আমি ভীতু প্রকৃতির মানুষ।
খুব সহজে কোনো কিছু পেয়ে গেলে আমার ভয় হয়। মনে হয়, এই পাওয়াতে কোনো গলদ নেই তো? খেটেখুটে পেলে মনে হয় সব ঠিকঠাক। নিজের সঙ্গে ক্রমাগত ভালো ঘটনা ঘটলে আনন্দিত বা উচ্ছ্বসিত হওয়ার বদলে আমার ভেতরে এক ধরনের চাপা টেনশন কাজ করে, এত ভালো তো ভালো নয়, কোথাও কোনো ঝামেলা নেই তো?’
এই বিষয়গুলোকে কে কিভাবে নেবেন, আমি জানি না। তবে আমি ইতিবাচকভাবেই নেই। আমার মা বলেন, দুর্বল অবস্থার চেয়ে সবল অবস্থায় মানুষকে সতর্ক থাকতে হয় সবচেয়ে বেশি। এতে নাকি মানুষ বিনয়ী হয়, পা ও চোখ মাটিতে রেখে চলে। এই আনত দৃষ্টির পথচলা খুব জরুরি। খুব জরুরি।
মানুষ আমাকে ভালোবাসলে, তুমুল প্রশংসায় ভাসিয়ে দিলেও আমার ভয় লাগে। আমার কেন যেন মনে হয়, সমালোচনা শুনে ভয় পাওয়ার বা অতি সতর্ক হওয়ার কিছু নেই, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই; বরং ভয় পাওয়ার আছে, সতর্ক হওয়ার আছে প্রশংসা শুনলে। অতি প্রশংসা শুনলে, অনেক ভালোবাসা পেলে, হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসা পেলে ভয় পাওয়ার আছে, সতর্ক হওয়ার আছে।
অদ্ভুত মনে হচ্ছে?
না, বিষয়টি মোটেও অদ্ভুত নয়।
সমালোচনা আপনাকে শেখায় আপনি দোষত্রুটিপূর্ণ অতি সাধারণ একজন মানুষ। আপনার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, ভুল আছে। আপনার উদ্ধত হওয়া চলবে না। আপনার নিজেকে শোধরাতে হবে। কিন্তু অতি প্রশংসা বা ভালোবাসা আপনাকে অবচেতনেই ভাবতে শেখায় আপনি আইডল, আপনি যা করছেন, তা-ই একটা স্ট্যান্ডার্ড, তা-ই সর্বজনগ্রাহ্য আচরণ, ভাবনা, তা-ই সঠিক। আপনার ভুল নেই, বা থাকলেও যৎকিঞ্চিত। আপনি মোটামুটি পার্ফেক্ট মানুষ। আপনার সতর্ক হওয়ার কিছু নেই। আত্মসমালোচনার কিছু নেই। কারণ এত এত মানুষ আপনাকে ভালোবাসে, পছন্দ করে, প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বিশেষ কিছু, আলাদা কিছু, শ্রেষ্ঠ কিছু। সুতরাং এত ভাবাভাবির কী আছে? তখন নিজেকে মনে হতে থাকে সুপার হিউম্যান। নিজের ভেতর বেড়ে উঠতে থাকে আত্মঅহমিকা, ঔদ্ধত্য, অহঙ্কার। সচেতনভাবে না হলেও, অবচেতনে তো অবশ্যই।
ফলে এই সময়টায় সতর্ক হওয়া সবচেয়ে জরুরি। সবচেয়ে বেশি। মাটিতে পা রেখে চলতে শেখা, ভাবতে শেখা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
ভাবতে হয়, বিশ্বাস করতে হয়, এই এত এত ভালোবাসার যোগ্য আমি নই, এই মানুষগুলো নিজেদের মহানুভবতার কারণে আমাকে এত ভালোবাসেন। সুতরাং আমার নিজেকেই তাদের এই অবিশ্বাস্য ভালোবাসার যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।
এই ভাবনাগুলো গতকাল সারাদিন, সারারাত, আজ এখন অবধি আমাকে কুটকুট করে ছারপোকার মতো খেয়ে চলেছে। জন্মদিনে একটা মানুষ কী পেতে পারে? কতটুকু পেতে পারে? আমি জানি না। আমি যা পেয়েছি, আমার ধারণা, এই জীবনে এর কিয়দংশও আমি কখনো আমার স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রত্যশা করিনি।
সেই থেকে আমার ভয়। এই ভালোবাসা আমাকে না অসতর্ক করে ফেলে! অসংযমী করে ফেলে! অনিয়ন্ত্রিত করে বা উদ্ধত করে ফেলে! এই ভয়টা আমাকে পেয়ে বসেছে। ওই যে বললাম, আমি ভীতু মানুষ। আমার ভয় করছে।
জানি না কারও ভালোবাসা পেয়ে এমন ভয় পেয়ে ভীতু হয়ে যাওয়া কতটা ঠিক!
তবে এও মনে হয়, এই ভয়টা হয়তো জরুরি ছিল, খুব খুব খুব জরুরি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, এই জায়গাটাতে আল্লাহ আমাকে এমন ভীতু করেই রাখুন। বুকের ভেতরটা ভয়ে কাঁপিয়েই দিন। উদ্ধত হতে না শেখান। মাটির বুকে চোখ রেখে ধীর পায়ে হাঁটতে শেখান। এইটুকুই প্রার্থনা। আর এমন অবারিত, অসীম, বিস্ময়কর ভালোবাসার প্রতিদান কিভাবে দিতে হয় আমার জানা নেই। তবে আমি কৃতজ্ঞ। হ্যাঁ, ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ।
এমন অভাবিত ভালোবাসা কে হারাতে চায়! কেউ না, কেউ না। আমিও চাই না। কিন্তু দিন শেষে আমরা সবাই রক্ত মাংসের মানুষ। আমাদের লোভ আছে, লালসা আছে, কাম, ক্রোধ, ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ, এইসব আছে, এই রিপুগুলোর সমন্বয়েই আমরা মানুষ। খুব সাধারণ মানুষ। সুতরাং সেই সাধারণ মানুষ হিসেবেই ভুলও নিশ্চয়ই অসংখ্য আছে, থাকবেও। সেই ভুলগুলো ধরতে পারাটাই আসল। এমন ভালোবাসা আমাকে তাই আরো ভীতু করুক, আরও আতঙ্কিত করুক। যে ভয় আমাকে শেখাবে কিভাবে বুকের ভেতর কান পেতে শুনতে হয়, হৃদয় কী বলে!