বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় শব্দযুগল জিরো টলারেন্স। যখন কোনো অনিয়ম, অপরাধ বাড়তে বাড়তে চারদিক থেকে জাপটে ধরে, গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে, মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়, কোনো সমাধান চোখে পড়ে না; তখন স্বস্তি খোঁজে ওই জিরো টলারেন্সে। এর আগে বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার ভালো ফল দেখিয়েছে এই শব্দযুগল। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পদ্ধতি সুফল দিয়েছে।
নীতিজ্ঞান যখন কাজ করে না, প্রচলিত আইনে যখন অপরাধ রোধ করা সম্ভব হয় না; তখন এই জিরো টলারেন্সের দিকেই তাকিয়ে থাকে সাধারণ নাগরিক। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, ‘এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।’ দুঃখের বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও সেই রুচির দুর্ভিক্ষ আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
করোনাভাইরাসের মতো এত বড় মহামারির মধ্যেও দুর্নীতিবাজরা এ ত্রাণসামগ্রী ও স্বল্পমূল্যের চাল আত্মসাৎ করতে ব্যস্ত।
অনেক বিষয়ে অনেক সফলতা পেয়েছি আমরা। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত জয় থেকে শুরু করে মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠানো পর্যন্ত কত অসাধ্যই আমরা সাধন করেছি। কত অসহায়ত্ব কাটিয়ে উঠে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছি। কিন্তু কাটেনি সেই রুচির দুর্ভিক্ষ। নতুবা এই দুঃসময়ে; যখন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ছে একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যখন সমস্ত কিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে। যে যার সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াচ্ছে অপরের; তখন অসহায়দের জন্য বরাদ্ধ ত্রাণে অনিয়ম করা কিভাবে সম্ভব! প্রতিদিনই ত্রাণের চাল আত্মসাতের খবর পাচ্ছি। যেন করোনাভাইরাসের চেয়েও দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে আত্মসাতের বিষয়টি।
অধিকাংশ জেলা উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বাররাই এই অনিয়মে মেতে উঠছেন। তাদের আটক করা হচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত কারো এক মাস, কারো ছয় মাস কারাদণ্ড দিচ্ছে। তবু থামছে না। থামা তো দূরে থাক কমছেও না। এ থেকে বোঝা যায়, এই অনিয়ম রোধে চলমান বিচার প্রক্রিয়া যথেষ্ঠ নয়। এজন্য শক্ত কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে সরকারকে। প্রয়োজনে হাজির করতে হবে সেই শব্দ যুগল ‘জিরো টলারেন্স’। অপরাধের ধরন গুরুত্ব বিবেচনায়ই সাধারণত জিরো টলারেন্স আনা হয়। সে হিসেবে ত্রাণের চাল আত্মসাৎকে সাধারণ চুরি হিসেবে দেখলে চলবে কেন? লকডাউনের কারণে সমগ্র দেশে কয়েক কোটি হতদরিদ্র এবং বেকার মানুষ অতি কষ্টে জীবনযাপন করছে। তাদের এই কষ্ট লাঘবের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্পমূল্যে চাল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো এত বড় মহামারির মধ্যেও দুর্নীতিবাজরা এ ত্রাণসামগ্রী ও স্বল্পমূল্যের চাল আত্মসাৎ করতে ব্যস্ত।
যারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে অসহায়দের জন্য বরাদ্ধকৃত চালের লোভ সামলাতে পারেন না তারা সুযোগ পেলে দেশের যে কোনো প্রকারের ক্ষতি করতে পারেন; সন্দেহ নেই। এই শ্রেণি সব সময়ই বাংলাদেশে ছিল, এখনো আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে এভাবে লুটতরাজ করে খায়। আমি শুধু এমার্জেন্সি দিই নাই, এবারে প্রতিজ্ঞা করেছি, যদি ২৫ বছর এই পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে, জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে গোলাম মোহম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর আমার ৩০ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পারব না?
এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ববান ভূমিকা রাখতে পারেন তারাই। অথচ তারাই এখন আত্মসাতে মেতে উঠছেন। এদের দমাতে যেকোনো শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
এই বাংলার মাটি থেকে এই দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোরী এই চোরাচালানকারীদের নির্মূল করতে হবে। আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার জনগণও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো। আর না, অধৈর্য, সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এই জন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই। এই জন্য শহীদরা রক্ত দিয়ে যায় নাই। কয়েকটি চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বাইর করে দিয়ে আসে, …মানুষকে না খাইয়া মারে। উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকের থেকে এদের। দেখি কত দূর তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি না ঈমানদারের শক্তি বেশি, সেটাই আজ প্রমাণ হয়ে যাবে।’ দুঃখজনক সত্য হচ্ছে সাময়িকভাবে সেই চোরদের শক্তিই বেশি প্রমাণিত হয়েছিল।
তাদের উৎখাত করার আগেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় জাতির পিতাকে। ফের পিছিয়ে দেয়া হয় দেশটাকে। ৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নতুন করে। ধারণা করা হয় এবার হয়তো সেই চোরদের উৎখাত করা হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে অনেক অপরাধ দমনও হয়েছে এরইমধ্যে। জঙ্গিবাদের মতো সন্ত্রাসবাদও দমন করেছেন কঠিন হাতে। বিশে^ নজির স্থাপন করেছেন। কিন্তু ভেতরকার এই দুর্নীতি এখনো রয়ে গেছে। এদের জন্য জনসাধারণের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অধৈর্য হয়ে পড়ছে জনগণ। রোববারের একটি খবরে মনে শঙ্কা দানা বাঁধে। খবরটিতে বলা হয়েছে- ‘জামালপুরে ট্রাক থামিয়ে ত্রাণসামগ্রী লুট করে নিয়েছে হতদ্ররিদ্ররা। ট্রাকটি সিংহজানি খাদ্য গুদাম থেকে পৌরসভার ২, ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিল।’ এ নিশ্চয় অন্যায় করেছে। কিন্তু কেন করেছে এমনটি? যারা ত্রাণ বিতরণ করছে তাদের প্রতি অনাস্থা থেকেই অসহায় দরিদ্রদের এই অপরাধটি করতে হয়েছে। এখানেই শঙ্কা। জনগণ বেসামাল হলে পরিস্থিতি কখনোই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।
এমনিতেই করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত অবস্থা বিরাজমান। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েছে অনেক দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বেকায়দায় পড়েছে উচ্চবিত্তরাও। এরমধ্যে এমন খবর নিশ্চয় স্বস্তি দেয় না। এদের সামলাতে হলে সর্বাগ্রে ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। ওয়ার্ড মেম্বার, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরাই তাদের সবচে কাছের। জাতির এই ক্রান্তিকালে তাদের দায়িত্ব সবচে বেশি। চেয়ারম্যান, মেম্বাররাই পারেন এই সময়ে চাহিদা ও সাধ্যের সমন্বয় রেখে জনগণের পাশে দাঁড়াতে। এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ববান ভূমিকা রাখতে পারেন তারাই। অথচ তারাই এখন আত্মসাতে মেতে উঠছেন। এদের দমাতে যেকোনো শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। ।
লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক