আমি, ফরিদ কবির আর মৃদুল দাশগুপ্ত শ্রীরামপুরে থেকে ট্রেনে রওনা হলাম রানাঘাটে। মৃদুলের বাড়ি থেকে জয়ের বাড়িতে। তখন জয়-মৃদুল দু’জনেই কলকাতার বাইরে থাকেন। আমরা মফস্বলের মতো একটি রেল স্টেশনে নেমে অল্প কিছু দূর হেঁটে একটা পুকুর পাড়ে গিয়ে থামলাম। পুকুর ঘিরে ঘরবাড়ি। একটা ছোট্ট খুপরি ঘরে জয় থাকেন। তিনি খুব অসুস্থ! শুয়ে আছেন। আস্তে ধীরে উঠে বসলেন। এলোমেলো বিছানা। আশেপাশে বইপত্রপত্রিকা ছড়ানো। বিছনার পাশে পিঁপড়ার লম্বা সারি জয়ের রেখে দেওয়া পাউরুটি খাচ্ছে। কিন্তু জয় তাদের তাড়াচ্ছেন না। প্রথমত পিঁপড়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত বাধা দিলে বিগড়ে যাবে।
জয়ের তাত্ত্বিক কথায় মজা পেলাম। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চললো আমাদের আড্ডা। সালটা হবে ১৯৮৬। তখন জয়ের দ্বিতীয় বই ‘উন্মাদের পাঠক্রম’, মৃদুলের ‘এভাবে কাঁদে না’ আর আমার ‘অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো’ বেরিয়েছে। বই বিনিময় করার পর জয় আমার বই থেকে ‘বালিশ’ কবিতা পড়লেন। তখন আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে জানা গেলো নীরেন দা, শক্তি-সুনীল দা চেষ্টা করছেন জয়কে ‘দেশ’ পত্রিকায় চাকরির জন্য। ইতোমধ্যে তাঁকে একটা কোস্টার জাতীয় গাড়ি দেওয়া হয়েছে। জয়ের ভাই সেটা দেখাশোনা করবেন। জয় একটু সুস্থ হলেই চলে যাবেন কলকালতায়। বিকেলে একটা লাঠি ভর করে আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্য রেল স্টেশন পর্যন্ত এলেন। একের পর এক ট্রেন যাচ্ছে। আমরা চা খাচ্ছি। আড্ডা ফুরাচ্ছে না।
দুই বছর পর আবার জয়ের সঙ্গে দেখা, ভিন্নভাবে। পশ্চিম বঙ্গের প্রায় সব ছোটকাগজের সম্পাদকের বড় কাগজের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক পর্যায়ে কৃষ্ণ নগরে ‘শত দল ঝর্ণার ধ্বনি’ সম্মেলন। বাংলাদেশ থেকে যোগ দিয়েছি কবি তুষার দাশ, বিশ্বজিত চৌধুরী, ফরিদ কবির, দারা মাহমুদ ও আমি। আমরা কলকাতা থেকে কৃষ্ণ নগরে গেলাম। ট্রেনে আড্ডা হলো- কালী কৃষ্ণ গুহের সঙ্গে। তিনি জানালেন, জয়ও যাচ্ছেন।
জয় সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যায়। বন্ধু গৌতম মণ্ডলের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, ‘প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না, তিনি তা গ্রহণও করেননি সেভাবে কিন্তু প্রস্তুত হয়ে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছেন এবং লিখতে এসেই পাঠকের সমীহ আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি সারাজীবন একই ধরনের কবিতা লেখেননি, বারবার বদলেছেন, ভেঙেছেন নিজেকেই। প্রকরণেও তিনি একজন মাস্টার। ওস্তা। অনেক সময় তিনি গৌণ কবিতা লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না, জীবনানন্দ-উত্তর যুগের অন্যতম প্রধান কবি তিনি। তিনি জয় গোস্বামী।’
জমজমাট ‘শত দল ঝর্ণার ধ্বনি’ সম্মেলনে সেই জয় প্রথম সারিতে বসা। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তিনি এসেছেন। ইতোমধ্যে জয় আনন্দ বাজার গ্রুপের সাপ্তাহিক দেশ-এ যোগ দিয়েছেন। এখানে বলা প্রয়োজন, ‘শত দল ঝর্ণার ধ্বনি’র উদ্দেশ্য স্টাবলিশডম্যানের বিরুদ্ধে! মানে আনন্দ বাজার গ্রুপের বিরুদ্ধে। জয়কে বার বার বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা পরও তিনি চুপ ছিলেন, অসুস্থও ছিলেন।
সেই ধারাবাহিকতায় আমরাও পরের বছর বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রে ‘এই সব স্রোতের বিরুদ্ধে’ সম্মেলন করেছিলাম। আমাদের ‘এই সব স্রোতের বিরুদ্ধে’ জয় আসেননি। অনেক পরে সম্ভবত ২০০০ সালে জয় ঢাকায় এলেন। উঠেছেন শান্তিবাগের হোয়াইট হাউজে। আমি তখন বিটিভিতে সাহিত্য বিষক অনুষ্ঠান ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ উস্থাপনা করি। জয়কে ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’তে আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি অসুস্থ। তাই গেলেন না।
আমি মন খারাপ করে ফোন রেখে দিলাম। পরদিন সকালে আজিজ মার্কেটে আমার স্বরব্যঞ্জন অফিসে এসে হাজির। বললেন, ছফা ভাই আর আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি লাজুক লজ্জাবতী। তাই আড়ালে থাকতে চাই।
দ্বিপাক্ষিক আড্ডা হলো। পরে ছফা ভাইয়ের অফিসে ত্রিপাক্ষিক আড্ডা। সেই আড্ডায় এসেছিল তার ‘বেনী মাধব’ কবিতার কথা। কবিতা থেকে পরে গান। তাঁর অসাধারণ অসমাপ্ত বাক্যের ভেতর কী যে এক কাব্যিকব্যঞ্জনা, ‘আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ী’। সেদিন জয় যেন লজ্জাবতীর মতো লজ্জায় পেলেন। বলেন, সেটা কৈশোর প্রেম।
সেই গানের শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র পরে ২০১৩ সালে টরন্টোস্থ মেট্রো কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত ৩৩তম উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনে আড্ডা দিতে দিতে আমাকে বললেন, ‘বেণী মাধব’ আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং সেরা গান। এই গানের জনপ্রিয়তা ও জয়জয়কারের সঙ্গে দুই জয় জড়িত। আপনার কবিবন্ধু জয় গোস্বামী আর আমার স্বামী-বন্ধু জয় সরকার। জয় গোস্বামীর কবিতায় সুর দিয়েছে জয় সরকার আর সমীর চট্টোপাধ্যায়। ফলে কবিতার চেয়ে গান হিসেবে ‘বেণী মাধব’ আরও বেশি মাত্রা পেয়েছে।
আজ তেরো হাজার মেইল দূরে প্রবাসে বসে এই গান শুনছি। সেই সঙ্গে মনে পড়ছে আড্ডাগুলো। মনে পড়ছে জয়কে। ১০ নভেম্বর ছিল জয়ের জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে শুভেচ্ছা। জয়ের আরও জয় হোক!