ফ্রিদা কাহলো—ইতিহাসের এমন একজন চিত্রশিল্পী, যিনি নিজেই নিজেকে নিয়ে আঁকতেন। তার শৈলী সবসময় ছিল মূর্তিবাদী। একইসঙ্গে স্বশিক্ষিত, কল্পনাপ্রসূত উপাদান এবং তার নিজস্ব ব্যক্তিগত, জীবনীগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দিয়ে করা। ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকর্মগুলো মেক্সিকান শিল্পকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্থান দিয়েছে। তাই হয়তো নিজের প্রতিকৃতি নিয়ে আঁকা সম্পর্কে ফ্রিদা বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে আঁকতে পারি। কারণ আমি প্রায়শই একা থাকি। আমি এমন একজন, যার সম্পর্কে আমিই সবচেয়ে ভালো জানি।’
দ্য টু ফ্রিদাস (The Two Fridas) চিত্রকর্মটি ফ্রিদা ১৯৩৯ সালে এঁকেছিলেন। ‘দ্য টু ফ্রিদাস’—ফ্রিদার প্রতিকৃতির সবচেয়ে স্বীকৃত সৃষ্টিকর্মগুলোর মধ্যে একটি, যা তিনি দিয়েগো রিভেরা সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর এঁকেছিলেন। ডায়রিতে তিনি এই পেইন্টিং সম্পর্কে লিখেছেন, এটি তার শৈশবের একটি কাল্পনিক বন্ধুর স্মৃতি থেকে নেওয়া হয়েছে। এরপরে তিনি জানিয়েছিলেন, এটি তার দিয়েগোর সঙ্গে বিচ্ছেদর পর হতাশা ও একাকিত্বকে প্রকাশ করেছে।
এই প্রতিকৃতিটি ফ্রিদার দুটি ভিন্ন সত্তাকে দেখায়। এটি একটি ডাবল সেলফ-পোর্ট্রেট, যেখানে দুই জন ফ্রিদা একসঙ্গে হাত ধরে বসে আছে। একজন সাদা ইউরোপিয়ান-শৈলীর ভিক্টোরিয়ান পোশাক পরেছেন; অন্যজন ঐতিহ্যবাহী মেক্সিকান তেহুয়ানা পোশাক পরেছেন। উভয় ফ্রিদার কোলে একটি জিনিস রাখা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ফ্রিদা দিয়েগো রিভারার একটি ছোট প্রতিকৃতি ধরে আছেন। ইউরোপিয়ান ফ্রিদা কাঁচি ধরে আছেন। উভয় ফ্রিদার হৃদয় উন্মুক্ত। প্রধান ধমনী-ঐতিহ্যবাহী ফ্রিদার ছিঁড়ে যাওয়া উন্মুক্ত হৃদয় থেকে বের হয়ে হাতের চারপাশ আবৃত্ত করে স্বামীর শৈশবের ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইউরোপিয়ান ফ্রিদার হৃদয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। ইউরোপিয়ান ফ্রিদা কাঁচি দিয়ে সেই ধমনী কেটে ফেলেছেন। রক্তনালী থেকে তার সাদা পোশাক রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
দ্য টু ফ্রিদাস, আমার ভাবনাগুলোকে একত্রিত করাতে বেশ সময় নিয়েছে। চিত্রকল্পে ব্যবহার করা তার কৌশল ও প্রতিটি উপাদান কথা বলে। মজার ব্যাপার হলো, তারা একাধিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কথা বলে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এই চিত্রকর্মটি শিল্পীর বিবাহবিচ্ছেদের পর মানসিক ব্যথার প্রতীককে চিহ্নিত করে। তবে পাঠক এখানে ব্যথার সঙ্গে শিল্পীর জেদ, ও শক্তিকেও দেখতে পাবে, যা তার অস্তিত্বকে ধারণ করে।
দ্য টু ফ্রিদাস-চিত্রকল্পটিতে ফ্রিদার দ্বৈতসত্তা, পোশাক ও রক্তের সঙ্গে তার অস্বাভাবিক এবং নজরকাড়া আত্ম-প্রতিকৃতি চিত্রটি মূলত ফ্রিদার অভ্যন্তরীণ লড়াইকে বোঝায়। একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি কী বা কে, তা বোঝার জন্য সমস্ত উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে।
ফ্রিদা তার শিল্পে খুব স্পষ্টভাবে নিজের দ্বৈতসত্তাকে উপস্থাপন করেছেন। এক সত্তায় ফ্রিদা দুর্বল, অতীতে বাস করছেন (ঐতিহ্যবাহী ফ্রিদা) এবং আরেক সত্তায় ফ্রিদা আধুনিক এবং শক্তিশালী (ইউরোপিয়ান ফ্রিদা)। উভয় ফ্রিদার হৃদয় দুটো উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী মেক্সিকান ফ্রিদার হৃদয়টি অক্ষত দেখাচ্ছে, যেখানে ইউরোপীয় ফ্রিদার হৃদয়টি কাটা। এখানে দুটি পৃথক ব্যক্তিসত্তা দিয়েগোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর ফ্রিদার ভেতরের ব্যথাকে উপস্থাপন করছে এবং একই সঙ্গে নিজেকে ভিন্নরূপে দাড় করাতে ফ্রিদার ক্রমাগত লড়াইকেও উপস্থাপন করছে।
তেহুয়ানা পোশাকে ঐতিহ্যবাহী ফ্রিদা হলো সেই একজন, যাকে তার স্বামী দিয়েগো রিভেরা ভালোবাসতেন। তাই তার হৃদয়টি সুস্থও অক্ষত দেখায়। হাতে ছোট দিয়েগোর একটি প্রতিকৃতিটি রয়েছে, অর্থাৎ ফ্রিদা তখনো দিয়েগোর পছন্দগুলোকর সঙ্গে তার অস্তিত্ব ও অতীতকে ধরে আছেন। এটি একদিকে দিয়েগোর প্রতি ফ্রিদার প্রেম, আনুগত্য প্রকাশ করে, আবার অন্যদিকে এটি তার দুর্বলতাকেও প্রকাশ করে, যেখানে তিনি বিচ্ছেদের পর ও দিয়েগোকে ভুলতে পারছেন না।
খানে দ্য টু ফ্রিডাস-চিত্রকর্মে ইউরোপিয়ান ফ্রিদার পোশাকটি তার পছন্দ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিককে নির্দেশ করে। অর্থাৎ তিনি এখন তার জীবনের দায়িত্বে আছেন। এটি নারীবাদী প্রতিবাদকেও দেখায়।
ইউরোপিয়ান ফ্রিদা হলেন সেই একজন, যিনি মেক্সিকান ঐতিহ্যের বাইরে আধুনিক ফ্রিদা এবং যাকে দিয়েগো প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্য টু ফ্রিদাস-দেখায় যে, ঐতিহ্যবাহী ফ্রিদার হৃদয় থেকে বেড়িয়ে আসা ধমনীটি ইউরোপিয়ান ফ্রিদা নিজ হাতে কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলেছেন। রক্তনালী থেকে লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার সাদা স্কার্টে। অনেক শিল্প ইতিহাসবিদ এই রক্তকে ফ্রিদার দুর্বলতার প্রতীক এবং আজীবন রক্তক্ষরণের আশঙ্কা হিসাবে দেখেন। মূলত, যেকোনো সম্পর্ক বা বিবাহ ভেঙে গেলে আমাদের সবারই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। জন্ম দেওয়ার সময়ও আমাদের রক্তপাত হয়। প্রতি মাসে আমাদের রক্তপাত হয়। আবার সময়ের সঙ্গে সেই রক্তপাত বন্ধও হয়। আমরা স্বাভাবিকভাবে আবারও চলতে শুরু করি। কাজেই ফ্রিদার এই রক্তপাত দুর্বলতার প্রতীক নয়, এটি একটি নতুন শুরুর প্রতিনিধিত্ব করে।
এখানে ফ্রিদা দেখাচ্ছেন যে, যদিও বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে (হওয়াটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া), কিন্তু তিনি এখনো নিজেকে শক্তভাবে ধরে আছেন। আর তাই ঐতিহ্যবাহী ফ্রিদার হৃদয় থেকে বেড়িয়ে আসা একক ধমনী যা ছোট দিয়েগোর উপস্থিতিসহ ইউরোপিয়ান ফ্রিদার হৃদয়কে সংযুক্ত করেছে, সেই ধমনীটি ইউরোপিয়ান ফ্রিদা নিজ হাতে কাঁচি দিয়েকেটে ফেলেছেন এবং রক্ত ঝরাচ্ছেন। এই রক্ত ঝরানো মূলত তার পূর্ব ফ্রিদার আবেগ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা দিয়েগোকে একেবারে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টাকে বোঝায়। ফ্রিদার হৃদয় তার রক্তের উৎস চিহ্নিত করে। কিন্তু দিয়েগোর ছবি তার ব্যথার উৎসকে দেখায়।
পোশাকের ভিন্নতায় এই চিত্রকল্পটি ফ্রিদার অতীতের ভিন্ন কিছুকেও প্রতিনিধিত্ব করে। একজন স্বামী হিসাবে, দিয়েগো রিভেরাফ্রিদাকে নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পছন্দ করতেন। তিনি আশা করতেন যে, ফ্রিদা একজন আদর্শ ঐতিহ্যবাহী মেক্সিকান স্ত্রীর ভূমিকা পালন করবেন। বিয়ের আগে ফ্রিদা ইউরোপিয়ান স্টাইলের পোশাক পরতেন। কিন্তু বিয়ের পর ফ্রিদার ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি ছিল মূলত দিয়েগোর পছন্দ। দিয়েগোর পরামর্শ অনুসারে ফ্রিদা তার জন্মস্থান টেওয়ানটেপেকের ইস্তমাসকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং মেক্সিকান গর্বকে ধরে রাখতে তেহুয়ানা পোশাক পরতে শুরু করেছিলেন। দ্য টু ফ্রিদাস-চিত্রকর্মটি সেই ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার প্রতিবাদ করে। এখানে দ্য টু ফ্রিডাস-চিত্রকর্মে ইউরোপিয়ান ফ্রিদার পোশাকটি তার পছন্দ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিককে নির্দেশ করে। অর্থাৎ তিনি এখন তার জীবনের দায়িত্বে আছেন। এটি নারীবাদী প্রতিবাদকেও দেখায়।
উন্মুক্ত হৃদয়গুলো ফ্রিদার চিত্রকল্পে কেবল প্রেম, রক্তক্ষরণ, ব্যথা, ধারণ, সহন ক্ষমতাকে বোঝায় না, এগুলো অ্যাজটেকদের প্রতীককেও উপস্থাপন করে। ফ্রিদা তার আদিবাসীদের সম্মান করেতেন। অ্যাজটেকদের জন্য সাংস্কৃতিক একটি প্রাথমিক প্রতীকহল হৃদয়, যা তাদের দেবতাদের খাওয়ায়। অ্যাজটেক মিথ দাবি করে যে, তাদের রাজধানী শহর টেনোচটিটলান-কপিলের হৃদয়ে অবস্থিত। কপিল-ই শহরের প্রকৃত এভিল এবং চূড়ান্ত শত্রুতা প্রতিনিধিত্ব করেন। কপিলকে ঈশ্বরের-বাহক হুইট জিলো পোচটলি’র বোন মালিন্যালসোচিলের ছেলে বলা হয়। ফ্রিদার চিত্রকল্পের হৃদয় অ্যাজটেক নিষ্কাশনের প্রথম উদাহরণ দেখায়। সুতরাং, প্রতীক হিসাবে অ্যাজটেকের হৃদয়ে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য এবং সন্ত্রাস দুটোই রয়েছে।
হৃদয় সব সময়-ই ভালোবাসার প্রতীক। হৃদয় মানব দেহের মূল রক্তের কেন্দ্রবিন্দুও। সুতরাং, ফ্রিদা কাহলো দ্বৈত উদ্দেশ্য নিয়ে তার ‘দ্য টু ফ্রিডাস’-এ হৃদয় ও রক্ত দুটোই ব্যবহার করেছেন। ফ্রিদার হৃদয় তার মেক্সিকান ঐতিহ্যের প্রতি একটি উচ্চারণও বটে। এই হৃদয়গুলো তার সাদা স্কার্টে তার বিধ্বস্ত প্রেমের গল্পকে রক্তাক্ত করেছে।
অ্যাজটেক সভ্যতা—উত্তর-ধ্রুপদি যুগপর্যায়ের ১৩০০ থেকে ১৫২১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে অধুনা মধ্য-মেক্সিকো ভূখণ্ডে বিকাশ লাভ করা একটি মেসো আমেরিকান সভ্যতা। অ্যাজটেক জাতি বলতে মধ্য মেক্সিকোর বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে বোঝায়, বিশেষ করে নাওয়াৎজ ভাষী ও খ্রিষ্টীয় ১৪ শতক থেকে ১৬ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে মেসো আমেরিকার বৃহৎ অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীগুলিকে বোঝানো হয়।
দ্য টু ফ্রিডাস, চিত্রকর্মের কেন্দ্রবিন্দু হলো ভারসাম্য, অনুপাত, জোর ও বৈসাদৃশ্য। লক্ষ করলে দেখা যাবে, দুই ফ্রিদার পেছনে একটি উত্তেজিত মেঘে ভরা ঝড়ো আকাশ, যা ফ্রিদার ভেতরের অশান্তিকে প্রতিফলিত করে। আবার একই সময়ে উভয় ফ্রিদার হাত একে অন্যকে ধরে রাখা হয়েছে, যা একতার প্রতীক। এটি দেখায়, যদিও দুটি চিত্রের পার্থক্য রয়েছে, তবে তারা উভয়ই একটি ফ্রিদা এবং একসঙ্গে তারা আত্ম-প্রতিকৃতি তৈরি করে। চিত্রকর্মটিতে হাত থেকে হৃৎপিণ্ডের মধ্য দিয়ে আসা একক ধমনী; দুই ফ্রিদাকেই সংযুক্ত করছে, যা ফ্রিদাকে দর্শকদের সামনে একটি স্পষ্ট ও শক্তিশালী দৃষ্টিতে উপস্থাপন করে।
ফ্রিদা কাহলো যখন প্রথম ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ বিক্রি করেছিলেন, তখন এই চিত্রকর্মের জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য পেয়েছিলেন তিনি। মেক্সিকো সিটির ‘ইনস্টিটিউটো ন্যাসিওনাল ডি বেলাস আর্টেস’ ১৯৩৯ সালে এটি প্রায় ১০০০ ডলারে কিনেছিল, যা আজ প্রায় ২০,০০০ ডলারের রূপান্তরিত হয়েছে। এখনো পেইন্টিংটি মেক্সিকো সিটির ‘মিউজেও দে আর্ট মোডার্নো’তে আছে।
রঙ তুলির আঁচড়ে স্বপ্নকে না এঁকে বাস্তবতাকে আঁকা ফ্রিদা কাহলো শুধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মেক্সিকান চিত্রশিল্পীদের একজনই নন—তিনি একজন অবিসংবাদিত নারীবাদী আইকন হিসেবেও বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। রঙ তুলির আঁচড়ে ফ্রিদা জীবন ও বাস্তবতার চিত্র আঁকতেন, চিত্রকর্মে তিনি পরিচয় বহন করা প্রতিকৃতি, মানবদেহ ও মৃত্যুর মতো থিম নিয়ে কাজ করে গেছেন।
দ্য টু ফ্রিদাস; দেখার মতো লোভনীয় কিছু নয়, বরং পীড়াদায়ক বা ভয়ঙ্কর কিছুও বলা যায়। তবে আসলে ব্যাপার হলো–এটি একটি ব্যবচ্ছেদ বা ডায়াগ্রামের মতো, যাতে কাহলোর সতেজ প্রত্যক্ষতা ছিল তার সবচেয়ে বড় গুণ। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, তার ভেতরের বাইরের আসল আত্মা, সত্তা, পোশাক, অক্ষত-ক্ষত ভাঙাহৃদয়, রক্তপাত ও ধমনী; সবকিছুই স্পষ্টতার সঙ্গে কথা বলে। আর এই স্পষ্ট সত্যের প্রকাশই তাকে তার নৈপুণ্যে একজন দক্ষ শিল্পী করে তুলেছে।
একাধিক শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে লড়াই করে বিশ্ববাসীর কাছে শিল্পকলা জগতের লুব্ধক শিল্পী হিসেবে পরিচিত ফ্রিদা কাহলো, তার পুরো নাম ম্যাগদালিনা কারম্যান ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরন।
ফ্রিদা কাহলোর অক্ষমতার লড়াইয়ের শুরু সেই শৈশব থেকেই। ফ্রিদা পোলিওতে আক্রান্ত হন ছয় বছর বয়সে। যে কারণে তার দুটো পা সরু ও ছোট হয়ে যায়। এরপরই ঘটে তার জীবনের বড় দুর্ঘটনাটি। ১৮ বছর বয়সে যখন তিনি একটি ভয়াবহ ট্র্যাফিক দুর্ঘটনার শিকার হন, তখন একটি লোহার শিক তার নিতম্বে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় ফ্রিদার মেরুদণ্ডের কলাম, কলারবোন, পাঁজর, পেলভিস, ডান পায়ের ১১টি জায়গা ভেঙে যায়। তার কাঁধটি স্থানচ্যুত হয়।
সেই দুর্ঘটনায় ফ্রিদা মরে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত বেঁচে উঠেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাস ফ্রিদাকে হাসপাতালের বিছানায় থাকতে হয়েছিল। হাসপাতালের বিছানায় দীর্ঘদিন একা সময় কাটানো ফ্রিদা একসময় চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নকে ছুড়ে ফেলে, বাস্তবের রূপকে প্রতিকৃতি হিসেবে সাজাতে ব্যস্ত হন রঙতুলির আঁচড়ে।
ফ্রিদার দীর্ঘ বেঁচে ওঠার পেছনের কারণ ছিল, তার ছবি আঁকা। বাবা-মা তাকে বানিয়ে দেন কাঠের ইজেল, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছবি আঁকার মতো সব ব্যবস্থা করে দেন। বেশিরভাগ সময় তিনি ঘরের আয়নায় নিজেকে দেখে প্রতিকৃতি আঁকতেন। সেই থেকে শুরু তার শিল্পী জীবনের পথ চলা। ফ্রিদার মেরুদণ্ডের চিকিৎসায় তার জীবনে ৩৫টি অপারেশন করাতে হয়েছিল।
একাধিক অক্ষমতা নিয়ে লড়াই করা ফ্রিদা জীবনের কাছে হার মানেননি। বরং খুঁজে নিয়েছিলেন বেঁচে থাকার ভিন্ন এক পথ! আর সেটা ছিল রঙতুলির আঁচড়ে জীবন ও বাস্তবতার চিত্র আঁকা।
রঙ তুলির আঁচড়ে স্বপ্নকে না এঁকে বাস্তবতাকে আঁকা ফ্রিদা কাহলো শুধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মেক্সিকান চিত্রশিল্পীদের একজনই নন—তিনি একজন অবিসংবাদিত নারীবাদী আইকন হিসেবেও বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। রঙ তুলির আঁচড়ে ফ্রিদা জীবন ও বাস্তবতার চিত্র আঁকতেন, চিত্রকর্মে তিনি পরিচয় বহন করা প্রতিকৃতি, মানবদেহ ও মৃত্যুর মতো থিম নিয়ে কাজ করে গেছেন।
ফ্রিদা কাহলো ১৯০৭ সালে জুলাইয়ের ৬ তারিখে মেক্সিকো সিটির উপকণ্ঠে একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই চিকিৎসাকালীন আনুমানিক ছয়টায় তাকে নার্স বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পান।