মৃত্যুর আগে তরু দত্ত (৪মার্চ, ১৮৫৬ –৩০আগস্ট, ১৮৭৭) ফরাসি ও ইংরেজি কবিতার পাশে তাঁর ছাপা দুটো উপন্যাস দেখে যাননি৷ ‘শ্রীমতি দ্যারভ্যারের দীনপুঞ্জি’ (Le Journal de Mademoiselle d’Arvers) কে বলা হয়, প্রথম ভারতীয় সাহিত্যিকের লেখা ফরাসি ভাষায় উপন্যাস আর বিয়াঙ্কা, এক তরুণী স্প্যানিশ পরিচারিকার কাহিনী (Bianca, or the Young Spanish Maiden )কে বলা হয় ইংরেজিতে লেখা প্রথম ভারতীয় নারী সাহিত্যিকের কাজের নিদর্শন। তরু দত্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক অভিনব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন তাঁর লেখায়। ভাবে ভারতীয়, মননে ফরাসি আর লেখনীতে ব্রিটিশ কলাকৃতির এক অভিনব অনুভব পাওয়া যায় তাঁর লেখায়।
তরু ও তার বোন অরু মিলে ১৮৭৬ সালে বেশকিছু ফরাসি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে৷ ভবানীপুর সাপ্তাহিক সংবাদ প্রেস থেকে সেগুলো বই হয়ে প্রকাশও হয়েছিল৷ তরু দত্তের ফরাসি ভাষার প্রতি দখল প্রভাবিত করেছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর মতো ব্যক্তিত্বকেও৷
বিয়াঙ্কা—এক তরুণী স্প্যানিশ পরিচারিকার কাহিনী। তরুদত্তের মৃত্যুর পর ১৮৭৮ সালে বেঙ্গল ম্যাগাজিনে বিয়াঙ্কা প্রকাশ পায়। আর ছিল ভারতীয় প্রবাদ, ভারতীয় উপাখ্যান, সনাতন কাহিনীনির্ভর কিছু অসমাপ্ত ব্যালাডধর্মী কবিতা। ইংরেজি ভাষায় লেখা সনাতন ভারত সম্পর্কে অসমাপ্ত কবিতাগুচ্ছ, কিগান পল ১৮৮২ সালে Ancient Ballads নামে যা প্রকাশ করেন। অনেকে এই সংকলনটিকে সংস্কৃত পদ্যের ইংরেজি অনুবাদও বলে থাকেন।
তরু দত্ত মারা গিয়েছিলেন ১৮৭৭ সালে৷ ২১ বছর বয়সে৷ তাঁর ‘আওয়ার ক্যাসুরিনা ট্রি’ কবিতা এতটাই বিখ্যাত যে সেটা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে চর্চা চলে এখনও৷ তাঁর কলকাতার রামবাগান বা বাগমারির কোনও প্রাসাদোপম বাড়ির ক্যাসুরিনা গাছ নিয়ে চমত্কা র কবিতা লিখেছিলেন সেই অকালপ্রয়ত কবি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন পড়তে৷ তার আগে ফ্রান্সের নিস শহরেও ছিলেন অনেকদিন৷ কিভাবে তাঁর বাড়ির বাগানের ওই ক্যাসুরিনা গাছ তাঁকে ইউরোপের নানা শহরে, সৈকতে তাড়া করত মননে, অসাধারণ লেখায় তুলে ধরেছিলেন তরু৷
০২.
অরু-তরু দুই বোন তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে গমন করেন। এরপরে তরু ফ্রান্সে যান। উত্তর কলকাতার রামবাগানের দত্ত পরিবারে ১৮৫৬ সালের ৪ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত ছিল। ১৮৬৯ সালে দিদি অরু দত্তের সঙ্গে ফ্রান্স, ইটালি ও ইংল্যান্ড ভ্রমণে যান তিনি। তরু দত্তের পিতা মেয়েদের সুশিক্ষা, উন্নত রুচি ও মানস গঠনের জন্য দুই মেয়েকে ইউরোপে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি আবাসিক স্কুলে। এখানেই তরুর ফরাসি ভাষা শিক্ষার সূচনা। তিনি যে শুধু ফরাসি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন তা নয়, তাঁর স্বল্প জীবনে তিনি ফরাসি সৌজন্য, শিষ্টাচার ও আভিজাত্য অনুসরণ করেছিলেন। তাই তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, ‘তরু দত্তের রক্ত ছিল বাংলা, মন ইংরেজি আর অন্তর ফ্রেঞ্চ।’
১৮৭১-এ জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পরাজয়ে ব্যথিত তরু দত্ত তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন—‘আমি অবিচলিতভাবে ফরাসি’। শিশুকাল থেকে ফরাসি চর্চা করে এই ভাষায় তাঁর একটি অধিকার জন্মেছিল। কয়েক বছর ফ্রান্সে থেকে তিনি ইংল্যান্ডে চলে আসেন। তিনি ইংরেজিতেও সমান দক্ষ ছিলেন। আসলে তরু দত্ত কেবল ইংরেজি ভাষাতেই কবিতা, গান ও গীতিকা রচনা করতেন। তিনি বেশকিছু ছোট কবিতা লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়। তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম তাকে পরিণত করে এক জাতীয় সম্পদে। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় উত্তমরূপে শিক্ষা লাভ করে, ১৮৭৩ সালে তরু দত্ত কলকাতায় ফিরে আসেন।
১৮৭১ সাল থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যামব্রিজে কাটান এবং সেই সময়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হায়ার লেকচারস ফর উইমেন-এ যোগ দেন। সিডনি সাসেক্স কলেজের রেভারেন্ড জন মারটিনের মেয়ে মেরি মারটিনের সঙ্গে এই সময়ে তরু দত্তের পরিচয় হয়। তাঁদের ভেতর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। দেশে ফিরে আসার পরেও তাঁরা চিঠির আদানপ্রদান চালিয়ে যান। ইংল্যান্ড থেকে আত্মীয়দের লেখা তরু দত্তের চিঠিগুলো তাঁর চিঠির সংকলনে স্থান পেয়েছে। ১৮৭৩ সালে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে এলেন তখন তাঁর বাবার অনুপ্রেরণায় ফ্রান্স থেকে বই আনিয়ে পড়াশোনা করতেন। এই সময় তিনি ফরাসি ভাষা থেকে দেড় শ কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। সেই সংকলনের নাম দেওয়া হয় A Sheaf gleaned in French Fields,যা ১৮৭৬ সালে তা প্রকাশিত হয়। এর পরের বছরেই ৩০ আগস্ট মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তরু দত্ত বেশকিছু মৌলিক কবিতা লিখেছেন। মৌলিক কবিতাগুলো ছোট। তবে মানবজীবনের নানা সমস্যার কথা তিনি বর্ণনা করেছেন এসব কবিতায়। নারীর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিতে বিশ্বাসী তরু পৌরাণিক ভারতের সাবিত্রীকে খুব পছন্দ করেছিলেন।
মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় তাঁর ফরাসি ভাষায় রচিত উপন্যাস ‘লা জার্নাল’ ও ইংরেজিতে লেখা ‘বিয়াঙ্কা’র পাণ্ডুলিপি। পাশাপাশি খুঁজে পাওয়া যায় ‘এনসিয়েন্ট ব্যালাডস’ ও ‘লিজেন্ডস অব হিন্দুস্তান’ নামে দুটি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি। তাঁর বাবা গোবিন্দচন্দ্র বইগুলো প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ‘লা জার্নাল’ অনুবাদ করে বসুমতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫৬ সালে বই আকারেও প্রকাশিত হয়। ভূমিকা লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।
0৩.
পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকে ষোল-সতের বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন। ওই সমাজের জীবনযাত্রা, নারীর স্বাধীনতা, লেখাপড়া ও ঘরে-বাইরে অবাধে চলাফেরা করার যে একটি পরিবেশ তাঁর ছিল, মাতৃভূমিতে এসে তা সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। মানুষ হিসেবে তরু দত্ত অসম্ভব স্পষ্টবাদী ছিলেন। তাই ১৮৬৯ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত আগমন উপলক্ষে যে বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছিল, তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল এই আতসবাজি, এই জৌলুস অপ্রয়োজনীয়। কলকাতায় তাঁর চারপাশের নারীর যে জীবনযাপন দেখেছিলেন, তা তাঁকে কিছুটা হতাশ ও বিষণ্ন করেছিলে বৈকি। যে কারণে ‘শ্রীমতি দ্যারভ্যারের দীনপুঞ্জি’ কলকাতার বাঙালি জীবনচিত্র আঁকতে বসে ফ্রান্সের ব্রিটানি প্রদেশের পটভূমিকায় উপস্থাপন করতে হয়েছে তাঁকে। ‘শ্রীমতি দ্যারভ্যারের দীনপুঞ্জি’ ( Le Journal de Mademoiselle d’Arvers) ডায়েরি আকারে লেখা উপন্যাস, যদিও এই গল্পের পটভূমি গড়ে উঠেছে ফ্রান্সের ব্রিটানি প্রদেশে। কিন্তু এর কাহিনী, চরিত্র, জীবন আচরণ সব তাঁর জন্মাস্থান কলকাতাকেন্দ্রিক। একাধিক চরিত্র, ভালোবাসার ত্রিকোণ সমস্যা, খুন রক্তক্ষয়, আভিজাত পরিবারের রক্ষনশীলতা, মানুষের দায়বদ্ধতা, স্নেহ-প্রেম-লোভ-লালসা মিশ্রিত একটি গোলমেলে কাহিনী নিয়ে তরু দত্তের উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। এটি তরু দত্তের মৌলিক রচনা। এই বইটির পাণ্ডুলিপি তরু দত্ত গোপনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর লেখার প্রথম শ্রোতা ও উৎসাহদাতা ছিলেন তাঁর বাবা। তবু তরু কিন্তু তাঁর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি বাবাকেও দেখাননি। মৃত্যুর পরে তরুর ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে পাণ্ডুলিপিগুলো তাঁর বাবা হতে পান। তিনি অকাল প্রয়াত মেয়ের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য বইটি প্রকাশ করেন। যদিও এই বইটি অনেকবার ইংরেজি ও বাংলায় অনুদিত হয়েছে। কিন্তু এই বইয়ের কাহিনী, উপস্থাপনা, বর্ণনা কোনোটিই সে রকম উল্লেখযোগ্য নয়। ফরাসি ভাষায় তাঁর শব্দ ভাণ্ডার তত সমৃদ্ধ না হওয়ায় বইটির বেশিরভাগই গতানুগতিক।
০৪.
মাত্র ১৮ বছর বয়সে বেঙ্গল ম্যাগাজিনে ফরাসি কবি Leconte de Lisle-র ওর রচনাধর্মী লেখ বার হয়। এটাই ছিল সাহিত্যিক হিসেবে তরু দত্তের প্রথম মুদ্রিত স্বীকৃতি। দ্বিতীয় লেখাটি ছিল আরেক ফরাসি কবি Josephin Soulary-এর ওপর। সঙ্গে তাদের ফরাসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদও ছিল। এর পরপর-ই দিদি অরুর সঙ্গে যুগ্মভাবে ১৮৭১ সালে বিশিষ্ট কয়েকজন ফরাসি কবির কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন, বেশকিছু কবিতায় তরু লিখেছেন, অরু ছবি এঁকেছেন। অরুর কবিতাও দুই/একটি আছে। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। শার্ল বোর্দলেয়ার কিংবা হুগো কেউই বাদ যাননি তাঁর অনুবাদ থেকে। এই গ্রন্থটিকে ভারতে ইংরেজি ভাষায় লেখা কবিতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে মনে করা হয়।
১৮৭৩-এ কোলকাতায় ফিরে এসে বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি A sheat gleaned in french field (ফরাসি ক্ষেত্রে কুড়ানো এক আঁটি ফসল)। নামে ফরাসি ভাষার দেড় শ কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। অনুবাদ হিসেবে দেখতে গেলে প্রাথমিক প্রচেষ্টায় লেখার মান খুবই দুর্বল। এই অনুবাদ কাব্য সংকলনটির বাক্যবিন্যাস ও ছন্দ; উভয়ই যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু আগাগোড়া বইটিতে তরুণী কবির আন্তরিকতা ও আকুলতা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। তিনি এই পৃথিবীকে ভালোবেসেছিলেন, ভালোবেসেছিলেন প্রকৃতি, মানুষ, জীবন, লেক, বন, ঝাউ, ফুল, পাখি আর আকাশের চাঁদ। নিখাদ এই ভালবাসাকে সঙ্গী করেই তিনি ফ্রান্সের গ্রামের কৃষিক্ষেত্রের পরিবেশ, ফুল, ফল, পাখির চমৎকার ছবি এঁকে গেছেন শব্দের মাধ্যমে। তরু দত্ত তখন অসু্স্থতার কারণে প্রায় শয্যাশায়ী, সেই অবস্থায় তাঁর স্নেহশীল পিতা নিজের টাকায় এই দেড়শোটি কবিতার সংকলনটি প্রকাশ করেন ১৮৭৬-এ। সাপ্তাহিক সম্বাদ বইটি প্রকাশ করেন। ৪০১ পাতার বইয়ের শব্দসংখ্যা ৭৭ হাজার ৫০৫। ১৮৭৭ সালে সংকলনটি ওই সময়ের সমালোচক অ্যাডমন্ড গুজের কাছে রিভিউ করতে পাঠানো হয়। ১৮৭৮ সালে অনুবাদ সংকলনের দ্বিতীয় ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কিগান পল নামক জনৈক কাব্যবোদ্ধা লন্ডনে এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। আক্ষেপের বিষয়, A sheat gleaned in french field প্রকাশনার ঠিক এক বছর পরে তাঁর মৃত্যু হয় (১৮৭৭)। নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনেও তিনি ভয় পাননি। তাঁর লেখায় প্রাণ জেগে উঠেছে। শেষ কবিতা AMon Pere সুধীজনের কাছে এই কারণেই বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল।
০৫.
তাঁর মৌলিক কবিতাগুলোয় মানবজীবনের নানা সমস্যার কথা, উৎসবের কথা, আনন্দ উচ্ছ্বাসের কথা আছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে কবিতার যে আবেদন, তা মৃত্যুর নয়, শাশ্বত জীবনের উচ্ছ্বাসে ভরপুর। তাঁর কবিতার আন্তরিকতা, সরলতা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। কবিতায় যে কবিমনের প্রকাশ ধরা পড়েছে একেবারে কম বয়সে, উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা নয় এক গভীর জীবনবোধে তাঁর কবিতা সৌন্দর্যময়। তাঁর কবিতাগুলো সংবেদনশীল হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছে। পাঠককে মুগ্ধ করেছে, করেছে অভিভূত।
দোহাই:
১। শ্রীমতী আরভের: তরু দত্ত, অনুবাদ–পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
২। ঘুমের দরজা ঠেলে: চিন্ময় গুহ