মানুষের জীবনে উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া, আরও কত কিছুই না হয়ে থাকে। তবে কারও কারও জীবনে এসবের কোনো ছোঁয়া লাগে না। জীবন যেন একইভাবে প্রবহমান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের জীবন বয়ে চলে স্রোতের মতো। তেমনই একজন ছিলেন কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী।
বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অল্পদিনের। অথচ তার মৃত্যু আমাকে ছুঁয়ে গেছে। সাধারণত কারও মৃত্যুতে আমার ভেতরে তেমন প্রভাব ফেলে না। মানুষ মরণশীল বলেই আমার মনে তেমন রেখাপাত করে না। কিন্তু বুলবুল ভাইয়ের মৃত্যুতে কেন যেন আমার মধ্যে শূন্যতা বিরাজ করছে। অথচ তার সঙ্গে আমার দেখা বা কথা হয়নি এক যুগেরও বেশি। যখন তার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলাম, তখন বুকের ভেতর কিছু একটা অনুভব করলাম। তাকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। কেউ রাগ করলেও তাকে শান্ত করেছে তার সব কথা মেনে নিয়ে। কখনো বলেননি আমার কথায় সঠিক। বলতেন, আরে মিয়া বাদ দেন তো।
বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করতাম। এ জন্য কাজের ফাঁকে অনেক কথা হতো আমাদের। এসব কথার মধ্যে কখনো পারিবারিক কথা থাকতো না। সবই তাৎক্ষণিক আলোচনা। চায়ের আড্ডায় বসলে কখনোই আমাকে বিল দিতে দিতেন না। বলতেন, বিল দিয়েন না। বাধা দিলে বলতেন, ‘ধুরো মিয়া’, আপনি দিয়েন না। তার বলা ‘ধুরো মিয়া’ দুটি শব্দ আমার সারাজীবন মনে থাকবে। হয়তো তার মতো করে ‘ধুরো মিয়া’ শব্দ দুটি আর কেউ বলবেন না। তিনি কখনো অহঙ্কার করেননি। এত বড় লেখক হয়েও থাকতেন সাধাসিধে। সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরে কাটিয়ে দিয়েছেন সারাজীবন। শীতকালে গায়ে জড়ানো থাকতো সাধারণ একটি শাল।
আমাকে বুলবুল ভাই একসময় খুবই কাছের মানুষ ভাবতেন। এর কারণও ছিল। একদিন কাজ করতে করতে হঠাৎ বললেন, ভাই, আমাকে একটু ধরেন, খুব খারাপ লাগছে। এ কথা বলেই তিনি আমার গায়ের ওপর পড়ে গেলেন। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার মুখ দিয়ে শুধু লালা ঝরছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার রুমাল দিয়ে ওই লালা মুছতে মুছতে তাকে অফিসের পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার দেখেই একটি ইনজেকশন দেওয়ার পর তার জ্ঞান ফিরে আসে।
তার জীবনে কখনো পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। শত অভাব-অনটনেও তিনি সাবলীল থাকতেন। বুলবুল চৌধুরীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
আমার রুমাল এতটাই ভিজেছে যে, তা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যায়। চার-পাঁচ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকার পর একটু সুস্থ হলে তাকে বাসায় পৌঁছে দেই। অসুস্থ অবস্থাতেই বারবার আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন আর বলছেন, ভাই, আপনি না থাকলে আমার যে কী হতো! সুস্থ হয়ে অফিসে জয়েন করার আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতে লাগলেন। তখন থেকে তার অনেক ব্যক্তিগত কথা জানতে পারি। মানুষের জীবনে এমন কিছু কথা থাকে, যা আসলে কখনোই প্রকাশ করা যায় না। তাই তার গোপন কিছু কথা আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে চিরকাল।
বুলবুল চৌধুরী কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। কিন্তু যখন মনোনয়ন পেয়েও একুশে পদক পেলেন না কোনো এক সম্পাদকের বিরোধিতায়, তখন বেশ মন খারাপ হতে দেখেছি। এ সময় জানতে চেয়েছি কেন ওই সম্পাদক কেন তার পদকের বিরোধিতা করলেন? জবাবে তিনি তখন বলেছিলেন, তার আন্ডারে এখানে আমি চাকরি করি। আমি একুশে পদক পেলে তার সম্মানহানি ভেবে তিনি বাধা দিয়েছেন। যাক, আমি আর এখানে চাকরিই করব না। এরপর সত্যি সত্যি তিনি এক সময় চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর থেকে তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
ওই সম্পাদকের প্রতি প্রথম থেকেই বুলবুল ভাইয়ের ক্ষোভ ছিল। কারণ তিনি চেয়েছিলেন সাহিত্য সম্পাদকের পদ। কিন্তু সম্পাদক তাকে সম্পাদনা সহকারী পদে চাকরি দেন। তার ওই সময় চাকরিটা দরকার ছিল। তাই মনে কষ্ট নিয়েই চাকরিটি করেন তিনি। তবু লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তার আশা ঠিকই পূরণ হয়েছে। তিনি একুশে পদক পেয়েছেন। তবু তার চলন-বলন, কথা-বার্তা আগের মতো ছিল। তিনি একটুও বদলাননি। মানুষ জীবনের প্রয়োজনে অনেক কিছুই করে। কেউ কেউ নীতিভ্রষ্টও হন। অনেকে নিজেকে বিকিয়ে দেন।
বুলবুল ক্ষেত্রে এসব কিছুই ঘটেনি। তার জীবনে কখনো পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। শত অভাব-অনটনেও তিনি সাবলীল থাকতেন। বুলবুল চৌধুরীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। বুলবুল ভাই, আপনি পরকালে ভালো থাকুন এবং ইহকালে যেমন ছিলেন, তেমনই থাকবেন। তার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা রইল।
আরও পড়ুন: মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতা: প্রজ্ঞার শিল্পরূপ ॥ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ