতারে রোদ লাগলে নেতিয়ে পড়ে।
মহড়ায় সংলাপ আয়ত্ত করতে আমাদের বেশি বেগ পেতে হয়নি। নাট্যকর্মীরা আন্তরিকতার সঙ্গেই মহড়া সম্পন্ন করে। মহড়া চলার সময় সেলিম আল দীন সম্পর্কে মজার মজার অনেক তথ্য দিতেন নাট্যপ্রশিক্ষক। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। সেলিম আল দীন সম্পর্কে ওই প্রথম আমার ধারণালাভ।
নাটকের প্রতিবাদী চরিত্র ‘জমির’। যে চরিত্রে অভিনয় করেছি আমি। বাসনে যারা অভিনয় করেছেন, তাদের মধ্যে আমি ছাড়া যারা ছিলেন, তারা হলেন বি এ কে মামুন, রকিবুল ইসলাম, মিঠুন আচার্য, নুসরাত জাহান মৌ, নুরুদ্দিন আহমেদ, সোহরাব হোসেন। তবে আমরা কেউ আর মঞ্চে নেই।
নেই আমাদের সেলিম আল দীন। রয়ে গেছে তাঁর কর্ম। নাট্যকর্মী ও দর্শকের মুখে মুখে রয়ে গেছে বাসন। বাসন নাটকের পাণ্ডুলিপি তৈরির আগে তিনি গিয়েছিলেন শিবচরে। সেখানকার মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, কথা বলেছেন। হাজী শরীয়ত উল্লাহর সমকালীন রীতি-নীতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছেন। এরপর খুব সতর্কতার সঙ্গে আঞ্চলিকতাকে অক্ষুণ্ন রেখে সংলাপ নির্মাণ করেছেন।
নাটকটি মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে তিনি ব্যতিক্রম আয়োজনও করেছিলেন। প্রথম প্রদর্শনীতে শুধু হ্যারিকেনের আলোতে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। জানালেন আ জ ম কামাল। গ্রাম থিয়েটারের কথা চিন্তা করেই তিনি এমন আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন। যেন যেকোনো স্থানে যেকোনো পরিবেশে নাটকটি মঞ্চস্থ করা যায়।
যদিও আমরা সোডিয়াম লাইটের আলোতে বাসন মঞ্চে এনেছিলাম। কোনো সেট ডিজাইন করা হয়নি। রূপসজ্জায় সহযোগিতা করেছেন কামাল খালু। সেবার বৈশাখী মেলামঞ্চে সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল বাসনের মঞ্চায়ন। তবে এরপর আর সেলিম আল দীনের কোনো নাটকে হাত দিতে পারিনি। আর হয়তো পারবও না। কারণ এখন তো আমি আর মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত নই। জানি না, প্রথমা রঙ্গমঞ্চের ব্যানারে আর কখনো নাটক মঞ্চস্থ হবে কি না?
আমার হাতে ‘বাসন’ই সেলিম আল দীনের প্রথম এবং শেষ নাটক। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের মৃত্যুতে মাদারীপুর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত শোকসভা শেষে বাসনের অংশ বিশেষ দেখেছিলাম। সেদিনই ‘বাসন’ নিয়ে কাজ করার একটা পরিকল্পনা করেছিলাম মনে মনে। মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে সেদিন মাহমুদা খান লিটার ‘কৈতরী’ ও চিন্ময় সরকারের ‘বাবা’ চরিত্রের অভিনয় আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। মুগ্ধও হয়েছিলাম। সেই চিন্তা-ভাবনার দু’বছর পর বাসন মঞ্চে আনতে পেরেছিলাম। সুযোগটি করে দিয়েছিলো কালকিনি উপজেলা প্রশাসন।
তখন কালকিনির মানুষ জানতে পেরেছিল একটি বাসনের ইতিহাস। হাজী শরীয়ত উল্লাহর ব্যবহৃত একটি বাসন তাঁর মৃত্যুর পরে স্থানীয় এক কৃষক পরিবার যত্ন সহকারে আগলে রাখে। কিন্তু স্থানীয় এক জমিদার বিষয়টি জেনে যান। ফলে তিনি তা হস্তগত করার জন্য কৃষককে প্রলোভন দেখায়। বাসনটি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বাসনটি নিতে পারলে তার সম্মান বৃদ্ধি পাবে। প্রয়োজনে বেশি দামে বিক্রি করারও প্রলোভন দিতে থাকেন।
কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কৃষক কন্যা কৈতরী। কৈতরী বাসনটিকে শরীয়ত উল্লাহর স্মৃতি হিসেবে আগলে রাখতে চায়। তবে কৈতরীর বাবা জোরপূর্বক বাসনটি নিয়ে জমিদারের কাছে বিক্রি করে দেয়। বাসন হারানোর রাগে-ক্ষোভে কৈতরী আত্মহত্যা করে।
কৈতরীর আত্মহত্যা মেনে নিতে পারে না ভাই জমির। তাই সে আত্মহত্যার বদলা নিতে চায়। সে গ্রামবাসীকে নিয়ে জমিদারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। কৈতরীর মৃতদেহ সামনে নিয়ে জমির প্রতিজ্ঞা করে,‘আগে প্রতিশোধ, তারপরে দাফন।’ জমির চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে সংলাপটি আমাকেই বলতে হয়ে ছিল। কিন্তু আমি তা বলতে গিয়ে সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলাম। এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম যে, রাগে-ক্ষোভে আমার সর্বশরীর কাঁপছিল।
সেই স্মৃতি এখনো আমাকে আবেগাপ্লুত করে দেয়। একটি বাসনের এত শক্তি দেখে আমি সত্যিই বিহ্বল। সেই স্মৃতি কখনোই বিস্মৃত হওয়ার নয়। ধন্য নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। ধন্য তাঁর ‘বাসন’। আমিও ভাগ্যবান এজন্য যে, নাটকের শেষ দৃশ্যে ‘বাসন’টি হাতে নিয়ে দর্শকের উদ্দেশে বলেছিলাম, ‘এ বাসন আমাদের।’