জিজ্ঞাসার উপযুক্ত উত্তর পেতে, মোক্ষম প্রশ্নের যেমন দরকার; তেমনি প্রয়োজন প্রকৃত চিন্তার বিনিময়ও। আর চিন্তাশীলের জুঁতসই ভাবের সে আদান-প্রদান এমন এক জনের সঙ্গেই ভালো ঘটে; যে তার কৌতুহলের দরজার কপাট সর্বদা খুলে রাখতে প্রস্তুত। তবেই না জমে ওঠে যুক্তির পিঠে যুক্তি, তর্কের পিঠে তর্ক আর চিন্তার বিরুদ্ধে প্রতিচিন্তা। সমস্যা হলো, আমার ব্যক্তিগত মতামত এই যে জাতিগতভাবে আমরা চিন্তাশীল নই, বরং সর্বদা চিন্তাগ্রস্ত। অর্থের সংস্থান, একটু ভালো করে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা, আকালের সঞ্চয়, সামাজিক প্রতিপত্তি, শ্রেণি সংগ্রামে খাপ খাওয়ানো, মিনমিনে হয়ে সিস্টেমের লাথি-ঝাটা খেয়ে গোবেচারা মতো টিকে থাকা। এমন আরও অসংখ্য দুঃশ্চিন্তা, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তাগ্রস্ত করে রাখে। ফলে নিজের অস্তিত্ব, সৃষ্টি জগৎ, সুখ-অসুখের পরম পার্থক্য নিয়ে চিন্তাশীল হওয়ার সময় আমাদের কোথায়! চিন্তাশীল হওয়াকে বরং আমরা অলস মস্তিষ্কের বিলাসীতা মনে করি। আবার চিন্তাশীলতা বিস্তারের জন্য যে মুক্তচিন্তার চর্চা প্রয়োজন, প্রকৃত শিক্ষার অভাবে তা আমাদের মধ্যে নেই। ফলে এমন এক সময়ে থিয়েটারওয়ালা মঞ্চ সাঁজিয়ে আয়োজন করে দর্শনীর বিনিময়ে মানুষের সঙ্গে নাটকের মাধ্যমে প্রশ্ন ও চিন্তা বিনিময় করবে, তা অভাবনীয়ই বটে।
অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, গত ১৯ মে থেকে বেইলি রোডের মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে থিয়েটারওয়ালা মঞ্চায়ন শুরু করেছে নাটক ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’। যাকে দলগতভাবে বলা হয়েছে প্রশ্ন ও চিন্তা বিনিময়ে নাটক। সু সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের লেখা নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকার মঞ্চের আলোচিত নির্দেশকদের একজন সাইফ সুমন। আগামী ২৭ মে পর্যন্ত টানা নয় দিন নাটকটির ১২টি প্রদর্শনী চলবে নাটকটির।
অবাক হওয়ার কথা এ জন্যই বললাম যে, একই নামে শাহাদুজ্জামানের লেখা গল্পটি আমি তার মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বইতে পড়েছি। প্রচলিত কাহিনী নির্ভর গল্পের বাইরে গিয়ে তিনি সেখানে একজন প্রাজ্ঞ পূর্বসূরির সঙ্গে উদ্রান্ত তরুণ উত্তরসূরির কাল্পনিক দার্শনিক আলাপ তুলে ধরেছেন। অমীমাংসিত নানা প্রশ্ন উত্তরের খেলা আর গভীর বোধের সে আদান প্রদান কোনভাবে যে নাটক হয়ে উঠতে পারে প্রথমত তা ভাবিনি। দ্বিতীয়ত চাকচিক্যহীন গুঢ় সংলাপ নির্ভর এই নাটক যে মানুষ মনোযোগ দিয়ে দেখবে তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। কিন্তু গত ২১ মে চতুর্থ প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখলাম, প্রায় হল ভর্তি দর্শক পিনপতন নীরবতায় নাটকটি মনোযোগ সহকারে দেখছে। তাদের অভিব্যক্তি দেখলেই বোঝা যায়, নাটকের সংলাপের সঙ্গে তারা নিজেদের ভাবনার সুতোটা জুড়তে পারছেন। দেখলাম, পরের প্রদর্শনীরও সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। অর্থাৎ নাটকটি বেশ সাড়া ফেলেছে।
জবরজং সেট, লাইট, কোরিওগ্রাফি, কোরাস থিয়েটারের এই সময়ে এসে অভিনয় ও সংলাপ নির্ভর এই নাটক কেন মানুষ এত আগ্রহ নিয়ে দেখছে, বিষয়টি সম্পর্কে ভাবতে পারেন নাটক সংশ্লিষ্টরা। এটা কি প্রমাণ করে না, যে ক’জন মানুষ এখনও মঞ্চে নাটক দেখতে আসেন, তারা আসলে সবকিছুর বাইরে অভিনয়টাকেই খোঁজেন?
নাজুক মানুষের সংলাপ নাটকের জন্য ধারাবাহিকভাবে যারা অতি ধন্যবাদ প্রাপ্য, তারা হলেন প্রথমত শাহাদুজ্জামান, দ্বিতীয়ত নির্দেশক সাইফ সুমন এবং তৃতীয়ত দুই অভিনেতা ইউসুফ হাসান অর্ক ও রুদ্র সাওজাল। দক্ষ অভিনেতা ইউসুফ হাসান অর্কের সুঅভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি তার জায়গায় ঠিকঠাক। তরুণ রুদ্র সাওজালও চেষ্টা করেছেন তার সর্বোচ্চটা দিয়ে। তবে সব ছাপিয়ে এ নাটকের প্রধান নায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে আসলে সংলাপ। এমনকি কোন কোন দৃশ্যে আলোর গিমিকও সংলাপের শক্তিমত্তাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। অভিনয় সেখানে অলঙ্কার পড়িয়েছে মাত্র।
এটা নিশ্চিতভাবে সম্ভব হয়েছে শাহাদুজ্জামানের শক্তিশালী লেখনির জোরে। এই লেখনির সুনিপুণ গাঁথুনি নির্দেশক সাইফ সুমনকেও হয়তো পথ বাতলে দিয়েছে প্রায় অনাট্য একটি গল্পকে নাটক রূপে পরিবেশনের। যদিও এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রবণতা তার জন্য নতুন নয়। এরইমধ্যে বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ বা সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘জনক ও কালোকফি’ অবলম্বনে ‘স্বপ্নভূক’ এর মতো নাটক উপস্থাপন করে দর্শকদের কাছে তিনি নিজের নির্দেশনা কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন।
ফিরে আসি নাজুক মানুষের সংলাপে। ঘটনাচক্রে একদিন প্রাজ্ঞ এক বৃদ্ধের সঙ্গে আত্মপথ খুঁজতে থাকা এক তরুণের দেখা হয়ে যাওয়া আর প্রশ্ন ও চিন্তা বিনিময় নিয়েই এই নাটক। কথপোকথনে প্রাজ্ঞ সেই বৃদ্ধ যেন খানিকটা সক্রেটিস, খানিকটা প্রাচীন গ্রিসের সোফিস্টদের মতো হয়ে ওঠেন। বেভুল তরুণের প্রতিটি আত্মজিজ্ঞাসার এমন সুক্ষ্ম উত্তর তিনি এত সুচারুভাবে দেন, যেন এ কালের কোন রহস্যময় বুড়ো নন, বরং শিষ্য প্লেটোর সঙ্গে কথা বলছেন খোদ সক্রেটিস। নাটকে বৃদ্ধ সেই তরুণকে বলে- যে ব্যাপারগুলো আমরা সবার শেষে আবিষ্কার করি তার নামই সত্য। কিংবা সেই সংলাপ- যে হিসেব কষবে তা মেলবার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ মানুষ ভীষণ নাজুক। কতটা নাজুক মানুষ তা নিজেই জানে না। অন্যে না জানুক, অন্তত তুমি তা জেনে রেখ।
মানুষ মঞ্চে নাটক বা হলে সিনেমা দেখতে যায় আসলে উপভোগের জন্য। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হলো, নাজুক মানুষের সংলাপ নাটকটি আসলে উপভোগের নয় বরং অনুভবের, অনুধাবনের। যারা শুধুই গল্পনাট্য উপভোগের কথা ভেবে নাটকটি দেখবেন তারা হয়ত হতাশ হবেন। কিন্তু চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই যে এর শক্তিশালী দার্শনিক সংলাপে অভিভূত হবেন, তা গ্যারান্টি দেওয়া যায়।
নির্দেশনায় সাইফ সুমন মহিলা সমিতির গোটা মঞ্চটির উপর-নিচ যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা প্রশংসা পাওয়ার মতো। সব মিলে ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ যে ঢাকার মঞ্চে এ সময়কার ভিন্নধর্মী এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া থিয়েটার চর্চার সৌখিন মনোবৃত্তির অবসানে থিয়েটারওয়ালা নতুন নাটকের একটানা থোক প্রদর্শনীর যে উদ্যোগ নিয়েছে, সময় এসেছে দর্শক হিসেবে তাতে সাড়া দেওয়ার।