আত্মহনন যখন মোহন হয়ে ওঠে, তখন তাকে কী বলা যেতে পারে? এই প্রশ্ন কতদিন বহুবার রক্তাক্ত করেছে আমাকে। এই প্রশ্ন বহুবার ক্ষত বিক্ষত করেছে আমাকে। রক্তাক্ত হতে হতে জেনেছি এর কোনো উত্তর নেই। ক্ষত বিক্ষত হতে হতে জেনেছি এর কোনো উত্তর নেই। রক্তাক্ত হতে হতেই জেনেছি এর অনেক উত্তর। ক্ষত বিক্ষত হতে হতেই জেনেছি এর অনেক উত্তর। মনে হয়েছে ওই মোহন আত্মহত্যা মানে পথে পথে হাঁটা। কারণ তার কোনো শেষ নেই। দুর্লঙ্ঘ্য অনির্দিষ্টতা যার সঙ্গী, তার চেয়ে আত্মহননকারী আর কে আছে পৃথিবীতে! আবার হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে, এটা কোনো পথ নয়। পথের ধারণা মাত্র। পথের বিশ্বাস মাত্র। মনে হয়েছে ওই মোহন আত্মহনন মানে নিজেকে পতঙ্গ করে তোলা। আগুন যার পথের গ্রন্থি এঁকে দেয়। আগুন যার জীবনে এনে দেয় পরিসমাপ্তি। মনে হয়েছে ওই পথ এই পতঙ্গ এই আগুন—এসব রসায়ন শুধুই দুর্লঙ্ঘ্য অনির্দিষ্টতা নিয়েই ধাবমান নয়। কোনো না কোনো সত্যের বেদীতে তা দাঁড়িয়ে। কিন্তু সত্যটাই বা কী! ঠিক ঠিক সত্য বলে কিছু কী আছে! তবে কি মিথ্যা! না, তাও নয়। সত্য সত্য মিথ্যা মিথ্যার এই ভূগোলে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে আসলে পথ বলে কিছু নেই।
কবি জাকির জাফরানের কবিতা পড়তে গিয়ে যেন এইসব লিখিত-অলিখিত প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়। সেখানে সময় বলে কিছু নেই। এক সময়হীন সময়ের মধ্য দিয়ে যেন সে যাত্রা। যেন গুপ্ত দিনে হেঁটে যাচ্ছে নিজস্ব গণিত।
ওই গণিত নিজস্ব বলে এর কোনো তত্ত্ব নেই। সংখ্যাও নেই। তবে বিন্যাস আছে। কারণ জাকির জাফরান বিচ্ছূরণে বিশ্বাস করেন না। তিনি কেন্দ্রে আছেন। কেন্দ্রে থাকেন। কেন্দ্রকে কেন্দ্রিভূত করে তিনি বিস্তারিত হন। বিচ্ছুরিত হন সামান্য। কারণ অতি বিচ্ছূরণে থাকে শুধু চোখ ধাঁধানো চমক। কবিতার প্রাণভোমরা থাকে না সেখানে। কিন্তু স্বল্প-বিচ্ছূরণে কী হয়? পাঠক যে কেন্দ্র থেকে যাত্রা শুরু করেন সেখান থেকে ছিটকে পড়েন না। নীরব যাত্রা শুরু করেন পাঠক। আশে পাশে তাকান। দেখেন বিবিধ জানালা। দেখেন বিবিধ দরোজা। মনোহর তাদের রূপ। এই রূপদৃশ্যের ভেতরে যে রূপকার্থ তাতেই সিঞ্চিত হন তিনি। তৃপ্ত হন। কারণ তিনি ধরে নিয়েছিলেন এটুকুই তার আরাধ্য ছিল। কারণ বহুবিধ কেন্দ্রে গেলে নানাবিধ জটিলতায় আক্রান্ত হতে হতে তো খেই হারানোর আশঙ্কা ছিল। জাকির জাফরানের কবিতা এই খেই হারানোর ঝুঁকি থেকে পাঠককে মুক্ত করে।
কেন করে? কারণ জাকির জাফরান এক-কেন্দ্রিকতাকে সমর্থন করেন। এক কেন্দ্র থেকে বিস্তারিত ও বিচ্ছুরিত হয়ে আরেক কেন্দ্র নির্মাণ, সেই কেন্দ্র বিস্তারিত ও বিচ্ছূরিত হওয়ার মাধ্যমে আরেক কেন্দ্র নির্মাণ, সেখান থেকে আরেক কেন্দ্র। এভাবে বিচ্ছুরিত কেন্দ্রের বিচ্ছুরিত প্রশাখা তার আরাধ্য নয়। সে চেষ্টাও তিনি করেন না।
তবে কি একটু আবেশ দিয়ে, একটু আশে পাশে তাকিয়ে দৃশ্য দেখিয়ে, ভাবনায় একটু দোলা দিয়ে তার কবিতার রেশ ফুরিয়ে যায়? না। তিনি হয়তো বহুকেন্দ্রিকতাকে এড়িয়ে চলেন কিন্তু এক কেন্দ্রিকতাকে তিনি যেভাবে বিস্তৃত করেছেন তাতে এবং এমন আবেশ দিয়েছেন যে, পাঠককে সেখানে নিরন্তর যাওয়া আসা করতে হয়। এই ভ্রমণ বোধ প্রসারক। ফলে তার কবিতা-যাত্রায় ভ্রমণ ক্লান্তির ছাপ বা বিরক্তির আভাস খেলে যায় না। বরং আকাঙ্ক্ষার পাখিরা পেয়ে যান ঠিক ঠিকই বৈচিত্র্যের সন্ধান।
জাকির জাফরানের মূল শক্তি ও স্বাতন্ত্র্য বোধ হয় এখানেই। কেননা তার প্রজন্মের অধিকাংশ কবিই যে ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত, জাকির জাফরান সেখান থেকে নিজেকে সযত্নে আলাদা করেছেন। এ এক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কেননা আধুনিক মানসিকতা ও জীবনযাত্রার জটিলতা মানুসের সব সত্তাকে বিবিধ জটিল করে তুলেছে। এই জটিলতর জীবন-ধারাপাতে মানুষ রহস্য খোঁজে। এক কেন্দ্রিকতা মানুষকে এই রহস্যের সন্ধান দিতে প্রায়ই ব্যর্থ হয় বলেই অধিকজনের ধারণা। জাকির জাফরান এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছেন। তিনি রহস্য নির্মাণ করতে গিয়ে আরোপিত জটিলতার আশ্রয় নেননি। অপরিকল্পিত-সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো কবিতাকে ধোঁয়াশার অন্ধকারে হারিয়ে ফেলেননি। কিংবা ডুবিয়ে দেননি সমুদ্রের গভীর তলদেশে। যেখানে সূর্যোদয় নেই, যেখানে সূর্যাস্ত নেই।
বোধ চেতনা সমৃদ্ধ মানসিকতা কবিতার অধরা আলোয় নিজেকেই দেখতে চায়। কিন্তু নিজ বা নিজস্বতার সংজ্ঞাই তো আপেক্ষিক। সেখানে বিবিধ পারিপার্শ্বিকতার ব্যাখা কী হতে পারে? সেটা কোনো ব্যক্তিমানুষই নিরঙ্কুশ জানে না। বোঝে না। সুতরাং তার চাওয়াটা প্রায়শই বিমূর্ত থেকে যায়। কিন্তু অনুভবের গভীরে সে কী যেন খোঁজে। খুঁজতে থাকার যেমন তার পরিসীমা নেই, কী খোঁজে তারও কোনো মূর্ত-বিমূর্ত রূপ নেই। এখন প্রশ্ন বিবিধ মানুষের বহুবিধ মানসিকতার শৈল্পিক প্রত্যাশা জাকির জাফরানের কবিতা কতটুকু মেটাতে পারবে? যেখানে পরিসীমাহীন খোঁজাখুঁজি! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে তেলাওয়াত করতে হবে জাকির জাফরানের কবিতার প্রতিটি শব্দ।
তার আগে সূত্র অন্তত ধরিয়ে দেওয়া যায়। তার প্রথম কাব্য সমুদ্র পৃষ্ঠায় অনেক পাখি আছে। এই পাখিগুলোর মধ্যে কিছু পাখি প্রাকৃতিক, কিছু কাল্পনিক, কিছু পাখি রূপক, কিছু পাখি সিনথেটিক। পাখিগুলোকে এক নামে ডাকা যেতে পারে জাফরানীয় পাখি বলে। পাখিগুলো প্রায়ই সমুদ্রপৃষ্ঠা থেকে উড়ে এসে একটা মাঠে খড়কুটো খোঁজে। উড়ে যায়। দূরে যায়। আবার আসে। আমি ওই মাঠটির নাম দিয়েছি কুহেলী প্রান্তর।
মাঝে মাঝে ওই কুহেলী প্রান্তরে আমি মনোভ্রমণে যাই। দেখা হয় সে-সব পাখিদের সাথে। তাদের চেনা চেনা লাগে। কখনো অচেনা লাগে। কিন্তু পাখিগুলোকে ভালো লাগে খুব। পাখিদের সঙ্গে আরেকবার বিনিময় হোক চোখের পলক:
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন: ধরো, ডালে-বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারীর গুলিতে একটি পাখি মরে গেল
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?
অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে
আর মনে হলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি
(চিঠি: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
সেদিন অগ্রজ বললেন:
ঐ যে দেখছ অজস্র কাক
তারা সকলেই পাখি নয়
কেউ কেউ পাখি।
সে রাতেই স্বপ্নে দেখলাম—
জন্ম হয়েছে আমার, তবে
পাখিদের গৃহে নয়
দুঃখিত সেই সব কাকেদের গৃহে
(কাক: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
দল বাঁধিয়াছি কালো চোখের অক্ষরে
পরিচয় দিবসের ঘ্রাণে
সংবেদনার রক্তে আমি জবুথুবু, মহাকাল!
লাজুক ধানের মতো ছাত্রী ভেসে আসে
বই খাতা হাতে
রুল-করা আকাশের দিকে
চোখ, আর
একটি মাছ ভালোবাসে একটি পাখিকে
(সংবেদনা: সমুদ্র পৃষ্ঠা)
নিজেরই নাভিতে যে এতো ঘ্রাণ
হরিণ তা জানে না।
ক্লাস শেষে তোমার ত্রস্ত ছোটাছুটি—
আরজুটা কি চলে গেল!
এস বি স্যার কি রুমে আছে!
অথচ আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, স্টেথো
তুমি তা দেখেও দেখলে না।
তারপর চলে গেলে তুমি
তোমার সে অ্যাবসেন্স-পোড়া ছাই থেকে
জন্ম নিল পাখি।
দুই.
কতদিন তোমাকে দেখি না! স্টেথো, এতদিন
পরে তুমি এলে! মিথ্যে এ চাঁদের নিচে
তুমি ছাড়া কেউ নেই, কেউ নেই
একটি শালিখে ডুবে আছে দেহ—
আজ ফার্ণ উদ্ভিদ সেজে বসে থাকা ভালো
(স্টেথো : সমুদ্রপৃষ্ঠা)
নিচু এ কৌতুকে আজ মজে গেছে মন
বিস্তৃত অনাগ্রহের প্রতি উড়ে এলো মেঘ
তোমাকে জড়িয়ে ধরে মনে হলো ধান
মনে হলো উৎসব: জন্ম ভেঙে
. দূর দূর অন্ধ দ্রাঘিমায়
নিচু ক্লাসে পড়ো! আহা! চুলে
এতো রৌদ্র-কুমকুম, চোখ যেন সমুদ্র পৃষ্ঠা
টেনে নাও আমাকে তোমার ছত্রে ও ছায়ায়
পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম, পাখি উড়ে যায়
(পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
খোঁপায় কদমফুল গুঁজে এসে
ক্লাসে উপবিষ্ট রোদগুলোকে তাড়ালে তুমি
আমি ডায়াসের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
উপযাচকের মতো, তোমাকে দেখতে
অন্য ক্লাস থেকে দুটি ছেলে এলো,
আমি শুনতে পেলাম সেইসব অনুচ্চার
দেখলাম, ডালে-বসা পাখিটুকু
জেগে আছে অনিঃশেষ প্রেমে কি বিরহে।
আসলে কদম এক আশ্চর্য ফুল
ভীষণ এক কাঁদতে না পারা
(কদম এক আশ্চর্য ফুল: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
আয় পাখি, পাখি আয় যুদ্ধংদেহী
হৃদয়-চূর্ণের প্রতি আয়
বলেছি সমুদ্রে সমর্পিত আমি, তবু
সুদূরের জল সংগোপনে আমাকেই খায়
(জল: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
পাখিপূর্ণ স্থানে তুমি বসে আছো একা
এভাবে চৌচির হয়ে বসে থাকা, তোমাকে মানায়?
(নক্ষত্রের প্রস্থান: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
এন-জাকিরের ছাড়ানো সংকেত দেখে
কত পাখি ডালে এসে বসে
অথচ বৃষ্টি, তুমি কেন
খল-নায়কের মতো আজ প্রেমের কথাটি বলো?
(বৃষ্টি: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
এসেছি শিরস্ত্রাণ পরে, দুটি চোখে পাখি,
চেনা যায়?
-কে গো তুমি?
আমি জাফরান, তোমার পশ্চাদভূমি
-কেন এলে?
আয়ুর কৌটায় দাঁত বসাতে এসেছি
-কিন্তু দাঁত তো ফেলে এসেছো বেদেনীর ঘরে
(অস্তিত্ব বিষয়ক: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
যে পাখিটা রোজ রোজ আমাদেও ছাদে আসে তার নাম শ্রাবণী সেন
(পাখি : সমুদ্রপৃষ্ঠা)
এত সব জাফরানীয় পাখির ওড়াউড়ি যেখানে, সেখানে কবিতার বিশ্লেষণ কি মানায়? মানায় না। সুতরাং এখানে পাখির ওড়াউড়ি চলুক। আমরা রসকসহীন আলোচনা থেকে দূরে সরে যাই।