‘মানুষ আফ্রিকা যায়। সেখানে তাদের চোখ তা-ই দেখে, যা তাদের মন ইতোমধ্যেই বিশ্বাস করে বসে আছে। ফলে প্রকৃতই চোখের সামনে যা আছে, ব্যর্থ হয় তা দেখতে। পশ্চিমারা আফ্রিকাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশ হিসেবে গণ্য করে না। তাদের কাছে, আফ্রিকা দুনিয়ার যত আজগুবি, অবিশ্বাস্য আর অযৌক্তিক বস্তুতে ভরপুর।’ চিনোয়া আচেবে আঙুল দিয়ে এভাবেই দেখান পশ্চিমের আফ্রিকা দেখার চোখকে। আফ্রিকা মানেই অন্ধকারের জগৎ। আফ্রিকার মানুষ অসভ্য, সংস্কৃতি বর্বর, ঐতিহ্য কুসংস্কারচ্ছন্ন, জীবনাচার নিকৃষ্ট। গায়ের রঙের মতোই তারা অন্ধকারের বাসিন্দা। তাই আফ্রিকাকে কথা বলতে দেওয়া অযৌক্তিক; সে নিজেকে চেনে না, জানে না; তাকে সবচেয়ে ভালো চেনে-জানে পশ্চিমের লোকেরা। আর যেহেতু কালো লোকেরা নির্বাক ও নিকৃষ্ট, সেহেতু তাদের শাসন, দমন বা ‘আলোকিত’ করার দায়িত্ব পশ্চিমের। আফ্রিকা বা ‘ড্রার্ক কন্টিনেন্ট’ সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি শত শত বছর ধরে লালিত-পালিত হয়েছে পশ্চিমা সমাজে ও মগজে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীনতা প্রাপ্ত আফ্রিকান দেশগুলোতে উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার বিকাশ এবং পশ্চিমে তা প্রচার হওয়ার সুবাদে ধীরে ধীরে সেই ধারণায় ভাঙন ধরে; গলতে শুরু করে পুরনো সংস্কারের বরফ। তবে বরফ সম্পূর্ণ গলেনি এখনো। কারণ এখন নতুনরূপে সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ স্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের তালিকায় প্রথমেই আছে সংস্কৃতি—সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি করে স্থানীয় জনগণের মধ্যে হীনমন্যতার বীজ বুনে দেওয়া। আবহমান সংস্কৃতির ধ্বংস সাধন করে রাজনৈতিক আগ্রাসন তরান্বিত করা। প্রাচীন সংস্কৃতির সঙ্গে এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কালজয়ী সৃষ্টি চিনোয়া আচেবের ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’। কার্ল মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মাধ্যমে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক জীবন, সামাজিক ঘটনা ও সামাজিক ইতিহাস অধ্যয়ন করেছেন। এই তত্ত্বে তিনি সমাজের পরিবর্তন ও রূপান্তরের ধারাকে নির্দিষ্টভাবে সূত্রবদ্ধ এবং বাস্তব বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটনা প্রবাহের গতিপ্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করেন। আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমের নতুন সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’এ ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রায়োগিক ও শৈল্পিক দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
২
আফ্রিকার জনজীবন গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে আস্থাশীল। ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করে তাদের গোষ্ঠীজীবনকে। শতাব্দীর পর শতাব্দী একই উৎপাদনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কাঠামো, জীবনাচার, আইন, সংস্কার, শিল্পকলা, ব্রত-উৎসব-অনুষ্ঠানাদি পালনে তারা ঐতিহ্যবাদী। ধর্মীয় বিশ্বাসে পৌত্তলিক, উৎপাদনব্যবস্থা আদিম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকা- ঐতিহ্যিক। উপনিবেশ স্থাপনের আগ পর্যন্ত আবহমানকাল ধরে আফ্রিকায় প্রাচীন সংস্কৃতি অটুট ছিলো, লালিত-পালিত হয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে দ্বিধাহীনভাবে। এককথায় লোকসংস্কৃতির আবহে সাধারণ লোকের জন্ম-বিকাশ-পরিণতি। পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ এসে সেই সংস্কৃতি শুধু ধ্বংসই করেনি; সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পশ্চিমের নতুন ধর্ম, নতুন সংস্কৃতি। অনেক গোত্র-সম্প্রদায়কে গণহত্যার মাধ্যমে সমূলে বিনাশ করে দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে বিজ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে প্রাচীন সংস্কৃতির অনেক কিছুই গ্রহণযোগ্য বা যুক্তিগ্রাহ্য নয়; কিন্তু এই কারণে কোনো জাতিকে দমন ও নির্মুল করারও কোনো অধিকার কারও নেই। নাইজেরিয়ার অমর লেখক চিনোয়া আচেবে ম্যানবুকারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এ সেই প্রাচীন সংস্কৃতির গৌরবগাথা, উত্তরাধিকার এবং উপনিবেশ স্থাপনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের আখ্যানলিপিকে শিল্পরূপ দিয়েছেন।
থিংস ফল অ্যাপার্ট মূলত প্রাচীন ইবো গোত্রের এক বীর যোদ্ধা ওকোনকোর জীবনাখ্যানকেন্দ্রিক আধুনিক ক্লাসিকধর্মী উপন্যাস; নায়কের জীবনের অনুষঙ্গেই এসেছে আফ্রিকার জীবনঘনিষ্ঠ সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ভাঙন। উপন্যাসটি তিনটি অংশে বিভক্ত: প্রথম অংশে তের, দ্বিতীয় অংশে ছয়, তৃতীয় অংশে ছয় অর্থাৎ মোট পঁচিশটি পরিচ্ছেদে সমগ্র আখ্যানের সূচনা, বিকাশ ও পরিণতি।
প্রথম থেকে পনের পরিচ্ছেদ পর্যন্ত ওকোনকোর জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে-সঙ্গে আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতির ক্যানভাস দেখা যায়। ওকোনকো সংগ্রামী যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে; ভাগ্যের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেনি। অলস বাবার কাছ থেকে সে কিছুই পায়নি। মাত্র আঠের বছর বয়সে ভয়াবহ মল্লযুদ্ধে ‘অপরাজেয় বিড়াল’ খ্যাত আমালিনজোকে পরাজয়ের মাধ্যমে তার খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। সে দীর্ঘ ও বিরাট দেহের অধিকারী, ভুরু ঘন ও নাক চওড়া। পায়ের গোড়ালি মাটি স্পর্শ করে না তার, যেন স্প্রিংয়ের উপর হাঁটছে। যুবক বয়সে সে একাধিক উপাধি ও স্ত্রী গ্রহণ করেছে; সে সম্পদশালী ও গোত্রসমাজে সে একজন জমিদার সমপর্যয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও মল্লবিদ।
বছরে একবার গোত্রবাসী খামার তৈরি করে ফসল ফলায়। বর্ষার শুরুতে বৃষ্টিতে জমিন নরম হয়ে আসলে জঙ্গল-আগাছা পরিষ্কার করে ইয়াম বীজ বোনা হয়— এই ইয়াম ফসলের রাজা, প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় এর জন্য। প্রবল বর্ষা শুরু হলে ইয়াম ঢিবির মাঝে যব, তরমুজ ও সিম বোনা হয়; তবে ইয়াম তাদের প্রধান খাদ্য, সারা বছরের খোরাকি; তাছাড়া ইয়াম পৌরুষের প্রতীক। ওকোনকো ইয়াম উৎপাদনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে সে খামারে কাজ করে।
নবান্নের উৎসবকে বলা হয় নব-ইয়াম উৎসব। ফসল কাটার আগে এই উৎসব হয়। আগের রাতে মজুত সমস্ত ইয়াম খেয়ে শেষ করে নতুন ইয়াম দিয়ে শুরু হয় নবান্ন উৎসব ও নতুন বছর। উৎসবের প্রথম দিনে ভোজন উৎসব ও বন্ধুত্ব— সকালে দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ, সন্তানদের জন্য প্রার্থনা; বেলা হলে আশপাশের গ্রাম থেকে আত্মীয়-স্বজনের তালরসের মদপূর্ণ পাত্রসহ আগমন ও পানাহার চলতে থাকে। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে ‘ইলোতে’ ওকোনকোর গ্রামের সাথে পাশের গ্রামের মহামল্লযুদ্ধের আয়োজন; ঢাকের বাদ্যের তালে তালে মল্লযুদ্ধ চলে; ছেলে-মেয়ে, শিশু, যুবক, বৃদ্ধা, পুরুষ সবাই দাঁড়িয়ে একটা বৃত্ত তৈরি করে মাঠের মধ্যখানটা ছেড়ে দিয়ে; প্রবীণ ও বয়স্ক লোকেরা তাদের চৌপায়ায় বসে। উচ্ছ্বসিত জনতা করতালি আর মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি, হৈ চৈ আর উত্তেজনায় যুদ্ধ উপভোগ করে। আশপাশের নয় গ্রামের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুই মল্লবিদ ওকোনকো ও ইকেজুয়ে পরস্পর লড়াই করে কেউ কাউকে হারাতে পারে না। সমর্থকরা যুদ্ধশেষে ওকোনকোকে কাঁধে তুলে নিয়ে গ্রামের দিকে রওয়া দেয় আনন্দ-উল্লাসে।
আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতিতে ধর্মবিশ্বাস বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছে। কল্পিত দেব-দেবী তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। যেমন, মৃত্তিকা দেবী আনই, সব উর্বরতার উৎস এই দেবী; নবান্নের উৎসবে বিশেষরীতিতে এই দেবীকে ও পূর্বপুরুষের আত্মাকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। দৈব বাণী আগবালা, পাহাড়ের গুহায় সে থাকে, কোনো বিষয়ে নির্দেশ পেতে বা বিপদে পড়লে মানুষজন এসে এই দেবতার কাছে বাণী গ্রহণ করে ও সেভাবে কাজ করে। এছাড়া তাদের রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে ও বিষয়ে আলাদা আলাদা দেবতা। যেমন: ইয়াম দেবতা, গোত্র দেবতা, ব্যক্তিগত দেবতা এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দেবতা। এইসব দেবতার প্রতিনিধিত্ব করে বিভিন্ন পুরোহিত, যারা সমাজে প্রচণ্ড প্রভাবশালী; যেমন চিয়েলো আগবালার পুরহিত। ওকোনকোরও ব্যক্তিগত দেবতা রয়েছে, যাকে সে সব সময় সন্তুষ্ট রাখে বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করে। এই দেবতাদের মাধ্যমেই লোকেরা পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাদের সঙ্গে পূর্বপুরুষের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ; অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে-উৎসবে-ব্রতপালনে তারা দেবতার মাধ্যমে পূর্বপুরুষের আত্মার সঙ্গে আত্মীয়তা বজায় রাখে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শুধু আইন-কানুনের ব্যবহার আছে তা কিন্তু নয়; প্রাচীন সংস্কৃতিতেও আইন বা রীতনীতি মানুষের জীবনে বিরাট ভূমিকা রাখে। ওকোনকোর গ্রাম উমুওফিয়ার একজন ব্যক্তির স্ত্রীকে পাশের গ্রামের লোক হত্যা করে। এ-কারণে ওকোনকো বার্তা নিয়ে যায়: হয় যুদ্ধ, নয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি কিশোর বালক ও একটি কুমারী মেয়ে প্রদান করতে হবে। ওকোনকোকে তারা ভয়ে রাজসম্মান দিয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেয়। কুমারী মেয়েটি স্ত্রী হিসেবে নিহতের জায়গায় এবং বালকটি ওকোনকোর তত্ত্বাবধানে থাকে। তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে বালকটি আত্মীয়ের মতো মিশে যায়। কিন্তু তিন বছর পর নয় গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠের একটা দল ওকোনকোকে নিয়ে অরণ্যের এক প্রান্তে সেই কিশোরকে হত্যা করে। এ-ঘটনায় ওকোনকো মানসিকভাবে মারাত্মক আঘাত পায়। কারণ বালকটি তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতো। অন্যদিকে একজন মহৎ ব্যক্তিত্বের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জনসমাবেশে হঠাৎ ওকোনকোর বন্দুকের গুলি অনিচ্ছাকৃতভাবে একজনকে বিদ্ধ করলে সে মারা যায়। নারীজাতীয় ও মৃত্তিকা দেবীর বিরুদ্ধে এই ধরনের অপরাধের জন্য ওকোনকোকে পরিবারসহ গ্রাম ছাড়তে এবং গোত্রের বাইরে মায়ের গ্রাম মবান্তায় সাত বছর নির্বাসনে থাকতে হয়।
আফ্রিকান সংস্কৃতিতে বিরাট উৎসব-আয়োজন হয় বিয়ে উপলক্ষে। বাঙালি বিয়ের মতোই কনে দেখা, কন্যাপণ ও বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ এবং মহাধুমধাম, ভোজ, আত্মীয়-স্বজন সহকারে বিয়ের অনুষ্ঠান, উপহার প্রদান করা হয়। তবে বিয়েতে তালরসের প্রচুর মদ প্ররিবেশন; ভোজে কোলা বাদাম, ফু-ফু, সুরুয়া ও ইয়ামের তরকারি; কন্যা ও কন্যার মায়ের নাচের তালে তালে গানবাজনা আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতির নিজস্ব ঢঙ। ওকোনকোর বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে এভাবে সকলে উৎসব-আমেজে মেতে ওঠে।
ইবো সম্প্রদায়ের কাছে জন্মমৃত্যু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কোনো শিশু স্বাভাবিক গঠনে জন্ম নিলে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়; কিন্তু যমজ শিশু বা অস্বাভাবিক শিশু জন্ম নিলে তাকে অস্ত্র দিয়ে জখম করে ‘দুষ্টুবনে’ ফেলে দেওয়া হয়, যেন সে আর ফিরে না আসতে পারে মাতৃগর্ভে। কোনো উপাধিধারী বা বীরের মৃত্যু হলে ঘটা করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়; ঢাক বাজিয়ে ঘোষণার মাধ্যমে। অন্যদিকে জীবিত মানুষজনের সঙ্গে মৃত মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের মাঝে যোগাযোগ হয়। বিশেষভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এই সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়।
শুধু আফ্রিকা নয়, প্রায় সমস্ত জাতির প্রাচীন সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যেই পুরুষতান্ত্রিকতা বিরাজমান। নারীর অবস্থান সেখানে একদম নিচে। যেকোনো সামর্থ্যবান পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকে; সমাজ-সংসারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারী বা স্ত্রীদের মতামত দেওয়ার কোনো অধিকার নেই; এটাই তাদের রীতি। উৎপাদন থেকে শুরু করে মল্লযুদ্ধ পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারে পুরুষদের আধিপত্যই তাদের ঐতিহ্য। ওকোনকোর অনেকগুলো স্ত্রী থাকলেও মতামতের কোনো গুরুত্ব দেয়নি।
লোককাহিনি, প্রবাদ ও ছড়ার প্রাচুর্য প্রাচীন সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চিনোয়া আচেবে এই উপন্যাসে তাৎপর্র্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতধর্মী বেশ কিছু লোকসাহিত্যের উপাদান কৌশলে ব্যবহার করেছেন, যা অত্যন্ত সুখপাঠ্য হয়েছে। সমগ্র উপন্যাসের পটভূমি, বিন্যাস ও মেজাজের সঙ্গে সেগুলো একাত্ম হয়ে গেছে।
৩.
উপনিবেশ সাম্রাজ্যবাদের বাস্তব প্রকল্প; উদ্দেশ্য রাজনৈতিক-সামরিক আধিপত্যের মাধ্যমে স্থানীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও জনগণকে শাসন-শোষণের বিনিময়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া। নাইজেরিয়ার সনাতন সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রথমে উপনিবেশ এসেছে ধর্মের ছদ্মাবরণে; ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক পথে, আইন-আদালতের অজুহাতে ও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এ আচেবে নতুন উপনিবেশ ও সনাতন সংস্কৃতির মধ্যকার দ্বন্দ্বকে জীবনঘনিষ্ঠ আখ্যানের রূপ দিয়েছেন।
ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক আবহে ওকোনকোর জীবন উমুওফিয়া গ্রামে পরিবার, সন্তান, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বেশ স্বচ্ছন্দ্যে ও প্রাচুর্যে কাটছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে অনিচ্ছাকৃত একটা খুনের ঘটনা তার জীবন পালটে দেয়। প্রচলিত আইনানুসারে সাতবছর পাশের গ্রামে নির্বাসনের সময়েই সে নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশে এই নির্বাসন শুরু। খ্রিস্টান পাদ্রিদের আগমনে ও তাদের সম্পর্কে নানা গল্প তাকে বিচলিত করে তোলে। সবচেয়ে বড় আঘাত পায় যখন নিজের ছেলে নওয়াই পাদ্রি ও মিশনারির লোকদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে স্কুলের শিক্ষক হয়। মিশনারির লোকজনের আগমন, কর্মকাণ্ড, ‘দুষ্টুবনে’ গির্জা নিমার্ণ, সম্প্রদায়ের অচ্ছুত লোকদের নিয়ে গির্জায় প্রার্থনা, নতুন ধর্ম প্রচার, স্কুল স্থাপন ইত্যাদি মবান্তার সনাতন সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রচণ্ড এক আঘাত হানে। শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ওকোনকো কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি এ সব ঘটনা। অন্য গ্রামে থাকার কারণে সে বারবার ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হয়েছে; কিছু করতে না পারার নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করেছে।
উপন্যাসের তৃতীয় অংশে ওকোনকো নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে। ভেবেছিল তার প্রত্যাবর্তন হবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সে গোত্রের সর্বোচ্চ উপাধি গ্রহণ করবে; বাড়িঘর, সীমানা প্রাচীর, গোলাঘর আরো উন্নত করবে; সুন্দরী দুটি মেয়ের ধুমধাম সহকারে বিয়ে দেবে; ছেলেদের ওজো সমাজের অন্তর্ভুক্ত করবে; এইসব কারার মাধ্যমে যেন দেশে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটলো না। তার প্রত্যাবর্তন একটা সাধারণ ব্যাপার যেন; কারণ উমুওফিয়া অনেক পালটে গেছে। নারকেল তেল ও ছোবড়ার বাজার তৈরি হয়েছে এবং বাইরের পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; নীচ ও অচ্ছুত ছাড়াও দুই একজন দামি ব্যক্তিত্ব মিশনারির সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সেখানে শুধু ধর্ম আসেনি, সঙ্গে তথাকথিত সরকার, আদালত, বিচারক ও পেয়াদাও আমদানি করা হয়েছে। যখন তখন যাকে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচার করা ও শাস্তি দেওয়া হয়। ধর্ম প্রচারের বেশ ধরে ধীরে ধীরে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব কায়েম করা হয়েছে। অথচ এই কাজগুলো পশ্চিমারা করেছে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি, বর্ণের আভিজাত্য, ধর্মের মাহাত্ম্য ঘোষণার মাধ্যমে; কল্যাণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এখনও যেমন করা হয়। এককথায় উড়ে এসে জুড়ে বসা, বৈধতা বা নীতির তোয়াক্কা না করেই। ওকোনকো এইসব মেনে নিতে পারেনি। মুক্ত, স্বাধীন ও দ্রোহী চরিত্রের এই নায়ক বারবার জেগে উঠতে চেয়েছে; কিন্তু সে নিজেকে একা পেয়েছে; পরিস্থিতির কারণে কিছু করতে পারেনি।
ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্য যেকোনো ছুতায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সংঘাত সৃষ্টি করা। সংঘাত সৃষ্টি করে আধিপত্য বিস্তার, দমন ও শক্তি পরীক্ষা করা; কেননা তাদের রয়েছে আধুনিক মারণাস্ত্র ও কূটকৌশল। এক পর্যায়ে মিশনারির লোকেরা স্থানীয় গোত্রের লোকদের সঙ্গে বিরোধ বাধায়। ধরণী দেবীর সম্মানে একটি অনুষ্ঠানে উগ্র নব্য খ্রিস্টান এনোক পুনরায় আবির্ভূত পূর্বপুরুষ বা ইগোগোর মুখোশ খুলে ফেলে। গোত্রীয় সমাজে এটা মহাপাপ কাজ। ফলে গোত্রের উত্তেজিত যুবকরা এনোকের ঘরবারি এবং গির্জা ভবনও ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। এই ঘটনায় ওকোনকো দারুণভাবে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, পুরনো দিন আবার ফিরে আসছে ভেবে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি দিন অতীত আর ফিরে আসে না। ফলে জেলা কমিশনার কৌশলে গোত্রের ছয় নেতৃবৃন্দকে ডেকে পাঠায়; মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আটক করে রাখে জেলখানায়; লাঞ্ছিত করে; অতঃপর জরিমানা দেওয়ায় ছেড়ে দেয়।
এই ঘটনায় গোত্রের মাঝে তীব্র ক্ষোভ-উত্তেজনা দেখা দেয়; বিরাট জমায়েত হয়; জমায়েতে বক্তারা প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলে; ‘দুষ্টুচক্রের শেকড়’ উপড়ে ফেলতে আহ্বান জানানো হয়। বীরযোদ্ধা ওকোনকো প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। কিন্তু এরই মধ্যে একদল পেয়াদা কমিশনারের নির্দেশে সভা ভঙ্গ করতে বলায় ওকোনকো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে; তরবারি কোষমুক্ত করে পেয়াদা সর্দারকে হত্যা করে। ফলে নিজের জীবনে সে ডেকে নিয়ে আসে চরম এক ট্র্যাজেডি। সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পরিবর্তে জনতা ভয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। অন্য দিকে ওকোনকো ক্ষোভে, অপমানে, লজ্জায় গোত্রের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। ‘প্রাচীন সংস্কৃতির ছাত্রের’ কাছে ‘কঠোর প্রশাসক নতিস্বীকার’ করে। কিন্তু উপনিবেশ স্থাপনের বাধা দূর হয়ে যায়। কমিশনার আফ্রিকার অন্ধকার জগতে ‘সভ্যতার আলো’ ছড়িয়ে দেওয়ার ‘মহৎ’ অভিজ্ঞতা এবং ওকোনকোর ঘটনা নিয়ে একটা গ্রন্থ রচনার ইচ্ছার মধ্য দিয়ে উপন্যাস শেষ হয়। গ্রন্থের নাম: ‘নিম্ন নাইজেরিয়ার প্রাচীন গোত্রের নিয়ন্ত্রণসাধন’। আসলে নিয়ন্ত্রণ নয়, ‘নিম্ন’ জাতের দেশে আগ্রাসন-লুণ্ঠন-দমন-শাসন। কালান্তরের নিয়মে ঔপনিবেশিক শক্তি ও কৃৎকৌশলের কাছে প্রাচীন সংস্কৃতি হার মানে।
৪.
আফ্রিকার প্রাচীন ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির বিপর্যয়কে চিনোয়া আচেবে সমাজ রূপান্তরের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের আলোকে ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এ বিন্যস্ত করেন। এক্ষেত্রে আবেগের প্রাধান্য দেননি লেখক। পরবর্তী উপন্যাসে লেখক ইবো সম্প্রদায়ের এক আধুনিক যুবকের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমের সুখময় জীবনের দ্বন্দ্বের আখ্যানকে রূপায়িত করেছেন। প্রাচীন সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে পশ্চিমের তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার রক্তাক্ত ও ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকে আচেবে বাস্তব জীবনের পটভূমিকায় ধারণ করেছেন শৈল্পিক শৈলীতে। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ এই অনিবার্য দ্বন্দ্বের সার্থক সাহিত্যিক সৃষ্টি।