দেখি কী করে! গল্পটা জানেন তো? ওই যে, ‘চুরি হওয়ার পর জিডি করতে যান গৃহকর্তা। বর্ণনায় জানান, দেখলাম চোর গৃহে প্রবেশ করলো, আমি ভাবলাম দেখি কী করে। এরপর সব গোছালো, ভাবলাম দেখি কী করে। আস্তে করে বের হলো, ভাবলাম দেখি কী করে। এরপর চলেই গেলো! পুলিশের জবাব, আপনি তবে দেখতেই থাকুন।’ এটি কল্পিত গল্প।
কিন্তু কিছু মানুষ আমাদের চারপাশেই আছেন, যারা সব সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে এত বেশি কনফিউজড থাকেন যে, সময় চলে গেলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অথবা তিনি কী চান, সেটাই জানেন না। কিছু কেন? বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে আশপাশের সব-ই কনফিউজড। বিশ্বে যখন ভয়াবহভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আমরা ভাবছি কী করা যায়? একের পর এক প্রবাসীরা ঢুকছেন, এয়ারপোর্টে স্ক্যানার নেই। পরিপূর্ণ পরীক্ষা ছাড়াই ঢুকে পড়লেন তারা। ছড়িয়ে পড়লেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
যখন করোনা শনাক্ত হলো, তখন লকডাউন-লকডাউন আওয়াজ শুরু হলো। সময়ের সহজ মাধ্যম ফেসবুকের উঠোন ভরে উঠলো এই দাবিতে। সরকার কিছু দেরিতে হলেও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো। সবাই উৎসবের আমেজে ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, ফেরিতে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে উৎসব পালনে ছুটলো সবাই। এতটুকু বুঝলো না, পাশে বসা লোকটি যে করোনার বাহক নন, তার কী নিশ্চয়তা? বুঝলো না, নিজে যতই নিরাপদ থাকুক, যাওয়ার পথে কারো স্পর্শে করোনা বহন করে নিয়ে যেতে পারে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য। কিংবা আদরের ছোট বাচ্চাটির জন্য!
চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধের মেয়ে ও মেয়ের জামাই ওমরাহ থেকে ফিরেছেন কয়েকদিন আগে। মানেননি কোয়ারেন্টাইন। মেয়ে ও মেয়ের জামাই করোনামুক্ত থাকলেও বৃদ্ধ কিন্তু ঠিকই আক্রান্ত হয়েছেন।
গবেষণা অনুযায়ী এই ভাইরাস বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য সবচে ঝুঁকিপূর্ণ। এরইমধ্যে এমন একটি দুঃসংবাদ আমরা পেয়েও গেছি। চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধের মেয়ে ও মেয়ের জামাই ওমরাহ থেকে ফিরেছেন কয়েকদিন আগে। মানেননি কোয়ারেন্টাইন। মেয়ে ও মেয়ের জামাই করোনামুক্ত থাকলেও বৃদ্ধ কিন্তু ঠিকই আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা যারা বেশি সাহস নিয়ে কিংবা হায়াৎ শেষ হলে মৃত্যু হবে টাইপের চিন্তা নিয়ে ঝুঁকি নিচ্ছি, এটা কাল হতে পারে প্রিয় কারও জন্য। যার জন্য আমি-আপনি মোটেও প্রস্তুত নই। এরপর যখন করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে, তখন গার্মেন্টস খোলার নামে লাখ লাখ মানুষকে ঢাকায় ফেরানো হলো একই কায়দায়। যেন ভুলের মাশুল আরেকটা ভুল দিয়ে। এতগুলো মানুষকে পায়ে হাঁটিয়ে, ড্রামে চড়িয়ে, গরু-ছাগলের মতো টেনে হিঁচড়ে এনে কনফিউশন কাটলো বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষের। তখন মনে হলো, এ মস্ত ভুল। গার্মেন্টস তবে বন্ধই থাক। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
এবার আসি মসজিদে নামাজ পড়ার বিষয়ের সিদ্ধান্তে। এখানেও কনফিউশন কাটতে সময় লাগলো ঢের। যখন সৌদি আরবের মতো দেশে ঘরে বসে নামাজ আদায় করতে বলছে। আজানের সুরই পাল্টে দিয়েছে; সেখানে আমরা এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না। এত অপেক্ষার পর সোমবার ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলো, ওয়াক্ত নামাজের জামায়াতে পাঁচজনের অধিক নয়, জুম্মার জামায়াতে দশজন নামাজ পড়তে পারবেন। তবু মসজিদে নামাজ পড়তেই হবে। সৌদির চেয়েও যে আমাদের আবেগ বেশি শক্ত! অথচ গত কয়েকদিনের করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্যাটার্ন যারা মনিটর করছেন, তারা জানিয়েছেন এখন বেশি ছড়িয়েছে মসজিদ থেকে।
রোববার যে দুইজন মারা গেছেন তার একজনের বাসা মিরপুর ১১। তার সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অনলাইন গণমাধ্যম জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর। ওই প্রতিবেদনে মৃতের ছেলের বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। অবসরের পর থেকে তিনি তেমন বাড়ি থেকে বের হতেন না। যেতেন কেবল মসজিদে।’ অর্থাৎ মসজিদ থেকেই তার ভেতর করোনা সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। করোনা ভাইরাস ভারি বলে এটা নিচে পড়ে। মসজিদের মেঝেতে আর জায়নামাজে এই ভাইরাস পড়বে, যদি একজনো করোনাবাহী মানুষ সেখানে ঢুকে থাকেন। তারপর অন্যজন সেখানে নামাজ পড়বেন। হাত, কপাল, নাক মেঝেতে রাখবেন সেজদার সময়। ওই সময়ে নাক দিয়ে প্রবশে করাটা স্বাভাবিক। টোলারবাগের এক ইমাম, একই মসজিদের মুয়াজ্জিনও মারা গেল। তবু আমরা সিদ্ধান্তে কনফিউজড। আসলে কী করা উচিত!
নিজের ভালোটুকুও বুঝছি না। ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেমন ভালো ফল এনে দেয়, তেমনি অতিভাবনা বা কনফিউশনফোবিয়ার ফলও সব সময় তিক্তই হয়।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে মানুষ দ্বিধায় পড়ে; এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সময়ের সিদ্ধান্ত সময়ে নেয়া তো জ্ঞানীর কাজ। এখানেই একটি মানুষ, জাতি বা দেশের দক্ষতার পরিচয় মেলে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া, ক্রমউন্নতি, জিডিপির হার বৃদ্ধি; এসব ক্ষেত্রে আমরা দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছি সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সংকটকালে কি তড়িৎ সিদ্ধান্ত জরুরি নয়?
এ তো গেল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কথা। জনগণ? যাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এত সিদ্ধান্ত, এত লেখালেখি, এত কথা বলা, এত হৈ চৈ? তাদের কনফিউশন কি কেটেছে? লকডাউন ঘোষণা করেও থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না কোনো কিছু। পুলিশ, সেনাবাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েও ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। অলি-গলিতে গিজগিজ করছে মানুষ। এখনো তারা বিশ্বাস করছে, করোনা কিছুই করতে পারবে না। অথবা করোনা থেকে বাঁচতে কী করণীয় এ বিষয়ে কনফিউজড। একটু বাজারে যাই, চা খেয়েই বাসায় ফিরবো, প্রয়োজনে বের হলে সমস্যা নেই; মানষিকতা থেকে এখনো বের হতে পারছি না। নানা ছুঁতোয় বের হতে পারলেই যেন স্বস্তি। নিজের ভালোটুকুও বুঝছি না। ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেমন ভালো ফল এনে দেয়, তেমনি অতিভাবনা বা কনফিউশনফোবিয়ার ফলও সব সময় তিক্তই হয়।
সমস্ত কনফিউশন দূর করে সঠিক সিদ্ধান্তটি নেয়ার সময় এখনো হয়তো আছে। কর্তৃপক্ষ, সেবক, জনগণ; সবাইকে এক হয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। এবং মানতে হবে।