প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রে মিলনেই উপন্যাসের সার্থকতা, না কি বিরহে? এমন প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’কে আলোচনায় নিয়ে আসলে হয়ত স্বাভাবিকতা বজায় থাকে। কিন্তু এই উপন্যাসে যে মনস্তাত্ত্বিক কূটনীতি শুরু থেকে মধ্য পর্ব পর্যন্ত। তা অনেকেরই নজর এড়িয়ে যেতে পারে।
উপন্যাসের নায়ক দেবদাসের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত-আচরণ কাহিনিকে বিয়োগাত্মক পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে গেছে। গতানুগতিক জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে নায়িকা পার্বতী ওরফে পারু ছিটকে বেরিয়ে গেছে অনেক দূরে। লৌকিকতার আড়ালে যে অলৌকিক শক্তির অহঙ্কার বা অহমবোধ থাকে, তা শরতের কাহিনিকে আরও আবেগময় করে তোলে। আর এমনটিই ঘটেছে দেবদাসকে ঘিরে।
সতর্ক ও অভিজ্ঞ লোকদের স্বভাব—তারা নিমিষেই কোনো বস্তুর দোষ-গুণ সমন্ধে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেন না। সবটুকুর বিচার না করে সব টুকুর ধারণা করে নেন না—দুটো দিক দেখে চারপাশের কথা বলেন না। কিন্তু আরেক রকমের লোক আছেন, যারা ঠিক এর উল্টো, কোনো জিনিস বেশিক্ষণ ধরে দেখার, চিন্তা করার ধৈর্য তাদের নেই, কোনো কিছু হাতে পড়ামাত্র স্থির করে ফেলে এটা ভালো কিংবা মন্দ তলিয়ে দেখার পরিশ্রমটুকু করেন না। দেবদাস কিছুটা এ রকম গোছের ডানপিটে। ঐশ্বর্যের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা নিজের খেয়াল খুশি মন চলা মানুষ। পড়াশোনা তার কাছে গুরুত্ববহ করে না। তার সঙ্গীও আছে। সে হলো পারু। পাঠশালা, দুষ্টামি হোক আর অন্য কোনো কাজ হোক, পারু ছাড়া তার চলে না। আবার পরুকে আঘাত করার সময়ও দুদণ্ড ভাবার অবকাশ নেই দেবদাসের।
এভাবে বছর কেটে যায়। একসময় বাবার আদেশে দেবদাস কলকাতায় চলে যায়, পার্বতী রয়ে যায়। দেবদাসের যাওয়ার দিন পারু অনেক কান্নাকাটি করে কিন্তু ধরে রাখতে পারে না। এটুকু কাহিনিতে দেখা যায়—পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ নিজের দম্ভ বজায় রাখতে গিয়ে নারীকে অপমান করতেও কুণ্ঠিত হয় না। নারীকে পুরুষ কেবল নিজের প্রয়োজনে নিজের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে, আবার প্রয়োজন ফুরালে ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধা করে না। যেমনটা দেবদাস যৌবনের তাড়না, হৃদয়াবেগে উদ্বেল হয়ে পারুকে একসময় ভালোবাসে সত্য, কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ, ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক মর্যাদার অহমকে বড় করে দেখতে গিয়ে ত্যাগ করতেও দ্বিধা করে না। পেছনে পারু, যার কথা ভাবার সময় দেবদাসের নেই। কিন্তু দেবদাসের মুখে রাজ্যজয়ের কথা। পারু সেখানে অস্তিত্বহীন।
পারুর পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার প্রস্তাব যাওয়ার পরও দেবদাসের পরিবার তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর দেবদাস চলে যায় কলকাতায়। এরপর দেখা যায়—পারুর জীবনে যে বাস্তবিকতা ছিল, সে অধিকার বোধ থেকেই হয়ত পারু দেবদাসের পায়ে স্থান পেতে চেয়েছিল। অথচ দেবদাস মনে করে পার্বতী ছেলে মানুষী করছে। এতে শুধু তার না পারুরও মান যাবে। তাই পারুকে সে বলে, ‘আমাকে ছাড়া কি তোমার উপায় নেই’।
এই যে পারুর ভালোবাসাকে অস্বীকার করা, পারুর পরিবারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা—এর ভেতরে কেবল দেবদাসের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই সুপ্ত ছিল না। একইসঙ্গে ছিল তাদের পারিবারিক দম্ভ, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার স্বেচ্চারও। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, দেবদাসের খেয়ালি আচরণ ও পারুর ভালোবাসার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের ভেতর একটি সমাজের বৈষম্য কতটা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। মানুষ তথাকথিত সামাজিক স্টাটাস ধরে রাখতে গিয়ে কতটা নির্দয় হতে পারে।
অবশ্যই, একটা সময় পারুর বিয়ের আগে দেবদাস পারুকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টাও করে। এই চেষ্টা আসলে পাওয়ার চেষ্টা নয় কোনোমতেই। এটা ধনী পরিবারের একটি খেয়ালি ছেলের ভীমরতি মাত্র। এ কারণেই পারুর কণ্ঠস্বর স্থির। সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়— ‘তোমার রূপ আছে গুণ নাই, আমার রূপও আছে, গুণও আছে, তাছাড়া দুদিন পর ঐশ্বর্যের অধিকারী ও হবো।’
বস্তুত এই প্রত্যাখ্যানের ভেতর যতটা আঘাত আছে, তারও বেশি আছে, ক্ষোভ ও নিজের সামাজিক অবস্থানের প্রতি শ্লেষ।
অবশেষে চল্লিশ বছর বয়সী ভুবন মোহন চৌধুরীর সঙ্গে পারুর বিয়ে হয়। চৌধুরী মশাই পারুর বড় আমোদের জিনিস, তাকে মনে হলেই পারুর হাসি পেত, খানিকটা কষ্টও পেত।
________________________________________________________________________________________________
এই উপন্যাসের কাহিনি ঊনিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই চিত্র শুধু তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় নয়, বর্তমান কালেরও। এখনও সমাজে সূক্ষ্মতর দৃষ্টি রাখলে অনিয়ম, বৈষম্য লক্ষ করা যায়। ঐশর্য আর দারিদ্র্যের মধ্যে চরম কষাঘাত শুধু তাই নয়, সার্থপরতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাতও পাওয়া যায়। প্রেমে নারী যেখানে অনড়, পুরুষ সেখানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে চিন্তাশীল। সবসময় সে ভাবে নারীর প্রতি টান ক্ষণকালের টান মাত্র, ভালোবাসা নয়।
_______________________________________________________________________________________________
একসময় দেবদাস কলকাতায় ফিরে এলো। চুনিলালের আশ্রয়ে দিন যেতে লাগলো তার। এদিকে, দেবদাসের জীবনে শুরু হয় নতুন যন্ত্রণা। সে কষ্ট ভোলার জন্য চুনিবাবুর সঙ্গে চন্দ্রমুখীর বাড়ি উপস্থিত হয়। নিজের ব্যথাও অনুভব করতে পারে। যে নিজের অজ্ঞাতে নারীদেহের ছায়ার প্রতি বিমুখ হয়ে উঠেছিল, চন্দ্রমুখীকে দেখার পর সেই ক্ষোভ তীব্রভাবে প্রকাশ পেল। অবজ্ঞা ভরে কটাক্ষও করল।
অবনতির সর্বশেষ সোপানে দেবদাস পৌঁছে গেল, আজকাল তার মদ ছাড়া দিন যায় না। সঙ্গে মেয়েমানুষও লাগে। কিন্তু দেবদাস সেখানে চন্দ্রমুখীর আচলে বাঁধা পড়তে আসে না।
চন্দ্রমুখীকে দেবদাস কটাক্ষ করে বলে, ‘ছুঁয়ো না আমার জ্ঞান আছে, তুমি তো জানো আমি তোমাদের কতটা ঘৃণা করি। চিরকাল ঘৃণা করব, তবু আসব, তবু বসব, তবু কথা কব, নাহলে যে উপায় নেই, তা কি তোমরা কেউ বুঝবে?
শরৎ দেখিয়েছেন, অর্থবিত্তের অহং মানুষকে যতই বিমানবিক করে তুলুক, বাস্তবে মানুষ একসময় নিজের অবস্থান বুঝতে পারে। এই বাস্তবতা-ই দেখিয়েছেন, শরৎ দেবদাসের জীবনে। শরৎ দেখালেন, দেবদাস অসুস্থ হওয়ার পর এলাহাবাদ, বোম্বাই বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়ায়। শেষপর্যন্ত দেবদাস ভৃত্য ধর্মদাসকে বন্ধু মান্য করে। এবং সে ধর্মদাসকে নিয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ট্রেনে চেপে বসে। কিন্তু বারবার ধর্মদাসকে দেবদাস বলছিল শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারবে তো? ধর্মদাসও অভয় দেয় দেবকে। কিন্তু দেবদাসের মনে অন্য ঝড়। সে আদৌ বাড়ি পৌঁছতে পারবে না, হলোও তাই। গাড়ি যখন পাণ্ডুয়া স্টেশন পৌঁছল, তখন ধর্মদাসকে না জানিয়ে দেবদাস ট্রেন থেকে নেমে গেল।
স্টেশনের বাইরে এসে পারুর বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলো।
পথের দূরত্ব যেন আর ফুরাতে চায় না। এই যে দেবের মনে আকাঙ্ক্ষা, জীবনের শেষ মুহূর্তে হলেও পারুর কাছে আশ্রয় নেবে সে, এটি মূলত প্রেম ও অনুশোচনার যুগল ক্রিয়া। শরৎচন্দ্র দেখাতে চেয়েছেন, মানুষ যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, সময়ে তার কাছেই তাকে আশ্রয় খুঁজতে হবে। দেবদাসের জীবনেও তাই ঘটল। দুদিন পর মধ্যরাতে পুরো জমিদার বাড়ি যখন নিস্তব্ধ, দেবদাস এলো পারুর বাড়ীর সামনে। মুখে কথা বলার শক্তি নেই। শুধু মৃত্যুর আগে একটিবার পারুকে দেখার বাসনা! অথচ তার সে ইচ্ছাও অপূর্ণ রয়ে গেল। সবার মায়া কাটিয়ে চলে গেল দেবদাস ওপারে।
সকালে খবরটা শুনলেও বিশেষ মনোনিবেশ করতে পারেনি, সন্ধ্যায় সবার মুখে একই কথা শুনে মহেন্দ্র, তার বড় ছেলের কাছে জানতে চাইলে মহেন্দ্র জানালো তোমার দেশের দেবদাস মুখার্জী! পারু বলল কেমন করে জানলে? মহেন্দ্র জানালো তার পকেটে দুটো চিঠি—একটা তার মায়ের অন্যটি দাদার, হাতে নীল রংয়ের আংটি, হাতের ওপর উল্কি দিয়ে নাম লেখা। সমস্ত শুনে পারু বুঝল, এ তার দেবদাস। পারু হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দেবদাসকে দেখার জন্য ছুটল। কিন্তু আজও পৌঁছাতে পারল না! এই হচ্ছে মানুষের পরিণতি। সবাই মিলে পারুর মূর্ছিত দেহ টেনে নিয়ে আসে।
এই উপন্যাসের কাহিনি ঊনিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই চিত্র শুধু তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় নয়, বর্তমান কালেরও। এখনও সমাজে সূক্ষ্মতর দৃষ্টি রাখলে অনিয়ম, বৈষম্য লক্ষ করা যায়। ঐশর্য আর দারিদ্র্যের মধ্যে চরম কষাঘাত শুধু তাই নয়, সার্থপরতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাতও পাওয়া যায়। প্রেমে নারী যেখানে অনড়, পুরুষ সেখানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে চিন্তাশীল। সবসময় সে ভাবে নারীর প্রতি টান ক্ষণকালের টান মাত্র, ভালোবাসা নয়।
পরিশেষে এতটুকু বলা যায়, পুরুষের অহঙ্কার বোধ ও আত্মমর্যাদার কাছে নারীর আসন সবসময়ই নিচু, তুচ্ছ। নিজ স্বার্থে সেই নারীর কাছে—আত্মসমর্পণ, তার স্নেহময় হাতের স্পর্শ পাওয়ার আকুলতা, প্রার্থনা দর্পচূর্ণের ইতিকথার মতোই; বিস্ময়েরও ব্যাপার। এই বিষয়টিই ফুটে উঠেছে দেবদাস উপন্যাসে।